একদল অন্ধ মানুষ শুনতে পেল শহরে অদ্ভুত এক প্রাণি এসেছে। প্রাণিটার নাম হাতি। তারা কেউ-ই হাতির অবয়াবব আর চেহারা সম্পর্কে অবগত ছিল না। কৌতুহলের বসে তারা বলল, “আমরা সবাই হাতিটা স্পর্শ দেখবে এটি কেমন। কারণ অন্ধ হলেও কোনকিছু স্পর্শ করে পরখ করতে আমরা সক্ষম।” তারা সবাই তাই হাতির কাছে গেল। একেকজন হাতির একেক জায়গায় দাঁড়িয়ে স্পর্শ করা শুরু করলো। প্রথম জন হাতির শুঁড় স্পর্শ করে বলল, “হাতি মোটা সাপের মতন দেখতে”। যার হাত কান স্পর্শ করলো সে বলল, এটা দেখতে এক ধরনের হাতপাখার মত। আবার যে হাতির পা ধরতে পারলো সে জানালো, এটি দেখতে গাছের গুড়ির মতো এক ধরনের পিলার। আর যে হাতির একপাশ স্পর্শ করলো সে বলল, “এটি দেখতে প্রাচীরের মতন ”। অন্যদিকে যে লেজ ধরার সুযোগ পেল সে বললো, এটি দড়ির মতো। শেষ ব্যক্তি হাতির দাঁত ধরে বললো, এটি শক্ত মসৃণ বল্লমের মতো।
প্রিয় পাঠক উপরের গল্পটা সাহিত্যের ময়দানে প্যারাবলের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা এ প্রবন্ধে প্যারাবল নিয়ে সাধারণ আলোচনা করবো – দেখার চেষ্টা করবো প্যারাবল কি, এর বৈশিষ্ট, প্যারাবলের সাথে রূপক, উপমা, এলিগোরি ও ফেবলের পার্থক্য, দেশে দেশে প্যারাবলের চর্চা, প্যারাবল চর্চার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি।
প্যারাবল কি?
সাহিত্যের ইতিহাসে প্যারাবলের উপস্থিতি প্রাচীন যদিও এটি কখনই একটি আলাদা শক্তিশালী স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে দাঁড় হয়নি। এর অন্যতম কারণ হতে পারে প্যারাবলের সাথে ধর্মীয় শিক্ষার একটা সম্পর্ক মধ্যযুগ থেকে বিশেষ করে বাইবেলে। আধুনিককালে হোর্হে ল্ইু বোর্হেস, কাফকা, জন হোকস, ডোনাল্ড বার্থহেলম, রবার্ট কোভার, উইলিয়াম এইচ গাস প্রভৃতি শক্তিশালী সাহিত্যিকরা প্যারাবলের চর্চা করায় সাহিত্যের এ শাখাটি আলোচনায় ফিরে এসেছে। এখানে বলে রাখা ভাল, সাহিত্যে কাহিনি বা আখ্যানের জন্ম থেকেই প্যারাবলের চর্চা হয়ে আসছে। ফলে লিখিত সাহিত্য ইতিহাসে রোমান, গ্রিক, চীনা, জাপানী, আফ্রিকান এবং ল্যাতিন আমেরিকান প্রাচীন সাহিত্যে প্যারাবলের চর্চা হয়েছে। ফেবলের মতো প্যারাবলও এক সংস্কৃিত থেকে অন্য সংস্কৃতির মাঝে সেতু বন্ধনের কাজ করেছে। ভারতীয় অন্ধের হাতি দর্শন প্যারাবলটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ প্যারাবলটি ভারতীয়, জাপানী, পার্শিয়ান এবং ইউরোপীয় সাহিত্যে দেখা যায়।
প্যারাবল শব্দটি ইংরেজিতে এসেছে গ্রিক শব্দ parabolē; এখানে para অর্থ হলো পাশাপাশি বা নিকটবর্তী আর bolē অর্থ হলো ছোঁড়া বা নিক্ষেপ করা। বৃহত্তর অর্থে প্যারাবল মানে ‘তুলনা করা, ব্যাখ্যা করা, প্রতিতুলনা করা’। সংক্ষিপ্ত কল্পকাহিনি বোঝাতে গ্রিক অলঙ্কারশাস্ত্রবিদরা প্যারাবল শব্দটি ব্যবহার করেন। প্যারাবল আসলে এক ধরনের রূপকাশ্রয়ী প্রতিচিত্র (metaphorical analogy)
এ গ্লোসারি অব লিটারারি টার্মস গ্রন্থে প্যারাবলের আলোচনায় বলা হয়েছে, ‘প্যারাবল হলো মনুষ্য বিষয়ে খুব সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যা অব্যক্ত প্রতিতুলনা (analogy) বা সাদৃশ্য, উপমা, তুলনা (parallel) এর মাধ্যমে একটি সাধারণ সূত্র (thesis) বা শিক্ষার সাথে যোগসুত্র তৈরি করে বর্ণনাকারী তার পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়।’
মার্ক টার্নার মনে করেন, প্যারাবল হলো একটি গল্পের মাধ্যমে আরেকটি গল্প এমনকি আরো অনেক গল্পের উপস্থাপন যা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত দু’ভাবেই হতে পারে। তাঁর মতে প্যারাবল বৃহত্তর অর্থে কেবল সাহিত্য বা শিক্ষা/নীতিবিষয়ক একটি পদ্ধতি না বরং এটি হলো মৌলিক জ্ঞান বা ধারণা সংক্রান্ত নীতি (every level of our experience) যা আমাদের জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যায় ভূমিকা রাখে এবং যার উপস্থিতি সর্বত্র দেখা যায় – সময় বলা থেকে জটিল সাহিত্য সৃষ্টি পর্যন্ত।
সাহিত্য সমালোচক এক্স জে কেনেডি মনে করেন, প্যারাবল হলো সংক্ষিপ্ত গল্প যা কোনকিছু শিক্ষা দেয় এবং কিছু প্যারাবল হলো এলিগোরি তবে প্যারাবলই এলিগোরি না। আবার পেঙ্গুইন ডিকশনারি অব লিটারারি টার্মস এন্ড লিটারারি থিওরি গ্রন্থে বলা হয়েছে, প্যারাবল হলো ছোট ও সাধারণ গল্প যা নৈতিকতার নির্দেশনা দেয় আর যার রয়েছে এলিগোরি আর ফেবলের সাথে সম্পৃক্ততা।
জন রাইট মনে করেন, প্যারাবল আংশিক ব্যঙ্গত্মক (satiric), বিদ্রুপাত্মক-ইউটোপিয়ান বিজ্ঞান-ফিকশন (mock-utopian science-fiction) জাতীয় গল্পের মতন এবং নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতায় এটি ব্যঙ্গতাযুক্ত (sardonic), পান্ডিত্যপূর্ণ গল্প। বেন বেলিটের মনে করেন, প্যারাবল হলো হেঁয়ালীপূর্ণ প্রচারের (enigmatic preachment) সাধারণ প্রক্রিয়া।
প্যারাবল আর ফেবল মানুষ মুখে মুখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করে নিয়ে এসেছে যা আসলে সাহিত্যের লিখিত রূপের আগ থেকে চলে এসেছে। ফলে এতে লোকজজ্ঞানের উপাদান পাওয়া যায়। প্যারাবল সমাজজীবন বিশ্লেষণে মনোযোগী নয় বরং পাঠক বা শ্রোতাকে তার বিশ^াস স্মরণ করিয়ে দেয়। প্যারাবলে গল্প বলার চেয়ে মানুষের আচরণের ঘটনাবলী তুলে ধরায় আগ্রহী। প্যারাবলের পাঠক বা শ্রোতা এটা শুনে মনে করে যে, এটা তো তাদের জনপদেরই গল্প, এটা তো জানাই ছিল, আবার তা মনে পড়ে গেল।
তাহলে বলা যায়, প্যারাবল হলো সংক্ষিপ্ত গদ্যে কিংবা পদ্যে লিখিত শিক্ষামূলক কল্পকাহিনি যার ভেতর এক বা একাধিক নির্দেশনামূলক শিক্ষা বা নীতি কিংবা তত্ত্বের সন্নিবেশ থাকে।
প্যারাবলের বৈশিষ্ট্য
আগেই আমরা ধারনা পেয়েছি যে, প্যারাবল হলো ছোট পরিসরে একটা গল্প যা সার্বজনীন কোন সত্যকে প্রকাশ করে। ফলে বর্ণিত আখ্যানে সার্বজনীনতা থাকে। আর এ গল্পের বর্ণনা হয় অতি সাদাসিধে। এর একটা ঘটনা থাকে, ঘটনায় একশন আর তার ফলাফল থাকে। প্যারাবলে অনেক সময় বর্ণিত চরিত্র এক ধরনের নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে আবার কখন চরিত্র বাজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এবং তার জন্য তাকে অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। যদিও প্যারাবলে বর্ণিত গল্পের অর্থ সরাসরি বোঝা যায় না। তবে তা আবার ইচ্ছে করে গোপনও রাখে না বরং সহজেই তা বোঝা যায়।
প্যারাবলের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো এটি পাঠ করে একজন পাঠক বুঝতে পারে, ব্যক্তির কী ধরনের আচরণ করা উচিত বা আচরণ কী হওয়া উচিত। ব্যক্তির জীবনে সঠিক আচরণের নিদের্শনা ও পরামর্শের পাশাপাশি প্যারাবলে সাধারণভাবে রূপক ভাষায় কঠিন ও জটিল ধারনা/তত্ত্বের উপস্থাপন করা হয়, যাতে মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে। তাই প্যারাবল সুনির্দিষ্ট মূর্ত ঘটনা বর্ণনা করে যার মাধ্যমে বিমূর্ত যুক্তি পাঠক সহজে বুঝতে পারে। এতে একটা নীতি এবং একটা নৈতিকতায় কেন্দ্রীভূত থাকে এবং পাঠক তা নিজের জীবনে উপলব্ধি করতে পারে।
