কবিতায় বিষয় ও শব্দের বহুমাত্রিকতা
কামরুল ফারুকী
[এক]
শস্য,রক্ত ও ঘাম–এ তিন থেকে শিল্প যত দূরে সরে তত তা কৃত্রিম হয়। টানা তার বাদ্যযন্ত্রের দুইপ্রান্তে বাঁধা থাকে বলেই তারগুলোর মাঝবরাবর আঘাত করলে নানা সুর পাওয়া যায়। সৃষ্টিশীল মানুষের চেতনাও এরকম একদিকে অতীত ও অন্যদিকে ভবিষ্যতে বিস্তৃত থাকে,ফলে মধ্যবর্তী বর্তমানের আঘাতে তার চেতনায় নানা শৈল্পিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শিল্পী হতে গেলে তাই ইতিহাস বিষয়ে যেমন সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা জরুরি,তেমনি প্রাজ্ঞ দৃষ্টি থাকা জরুরি দূর ভবিষ্যতের দিকেও। সেইসাথে জরুরি বর্তমানের আঘাতে প্রতিক্রিয়া দেয় এমন সংবেদী এক হৃদয়।কুণ্ডলী পাকানো তার বহু মূল্যবান হলেও তা ন্যূনতম সুর সৃষ্টি করতে পারে না।
জীবন সংগ্রামের অংশ হিসেবে শিল্প-সাহিত্যের জন্ম। প্রাচীনকালের মানুষেরা তাদের ট্যাবু বিশ্বাস থেকে গুহার দেয়ালে শিকারের ছবি এঁকে,ফসল বুনে ও বৃষ্টির প্রত্যাশায় নেচে-গেয়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে চাইত।তারা ভাবত তাদের এই নাচকে নকল করে ফসলও দোলতে দোলতে বেড়ে উঠবে,বৃষ্টিও অনুসরণ করবে একই পথ। ঠিক তেমনি গুহায় আঁকা ছবির মত বাস্তবেও একইভাবে তীরবিদ্ধ হবে হৃষ্টপুষ্ট হরিণ।
আধুনিক যুগে শিল্প-সাহিত্য জীবন বাস্তবতার সাথে সাথে ব্যক্তি কল্পনাকেও স্থান দিয়েছে,ফলে তার পরিসর বেড়েছে। তবে এই যে কল্পনা,তারও একটা শৃঙ্খলা আছে।জীবন থেকেই তা উদ্ভূত অথবা জীবনের দিকে ধাবিত,কোন কষ্টকল্পনা বা জগাখিচুড়ি নয়।
জীবন থেকে রস না পাওয়া ভারসাম্যহীন শিল্পকর্ম নান্দনিক হলেও তা সময়ের উত্তম আবর্জনা হিসেবে বিবেচিত হয়। জীবন যাকে কবি করেনি,কবিতা তাকে কবি করবে না।
যেহেতু ভাষাই কবিতার মূল উপাদান তাই ভাষার ধারাবাহিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার উপর তার প্রতিষ্ঠা অনেকটা নির্ভর করে। যে কোন ভাষার যখন কথ্য ও লিখিত রূপে মুখ্য পরিবর্তন হয়,পরিবর্তীত নতুন আঙ্গিকে দক্ষ হতে সে সময়ের শিল্পীদের যেমন বেগ পেতে হয়,তেমনি তারা কিছু বাড়তি সুবিধাও তখন পেয়ে থাকেন। নতুন জমিতে অল্প নিড়ানিতেই ফলন যেমন ভাল হয়,নতুন ভাষায় শিল্পীদের শব্দ ব্যবহার অল্পতেই পাঠকের মনে অনেক বেশি ব্যঞ্জনা তৈরি করে।
রবীন্দ্র-নজরুলের পর চলিত ভাষা প্রয়োগ ও শব্দ ব্যবহারে শহুরে জীবনের যে ছাপ পড়ে,তিরিশের কবিরা যার সার্থক অগ্রদূত–সেই ভাষাটাই এখনও কবিতায় প্রধান ভূমিকা পালন করছে।কয়েক দশকের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ব্যবহারের ফলে এখন তার অনেক টুলস পাঠকের মনে অভ্যস্ততা তৈরি করে ফেলেছে।
এই সময়ের কবিদের জন্য তাই ভাষায় নান্দনিকতা সৃষ্টি এক বাড়তি চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। ‘বর্ষা’ শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে প্রথমেই ভাবতে হচ্ছে রাবিন্দ্রীক টোনটা কীভাবে এই শব্দ থেকে দূর করা যায়। ‘হেমন্ত’,’সন্ধ্যা’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারে কড়া সতর্ক থাকতে হচ্ছে জীবনানন্দীয় মেজাজ এড়িয়ে যেতে। এখনতো কবিরা চাঁদ-তারা,গোলাপ-জুঁই ইত্যাদি শব্দের পাশ দিয়েও হাঁটতে চান না! এমন আরও অনেক বিষয় আছে যেখানে ভাষায় এত সতর্ক থাকতে গিয়ে কবিতা অনেকাংশেই হচ্ছে নীরস ও কৃত্রিম,আবার অনেকের হাতে কাব্যভাষা পাচ্ছে নতুন মাত্রা।
