১০টি কবিতা দয়াময় পোদ্দার কবির স্মরণ-সভা খুব পুরনো কাঠের টেবিল।তিনটি চেয়ার-মুখ।রাঙা ফুল, সবুজ লতাপাতায় না বলা টেবিলক্লথ, আরকবির নিরুত্তাপ ছবি। অনিবার্য রজনীগন্ধা। ঠারে শান্তপুকুরের পাড়ে কড়েমাটির ফুলদানি। একটি মাছি তাকেঘুরে ঘুরে উড়ছে। বসছে গায়। ভাতঘুম ছেড়ে এসেছে শ্রোতারা।হারমোনি বাজিয়ে শর্মিষ্ঠা ঘোষ মাইকে গাইছে- আলোকের ঝর্ণাধারাঅবিবাহিত বরেনকাকু তবলায় তিনবার তাল কেটেতবেই ছাড়লো! ‘কবির কোন চাকরি ছিলোনা, অনটনের মাঝেও স্মিতা প্যাটেল হাসি মুখ।সংযম পরাকাষ্ঠে নিগূঢ় বাঁধা ছিল টিকি;প্রধান অতিথির বলা শেষে স্বরচিত পান্তাভাত পেশ হল।তিনজন, না না চারজন। ননীচোরা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারেরপ্যাকেটে টিফিন- একটি সিঙ্গারা, একটি খাস্তা গজা, দুটি রসগোল্লা চরমতম লাড্ডু।ছবিতে করুণ চোখদুটো দৃশ্যমান। টেবিলের নিচেনরম মাটিতে কব্জি থেকে কাটা কবির হাত পড়ে আছে। তিনটি সমুদ্র, তাদের পাড়ি দিয়ে এসে আজ টেবিলে ছবি উঠেছে। হলঘরের জানালা চুঁয়ে কৌতুক-আলো লুটনো। দূরে বারান্দায় এলোচুল, সাদাশাড়িভ্রু-প্লাক করা কবির বিধবা বৌ, স্মরণ-সভায় ডাকুকবলে বসে আছে! ডাকপিওন জড়িয়ে নেবার নিঝুম দুপুর খুবলুটেরা হাওয়া ডুবছে উদাস বুকেতাইকি কথার অঝোর ধারায় চুপ?একটা আকাশ লিখতো হনন-কূলে! ঝুমকোলতায় তোমার প্রেমিক খামসাইড ব্যাগের গোপন কোঠায় ভরেআমার কেবল ডাক পিওনের কামবসন্ত, তোমার সে অপেক্ষাতেই আসে…. ধান্যকথা ধানগাছ | ঠিক ধানগাছের মতো পরিমিতি না ,মানুষের মতো |রাহাদের বাড়ির পিছনে বেলা নেমে আসেতিলবর্ণ করে শবনম ফুটে ওঠে ধান্য-শরীরখুব নীরব সেই মহাকালের সন্ধিক্ষন ,মানুষের বোধের অতীত |প্রথম কথা বলে – উড়ন্ত ফিঙে পাখিটি | তারপরেআরও আরও সমস্ত পাখিদের ডানার ঘ্রানআসলে কেউ-ই কোন কথা বলেনা,শুধু আলো তার রঙের শরীর খোলেএকটি গঙ্গাফড়িং সেই বেদনার উন্মুখ,সোনালি অভ্যাসে সাঁতার কাটে;এইসব কথা যখন শুনি -আমের ডাল থেকে একটি লক্ষ্মীপেঁচানিশব্দে নেমে আসে আমার বুকের উপরে, পা’রাখেকীট-পতঙ্গ, ইঁদুর , ন্যাদা পোকা খুঁটে খুঁটে খায় ! সন্তান-কাব্য — হ্যাঁ, এবার আপনার কবিতা পড়ুন। মাথা নিচু, আত্মমগ্ন বুকপকেটে আলো মাখাচিরকুট তুলোট-আতুড়, ওমের আঘ্রান সহ,ভাঁজ খুলে একবার মাথা উঁচু করে দেখে নিই-সামনের দর্শক আসন, আজ আমিই দর্শকতারা সকলে কবি- সাদা মেঘ, নীল আকাশ!আমার ছেলের নাম শ্রীদীপ, জামা আরহাওয়াই চটিতে বিমুখ কথা। বৃষ্টির জমা জলেএলোমেলো অক্ষর- কাদা মাখে পালং পাতার মতোনবীন পায়। কাশির সিরাপ, জ্বর-শর্দি ঠাকুরদার সঙ্গেমাঠে গরু চড়াতে গেলেই সেরে যায়। সেমিকোলনে থামার অবকাশে দেখে নিই-আলোকিত চেয়ার সমস্ত। আমার দাঁড়িয়ে থাকাদু-পা জমি।