উইলিয়াম জি ডোটি প্যারাবলের নয়টি বৈশিষ্টের কথা বলেছেন। এগুলো হলো: ইহজাগতিকতা (এমনকি ধর্মীয় প্যারাবলেও), বিপরীতমুখী পরিবর্তন, রসবোধ, ঐতিহ্যের পুনমূল্যায়ন, সার্বজনীনতা, প্রায়োগিকতা, বর্ণনার জগত যেখানে রহস্য – প্যারাডক্স ও ধাঁধাঁ এবং চরিত্র, চরিত্রায়ন ও তার ভূমিকা।
বাইবেল অনেকগুলো প্যারাবল রয়েছে। এ সকল প্যারাবলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য যেগুলোর অনেকটাই অন্যান্য প্যারাবলেও দেখা যায়:
– এগুলো সংক্ষিপ্ত। অপ্রয়োজনীয় কোন শব্দের ব্যবহার নাই এগুলোতে। যতটা সম্ভব সরাসরি বক্তব্য।
– এর অন্যতম বৈশিষ্ট সরলতা এবং বিষয় উপস্থাপনে এককেন্দ্রীকতা (symmetry)। কোন প্যারাবলেই কোন পরিস্থিতি বর্ণনায় দুই গ্রুপ বা ব্যক্তির ব্যক্তির অধিক উপস্থিতি দেখা যায় না।
– প্যারাবলগুলোর মূল ফোকাস বা বিষয়বন্তু মানুষ। এখানে প্রকৃতি, প্রাণি বা ঈশ্বর বিষয় বর্ণনা নাই।
– প্যারাবলগুলোতে প্রতিদিনের জীবনের ঘটনার কল্পকাহিনির বর্ণনা। ফলে পাঠক/ শ্রোতা সহজে নিজের জীবনোর সাথে তা সম্পৃক্ত করতে পারে।
– প্যারাবলগুলো পাঠককে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করে তুলতে পারে। পাঠক প্যারাবলের সাথে একাত্ম বোধ করে।
– গল্পের শেষে চমক থাকে যাকে পাঞ্চ লাইন বলা যেতে পারে।
– প্যাবাবলে সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট থাকে।
– প্যারাবলগুলো মানুষের আচরণ পরিবর্তন ও শৃঙ্খলা আনতে ভূমিকা রাখে।
প্যারাবল, ফেবল ও এলিগরি, রূপক ও উপমা
আগেই বলা হয়েছে, প্যারাবলের প্লটে মানুষ হলো উপজীব্য আর ঠিক তার উল্টো হলো ফিবল। ফেবলের সাথে এর মূল পার্থক্য হলো, ফেবলের চরিত্ররা বস্তু, প্রাণি, প্রকৃতিক শক্তি কিংবা জীব জগত। এই পার্থক্যটুকু বাদে ফেবলের সাথে প্যারাবলের সাযুজ্জ্বই বেশি।
এলিগরি হলো রূপকাশ্রয়ী কল্পিত ন্যারেটিভ যার ভেতর বর্ণনা করা ঘটনার বাইরে অর্থ বিদ্যমান থাকে। এলিগরির প্রচলিত সাধারণ ফর্ম হলো ফেবল, প্যারাবল এবং এপিলগ যার মধ্যে দুই বা তার অধিক অর্থ লুকানো থাকে যা পাঠককে ব্যাখ্যা প্রক্রিয়ার (interpretive process) মাধ্যমে তার অর্থ বুঝতে হয়। এলিগরি ছোট বড় নানা রকমের হতে পারে। ফলে অধিকাংশ ফেবল ও প্যারাবলই আসলে সেই অর্থে একেকটা এলিগোরি।
প্যারাবলের সাথে ভাষালঙ্কারের সম্পর্ক রয়েছে বিশেষ করে রূপক (metaphor) এবং উপমা (simile) কিন্তু এ দুটোর সাথে প্যারাবলকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। প্যারাবল রূপকের মতো যা বিমূর্ত ধারণা মূর্ত করে প্রকাশ করার জন্য বাস্তব এবং উপলব্ধি করা যায় এমন বিষয়ের ব্যবহার করা হয়। তাই বলা যেতে পারে যে, প্যারাবল হলো এমন এক রূপক যা বর্ধিত হয় এক সংক্ষিপ্ত এবং সুসংগত ন্যারেটিভের মাধ্যমে। আবার প্যারাবল উপমার সাথেও সাদৃশ্য যা রূপকের মাধ্যমে তুলনা করে। তবে, প্যারাবলের অর্থ অন্তর্নিহিতি থাকে যদিও তা বোধগম্যের বাইরে না।
বাংলা সাহিত্যে প্যারাবল
সংস্কৃতে লেখা ভারতীয় সাহিত্যে পঞ্চতন্ত্র একটি উল্লেখযোগ্য ফেবল। পঞ্চতন্ত্র আর ঈশপের ফেবল বাংলায় অনেক আগেই অনূদিত হয়েছে। এবং এ গ্রন্থ দুটোর গল্পগুলো বাংলা সাহিত্যের সাথে এতটাই সম্পৃক্ত যে, এগুলোকে আর অনূদিত সাহিত্য বলে মনে হয় না। আবার মহাভারত যেহেতু প্যারাবলের আদি উৎসের একটি, তাই বাংলা সাহিত্যে এর উপস্থিতি প্রাচীনকাল থেকেই বলা যায়। তবে এটা বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে ফেবল বা প্যারাবলের তেমন বিকাশ হয়নি। গ্রামে মা, দাদী, নানীরা যে জীবজন্তু বা মানুষের গল্প শিশুদের শোনাতেন সেগুলোই আসলে এ অঞ্চলের ফেবল আর প্যারাবল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেগুলোর চরিত্র মানবকূল সেগুলোই প্যারাবল। ফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলা ভাষার ফেবল ও প্যারাবলের আদি উৎস লোকমুখে প্রচলিত কল্পকাহিনি। এগুলোই যুগে যুগে ওরাল ট্রাডিশনের মাধ্যমে মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করে এনেছে। ৮০০- ১২০০ সালের মধ্যে কোন এক সময় জন্মানো খনা বাংলা সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। খনার অনেকগুলো বচন এখনো প্রচলিত আছে। এই খনার বচনের অনেকগুলোর মধ্যে ফেবল ও প্যাবাবলের উপাদান দেখা যায়। আধিুনককালে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, সুকুমার রায়ের লেখায় প্যারাবল ও ফেবলের দেখা পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাখের কনিকা কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই ফেবল পর্যায়ে পড়ে। আর দুই বিঘা জমি কিংবা সোনার তরী কবিতাকে কেউ যদি প্যারাবল বলে দাবী করে তবে তা অস্ব^ীকার করা কঠিন হয়ে যাবে।
প্যারাবলের সকল বৈশিষ্ট হাজির না থাকলেও আমরা চর্যাপদের অনেকগুলো পদে দেখি গল্পের ছলে নৈতিক শিক্ষার দেয়া হয়েছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সংকলিত ৫০টি চর্যাপদে অন্তত গোটা দশেক পদের বর্ণনায় এক ধরনের ন্যারেটিভের আভাস পাওয়া যায়। এছাড়া, কয়েকটিতে ফেবলেরও উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আমরা জানি, চর্যাপদ হলো বাংলাভাষার অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য যা বৌদ্ধতান্ত্রিকদের রহস্যময় গান ও দোহা যেগুলো অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকে রচিত হয়েছিল। এখানে বিরুবাপাদানামের একটি পদের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কৃত আধুনিক রূপ পাঠকের জন্য দেয়া হলো। বিরুয়ার জন্ম ত্রিপুরায়। সম্ভবত দেবপালের রাজত্বকালে (৮১০-৮৫০ খ্রীষ্টাব্দ) তিনি জীবিত ছিলেন। তিনি কিছুদিন পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারে কাটিয়েছিলেন।
এক সে শুঁড়িনী (নারী মদবিক্রেতা) দুই ঘরে সেঁধয় (প্রবেশ করে)
চিকন বাকলে বারুণী (মদ) বাঁধে।।
সহজ দ্বারা স্থির করিয়া বারুণী চোলাই র্ক
যাহাতে অজরামর (মৃত্যু ও জরা) দৃঢ় হয় কাঁধ (দেহ)।।
দশম দোরে চিহ্ন দেখিয়া
এল গ্রাহক আপনি (কিংবা হাটে) (পথ) বহিয়া।।
চৌষট্রি ঘটীতে (সাজাইয়া) দিউক পসার
পশিল গ্রাহক, নাহি নিঃসরণ।।
এক ছোট ঘটী, সরু নল,
ভণেন বিরুয়া থির করিয়া চাল্ ।।
নিচে বনফুলের নিমগাছ গল্পটি দেয়ার লোভ সামলানো গেল না। পাঠকই বিচার করবেন এটি প্যারাবল কি না।
কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে।
পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ।
কেউ বা ভাজছে গরম তেলে।
খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে।
চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ।
কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে।
এমনি কাঁচাই…..
