শাশ্বত বোসের কবিতা
সমর শেষের অসিয়ৎনামা
ধূসর ধুলোতে প্রান্তরে, স্বপ্ন ভাসে পূরবী রাগে বোনা ঘুড়ির মত |
শত কবিরের দোঁহায় লেগে থাকে রক্তের দাগ, কালো ছাপ,
যন্ত্রনার ইতিহাসে,
অনসূয়া কাব্য আর উলঙ্গ ভারতবর্ষ এঁকে দেয় ভোট ছাপ,
অদুগ্ধ আপীনে ফুটে ওঠে নিনরণী ক্ষত |
আমার আস্যে তিতিক্ষা লিখে যায় উষর উর্বিধরের নোনাস্রাব,
অনামিকায় ইস্তেহারি আঁশে ||
আমার কলম আঁচড়ায় আধ্যাত্মিক শব্দের খোঁজ,
আমায় চমকে দিয়ে ডেকে ওঠে উন্নিদ্র ৭১ এর রাত |
আমার লেখনীর ডগায় ভিড় করে চোল, ভিল, মুন্ডারা,
মিছিলে হাঁটে মেহেদী হাসান, মান্টো, গালিবের দল,
কাশ্মীরি পণ্ডিত ও ইউক্রেনিয়ান তরুণী, উদ্বায়ী প্রেমের
নোনা শ্রমে ব্যারিকেড ভাঙে, রাখে ঠোঁটে ঠোঁট, হাতে হাত |
৪৭ এর দাঙ্গায় জ্বলে যাওয়া দলিল বেঁচে ওঠে গোধরায়, ফলস
এনকাউন্টার সাইরেন দামামা বাজায়, গেরিলা ছন্দে গর্জে
ওঠে কাস্তে, টাঙ্গি, বল্লম আর দিগম্বরী ছায়ালোকে ভেসে যায়
তেভাগার ফসল ||
আমার সুরার গ্লাসে মেশে আফ্রিকান উপজাতির শিশ্নাগ্রের
তীব্র বিষ, উর্ণনাভের ধমনী বেয়ে বয়ে চলা উদিত স্বেদ লেগে থাকে |
কবিতার ছন্দহীনতায় কিংবা বানান ভুলে ঠেসে ধরে,
আফগানিস্তানে বোমার আঘাতে ধ্বস্ত “ইকা নাগিবা” র শব,
ফুটপাতের বৃক্ষ ছেদন কেড়েছে মৌটুসী, ফিঙে, বুলবুলির নিশ্চিন্ত
আশ্রয়, তবু স্বপ্ন মেশে সায়ানাইট অমৃতেরই বাঁকে|
শিখ দাঙ্গায় জ্বলন্ত চিতা আর খানসেনার হাতে ধর্ষিতা রমণীর
গর্ভে যুদ্ধে র পারিজাত তোলে অত্যয়ী নিষ্কল রব ||
ভিয়েতনামের বিপ্লবী উমেদ মুছে যায় সদ্যঃপাতি চৈনিক আগ্রাসনে |
জমির পর জমি দখল, সীমান্তে শুয়ে থাকে, বরফ ঢাকা ভারতীয়
জওয়ানের লাশ,
আমার পাকস্থলী, ফুসফুস ঢেকে যায় নাগরিক মিছিলের উন্মত্ত
জনতার রোষে, নিযুত বিপ্লব জমা হয় বিবস্ত্র ভিখারিনীর উরোজে ও আপীনে |
নন্দীগ্রাম কিংবা বগটুই এর “মা” জ্বলন্ত শরীরে ধরা দেয়, রাজনীতির
শিমূল শিউলির যোনিদেশে, বিটপীর সঘন লেহনে ভিজে যায় চারিপাশ ||
আমার দেশে চৈতি চাঁদের জ্যোৎস্নায় গুলমার্গ খেলা করে,
এলাহী ঈদ রমজানী সংযমে দাঁড়ি টানে |
ফজরের নামাজ সুন্নতী নেক্সাস বয়ে আনে, ভাষার বদ্বীপ রচিত হয়
দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদী তত্ত্বে,
তবু কেন পুলওয়ামায় বীর শহীদের রক্ত ঝরে? ভাষার নামে
জেনোসাইড, মানুষ পোড়া গন্ধই কি বয়ে আনে?