আমার কবিতাকে গঙ্গাফড়িং ওড়া দেখাতে পারিনা,ডানায় উড়াল এঁকে দিতে পারিনা। মায়ের স্তনের দুধতার ঠোঁটে লেগে থাকে-‘এই সত্য ছাড়া আর কোনআকাশ নেই, বায়ুমন্ডল নেই…’ পড়ে তাকিয়ে থাকি-একদল কবন্ধ চেয়ার ফিসফিস করে, কাঁচা কাঁচাকথাদের জড়োতায় নাগরিক কবিতা হয়নি বলেচুপ মেরে যায়- কোলকাতা থেকে ফেরার শেষ মেট্রো।চিরকুট ভাঁজ করে বুকের কুয়োতে ছেড়ে দিই-সাঁতার শিখুক ঝড়-জল বিপন্ন সময়ে… রাত্রি মধ্যযামে বাড়ি ফিরে শ্রীদীপের ধুলোমাখাঘুমন্ত পায়ের কাছে চিরকুট নামিয়ে রেখে মাথা ঠেকাইজ্বর-শর্দি, কাশির সিরাপ… শবনম,তুমি যদি নদী হতে খুব ধীরে,ঠান্ডা স্রোতধারায় বয়ে যায়-আমাদের দুই ঘরের মাঝ বরাবর| সেখানে ষড়যন্ত্রী কুচোমাছ,জলদস্যূদের নাওপচাপাতা,শ্যাওলারা জমে | খলবল বাজিযে় যায়কাডা়-নাকাডা় | চুপ থাকার স্বাধীনতায় শিশিরখরায় মেশে,তৃষ্ণার হাহাকারে জমে বালি, শুনেছি- নদীর ওপারে মেলা বসে, বেদেনিরাসাপখেলা দেখায় , মনসা-মঙ্গল গায়নেচে নেচে | কি অনাযা়সে সকলেই পেরিযে় যায়জীর্ণ সাঁকো ; আমি তাকে ধরলেই ঝুঁপ করে ভেঙে যায়লম্ফ মেরেও ডিঙোতে পারিনি-মধ্যরাতের স্বপ্নে !শবনম,তুমি যদি নদী হতে -শীতকালে,পাখিরা সাইবেরিযা় থেকে উডে় আসতশাডি়র দুইপাডে় লতায়-পাতায় মুখর হতোহরপ্পা-সভ্যতা ! মেছোবাজার এইমাত্র এককোপে আমার ধড় থেকে মুন্ডুটা নামিয়ে ডালায় রাখা হল, আঁশবটিতে শরীর থেকে ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে বিড়ালের মুখের কাছে উদোম। হুড়মুড়িয়ে ঝুঁকে পরা ভিড় টিপে দেখছে- মধ্যমা আর পাশের আঙুলে (কি যেন নাম, একটু আগে ভুলে গেছি।) জাম-চতুরজন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চিনছে নাভিমন্ডল।মঙ্গল গ্রহে যাবার রাস্তা, শুরুর মুখে অগ্নিবর্ণ মাটি। কুবো পাখি ডেকে উঠলেই- খুলে যায় রাস্তার মোহন সিগনাল। বিশ্বাসী হবারআগে তুমিও টিপে দেখছো ব্যাক্তি স্বার্থ। ঘর বাঁধার জন্য ব-দীপ। সহজেই মঙ্গলের নাভিমূল পচে যায় অথবা দ্বিখন্ডিত, ভিড় কমার বাষ্প আত্মঘাতী, টিপে দেখা গলায় শ্বাসবন্ধ থেকে হৃৎপিন্ডে ক্ষত, দাবনায় কালশিটে দাগচোখের ভিতরে রক্ত ঝরতে থাকে। কেউ মাছ কিনতে আসে, কেউ শুধু চোখে দেখে মনে মনে খেয়ে নেয় মাছের মাখা দুই গ্রাস ভাত। ও হরি! বিড়ালের পাশে আজ কুকুরের দারুণ সহমরন। দামের দখল-সত্ত্বায় হানাদার নপুংশক, সরুগলা, মোটাগলা ছাপিয়ে যায় নাগরিক চুপ-যন্ত্রণা, নিরামিষ পদক্ষেপে ছিটকে ওঠা আঁশটে