কিংবা ভেজে বেগুন- সহযোগে।
যকৃতের পক্ষে ভারী উপকার।
কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক…। দাঁত ভালো থাকে। কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশি হন।
বলেন- নিমের হাওয়া ভাল, থাক, কেটো না।
কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না।
আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে।
শান দিয়ে বাঁধিয়েও দেয় কেউ- সে আর এক আবর্জনা।
হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এলো।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙ্গলে না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু।
বলে উঠলো, বাঃ কি সুন্দর পাতাগুলো…..কি রূপ। থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার….এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাঃ!
খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল।
কবিরাজ নয়, কবি।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভেতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তুপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ীর গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মী বউটার ঠিক এই দশা।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-৮৬) তাঁর ভক্তদের প্যারাবলের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা দিতেন। ভক্তদের বলা তাঁর একটা বিখ্যাত প্যারাবল এরকম:
আকবর আর ফকির
সম্রাট আকবরের শাসনামলে দিল্লির নিকটে এক বনে এক ফকির (মুসলিম সাধু) বাস করতেন। এই ফকিরের কাছে অনেকে আসতেন। তবে তাদের খেদমত করার মতো তার কিছুই ছিল না। এ জন্য তার অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়লো। এবং তিনি তা পেতে দয়ালুখ্যাত আকবর বাদশার কাছে গেলেন।
আকবর যখন মোনাজাত করছিলেন সেই ফকির তখন সেখানে ছিলেন। ফকির আকবরের মোনাজাত শুনতে পেলেন, “ হে আল্লাহ, আমাকে আরো সম্পদ দাও, আরো ক্ষমতা দাও, আরো রাজ্য দাও।”
এ মোনাজাত শুনে ফকির প্রস্থান করার জন্য উদ্যত হলেন কিন্তু আকবর তাকে বসতে বললেন। আকবর বললেন, “ জনাব আপনি আমার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছেন। এটা কেমন কথা যে আপনি কিছু না বলেই চলে যাচ্ছেন।”
তখন ফকির বললো, “ আলমপানা, আমি যে উদ্দেশ্যে আপনার কাছে এসেছি তার আর আপনাকে বলার দরকার নাই। ”
তখন আকবর বারবার জানতে চাইলেন তিনি কি চান, ফকির অবশেষে বললেন, “ আলমপানা, অনেকে আমার কাছে শিখতে আসে। কিন্তু অর্থের অভাবে আমি তাদের আতিথেয়তা করতে পারি না। আমার ধারনা ছিল এ সমস্যার সমাধান আপনি করতে পারবেন।”
এরপর আকবর জানতে চাইলেন তাহলে তিনি এটা না জানিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলেন কেন।
এর উত্তরে ফকির বললেন, “ যে নিজে একজন ভিক্ষুক তার কাছে আমি কীভাবে ভিক্ষা চাই? তার চেয়ে আমি সরাসরি আল্লার কাছেই ভিক্ষা চাইবো। অবশ্য আমার ভিক্ষা না চেয়ে যদি আর কোন উপায় না থাকে।”
শামসুর রাহমান প্যারাবল নামেই একটি কবিতা লিখেছেন:
নাড়েন সবল হাত ছুটে আসে নফরের দল
তড়িঘড়ি চতুঃসীমা থেকে। তাঁর প্রবল নির্দেশে
সমুদ্রে জাহাজ ভাসে, অবিরাম চাকা ঘোরে কল-
কারখানায়, তৈরি হয় সেতু দিকে দিকে; দেশে দেশে
নিমেষে জমান পাড়ি রাষ্ট্রদুতগণ, কারাগারে
জমে ভিড়, সৈন্য বাড়ে রাতারাতি, কানায় কানায়
ভ’রে ওঠে অস্ত্রাগার, এমন কি আগাড়ে ভাগাড়ে
শকুনের বসে ভোজ। কিন্তু ছোট কোমল ডানায়।
ভর ক’রে পাখি আসে ডালে তাঁর নির্দেশ ছাড়াই-
বিখ্যাত কোকিল। ডাকে অন্তরালে, নির্ভীক স্বাধীন।
হঠাৎ বলেন তিনি, ‘পাখিটাকে কী ক’রে তাড়াই?
থামা তোর গান, নইলে দেবো শাস্তি ওরে অর্বাচীন।
তবু সুর আসে ভেসে। কোকিল নয়কো কারো দাস,
কখনো পারে না তাকে স্তব্ধ করতে কোনো সর্বনাশ।
ইহুদি ধর্মশাস্ত্রে প্যারাবল
প্যারাবলের মাধ্যমে যেহেতু মানুষকে সহজে কঠিন ও জটিল বিষয়ে সম্পর্কে বোঝানো সম্ভব হয় তাই এক্ষেত্রে ইহুদি ধর্মের টেক্সটেও এর ব্যবহার দেখা যায়। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রাব্বিরা (ইহুদি ধর্মপ্রচারক) প্যারাবলকে একটা উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং ঈশ্বরের আইনের সঠিক অর্থ বোঝাতে তারা এর ব্যবহার করেছেন। তাদের ধর্মশান্ত্র তালমুদ এবং মিডরাশ এ অনেক প্যারাবল রয়েছে। পাঠকদের জন্য এর মধ্যে থেকে একটি প্যারাবল তুলে দেয়া হলো:
পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাসী এক দার্শনিক একবার আর. গামালিয়েলকে জিজ্ঞাসা করলো, ঈশ্বর কেন মূর্তির উপর না রেগে মূর্তি পূজারীর উপর রাগান্বিত হন। গামালিয়েল দার্শনিকের এ প্রশ্নের উত্তর করলেন এই প্যারাবলটা বলে। এক রাজার এক ছেলে ছিল। ছেলেটা একটা কুকুর পুষলো এবং কুকুরটার নাম তার রাজকীয় পিতার নামেই রাখলো। যখনই সে কসম করে তখনই সে বলে, “কুকুরের জীবনের কসম, পিতা।” রাজা এটা যখন শুনলেন, তখন তার রাগ কার প্রতি হবে, সন্তানের প্রতি না কুকুরের প্রতি? অবশ্যই সন্তানের প্রতি। (আব জারাহ ৫৪বি)
বাইবেলে প্যারাবল
বাইবেলে প্যারাবলের ব্যবহারের কারণে ইউরোপের ধর্ম ও সাহিত্য জগতে প্যারাবল অতি পরিচিত নাম। ধর্মযাজকেরা এর প্রচারের ফলে ব্যাপারটা এমন হয়ে যায় যে, প্যারাবল যেন কেবল বাইবেলেরই ব্যাপারস্যাপার। বাইবেলের নিউটেস্টামেন্টে লুকের গসপেলে ২৪টি যার মধ্যে ১৮টি স্বতন্ত্র, ম্যাথু এর গসপেলে ২৩টি যার মধ্যে ১১টি স্বতন্ত্র আর মার্কের গসপেলে ৮টি যার মধ্যে দুটি স্বতন্ত্র প্যারাবল। যিশু মূলত তার বাণী সহজভাবে জনতাকে বোঝাতে এসব প্যারাবল ব্যবহার করতেন। নিচে বাইবেল থেকে একটি প্যারাবল:
ভালো শমরীয়ের কাহিনী
একদিন, ইহুদি ব্যবস্থার নিপুণ এক গুরু এলেন যীশুকে পরীক্ষা করতে, বললেন, “গুরু, অনন্ত জীবন পাওয়ার জন্য আমাকে কি করতে হবে?” যীশু উত্তর দিলেন, “ঈশ্বরের বাক্যে কি লেখা আছে?”