গিরিশের অনুবাদে সিঁদুরী কোরান আর হবে না কনফেশনেরই দিনকাল,
উষ্ণ আগুনে ইওসিনোফিল আহুতি দেব না আর, কোন পলিগট
কবিত্বের শর্তে ||
আর কতকাল অপেক্ষার পর যুদ্ধ থেমে যাবে? কত শয্যা পরে নেমে আসবে
নির্বাত শান্তি?
আর কত ধূলিকণা মেঘ হলে বৃষ্টি হবে? কত পুরন্ধ্রি দময়ন্তীর
আম্রপালি হওয়া বাকি?
কতদিন আর হাল্লা-শুন্ডীর আকাশ জুড়ে লেখা হবে খাদ্যের সন্ধান?
অধ্রুব শোনিত ধারায় মুছে যাবে ক্লেদাক্ত মেদিনীর ক্লান্তি |
এবার তবে প্রৌঢ় পৃথিবীর বুকে মালশ্রী বৃষ্টি হোক, মানবতা হোক অজাতশত্রু,
নর্দমার শিরা বেয়ে নেমে আসা নর্মদার ধারায় কস্তূরী আবার কর্দম হয় নাকি?
তবু লিখি
তবু লিখি, অনৃজু, নক্ত সমাজের ক্ষয়িত শিরদাঁড়ায় ভর করে|
বাসন্তী পিতাম্বর গায়ে মেখে, প্রেমের দুর্বল অশ্রুপাতে প্রবোধী প্রেমিকের মতো|
কঞ্জমসৃত মধু গন্ধ ছড়িয়ে, আমার ঠোঁটে সে এঁকেছিল, বনেদি সংলাপের আভেরি চুম্বন|
আমার লেখায় খুঁজি তাকে, পরাকৃত উষ্ণতায়, বসন্তের অশ্মানী বহ্নিপলাশের মতো|
কার ঘর আলো করে এসেছিল সে, তা জানা নেই|
কার ঘরেই বা জ্বলেছিল, অন্তিম প্রহরের অক্রূর প্রদীপখানি|
শুধু তার শুকতারা ভরা মুখে, দশমিক তিলের ভগ্নাংশে ডুব দিয়েছিলুম,
চৈত্রের শেষ অবীরা আণবিক ঝড়ের মতো|
মনে প্রাণে বুঝেছিলুম, আমি আসলে, সাহারার উদ্বাস্তু যাযাবরের মতো, কল্পনাপ্রবণ|
তবু লিখি, কারণ এই লিখতে পারাটাই আমার, একমাত্র অবলম্বন|
জানি, কোন অমূলদ সংখ্যাই পারে না, উন্নিদ্র রাতে, ফালির মতো চাঁদের বুক থেকে
খসে পড়া আঁচলটা, পুরো টেনে সরাতে|
গতিহীন তমসা, আমায় জাপটে ধরে, ডুবতে চাওয়া মরালির মতো|
তবু চতুর্বর্গ এ জীবনে প্রেম আসে, নতুন করে|
হয়তো এই অভিতপ্ত বসন্তেই তার বাসর সাজায়,
চৈতী চাঁদের বিরংসা সাঙ্গ হয়, জীর্ণ হন্বস্থির মাঝে দ্রাক্ষায়িত রুধির সংগমে|
কপর্দ বিনে কিনতে চাওয়া জগৎটা, হঠাৎ এসে ধরা দেয় মুঠোর ভেতর|
সীমন্তপথে যোনিরক্ত মেখে, সে সরে যায় অশরীরি অপলাপে কিংবা অপহাসে|
প্রেম সে তো অদেয় ছিলই, এই বসন্তে হয়তো হিমশৈলও অধরা হল||
সীমন্তিনী
অসার, অনুভূতিহীন পুরুষতার মাঝে, আমি তোমায় দেখেছি|
আমার ঘনঘোর মেঘনিপুণ মনে এঁকেছিলে তোমার সঘন চুম্বন|
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরশতার আবেশ মুছে যায়নি তখনো,