জল ধূতিতে লেগে গেলে- আমার মৃত্যুকে দিয়ে দেখি মাছেদের নিষ্পলক চোখ! মুখোশ ইদানীং আমি আর একটাও খুঁজে পাচ্ছিনা ,ঘরে যা কিছু আসবাব, সব তন্নতন্ন করে খুঁজছিকোথাও নেই কোথাও নেইচেনা – অচেনা , নাম জানা – না জানা , শুধু মুখ চেনাসবাই দেখলেই হেসে পথ করে দিচ্ছে – এই হাসিরবলয় থেকে বাঁচতে চাই ! জলের শরীরে দেখি – অবিকল আমিঠিক আমি নই – আমার রাজনীতি বিষয়কনিরপেক্ষতার আডা়লে সব দলের অনুগ্রহপাবার মুখোশ, ধর্মনীতি বিষয়কআমার হানাদারী মুখোশ,মহিলা বিষয়কবহুগামী মুখোশ, বন্ধুনীতিতে মধ্যমনি মুখোশসব খুলে ফেলছি – একটা মুখোশকে খুঁজে পাবার জন্য , খুলতে খুলতে আর কোন মুখোশ নেই |জলের শরীরে ভাসছে – আমার নগ্ন শরীররোগা , পুষ্টিহীন,চোখ বসা , ময়লায় পোডা় বুককোচকানো ত্বক , নিস্তেজ পুরুষাঙ্গ ,আমি নগ্ন , রাস্তায় রঙীন পোশাকের ভিডে়হেঁটে চলে যাচ্ছি ! তুমি আমার সম্রাট একটি শব্দের জন্ম হলেআমি তোমাকেই খুঁজে পাই-কবিতায় আর উপন্যাসে। একটি ফুলের জন্ম হলেআমি তোমাকেই খুঁজে পাই-বসন্তের কোন সুবাতাসে। অন্ধকারের ব্যাসার্ধ থেকেহায়নাদের দালালগুলোআজ আলোতে উল্লাস করে। তোমার রক্তের পিপাসায়লোভাতুর তারা- দাঁতে, নখেজিভের লালা গড়িয়ে পড়ে। নরখাদকের পদভারেএমাটি লজ্জায় মুখ ঢাকে,নদীর স্রোত শুকিয়ে যায়। ধু ধু করে চারিদিক, আরশুধুই কঙ্কাল, মানুষের শবশকুনেরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। একটি শিশুর জন্ম হলেআমি রাসেলকে খুঁজে পাই-কাঁঠালিচাঁপা পাঠশালায়। একটি পাখির জন্ম হলেআমি তোমাকেই খুঁজে পাই-মাঝিরাতো ভাটিয়ালি গায় । রমনা ময়দানকে যারাভয় পেয়েছিলো একদিন,বুলেটের আস্ফালনে হাসে। কাকের গতর চাটা কীটনারীর মাংস খেয়েছিলো-অভিশপ্ত গোরস্থানে বসে। ফসলের নোয়ানো মাথায়চাঁদ, এসে কেঁদে গেছে রোজ,দম্ভের বুটে সব মাড়ানো! কালরাত্রি যে ভোর হয়না,তোমার নিথর দেহ ঘিরেধান-শস্যের রক্ত ছড়ানো! একটি দেশের জন্ম হলেআমি তোমাকেই খুঁজে পাই-আকাশ-প্রদীপ যে ভাস্বর! নরপিশাচেরা ভেবেছিলোরমনার আম আর বটগুলিবিদ্ধ হলে যুদ্ধে জয়। মানুষ মারা যত সহজদৃঢ়তায় দাঁড়ানো গাছটামারা কঠিন, তাইতো ভয়। মুক্তিযোদ্ধার হ্নদয় যেনএকটি গাছের মতো দৃঢ়লৌহ-পুরুষ বলেই জানি। এখানে বিনিদ্র রাতগুলোঅশ্রুভেজা পথ, বুকে তবুহার না মানা সাহস মানি। একটি তৃণের জন্ম হলেআমি তোমাকেই খুঁজে পাই-কৃষকের স্বপ্নময় চোখে। একটি নদীর জন্ম হলেআমি তোমাকেই খুঁজে পাই-বাঁকে উচ্ছল তরঙ্গ দোলে। দেশের জন্য সজাগ যারাভাষার জন্য সজাগ যারা,তুমি তাদের অনুপ্রেরণা! এক আকাশ হয়ে রয়েছোহাতে বরাভয়, শৌর্যদীপ্তবাঙালির