ব্যবস্থার নিপুণ গুরু উত্তর দিলেন, “ তোমার প্রভু ঈশ্বরকে তোমার সম্পূর্ণ হৃদয়, প্রাণ, শক্তি, আর মন দিয়ে প্রেম কর। আর তোমার প্রতিবেশীকে নিজের সমান প্রেম কর৷” যীশু উত্তর দিলেন, “তুমি সঠিক বলেছ! এমনটাই কর আর তুমি বাঁচবে।”
কিন্তু সেই ধর্মগুরু প্রমাণ করতে চাইলেন যে তিনি ধার্মিক, তাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার প্রতিবেশী কে?”
ব্যবস্থার-গুরুকে যীশু এক দ্রষ্টান্ত দ্বারা উত্তর দিলেন। “এক ইহুদি ব্যক্তি ছিলেন যিনি জেরুজালেমের রাস্তা দিয়ে যিরীহোতে যাচ্ছিলেন।”
যখন সেই ব্যক্তি যাত্রা করছিলেন তখন একদল ডাকাত তাকে আক্রমণ করে। যা কিছু তার কাছে ছিল তারা তা লুট করল আর প্রায় আধমরা অবস্থা পর্যন্ত পেটালো। তারপর তারা সেখান থেকে চলে গেল।”
“তার পর পরই, এক ইহুদি যাজক সেই পথ দিয়ে আসছিলেন। যখন সেই ধার্মিক-নেতা সেই ডাকাত আক্রান্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিটিকে দেখলেন, তখন তিনি রাস্তার অন্য ধার দিয়ে চলে গেলেন, সেই সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তিটিকে উপেক্ষা করলেন আর চলতেই থাকলেন৷
“আরও কিছু সময় পর, এক লেবীয় সেই পথ দিয়ে এলেন। (লেবীয়রা হলেন ইহুদিদের একটি গোত্র যারা মন্দিরে যাজকদের সাহায্য করতেন।) সেই লেবীয়টিও রাস্তার অন্য ধার দিয়ে চলে গেলেন, সেই ডাকাত আক্রান্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিটিকে উপেক্ষা করে৷
“ এর পর যে ব্যক্তি সেই পথ দিয়ে এলেন সে হল একজন শমরীয়। (শমরীয় হল ইহুদিদেরই বংশের লোক যারা অন্য রাষ্ট্রের মানুষদের বিবাহ করেছিল। শমরীয়রা আর ইহুদিরা একে অপরকে ঘৃণা করত।) কিন্তু যখন সেই শমরীয় সেই ইহুদিকে দেখলেন তখন তিনি তার প্রতি খুবই সহানুভূতি অনুভব করলেন। তাই তিনি তার যত্ন নিলেন আর তার ক্ষত বেঁধে দিলেন। ”
“ শমরীয় সেই ব্যক্তিটিকে নিজের গাধার উপর চড়ালেন আর তাকে এক সরাই খানায় নিয়ে এলেন যেখানে তিনি তার যত্ন নিলেন।”
“ পরের দিন, সেই শমরীয়কে তার যাত্রা পুনরায় বহাল করতে হলো। তাই তিনি সরাইখানার মালিককে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, ‘ইহুদি ব্যক্তিটির সেবা-যত্ন করবেন, আর যদি আপনি বেশি টাকা তার জন্য খরচা করে থাকেন তাহলে যখন আমি এই পথ দিয়ে ফিরব তখন আমি তা শোধ করে দেব।’”
তখন যীশু সেই ধর্মগুরুকে প্রশ্ন করেন, “ আপনি কি মনে করেন? সেই তিন ব্যক্তির মধ্যে কে সেই ডাকাত আক্রান্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির প্রতিবেশী?” তিনি উত্তর দিলেন, “ সেই ব্যক্তি যিনি তার উপর দয়াশীল ছিল।” যীশু উত্তর দিলেন, “তুমিও যাও আর একই রকম কর। ” (লুক ১০:২৫-৩৭)
ইসলামে প্যারাবল
প্যারাবল ব্যবহারের মাধ্যমে যেহেতু সহজে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা মানুষকে সহজে বোঝানো যায়, তাই ইসলাম ধর্ম প্রচারে এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। নবীর রাস্তায় বুড়ির কাঁটা বিছানোর গল্পটি ইসলাম ধর্মে একটি উৎকৃষ্ট প্যারাবল। এমনকি কোরানেও প্যারাবলের উপস্থিতি রয়েছে। যেমন সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৯ এ বর্ণনা করা হয়েছে:
অথবা সে ব্যক্তির মত, যে এমন এক জনমত অতিক্রম করেছিল যা তার ছাদের উপর থেকে বিধ্বস্ত ছিল। সে বলল, ‘মৃত্যুর পর কিভাবে আল্লাহ্ একে জীবিত করবেন? তারপর আল্লাহ্ একে শত বছর মৃত রাখলেন। পরে তাকে পুনর্জীবিত করলেন। আল্লাহ্ বললেন, ‘তুমি কতকাল অবস্থান করলে?’ সে বলল, ‘একদিন বা একদিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি’। তিনি বললেন, বরং তুমি একশত বছর অবস্থান করেছ। সুতরাং তুমি তোমার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় বস্তুর দিকে লক্ষ্য কর, সেগুলো অবিকৃত রয়েছে এবং লক্ষ্য কর তোমার গাধাটির দিকে। আর যাতে আমরা তোমাকে বানাবো মানুষের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। আর অস্থিগুলোর দিকে লক্ষ করো; কীভাবে সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই।’ অতঃপর যখন তার নিকট স্পষ্ট হল তখন সে বলল, ‘আমি জানি নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’।
হাদিসেও প্যারাবলের ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক। যেমন তিরমিজি শরীফের ৫ম খ-ের ৪৩ অধ্যায়ের ২৮৬২ নম্বর হাদিসটি এরূপ:
জাবির বিন আব্দুল্লআহ কর্তৃক বর্ণিত: আল্লার নবী বলেছেন: আমার নিজের প্যারাবল (জীবনকাহিনি) এবং আমার আগের নবীদের প্যারাবল হলো এমন যে, যেন একজন মানুষ একটা বাড়ি তৈরি করেছে। তিনি সেটার নির্মাণ সম্পন্ন করেছেন এবং তা সুন্দরভাবে তা করেছেন। তবে বাড়িটার একটা একটা ইট কেবল ফাঁকা রেখেছেন। মানুষজন বাড়িটিতে প্রবেশ করে আর বলে, “ এই ইট পরিমাণ জায়গা যদি ফাঁকা না থাকতো!”
ইসলামের সুফি ট্রাডিশনে প্যারাবলের খুবই ব্যবহার হয়। তবে এর চর্চা বিশেষভাবে দেখা যায় ফার্সি সাহিত্যে যেমন আত্তার, জালালুদ্দিন রুমি, শেখ সাদি, মনসুর হাল্লাজ প্রভৃতি সুিফ সাধকদের প্রচারকর্মে প্যারাবলের উপস্থিতি প্রবল। সুফিবাদের শিক্ষা এবং মূল্যবোধ বোঝাতে এটির ব্যবহার হয় যেমনটি দেখা যায় বাউলদের ক্ষেত্রে। বাউল সাধকরা জ্ঞান মার্গের চর্চা করেন জীবনমুখী নানা উদাহরণের মাধ্যমে যার অনেকগুলি একধরনের প্যারাবল। সুফি ঘরানার প্যারাবলকে জনপ্রিয় করতে গবেষক ইদরিশ শাহ এবং অ্যাস্থনী ডি ম্যালো ভূমিকা রেখেছেন। নিচে একটি এ ঘরানার ঋণ শোধ নামে একটা প্যারাবল দেয়া হলো:
এক হোজ্জা (শিক্ষক) বাজারে জলপাই বিক্রি করছিলেন। সেদিন বাজারে বেচাবিক্রি ভাল ছিল না। তার পাশ দিয়ে এক নারী যাচ্ছিল। তিনি তাকে ডাকলেন। এবং তাকে জলপাই কেনার জন্য অনুরোধ করলেন। নারীটি মাথা নেড়ে জানালেন তার কাছে কোন টাকা নাই।
“ কোন অসুবিধা নাই”, হোজ্জা দাঁত বের করে বললো, “ আপনি আমাকে পরে দাম মিটিয়ে দিয়েন।” সে তখন দোনোমনা করছিল। এই দেখে তিনি তাকে একটা চেখে দেখার জন্য বললেন।
“ আরে না না, খেতে পারবো না। আমি রোজা আছি।,” নারী উত্তর করলেন।
“ রোজা? রমজান মাস তো ছয় মাস আগে পার হয়ে গেছে!”