শব্দকে নিরপেক্ষ করতে,পিটিয়ে নতুন চেহারা দিতে আর প্রায় শতাব্দীকাল ব্যবহারের চিহ্ন মুছে তাকে নিজের মত করে উপস্থাপন করতেই কবিদের এখন সবচেয়ে বেশি শক্তি ক্ষয় হচ্ছে।বাক্যে শব্দের কম্বিনেসন এমনভাবে করতে হচ্ছে যাতে তা থেকে নতুন কোন টোন পাওয়া যায়। শুধু জীবন-চেতনা নয়,আমি মনে করি ভাষায় নতুনত্ব সৃষ্টির এই চেষ্টাও শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতায় বিষয়ে এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হওয়ার অন্যতম কারণ।
আবার কবিতার এই বহুমাত্রিকতার সুযোগ নিয়ে অনেক অর্বাচীন টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন চিন্তা ও শব্দের পালিশ করা অবয়বকে কবিতা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছে। আশার কথা হল সব কবিতার ভেতরেই এমন কিছু থাকে যাতে বিদগ্ধ পাঠক প্রকৃত কবি ও অর্বাচীনকে চিনে নিতে পারে। কাগজের ফুল আর বনের ফুল চিনতে মানুষ এখনও সক্ষম।
[দুই]
কবিতাকে নতুন রূপ দিতে গিয়ে,উপাদানে ভিন্নতা আনতে গিয়ে ইদানীং শব্দ ও চিত্রকল্পের ব্যবহারে প্রচুর পাশ্চাত্যমুখীতা দেখা যায়। লাইনে লাইনে ইউরোপীয় মিথের চরিত্র ঢুকিয়ে দিলেই কবিতা আধুনিক হয় না। আবার কথার ফাঁকে-ফাঁকে রোদ-বৃষ্টি ঢুকিয়ে দিলেই তা অনুভূতিপ্রবণ হয় না। সকল উপস্থাপনের একটা সঙ্গতিপূর্ণ কাঠামো থাকা চাই। চিত্রকল্পের তালিকাই কবিতা নয়,তাদের সমন্বয়ে সৃষ্ট আলোড়নই কবিতা।
হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের সহাবস্থানই পানি নয়। যখন তারা উপযুক্ত পরিবেশে ক্রিয়া-বিক্রিয়া সম্পন্ন করে পানের উপযুক্ত হয়,তখনই তা পানি। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন থেকে যা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।যা উপস্থাপন করা হয়েছে,তাকে অতিক্রম করতে না পারলে তা কবিতা নয়।
বাংলা কবিতায় বাঁকবদলের ইতিহাস সুদীর্ঘ নয়। কবিতায় মধ্যযুগের ঈশ্বরবন্দনা,গতানুগতিক প্রেম উপাখ্যান,মাইকেলের বীর্যবান শব্দসম্ভার,ঈশ্বর গুপ্তের মৃদু আধুনিকায়ন,বিহারীলালের আধুনিক গীতি কবিতার পথনির্মাণ ইত্যাদি বর্ণীল দ্বীপ ও নদী-নালার পর রবীন্দ্রনাথ এক সমুদ্রতুল্য শক্তির আবির্ভাব। তার জন্য প্রস্তুতই ছিল না বাংলা কবিতা।সরু পথে যেতে যেতে এ এক বিরাট বিস্ফোরণ।ফলে তার ভাবময়তার অসীম বিস্তারে তন্ময় হয়ে যায় চারদিক।ভাবের কথা বলতে গেলেই তখন দেখা যেত তা রবীন্দ্রনাথে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মূলত তিনি ভাবের এত বিস্তৃত পথে হেঁটেছিলেন যে সেই সময়ে তার বাইরে গিয়ে চিন্তা করার মত শক্তি সমাজে ছিল না।