সত্য আলোকণা! বহু ঝড়-ঝঞ্জা, চোরাখুনপেরিয়ে এসেছি। তবু এইবাংলা রয়েছে আবহমান রুখে দেব সব কালরাত্রিজানি, তুমি আমার সম্রাটশেখ মুজিবুর রহমান! লিলিথের আমি ও লিলিথ So god created man in his own image in the image of god created he him; Male and female created he them. – Book of jenesis-1:27 প্রেক্ষাপট তৈরি ছিল- অথ ভুখ, তথামাটি দেহ নিমঘুমে- আপেল তলায়,ঝুরোঝুরো ভাঙছিল এই বৃত্তকলাচুলে আউলা-ঝাউলা, বিষাদ জামায়!ফোন বেজেছে গহন ছেঁড়া মনভূমিস্পর্শ-খিদের অসুখ নিয়ে সাঁকো পাড়ে ; জানলা পাশে হলুদ জামা মগ্ন তুমিউতল বুকে চশমা মুছে অপেক্ষাতে!ছোট চুলের উদাস টেনে ঢেউ তোলাদুকুল ছেপে শরীর তোমার প্রবাসী’প্রিয়’ বলে কাদামাটি দুইহাতে মাখানিশ্বাসে উতল তুমি চুম্বন পিয়াসী!প্রভু জানে- বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছোহাওয়ায়-জলে মাখামাখি একসাথে;তুমি এসে এভাবেই সামনে দাঁড়াওমনটা ছিল দিখন্ডিত এক আপেলে… জল-বিষাদ যতবার আমি একটি নতুন গায়ে মাখার সাবান কিনতে দোকানে যাই,সাবানটি কিনবার আগে তিনবার নাকে শুঁকে তার ঘ্রাণ নিয়ে দেখি-গভীরতম সুড়ঙ্গের অন্ধকারে রক্তঃক্ষরণ পেরিয়ে ছোট একটি নদীঘাট।ছলছল কুল ছাপিয়ে উছলে ওঠা জল হাওয়ায় দুলে সারাদিন ঢেউ তোলেবটের শিকড়ে বাঁধা মাঝিদের ছইঅলা নৌকো শূন্য ভেসে দিন গুজরানে যায় ;প্রথম সাবান গায়ে মাখা ছাড়া ধানশিষে শান্ত কিশোরটি অবাধ্য শুশুক জন্ম…আযিমা উতল হয়ে উঠছে- জল ভাসে অনন্ত ভাসানের দিকে কাশফুল যেন!সেই তখন শিমুল ফোটে আরও দূরের একটা মহল্লায় স্বহাস্যভিড় বাড়ে ডাঙ্গুলি খেলায়- একডাঙ-দুইডাঙ করে মুঠো থেকে হারায় ঝিনুক-পুঁতিদুকুল ভাঙনের ভয় বটের ছায়ায় রেখে পুনরায় স্নানে নামি, পুনরায় উতল…স্রোত নেমে গিয়ে ভাঁটার শুরু হলে- নদীস্নানে কখনও যাওয়া হয়নি ওদিকেএখনও সাবান কিনতে দাঁড়ালে- নতুন ঢেউ এসে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দেয়! দয়াময় পোদ্দার ছোট বেলা থেকে লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই সাতটা। লেখা প্রকাশিত হয়েছে, দেশ, উনিশ-কুড়ি, নৌকো সাহিত্য পত্রিকা, সাংস্কৃতিক খবর, দৌড়, গণশক্তি, গৃহশোভা, আত্মশক্তি ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় এবং এখনও প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
১০টি কবিতা > দয়াময় পোদ্দার
- Post author:monmanchitra
- Post published:October 20, 2022
- Post category:কবিতা / চলতি সংখ্যা
- Post comments:0 Comments
Tags: দয়াময় পোদ্দার