“ তা ঠিক। আমি একটা রোজা করতে পারিনি। আজ সেটা করছি। আচ্ছা ঠিক আছে। এক কেজি কাল জলপাই দিন। ”
“ থামুন!” চিৎকার করে উঠলেন হোজা, “ যার আল্লার পাওনা ঋণ শোধ করতে ছয় মাস লাগে, আমার ঋণ শোধ করতে না জানি তার কতমাস লাগবে।”
শেখ সাদি বড় মাপের সুফি সাধক ছিলেন। তার পোশাকের গুণ বাঙালী পাঠকের কাছে খ্বুই পরিচিত। গল্পটি এরকম:
শেখ শাদি খুবই সাদা-সিধে জীবনযাপন করতেন। একবার এক দাওয়াতে তিনি তার সাধারণ পোশাক পরে গেলেন। ফলে দাওয়াকারী তাকে চিনতে পারলেন না। তাকে ফকির ভেবে কম ও অনুন্নত খাবার খেতে দিলেন। তিনি বিষয়টি বুঝতে পারলেন। তখন তিনি সে খাবার খেয়ে ফিরে এলেন। কিছুক্ষণ পর আবার ভালো ও শাহেনশাহী পোশাক পরে ঐ বাড়িতে গেলেন। এবার তার সামনে সকল উন্নত খাবারদাবার এবং তাকে খুব যত্নআত্মি করা হলো। তিনি খাবার খেতে বসে কিছু খেলেন এবং কিছু খাবার তার পোশাকে ঢুকাতে লাগলেন। এই অবস্থা দেখে তাকে প্রশ্ন করা হলো, জনাব আপনি এটা কি করছেন ? জবাবে শেখ শাদি বললেন, একটু আগে আমি এসেছিলাম, আমি সাধারণ পোশাক পরেছিলাম। তখন আপনারা আমাকে সম্মান দেখাননি। অথচ এখন দেখাচ্ছেন। তাই ভাবলাম এই সম্মান ও খাবার আমার নয়, ওগুলোর প্রাপ্য এই পোশাকেরই।
এছাড়া শেখ সাদির আরেকটি প্যারাবল সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত উত্তম ও অধম নামে অনুবাদ করেছে যা পাঠকপ্রিয়তা আজও রয়েছে।
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তায়।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।
বাপেওে সে বলে ভর্ৎসনা-ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
“তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নেই দাঁত!”
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
“ তুই রে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়
দংশি কেমন করে!
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা ব’লে কুকুরে কামড়ানো কি রে
মানুষের শোভা পায়?”
বৌদ্ধধর্মে প্যারাবল
বৌদ্ধদের ধর্মীয় নিদের্শনাবলী বোঝানোর জন্য ফেবলের প্রচলন রয়েছে। বুদ্ধের জন্মকাহিনি, জাতক, এ ফেবলের ব্যবহার করে নৈতিক শিক্ষা প্রচার করা হয়েছে। তাদের একটি ধারা যা জেন নামে পরিচিত। এদের দার্শনিক ও শিক্ষামূলক বিষয়গুলো ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে বোঝানো হয় যার অনেকগুলিই প্যারাবল। নিচে কঠিন পরিশ্রম নামে একটি জেন প্যারাবল দেয়া হলো:
মার্শাল আর্টের একজন ছাত্র তার শিক্ষকের কাছে আগ্রহের সাথে জানতে চাইলো, “ আমি আপনার দেয়া মার্শাল আর্ট অতি নিষ্ঠার সাথে শিখছি। এ বিষয়ে পুরোপুরি পারদর্শী হতে আমার আর কতদিন লাগবে।
শিক্ষক নির্লিপ্তভাবে উত্তর করলেন, “ দশ বছর”। অধৈর্য হয়ে ছাত্রটি তখন বলল, “কিন্তু আমি আরো তাড়াতাড়ি এটা শিখতে চাই। আমি আরো পরিশ্রম করবো। আমি প্রতিদিন চর্চা করবো – প্রয়োজনে দশ কিংবা তার চেয়ে বেশি ঘন্টা করবো। তাহলে কতদিন লাগবে?”
শিক্ষক কিছুক্ষণ চিন্তা করে উত্তর দিলেন, “ ২০ বছর।”
ইউরোপীয় সাহিত্যে প্যারাবল
প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যে দার্শনিক বিষয়াবলী ব্যবহারের জন্য প্যারাবলের ব্যবহার হয়েছে। তবে বাইবেলের প্যারাবলই মূলত ইউরোপীয় সাহিত্যে বড় স্থান দখল করে আছে। উনবিংশ শতকে ডাচ দার্শনিক সোরেন কিয়োর্কেগার্ড তার দার্শনিক বিষয়াবলী সহজে বোঝাতে প্যারাবলের ব্যবহার করেছেন। তলস্তয়, বোর্হেস (যদিও জন্ম আর্জেন্টেনা, মৃত্যু জেনেভায়), কাফকা, আলবেয়ার কামু, অরওয়েল প্রমুখ সাহিত্যিকগণ প্যারাবল চর্চা করেছেন এবং বলা যেতে পারে প্যারাবলের পুনর্জন্ম হয়েছে তাদের হাতেই। এরাই ধর্মীয় গ-ি থেকে সাধারণ মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক চিন্তা-চেনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্যারাবল ব্যবহার করেছেন। অবশ্য সক্রেটিস এবং অন্যান্য গ্রিক দার্শনিকেরা আগেই ইহজাগিক প্রেক্ষাপটে প্যারাবলের ব্যবহার করেছেন। লিও তলস্তয়ের গল্প তিনটি প্রশ্ন আধুনিক প্যারাবল সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে।
গল্পটি এ রকম:
“একদিন এক রাজা ভাবলেন, ‘আচ্ছা, যদি আমি জানতাম কোনো কাজ শুরু করার সঠিক সময়টা কখন? যদি জানতাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা কে? আর সর্বোপরি, কোন কাজটা করা সবেচেয়ে বেশি প্রয়োজন? তাহলে আমার রাজ্যচালনার কাজে, সেই সাথে ব্যক্তিগত জীবনে কোনো ভুল হতো না!’
তিনি তাঁর রাজ্যজুড়ে ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, যে তাঁর এই প্রশ্ন তিনটির উত্তর খুঁজে দিতে পারবে তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। রাজ্যের সব জ্ঞানী-প-িত এসে উপস্থিত হলো কিন্তু তাদের সবার কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাওয়া গেলো।
প্রথম প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ বললো, সঠিক কাজ সঠিক সময়ে করার জন্য আগে থেকেই দিন-তারিখের ছক করে কার্যসূচি লিখে রাখতে হবে এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। কেউ আবার বললো, প্রতিটা কাজের সঠিক সময় আগে থেকে জানা কখনোই সম্ভব না। যা করতে হবে তা হলো অলস অবসর না কাটিয়ে সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়া। আর যখন যেটি করা প্রয়োজন সেটি করতে হবে।
এবার কেউ কেউ পরামর্শ দিলো, চোখ কান যতই খোলা রাখা হোক না কেন, তবু একার পক্ষে সবসময় কাজের সঠিক সময় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, তাই জ্ঞানী লোকের পরামর্শ নিতে হবে।
কেউ আবার প্রতিবাদ করে বললো, জীবনে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময় বরাদ্দ থাকে। সেক্ষেত্রে জ্ঞানী লোকের পরামর্শ নেয়ার মতো যথেষ্ট সময় হাতে থাকে না। সুতরাং সব কাজের সঠিক সময় জানতে জ্যোতিষীদের নিকট পরামর্শ চাইতে হবে।
একইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নের জন্যেও ভিন্ন ভিন্ন মতামত আসলো। কেউ বললো রাজার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার পরামর্শদাতারা। কেউ বললো যাজক, কেউ ডাক্তার আবার কেউ বা বললো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ তাঁর সৈন্যদল।
তৃতীয় প্রশ্নের জন্য উত্তর আসলো, বিশ্বব্রহ্মা-ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিজ্ঞান শিক্ষা, কেউ বললো যুদ্ধবিদ্যা শেখা আবার কেউ বললো ধর্মীয় আরাধনা।
রাজা সকলের উত্তরের এই বৈচিত্র্যের কারণে কারও সাথেই একমত হতে পারলেন না এবং কাউকে পুরস্কৃতও করলেন না। তবুও তাঁর প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে সেই আশায় এক সন্ন্যাসীর নিকট যেতে মনস্থির করলেন, যার জ্ঞান ও বুদ্ধির সুনাম রয়েছে রাজ্যজুড়ে।
সেই সন্ন্যাসী বহুদিন যাবৎ এক বনে বাস করতো এবং খুব সাধারণ মানুষ ব্যতীত কেউ সেখানে যেত না। তাই রাজা সাধারণ সাদাসিধে বেশ নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। তাঁর ঘরের অনেক দূরেই ঘোড়া থেকে নামলেন এবং তাঁর দেহরক্ষীদের তাঁর সাথে আসতে মানা করলেন।
রাজা কাছে গিয়ে দেখলেন সন্ন্যাসী তার কুঁড়েঘরের সামনে মাটি খনন করছে। রাজাকে দেখে সে সালাম দিয়ে আবার মাটি কাটতে লাগলো। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছিল, প্রতিবার মাটিতে কোঁদাল দিয়ে আঘাত করার সময় সে ভারী নিঃশ্বাস ফেলছিল।
রাজা বললেন, ‘ হে জ্ঞানী সন্ন্যাসী! আমি তোমার কাছে এসেছি আমার তিনটি প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে। বলতে পারো, আমি কোনো কাজের সঠিক সময়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কী তা কীভাবে জানবো?’