তিরিশের কবিরা কবিতায় নতুনত্ব আনতে গিয়ে পড়েন এই বিপাকে। তাই তারা যা কিছু রাবিন্দ্রীক সবই নিষিদ্ধ করেন তাদের লেখায়। প্রকৃতি ও জীবনের শুভবিশ্বাসের পরিবর্তে তাদের অবলম্বন হয় অবিশ্বাস, হতাশা ও ক্লান্তি। কিছুটা আধুনিক শিক্ষা,কিছুটা সংকল্প আর কিছুটা পাশ্চ্যাত্য মানসিকতা তাদের এই পথে সহায় হয়। তার আগে তাদের জন্য রবীন্দ্রবলয় থেকে বের হয়ে আসা সহজ করে দিয়ে যান নজরুল। বুদ্ধদেব বসু নিজেই তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে তার উল্লেখ করেছেন। নজরুলই প্রথম রবীন্দ্রনাথের গীতল ভাষাভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে তার প্রস্তরধর্মী ভাষাভঙ্গি নির্মাণ করেন। ভাবের দিক থেকে নতুনত্ব না আনলেও কবিতায় তিনি নতুন রক্ত সঞ্চালন করলেন। তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বাংলা কবিতার বাঁকবদলের অন্যতম নিয়ামক। এই এক কবিতাই রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বাঁকবদলের প্রথম স্টেশন।
[তিন]
সরাসরি মুখের ভাষাভঙ্গি প্রয়োগ আর বিস্তৃতভাবে সাহিত্যে সম্ভব নয়। স্বদেশি বা বিদেশি যে বাহনে চড়েই আসি,যতটুকু পথ এসেছি তাকে অস্বীকার করে আর পেছনে ফিরে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। যাইতাছে,খাইতাছে,মারতাছে, ধরতাছে ইত্যাদি কথ্যভাষার ক্রিয়াপদগুলো কাহিনী ও বিষয়ের প্রয়োজনে সীমিত ব্যবহার করা গেলেও,সামগ্রিকভাবে এসবের ব্যবহার আর নতুন কোন ব্যঞ্জনা দেবে না। আমরা বরং কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষা থেকে বিশেষ্য,বিশেষণ ও সমার্থক শব্দ নিয়ে লেখাকে অধিক বাস্তবমুখী ও নান্দনিক করে তুলতে পারি।সেইসাথে বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষার কিছু টোন ব্যবহার করা যেতে পারে লেখায়।
চন্দ্রকুমার দে’র মত পথে-ঘাটে,অলিতে-গলিতে ঘুরেই শব্দ আহরণের এই কাজ করতে হবে। অভিধান তাতে কিছু সহায়তা করতে পারে, কিন্তু শব্দের উপযুক্ত প্রয়োগ বুঝতে যেতে হবে সেই মানুষের কাছেই। গত ৭০-৮০ বছরে ভাষায় যে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ও শব্দের যে গ্রহণ-বর্জন হয়েছে,তা উপলব্ধি করেই সাহিত্যে বাঁক বদল সম্ভব। অযথা ধোঁয়াশা সৃষ্টি,ইংরেজি ব্যবহারিক ও প্রযুক্তিগত শব্দের অতিপ্রয়োগ এ ক্ষেত্রে কোন সমাধান নয়।সামাজিক পরিবর্তন ও তার প্রভাবই সাহিত্যে পরিবর্তন আনে,চিরকাল এভাবেই সাহিত্যে নতুন যুগ এসেছে। তাই গত ৭০-৮০ বছরে ভাষা,চিন্তা ও মূল্যবোধে সমাজে কী কী পরিবর্তন এসেছে তা বুঝেই সাহিত্যে নতুন কিছু করা সম্ভব। অফিসঘরের বদ্ধ হাওয়া ও পুনরাবৃত্তিমূলক একঘেয়ে জীবন থেকে একটু দূরে সরে না গেলে,পরিবর্তনের এ দৃশ্য চোখে পড়বে না,সাহিত্য অবিরতভাবে শুধু কূটকল্পনা ও নান্দনিক শিল্পজটার সমষ্টিই হবে। বিচিত্র জীবন ও ঘনিষ্ঠ ভাষা যার নেই,গন্তব্যমুখী সাহিত্যও তার নেই।
অনিবার্য শব্দ প্রয়োগ কবিতায় এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। চাইলেই এই অনিবার্য শব্দ প্রয়োগ করা যায় না,ধ্যান করেও মাঝে মাঝে তাকে পাওয়া যায় না। অনিবার্য শব্দ বিশেষ কোন নতুন শব্দ নয়,একটি নির্দিষ্ট ভাব নির্দিষ্ট ব্যঞ্জনায় প্রকাশের সবচেয়ে উপযুক্ত বাহন। কোন একটা ভাব যখন মনে উথলে ওঠে,তখন আপনা আপনিই সেই ভাব তার অনিবার্য শব্দে আরোহন করে কবির হৃদয়ে আসে।তখন তাকে ঘষামাজা করে শুধু আরেকটু উজ্জ্বলতা দিতে হয়।