রাত্রিপাতের স্বপ্নে তোমার অশরীরি আলিঙ্গন||
আমার কৈশোরের মূর্ছনায় মূর্ত তুমি,
কতকটা অপ্রেমী দাম্পত্যের মতো|
দেশভাগের যন্ত্রণা মুছে যায় তোমার খোলা চুলে,
ক্ষুব্ধ সায়রে সামিয়ানা আঁকে বিরহী নক্ষত্র যত||
সীমন্তিনী, তোমার সুদীর্ঘ্য বেণীপথে রাজপুত্রের সদর্প পলায়ন|
যতবার চিনেছি তোমায় রংতুলির বর্ধিত দামে,
ততবার ফাঁক হয়েছে সমুদ্রের বুক, ফেনিল প্রস্রবণে|
আকাশ কুসুম কল্পনায় ডেকেছি তোমায় বেপরোয়া,
বেনামী ডাকনামে||
তোমার সীমন্তরেখায় জমা হয়, ব্যর্থ কবির জন্মান্তরের ক্লেদ|
পুরোনো ট্রামের সমান্তরাল শিরাপথে, বন বীথিকার হাতছানি|
তোমার নামে মহাকাব্য পাল্টে যায়|
আমার অজ্ঞানে বেজে গিয়েছো তুমি, চোরাগলির নীরব অশ্রুখানি||
জারজ
আমি ঈশ্বর দেখিনি, কখনো আমার নিদ্রিত ইন্দ্রিয়ে এসে জমা হয়নি,
অনির্বচনীয় মহাজাগতিক সুঘ্রাণ|
পঙ্কিল ক্লেদ আর বিবশতার মাঝেই চিরকাল আমার সদর্প পদচারণ|
“এই ছেলে দিগল পাহাড়ি যাবে?”, আমায় কখনো বলেনি কেউ, কেউ
দেয়নি নির্মল, অনল্প আলোকবর্তিকার সন্ধান|
সুরবাহারের মূর্ছনায় মেঘমল্লার কিংবা পাখোয়াজের বিস্তারে খাম্বাজ,
চিরকালই আমার কাছে অপ্রণিধানা|
বদলে মধ্যরাতের শরীরে, চিরস্থায়ী ক্ষত জন্ম দেয় বিরংসার, আমার অন্তরে
বেজে যায়, তাপদগ্ধ উষর মালকোষ|
“মা” ডাকের আকুল পিয়াসা, অনন্তকালের মন্ত্র নিনাদে ধ্বনিত করেছে,
উরোজে অদুগ্ধ তিতিক্ষা|
আমি “জারজ”, কালের গর্ভে অজপা মন্ত্রের ধারাপাতে, উদ্যাপিত
দৌম্যনস্য ধূমকেতু আমি|
স্বর্গের নন্দনকাননে, ওজস্বী ভ্রমরের চৌর্যবৃত্তি যেমন জন্ম দেয়
নির্বাত পারিজাতের,
বৈবস্বতঃ কালে ওস্তাদের প্রেষিত আলাপে, যেমন প্রিয়ম্বদার অমিয়া জঠরে
জন্ম নেয় বিরহী চারুকেশী,
আমিও এসেছি তেমন, জননকোষের শারীরবৃত্তিয় কৌশলরোধে
নিষেকের প্রারম্ভে|
কোনো অপ্সরার গর্ভনালী ছিঁড়ে, অনাদ্র, পাংশু দানবের মতো|
হয়তো বা কোনো শবচ্ছেদের ঘরে, মাঘী শীতের অনুষ্ণ পরশে, মালশ্রী লিখে
চলেছে আমার শাম্ভবী|
যোগ্য বাদ্যসঙ্গতে, নব্য রুধির দ্রাক্ষায়ণে, শব্দকোষ রচনায়
মগ্ন ক্লান্ত ভানুসিংহ|
ঘুমহীন রাতের আভেরী জড়িমা, আমায় বদ্ধ করে
অপ্রেমিক গ্লেসিয়ারে|
আসলে জননীর যোনিপথে মূর্ত আমি, রক্তিম অক্ষরমালার
বিপ্লবী সম্ভাষণে||
**************************