সন্ন্যাসী তাঁর কথা শুনলো কিন্তু কিছুই বললো না। সে মাটি কাটা চালিয়ে গেলো।
রাজা বললেন, ‘ তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। তোমার কোদাল দাও, আমি কিছুক্ষণ কাজ করি’।
সন্ন্যাসী তাঁকে ধন্যবাদ জানালো এবং কোদালটি তাঁর হাতে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। বেশ কিছুক্ষণ কাজ করার পর রাজা থামলেন এবং তাঁর প্রশ্নগুলো আবার করলেন। কিন্তু এবারও সন্ন্যাসী কিছু বললো না। সে কোদাল চেয়ে বললো, ‘ আপনি এবার বিশ্রাম নিন আর আমাকে কাজ করতে দিন।’
কিন্তু রাজা তাকে কোদাল না দিয়ে কাজ করতেই লাগলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেলো। গাছের আড়ালে অস্তায়মান সূর্য উঁকি দিচ্ছিলো। অবশেষে রাজা থামলেন এবং বললেন, ‘ হে জ্ঞানী সন্ন্যাসী! আমি তোমার কাছে এসেছিলাম উত্তরের জন্য। তুমি যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর না জানো তাহলেও বলো, আমি বাড়ি ফিরে যাই’।
সন্ন্যাসী বললো, ‘ কে যেন আসছে! দেখা যাক সে কে!’
রাজা ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন একজন দাড়িওয়ালা লোক তার রক্তাক্ত পেটে দু’হাত চেপে দৌঁড়ে আসছে। লোকটি তাদের কাছে এসেই মাটিতে আছড়ে পড়লো। রাজা ও সন্ন্যাসী তার গায়ের পোশাক খুলে দেয়ার পর তার পেটে এক প্রকা- ক্ষত আবিষ্কার করলেন। রাজা যতটা সম্ভব ভালো করে জায়গাটা পরিষ্কার করে তাঁর নিজের রুমাল ও সন্ন্যাসীর তোয়ালে দিয়ে বেঁধে দিলেন। তাকে পানি পান করালেন।
সন্ধ্যা হয়ে এলে লোকটিকে ঘরে নিয়ে গেলেন। লোকটি কোনো কথা বললো না। রাজা ক্লান্তি বোধ করলেন এবং অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকালে উঠে রাজা নিজে কোথায় তা আবিষ্কার করতে খানিকটা বেগ পেতে হলো। তিনি দেখলেন এক দাঁড়িওয়ালা অচেনা লোক তাঁর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
লোকটি ক্ষীণকণ্ঠে বললো, ‘ আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন।’ রাজা অবাক হয়ে জবাব দিলেন, ‘ আমি আপনাকে চিনি না। আপনাকে ক্ষমা করার মতো কিছু ঘটেও নি।’ লোকটি বললো, ‘ আপনি আমাকে না চিনলেও আমি আপনাকে চিনি। আমি হচ্ছি আপনার সেই শত্রু যে আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কারণ আপনি তার ভাইকে মৃত্যুদ- দিয়েছিলেন এবং তার সম্পত্তি জব্দ করেছিলেন।
আমি জানতাম আপনি সন্ন্যাসীর সাথে একা দেখা করতে এসেছেন, তাই আমি আপনাকে ফেরার পথে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু গতকাল আপনি আর ফিরলেন না। আপনাকে খুঁজতে আড়াল থেকে বের হলাম এবং আপনার দেহরক্ষীদের কবলে পড়লাম। তারা আমাকে চিনতে পেরে আমাকে আক্রমণ করলো। আপনি আমার ক্ষত বেঁধে আমাকে বাঁচালেন। আপনি যদি চান আমি বাকি জীবন আপনার বিশ্বস্থ দাস হতে পারি। আমি আবারও ক্ষমাপ্রার্থী।’
শত্রুর সাথে এতো সহজেই মিটমাট হওয়াতে রাজা খুব আনন্দিত হলেন। তিনি কেবল তাকে ক্ষমাই করলেন না বরং তার সমুদয় সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন এবং তাকে নিজের দাস ও চিকিৎসকদের অংশীদারি দিলেন।
ঘর থেকে বেরিয়ে রাজা আরেকবার তার প্রশ্নগুলোর উত্তর চেয়ে সন্ন্যাসীর খোঁজ করলেন। সন্ন্যাসী ঘরের বাইরেই হাঁটু গেড়ে বীজ বপন করছিলো। রাজা বললেন, ‘ আমি শেষবারের মতো তোমার কাছে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রার্থনা করছি।’
সন্ন্যাসী মুখ ঘুরিয়ে বললো, ‘ উত্তরগুলো তো আপনি ইতোমধ্যে পেয়েই গেছেন।’
রাজা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ উত্তরগুলো পেয়েছি? কীভাবে?’
সন্ন্যাসী বর্ণনা করলো, ‘ লক্ষ্য করুন, আপনি যদি কাল আমাকে মাটি খননে সাহায্য না করে প্রাসাদে ফিওে যেতেন তাহলে ঐ লোক আপনাকে হত্যা করতো। সুতরাং তখন আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল যখন আপনি মাটি খনন করছিলেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলাম আমি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আমাকে মাটি খননে সাহায্য করা। যেহেতু তা আপনার জীবন বাঁচিয়েছে!’
একটু থেমে সন্ন্যাসী আবার বললো, ‘ আবার আপনি যখন লোকটির ক্ষত বেঁধে দিচ্ছিলেন তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল সেটা আর ব্যক্তি ঐ লোক। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তাকে সাহায্য করা, যেহেতু তা না হলে সে বাঁচতো না আর আপনাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠাও হতো না!’