অনিবার্য শব্দ প্রয়োগ সহজেই নির্দেশ করে কবিতা সৃষ্টির সময় কবির কী অনুভূতি কাজ করছিল মনে। তখন সহজেই কবির অনুভূতির কাছাকাছি হতে পারে পাঠক।যেমন—
“আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।”
কবিতাটি পড়লেই কবির সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাতা মুখটি ভেসে ওঠে মনের কোণে,অযথা কোন কষ্ট-কল্পনা আর করতে হয় না। পাঠক সহজেই গ্রহণ করতে পারে এই সৃষ্টি সুখের রঙ,তার রঙে নিজেও হতে পারে সমান রঙিন।
আরও অজস্র উদাহরণ দেয়া যাবে এ ব্যাপারে। পক্ষান্তরে কষ্ট-কল্পনা আর কবির বোধ থেকে আলো না পাওয়া কবিতা শব্দের অনিবার্য প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত।প্রথম পাঠেই তাকে চেনা যায়।
বাংলা কবিতার অন্তর্মুখী স্বভাব বহুদিনের। সেই বিহারীলাল থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ,জীবনানন্দে তা পরিপূর্ণ বিস্তৃত।মাঝে রাজনৈতিক নানা আন্দোলনে ও জীবন সংঘাতের প্রভাবে কবিতা উচ্চকন্ঠ হলেও এখন তা আবার পর্যবসিত হয়েছে নান্দনিক অন্তর্মুখীতায়। বাইরের জগতের সাথে বিচ্ছিন্নতা আর কল্পনা প্রবণতা যে বাঙালীর চিরকালের সঞ্চয়,তার কবিতায় এই আত্মমুখরতাকে অস্বাভাবিক বলার উপায় নেই। তবে আত্মমুখরতাকেও নৈর্ব্যক্তিক ভাব দেয়ার আকাঙ্ক্ষা এই সময়ের কবিদের এক সাধারণ চরিত্র,যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের চেয়ে শব্দ ও সূক্ষ্ণ নির্মাণ কৌশল বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কবিতায় শব্দ ও শব্দ সমবায়ের সাধনা একটা নতুন শাখা হিসেবে ঠিক আছে। কথা হল সব কবিই একসাথে কেন চিন্তাহীন এই নতুনত্বের দিকে ঝাপ দিলেন? একজন কবি চোখ-কান বন্ধ রেখে তার সমস্ত সাধনাকে এখানেই কেন নিয়োজিত করলেন?চিন্তাহীন,চারপাশের জীবন ও সময়ের ইঙ্গিতহীন এসব লেখা আদতে বড় কোন শিল্পমূল্য রাখে না। সাহিত্যের এক নান্দনিক অঞ্চল হিসেবে তার মূল্য আছে, সাফল্যও আছে,এর বেশি কিছু নয়।
কবিতায় শব্দের সাধনা একটি ভাল ব্যাপার।বোধের ব্যাপ্তি আছে এমন ক্ষেত্রে,কখনও কখনও দুই-একটি নান্দনিক শব্দ বিশ পঙক্তির একটি কবিতায় সর্বত্র আলো ছড়াতে বা আলো-আঁধারের কোলাজ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
তবে অহেতুক শব্দের সাধনা একটি অশিল্পীত ব্যাপার। বোধের ব্যাপ্তি নেই এমন কবিতায় শব্দের অতি সাধনা সময় ও জীবনের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। রক্তে আগুন বা বিষ কোনটাই না থাকলে কবিতা এত নান্দনিকনির্ভর গুনগুনময় হতে পারে।
[চার]
কবিতায় একটা বিষয় খুব লক্ষ্য করছি। একটা মায়া মায়া ভাব,নদীতে ছায়া পড়ছে,সন্ধ্যায় আলো-আঁধারে ভরে যাচ্ছে,দূরে কিছু একটা ঝরে পড়ছে–এইসব আবছা আবছা নানা চিত্রকল্প।আপনি এসবকে অকবিতা বলার সাহস দেখাতে পারবেন না। খুব চালাক এর লেখকগণ!