সন্ন্যাসী আবারও একটু বিরতি নিয়ে বললো, ‘ সুতরাং, মনে রাখবেন, আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হলো বর্তমান মুহূর্তটি কারণ শুধুমাত্র এর উপরই আপনার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো যে মানুষটার সাথে আপনি এই মুহূর্তে আছেন কারণ আপনি কখনোই জানেন না সেই মানুষটাই আপনার জীবনের শেষ মুহূর্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছে কিনা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তার জন্য ভালো কিছু করা কেননা এই উদ্দেশ্যেই আমরা এই পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি!’ (উৎস: িি.ি১০সরহঁঃবংপযড়ড়ষ.পড়স)
ফ্রানৎ্স কাফকা আধুনিক প্যারাবল রচয়িতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কাফকার আইনের দরজা একটি বিখ্যাত প্যারাবল। প্যারাবলের সার্বজনতার কথা বলা হয়। এটি সে ধরনের একটি প্যারাবল। এটি অনুবাদ করেছেন তানভীর আকন্দ।
আইনের দরজায় প্রহরী দাঁড়িয়ে। গেঁয়ো এক লোক এসে ভেতরে যাওয়ার আবেদন করলে প্রহরী তাকে বাঁধা দেয় – এই মুহূর্তে ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়। লোকটি কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে জানতে চায়, পরে কোনও এক সময় এলে তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে কি না। “ হতে পারে, কিন্তু এখন নয় ”- প্রহরী উত্তর দেয়।
বরাবরের মত সে সময়ও আইনের দরজা খোলাই ছিল। প্রহরী একপাশে সরে দাঁড়ালে লোকটি ঝুঁকে দরজার ভেতওে দেখতে লাগল। ব্যাপারটা খেয়াল কওে প্রহরী হাসতে লাগল, “ এতই যদি শখ থাকে, আমার কথা না মেনে ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করে দেখতে পার, কিন্তু মনে রেখ আমিও অক্ষম নই। আর কেবল আমিই নই প্রত্যেকটি ঘরের সামনেই প্রহরী রয়েছে, এবং এদের একেকজন অন্যজন থেকে আরও বেশি ক্ষমতাশালী। আমি নিজে এমনকি তৃতীয়জনের একটা পলকও সহ্য করতে পারি না ”।
লোকটি এতসব জটিলতা আশা করে নি: আইনের দরজা সর্বদা সকলের জন্যই খোলা থাকা উচিত – সে ভাবে, কিন্তু লোমশ কোট গায়ে প্রহরীকে যখন সে কাছ থেকে দেখে – তার লম্বা খাড়া নাক, পরিপাটি করে সাজানো, দীর্ঘ ও পাকানো কাল দাঁড়ি, প্রহরীর এমন মূর্তি দেখে সে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রহরী তাকে একটা চেয়ার দেয় বসার জন্য এবং দরজার সামনেই এক পাশে বসার অনুমতি দেয়। সেখানেই সে বসে থাকে দিনের পর দিন বছরের পর বছর। ভেতরে যাবার বহু প্রচেষ্টা চালায়, প্রহরীকে অনুরোধ করতে করতে ক্লান্ত করে তুলে। প্রহরীটি তাকে মাঝে মাঝেই এটা সেটা জিজ্ঞেস করে। তার আবাসস্থল এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায়। এ সবই গতানুগতিক প্রশ্ন, স্বাভাবিক সৌজন্যতামূলক, ভদ্রলোকেরা যেমন করে থাকে কিন্তু লোকটিকে যে তখনও ভেতরে ঢুকতে দিতে সে অপারগ এ কথাটাও বারবার জানিয়ে দিতে থাকে। লোকটি তার ভ্রমণের পাথেয় হিসেবে সাথে করে যা কিছু এনেছিল, এমনকি বহুমূল্যবান সামগ্রীও সে ঘুষ হিসেবে প্রহরীকে দিয়ে দেয় তাকে প্রলুব্ধ করার জন্যে। প্রহরী সে-সবই গ্রহণ করে কিন্তু বরাবারই বলে যায়, “আমি কেবলমাত্র এইসব নিচ্ছি এ জন্যেই যাতে করে তুমি এমনটা না ভাবো যে চেষ্টার কোনও ত্রুটি তুমি করেছিলে ”।
এই এত বছরের মধ্যে লোকটি প্রহরীকে অক্লান্তভাবে পরখ করতে থাকে। সে অন্য প্রহরীদের কথা ভুলেই যায়, এই একজনকেই তার আইনের পথে একমাত্র বাঁধা বলে মনে হয়। সে নিজের দুর্ভাগ্যকে অভিশাপ দিতে থাকে, প্রথম কয়েকবছর রূঢ় এবং উচ্চস্বরেই সে অভিশাপ বর্ষণ করত, ধীরে ধীরে যতই সে বৃদ্ধ হয়ে আসতে থাকে কেবল নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে থাকে, তার মধ্যে পাগলামির লক্ষণ ফুটে ওঠে, এত বছর ধরে প্রহরীকে দেখতে দেখতে এমনকি তার কলারে বসে থাকা মাছিগুলোকেও এখন সে চিনতে পারে, সেই মাছিগুলিকেও সে অনুরোধ কওে প্রহরীর মন গলিয়ে দেওয়ার জন্যে।
অবশেষে তার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতে থাকে, সে ঠিক বুঝতে পারে না চারপাশের পৃথিবীই কি অন্ধকার হয়ে আসছে নাকি তার দৃষ্টিই তার সাথে প্রতারণা শুরু করেছে। এমনকি এই অন্ধতা সত্ত্বেও আইনের প্রবেশপথ হতে বিচ্ছুরিত এক অদম্য আভা সে দেখতে পায়। আর বেশি সময় নেই। মৃত্যুর পূর্বে এত বছরের সমস্ত স্মৃতি তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে জড়ো হতে থাকে, একটি প্রশ্ন সে এখনও জিজ্ঞেস করেনি প্রহরীকে। প্রহরীর উদ্দেশ্যে সে হাত নাড়ে, নিজের এই জড়তাগ্রস্থ শরীর নাড়াতেও সে অক্ষম। প্রহরী লোকটিকে কুঁজো হতে হল, দুইজনের উচ্চতার পার্থক্যই লোকটির অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। “ বড্ডো নাছোড়বান্দা লোক দেখছি তুমি, কী জানতে চাও বল? ”- প্রহরী বলল। লোকটি জিজ্ঞেস করে “ আইনের অধিকার পাবার জন্যে সবাই লড়াই করে, কিন্তু এত এত বছরে আমি ছাড়া আর কাউকেই তো আসতে দেখলাম না এখানে? ” প্রহরী বুঝতে পারল লোকটির অন্তিম অবস্থা সমাগত। লোকটির কানের কাছে সে চিৎকার করে বলল যাতে তার বিকল ইন্দ্রিয়গুলো সেই শব্দ ধরতে পারে, “ আর কেউ কোনও কালেই এখানে প্রবেশের অনুমতি পাবে না, এ তোরণ কেবলমাত্র তোমার জন্যেই তৈরি হয়েছে যা এখন বন্ধ হয়ে যাবে।”
হোর্হে ল্ইুস বোর্হেসের কিংবদন্তী প্যারাবলটি পাঠ করে উপলব্ধি করা যেতে পারে আমাদের জ্ঞাত সত্যেও বাইরেও সত্য রয়ে যায় – প্রশ্ন রয়ে যায়।
হাবিল মারা যাবার পর কাবিলের সাথে সাক্ষাৎ। দ’ুজন একটা মরুভূমির মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দু’জনই অনেক লম্বা হওয়ায় দূর থেকে তারা পরস্পরকে চিনতে পারলো। দু’ভাই মিলে মাটিতে বসলো। আগুন ধরালো তারা। এরপর তারা খাওয়াদাওয়া করলো। গোধূলীলগ্ন শুরু হলে বিষন্ন মানুষ যেমন যা করে তেমনভাবে দু’ভাই নীরবে বসে রইলো। এমন সময় তখন আকাশে একটা তারা মিটমিট করে জ¦লে উঠলো। যদিও তখনো তারাটার নাম দেয়া হয়নি। আগুনের আভায় কাবিল হাবিলের কপালে পাথরের আঘাতের দাগটা দেখতে পেলো। দাগটা দেখে মুখে দিতে যাওয়া রুটি কাবিলের হাত থেকে পড়ে গেল। তাকে ক্ষমা করার জন্য ভাইকে অনুরোধ করলো।
“তুমিই কি আমাকে হত্যা করেছ? নাকি আমি তোমাকে হত্যা করেছি?” হাবিল উত্তরে বললো, “ আমার এখন আর মনে নাই। আমরা দু’জন এখন একসাথে। আগের মতই।”
“এখন বুঝতে পারছি সত্যিই তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ।” কাবিল বলল, “ কারণ ভুলে যাওয়াই ক্ষমা করা। আমিও ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবো।”
“ঠিকই” হাবিল আস্তে উত্তর দিলো, “ যতক্ষণ পর্যন্ত অনুশোচনা আর অপরাধবোধ থাকে।”
মজার ব্যাপার হলো সাহিত্য ও দর্শনের বাইরেও বিষয়বন্তু সহজে উপস্থাপনের জন্য প্যারাবলের ব্যবহার দেখা যায়। অর্থনীতিশাস্ত্রে এ ধরনের বিখ্যাত ভাঙ্গা জানালার প্যারাবল নামে একটি প্যারাবল লিখেছেন ফরাসি অর্থনীতিবিদ ফ্রেদেরিক বাস্তি ১৮৫০ সালে। এটি অনুবাদ করেছেন গৌরাঙ্গ হালদার।
প্যারাবলটি এ রকম:
জেমস গুডফেলো ছিলেন ভালো একজন দোকানদার। তার অমনোযোগী ছেলেটা যখন জানালার কাচ ভেঙ্গে ফেলেছিল, আপনি কখনো তাকে রাগতে দেখেছেন কি? আপনি যদি ওই ধরনের কোনো একটা দৃশ্যের সামনে উপস্থিত থাকেন, প্রত্যেক দর্শকের মতো আপনিও নিশ্চিতভাবে সেই ঘটনার একজন চাক্ষুষ স্বাক্ষী হবেন। এমন কি সেখানে যদি তিরিশ জনও থাকেন, গড়পড়তা সাধারণ সম্মতিতে, সেই হতভাগা দোকান মালিকের প্রতি এই একইরকম শান্তনাবাক্য শোনাবেন, “ ওটা ছিল শয়তানের আছর। ঈশ^র যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সবার বাঁচার হক আছে। এই জানালাটা যদি কখনো না ভাঙ্গতো, তাহলে জানালা মিস্ত্রিরির কী হতো?”