এই কাতারে এই সময়ের অনেক নামকরা কবিরাও আছেন। তারা বোঝেন বিষয়টা,তবে যেহেতু খাচ্ছে সবাই,কেউ কিছু বলছে না–তাই চোখ বুজে তারাও অল্প শ্রমের,শূন্য চিন্তার এসব চিটা ছড়াচ্ছেন চারপাশে। ভাষা ও শব্দের নান্দনিকতা সরাসরি বুঝতে দিচ্ছে না এই অন্তঃসারশূন্যতা।
কবিতা কবিতা আবহে ভরা এসব উপরি-চালাকি কবিতায় না আছে কবিতার কোন মর্ম,না আছে কবিতার কোন বিশেষ অনুরণ। কিন্তু আপনি এসবকে অকবিতা বলার সাহস দেখাতে পারছেন না। কেন? এসবতো কবিতার আয়োজন মাত্র,বর-,কনে ছাড়া বিয়ের উৎসবের মত। শুধু কারিগরীর উৎকৃষ্টতা কবিতা হতে পারে না। জিলাপির শরীরে এত যে কারুকাজ,তবু তো কারিগর রস রাখতে ভোলেন নাই। কারণ তিনি জানেন রসের জন্যই ভোক্তা তার কাছে আসে,প্যাচানো বিন্যাসটা সেই রসের সহায়ক মাত্র।
বর্তমানকালের কবিতা নিয়ে প্রধান অভিযোগ এই যে,তা সমাজ বিচ্ছিন্ন। শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা তিরিশের কবিতার উত্তরসুরী। তবে তিরিশের কবিতা থেকে তা কতটুকু অগ্রগামী তা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ। তিরিশের কবিরা মূলত লিখেছেন আধুনিক নগর মানুষের যাপন ও প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা। কখনও তাদের কবিতায় ক্ষীণ স্বরে দেখা গেছে বিপ্লবের সুর। উত্তরাধুনিকতা নামধারী শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা সেই অর্থে কোন বিশ্বাস বা আদর্শে বিশ্বাসী নয়। তা একধরনের আধ্যাত্মবাদী কিন্তু এটা ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার মত নয়,জীবন ও জগত বিষয়ে এক ধরনের উন্নাসিক ভাব। উত্তরাধুনিক কবিতা তাই শব্দ সম্ভার ও নান্দনিকতার দিকে বেশি ঝুঁকে গেছে। তবে কেন যেন আমার মনে হয় তিরিশের কবিতার বিস্তীর্ণ পথের চেয়ে তা ক্রমশ ক্ষীণ ও সরু এক পথে হেঁটে চলেছে,বিস্তীর্ণ জীবনের গন্ধ ও আবেগ যেখানে উপেক্ষিত। একদল কবি মিলে একই সুর ও স্বরের কবিতা নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখে চলছে। যেখানে ব্যক্তিগতভাবে তাদের চেনা যায় না,পাওয়া যায় শুধু দলগত পরিচয়। প্রতিভার পরিচয় থাকলেও তা গন্তব্যহীন,সময়ের অনুরণনহীন ও চাতুর্যময়।
[পাঁচ]
যথার্থ ও প্রকৃতিপুষ্ট কবিদের কবিতায় কবির আমির মধ্যে পাঠকের আমিত্ব গ্রহণের এক সুযোগ থাকে। কবি যে ইচ্ছে করে পাঠকের জন্য এই আসন সংরক্ষণ করেন তা নয়,উপলব্ধি থেকে নিঙড়ানো বোধে অন্য মানুষের বোধ এমনিতেই প্রশ্রয় পায়। এই যে জীবনানন্দের কবিতায় এত পরাবাস্তব অনুভূতি,তা কিন্তু বাস্তবকে আরও বেশি ঘনীভূত করে তোলে। বাস্তব থেকে দৃষ্টি ও কল্পনা এক সমান্তরাল দূরত্বে নিয়ে গিয়ে তা বাস্তবকেই বরং উদ্ভাসিত করে তোলে। তো এই ব্যাপারটি কৃত্রিম ধরনের লেখায় থাকে না,তাতে অনেক চকমকি পাথর থাকে,দক্ষতা থাকে,শ্রমের চিহ্ন থাকে কিন্তু পাঠকের আমিত্বকে কোথায় যেন তা বঞ্চিত করে। কারণ সৃষ্টির সময় থেকেই কবিতাটি এক নিবিড় পরীক্ষাগারে নির্মিত হয়েছে,ফলে আমাদের গৃহস্থালি,আমাদের অভিজ্ঞতা কিছুই সেখানে প্রতিফলিত হয়নি। পরীক্ষাগারে নানা উপায় বা উপকরণের গবেষণা হতে পারে কিন্তু সেই গবেষণাপ্রাপ্ত উপকরণকে ল্যাবরেটরী থেকে বের করে এনে বাইরের জীবনের সাথে সম্পর্কিত করতে না পারা এত শ্রম শেষেও এক বিরাট ব্যর্থতা। বিশেষ করে এই ব্যাপারটির জন্য শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা কবিতার চেয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শব্দের কৃত্রিম এক নন্দন কাননে পরিণত হয়েছে। ব্যতিক্রম যদিও আছে,তবে খুব কম।ইতিহাস বলে,বড় শক্তি লক্ষ্যকে গ্রহণ করে আর মাঝারি শক্তি শুধু উপায়কে নিয়ে উপায়ের রঙ্গমঞ্চ সাজায়।
মৌমাছি তার চাকের জন্য প্রশংসার যোগ্য কিন্তু তাতে মধু আছে বলেই সে বিখ্যাত। মৌমাছির এই বিশ্বব্যাপী প্রশংসায় অনুপ্রাণিত হয়ে বোলতা যদি আরও সূক্ষ্ম ও নিপুণ চাক নির্মাণে নিজেকে নিয়োজিত করে তবুও সে বোলতাই থেকে যায়। কবিতা বোধে না জন্মে ভাষায় জন্মালে অধিকাংশ সময় তা ভাষার দোকান হয়। মূলত কবিতা নিজেই বলে দেয় তার জন্মের ইতিহাস,বলে দেয় তার অন্তঃসারকে কবি কতটুকু গভীরভাবে বা অগভীরভাবে ধারণ করেছেন। চিন্তা বা বোধ–এর যে কোন একটিকে উসকে না দিলে কবিতা শুধু শব্দের ম্যাজিকই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। উপমা ও চিত্রকল্প প্রসাধনীর মতো ব্যবহৃত হলে,যত গাঢ়,মিহি ও সুগন্ধী হোক না কেন,কবিতার সাথে তার বিচ্ছিন্নতা ঠিকই টের পাওয়া যায়। উপমা ও চিত্রকল্প নির্মাণে দক্ষতাই নয়,কবিতার মূল চেতনার সাথে তাকে এক করতে পারাই কবিত্ব।
শরতের আকাশে ভাসমান মেঘের মত স্বাভাবিকতা কবিতায় জরুরি– যেখানে মেঘ ও নীল কেউ কাউকে অতিক্রম করে না বরং পরস্পরকে উদ্ভাসিত করে। স্বাভাবিক কবিপ্রতিভা নিয়ে যিনি জন্মেছেন তিনি তার কবিতাকে কখনও নান্দনিক মেঘ দিয়ে এত ভারী করে তোলবেন না যাতে আকাশের নীল অদৃশ্য হয়ে যায়। ভ্রমণ যেখানে অল্প সেখানে কোমড় দুলিয়ে না হাঁটলে দর্শকের মনোরঞ্জন হয় না। বাংলা সাহিত্যে তাই বিস্তীর্ণ জীবনাভিজ্ঞতার প্রতি মনোযোগী চটি স্যাণ্ডেলে হাটা দূরগামী পথিক চাই।হাই হিলে হাটা তরুণীকে দেখেই বুঝা যায় সে বেশি দূর যাবে না।
=============