এবার, শান্তনাবাক্যের এই ধরনটির মাঝে একটা সমগ্র তত্ত্ব আছে। তত্ত্বটাকে এই মামুলি ঘটনাটার মাঝেই যুতসইভাবে দেখা যায়। সুখকর না হলেও, আমাদের বেশিরভাগ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, এটা দেখতে একদম সেই রকম।
মনে করুন, ক্ষয়ক্ষতিটা সারিয়ে নিতে ৬ টাকা খরচ হয়। এবং আপনি বলবেন, দুর্ঘটনাটা মিস্ত্রিরির জন্য ৬ টাকার সংস্থান করেছে। মানে, দুর্ঘটনাটা সেই কাজকে ৬ টাকা সমপরিমাণ উৎসাহ দিয়েছে – আমি একে মঞ্জুর করছি; এর বিরুদ্ধে একটি শব্দও আমার বলার নেই; আপনি ঠিকই বুঝেছেন। মিস্ত্রি এলো। তার কাজ করলো। ৬ টাকা মজুুরি নিলো। হাত পরিষ্কার করে খাস দিলে সেই অমনোযোগী বাচ্চাটাকে দোয়া করলো। যা দেখা গেলো এই তার সব।
কিন্তু অন্যদিকে, আপনি যদি উপসংহারে আসেন, জানালা ভাঙ্গা দারুণ একটা কাজ, এটা টাকা সঞ্চালিত হওয়ার কারণ। এবং এই জানালা ভাঙ্গার ফলে, সাধারণভাবে শিল্প কারখানা উদ্দীপনা পাবে, যেহেতু ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। এবার আপনি চিৎকার করে আমাকে বাধ্য করবেন “ ওখানেই থামো! তোমার তত্ত্ব সেখানেই আটকে গেছে যা দেখা গেছে, যা দেখা যায়নি, তোমার তত্ত্বে তার কোনো খতিয়ান নেই।”
এটা দেখা হয়নি যে, যেহেতু আমাদেও দোকানদার একটা জিনিসের জন্য ৬ টাকা খরচ করেছে, সে ওই টাকা আরেকটা জিনিসের জন্য খরচ করতে পারবে না। এটা দেখা হয়নি যে, তাকে যদি জানালা পাল্টাতে না হতো, সে হয়তো তার পুরানো জুতা পাল্টাতো, অথবা তার লাইব্রেরিতে আরেকটা বই যোগ হতো। সংক্ষেপে বললে, কোনো না কোনোভাবে সে এই ৬ টাকা কাজে লাগাতো, যাকে কিনা এই দুর্ঘটনাটা আটকে দিয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্যারাবল চর্চা
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে মৌলিক প্যারাবল চর্চা চোখে পড়ে কম। কবে কাফকা, বোর্হেস, খহলীল জিবরানের প্যারাবলের অনুবাদ হচ্ছে। এটা আশার দিক। বদরুজ্জামান আলমগীর, রোমেল রহমান, রফিক জিবরান এরা মৌলিক প্যারাবল রচনা করছেন। রোমেল রহমানের গ্রন্থ মহামারি দিনের প্যারাবল । বদরুজ্জামান আলমগীরের হৃদপেয়ারার সুবাস একটা এক্সপেরিমেন্টাল প্যারাবলের বই। তার একটি প্যারাবল এখানে দেয়া হলো:
মৈজুদ্দিন ও আজরাইল ফেরেশতা
মৈজুদ্দিন দৌড়ের উপর থাকে, যেমন আঙ্গুলের উপরে নখ, তেঁতুল গাছের মগডালে ভূত, নর্তকীর চোখের সামনে ইশারা, সাপের মাথার ফণার শীর্ষে মনি, তেমনি ডুক্কুডুক্কু মনগুড়া – মৈজুদ্দিনের জন্মকর্ম জোয়ারভাটা সবকিছুর ঊর্ধ্বে সত্য-দৌড়।
রীতিমত চার চারটা গ্রামের বড়, মাঝারি গৃহস্থ বাড়ির কর্তা, বৌঝিদের ফুটফরমাশ সবই মৈজুদ্দিনকে সামলাতে হয়; অমুকের বাড়ির নাকউঁচা মেয়েটির বিয়ে হয়েছে-সাত গেরাম পরে বরের বাড়িতে পিঠা নিয়ে যেতে হবে, ১০৩ বছরের বুড়ি হাঁটতে পারে না, মৈজুদ্দিনকে হাঁকাও সে বুড়িকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, নসরুল্লাহ মিয়ারর দক্ষিণী পালানে যে ধান কাটার জন্য এতোগুলি মুনিষ নামানো হয়েছে তাদের দুপুরের খাবার নিয়ে মাঠে যাবে কে- আবার জিগায়- মৈজুদ্দিন! শারমিন ঢেকুর দিয়ে বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠেছে- তার যে এখন অন্তর্বাস লাগবে শারমিনের মা ওই চার গ্রামে কাকে নির্ভয়ে বিশ্বাস করে হাট থেকে অন্তর্বাস আনার জন্য বলতে পারে- ওই আবারো মৈজুদ্দিন!
এই সে মৈজুদ্দিন – তার এমনতো কখনো হয় না- তিনসন্ধ্যার মুখে দৌড়ের মধ্যেই আজ কৈলাগ গোরস্থানের কাছে নারকেল গাছের গোড়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গোত্তা খেয়ে বসে পড়ে! চিরদিনের স্বভাবে মৈজুদ্দিন মোচড় দিয়ে জেগে উঠে যেইনা আবার দ্রুত হাঁটতে শুরু করবে তখনই সে পাভাঙা কুকুরের মতো কেমন লেঙচিয়ে ওঠে, আর মনে হয় তার শরীরে কে যেন পেরেক ঠুকে দিয়েছে!
তাজ্জব ব্যাপার, এখনো তার কতো জায়গার কাজ সামলানো বাকি!
কেডায় তুমি, আমার উপর হামলাইয়া পড়ো, পথ ছাড়ো!
আমি আজরাইল!
আজরাইল হও, আর সাদ্দাম হোসেন হও- এখন ভাগো। পরে আইসো। কত মানুষের কতো কাম আমার হাতে পইড়া আছে, অহন ফুটো, পরে আইসো।
আমি জান বিনাশ করি।
মঙ্গলবারের আগে আমার সময় হইবো না, এহন সরো মিয়া!
আমি আজরাইল, আমি সরি না। আজই তোমার খেলা শেষ।
আমারে একটু সময় দেওন যায় না! এক দৌড়ে যামু, এক দৌড়ে আসুম। আগামী মঙ্গলবার ঠিক এইখানে, কথা দিই।
মানুষ সারাজীবনের লাগি চইলা গেলে তার আত্মীয় স্বজনরা কান্নাকাটি করে। আমি পুরাজনম এমন দৌড়ের উপর ছিলাম যে সয়সন্তান কিচ্ছু লইবার পারি নাই।
একটু সময় দেও ভাই, দেখি, নিজের লাগি নিজেই একফোঁটা চোখের পানি ফেলতে যদি পারি!
বর্তমান সময়ে প্যারাবল চর্চার প্রাসঙ্গিকতা
প্রথমত সাহিত্যের কোন শাখায় কে লিখবে তা একেবারেই সাহিত্যিকের মর্জির উপর নির্ভর করে। একজন সাহিত্যিক তার সাহিত্যকর্ম যে ফর্মে প্রকাশ করে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চান সেই ফর্মই তিনি ব্যবহার করবেন। শিল্পের জন্য শিল্প রচনায় যারা বিশ^াসী তারা এ ফর্মটি ব্যবহার করতে পারেন।
আধুনিক যুগ টেকনোলজির যুগ। অনেকেরই পাতার পর পাতা পড়ার এখন আর সুযোগ ও ধৈর্য নাই। ফলে এই সংক্ষিপ্ত ফর্মটি ব্যবহার করে সহজে পাঠকের কাছে পৌঁছানো যেতে পারে।
বর্তমান সময়ে কর্পোরেট ও পূঁজির দৌরাত্মে নীতি নৈতিকতা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। এক্ষেত্রে, প্যারাবল একটা সাহিত্য মাধ্যম হতে পারে। অন্যদিকে তৃতীয় বিশে^র বিভিন্ন দেশে সরকার নানা ধরনের গুম, খুন, ভয়ভীতি দেখিয়ে মানুষের কথা বলার স¦াধীনতা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রকম জুলুমবাজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে প্যারাবল ভূমিকা রাখতে পারে।
প্যারাবল হলো একটি দেশের লোকজ জ্ঞান ও তা চর্চার একটা মাধ্যম। ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়’ কিংবা ‘ এসব দেখি কানার হাটবাজার’ এই ধরনের দার্শনিকতা আর তার উত্তর খোঁজা হতে পারে বাংলা প্যারাবলের উদ্দেশ্য। যা একান্ত নিজস্ব, একান্ত আপন। নিদাঘ চৈত্রে খেতে কাজের ফাঁকে বাবলাগাছের তলায় একটু জিরোতে জিরোতে কৃষকের মনে একান্তে যে প্রশ্নগুলো জমা হয় তার উত্তর হতে পারে বাংলা প্যারাবল। দূর থেকে কলস কাখে করে যে নারী গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাওয়া না পাওয়ার যে হিসেব বোনে তা হতে পারে বাংলা প্যারাবল। ‘দূরে কোথায় দূরে —- মন বেড়ায় যে ঘুরে’ এর ভাবালুতা আর ‘জীবনের সব লেনদেন’ এর উত্তর হতে পারে বাংলা প্যারাবল।
তথ্য সহায়ক: