দাদির নীল স্যুটকেস
আদনান সৈয়দ
পুরাতন আর জীর্ণ জংধরা চাবিটা এখন আমার হাতে। চাবিটার গায়ে দাদির সুন্দর নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শ পাচ্ছি। শুধু স্পর্শ? তাঁর ঘ্রাণও পাচ্ছি। দাদি তাঁর চুলে জবা-কুসুম তেল মাখতেন। তিনি যখন ঘরে ঢুকতেন তখন ঘরের ভেতর জবাকুসুম তেলের ঘ্রাণে মউ মউ করতো। আজও ঠিক তাই পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, দাদি বুঝি ঠিক আমার পাশেই মাথায় জবাকুসুম তেল মেখে দাঁড়িয়ে আছেন। এদিকে চোখে আমার বিস্ময় আর মনে অদম্য কৌতূহল! কী আছে এই জাদুর স্যুটকেসে? কেন দাদি মৃত্যুর আগে বলে গেলেন এমন কথা? ‘আমার মৃত্যুর পর এই স্যুটকেসের মালিক আমার একমাত্র নাতি নাবিল।’
দাদির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সেই ছেলেবেলা থেকেই। যখন আমি বাংলাদেশে ছিলাম, দাদিই ছিলেন আমার একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান। এক সময় তিনি বাংলাদেশের মফস্বল শহরে একটি গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষক ছিলেন বলেই হয়তো পড়াশোনার দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর অনেক বেশি। আমি শিশুতোষ গ্রন্থগুলো প্রথম পড়তে শুরু করি তাঁর হাত দিয়েই। তারপর একদিন বাবা-মায়ের হাত ধরে চলে এলাম আমেরিকায়। তখন আমার বয়স মাত্র ১০ বছর। দাদির সঙ্গে এই বিচ্ছেদকে আমি কখনো মেনে নিতে পারিনি। বাবাকে অনেক বুঝিয়েছি। ‘বাবা, কেন আমেরিকায় যেতে হবে?’ কিন্তু আমার সেই শৈশবের অবুঝ প্রশ্নের উত্তর বাবার কাছ থেকে কখনোই পাইনি। শুধু এটুকুই জেনেছি বা আমাকে বোঝানো হয়েছে, আমেরিকা হলো সব পাওয়ার দেশ। সেখানে গেলে আমার ভালো পড়াশোনা হবে, বাবার ভালো চাকরি হবে, অনেক টাকা করি হবে, আরও কত কী হবে! কিন্তু এ কথাটি কেউ ভাবল না, আমরা চলে গেলে আমার দাদি খুব একা হয়ে যাবেন। দাদির সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের সুন্দর জীবনের ছেদ পরবে।
যেদিন আমরা নিউইয়র্কের উদ্দেশে বিমানে উঠি, সেদিন থেকেই দাদির সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ শুরু হতে থাকে। বেশ মনে পরে, দাদির কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তিনি আমার মাথায় হাত রেখে অনেক দোয়া করেছিলেন। কপালে চুমো খেয়েছিলেন। খুব জোরে বুকের সঙ্গে আমাকে ধরে রেখে কানে কানে বলেছিলেন, ‘নাবিল, তুই একেবারেই মন খারাপ করিস না। জীবনে কখনো কখনো কঠিন হতে হয়। তবে, তুই তোর দাদিকে ভুলে যাসনে যেন আবার! প্রতি মাসে একটি করে চিঠি লিখবি দাদু ভাই আমার। ফোনে কথা বলবি। আমি তোর ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকবো। আর আমেরিকায় তুই কত নতুন নতুন বই পড়বি। কত জ্ঞান বিজ্ঞানের ছোঁওয়া পাবি। তবে শুধু নিজে পড়বি না, আমাকেও পড়ে শোনাবি। দেখবি আমিও একদিন তোর সঙ্গে দেখা করতে ঠিক আমেরিকায় চলে যাবো।’ দাদি তাঁর কথা রেখেছিলেন। তিনি দু-দুবার আমেরিকায় এসেছিলেন। কিন্তু আমেরিকাকে দাদি কখনোই ভালোবাসেননি। আমরা অনেক চেষ্টা করেও দাদিকে আমেরিকায় ধরে রাখতে পারিনি। দাদির কথা একটাই। ‘আর ক’টা দিনই আর বাঁচবো? এই শেষ বেলাটা নিজের মাটিতেই কাটাতে চাই’।
একদিন খুব সকালে আমি যখন অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই বাবা আমাকে ডাকলেন। দেখি বাবার চোখ লাল। বেশ বুজতে পারলাম ভয়ংকর কোন খারাপ সংবাদ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। বাবা কোন ভূমিকা না করেই বললেন, ‘নাবিল, তোমার দাদি আর নেই। তিনি এই কিছুক্ষণ আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি আজই দেশে যাচ্ছি। মাস খানেক থাকব। তোমরা পরে যাবে। ’
যে দাদিকে আমি আমার পঁচিশটি বসন্ত অনেক ভালোবাসায় আগলে রেখেছিলাম, এখন সেই মানুষটি আর নেই! ‘দাদি নেই’ কথাটি আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বাবা বাংলাদেশে চলে গেলেন। আমি অনেক চেষ্টা করেও অফিস থেকে ছুটি নিতে পারিনি। হায়রে আমেরিকা! বাবা দাদির সব রকম সৎকার খুব নিখুঁত আর নিয়ম মেনেই করলেন। এভাবেই দাদিও একদিন আমার কাছে প্রয়াত হয়ে গেলেন। একদিন দুদিন করে করে প্রায় মাস পেরিয়ে গেল। এদিকে বাবারও নিউইয়র্কে আসার সময় হয়ে এল। একদিন সকালে হঠাৎ করে আবার বাবা আমাকে কল দিলেন।
‘নাবিল, তোমার জন্য একটা খবর আছে। তোমার দাদি তোমার জন্য তাঁর একটা পুরোনো স্যুটকেস রেখে গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি সবাইকে বলে গেছেন, এই স্যুটকেসটা শুধু তুমিই খুলতে পারবে, আর কেউ নয়। স্যুটকেসের চাবিটা আমার জিম্মায় রেখে দিয়েছি। তুমি চেষ্টা করে দেখ, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসতে পার কিনা।’
দাদি আমার জন্য কেন তাঁর স্যুটকেসটা রেখে গেছেন? শুধু আমাকেই তাঁর স্যুটকেস খোলার জন্য অধিকার দিয়ে গেলেন! কী আছে এতে? হয়তো সেই রহস্যময় স্যুটকেসের ভেতর থেকে অন্য এক দাদিকে আবিষ্কার করব। আবার কে জানে, এমনও হতে পারে দাদির অনেক অজানা রহস্যও হয়তো এর ভেতর থেকে উন্মোচিত হবে। হয়তো দাদি এই স্যুটকেসে এমন কিছু রেখে গেছেন যা অন্যকে বলা যাবে না। তিনি শুধু আমাকেই বলতে চান! রহস্যে যেন আমাকে ঘিরে ধরছিল! পুরো বিষয়টির মধ্যে আমি এক ধরনের কৌতূহল, আবার অ্যাডভেঞ্চারের ঘ্রাণ পেলাম। আমি আর দেরি করিনি। অফিস থেকে ছুটিছাটা নিয়ে একদিন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে উড়োজাহাজে চড়ে বসলাম। আমাদের গ্রামের বাড়ি ঢাকা থেকে খুব একটা দূরে নয়। গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। বাড়ির ফটকের সামনে আমার ট্যাক্সিটা ঢুকতেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। মনে হলো, দাদি যেন ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাকে এগিয়ে নিতে এসেছেন। আমাকে বলছেন, ‘দাদু ভাই, পথে কোন অসুবিধা হয়নিতো? চল চল ভেতরে চল। আগে তোকে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত দিই।’ বাবা আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। অনেক পর দাদির বাড়ি এসে নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসছিল। হায়! এখানে সবকিছুই আছে, কিন্তু শুধু দাদি নেই। পরিস্থিতি একটু শান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা আমার হাতে দাদির রেখে যাওয়া চাবিটা তুলে দিলেন। ‘এই নাও সেই চাবি। সকালে কেউ তোমার শোয়ার ঘরে স্যুটকেসটা নিয়ে আসবে।’
পরদিন সকালে আমার সামনে স্যুটকেসটা আনা হলো। খুব সাধারণ নীল রঙের একটা স্যুটকেস, ধুলোর আস্তরণ পড়ে নীল রং ফিকে হয়ে ধূসর হয়ে গেছে। আমি অনেক যতেœ ধুলো পরিষ্কার করলাম। বেশ বুঝতে পারলাম, দাদি এটি বহুদিন যাবৎ হয়তো ব্যবহার করেননি। হয়তো তাঁর জীবনের সব রহস্য তিনি এর ভেতরে রেখে দিয়েছিলেন।
চাবিটা হাতে নিয়ে আমি যেন ঘেমে গেছি। চাবি দিয়ে আমি কী খুলব? স্যুটকেস, নাকি দাদির জীবনের সব অজানা গল্প? নাকি আমি যা ভাবছি মোটেও তা নয়! হয়তো অন্য কিছু আছে! দেখতে পেলাম স্যুটকেসটির সামনেই ছোট্ট একটা কালো রঙের জং ধরা চাইনিজ তালা ঝুলছে। আমি ধীরে ধীরে তালাটি খুলে ফেলি। তারপর আস্তে করে স্যুটকেস এর ঢাকনাটা তুলে ধরি। স্যুটকেস খোলার সঙ্গে সঙ্গেই নেপথালিন এবং সেই সঙ্গে পুরোনো বোটকা একটা ঘ্রাণে গোটা ঘর ভরে গেল। বেশ বোঝা যায়, প্রচুর কাগজপত্রে স্যুটকেসটি ঠাসা। প্রথমেই চোখে পড়ল আমার আর দাদির বড় একটা ছবির অ্যালবাম। অ্যালবামের ওপরই রয়েছে একটি চিঠির খাম। সেই চিঠির খামের ওপর নাম লেখা, এই চিঠিটির প্রাপক ‘এনামুল হক নাবিল’। আমি চিঠিটি পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে হঠাৎ আবিষ্কার করি, আমার চোখ ঝাপসা। আর পড়তে পারছি না। তাঁর লেখা কয়কেটা লাইন আপনাদের শোনানোর লোভ সামলাতে পারছি না। ‘নিজের দেশকে কখনো ভুলবে না। নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিকে কখনো ভুলবে না। মনে রাখবে তোমার পরিচয় তোমার দেশ। তোমার পরিচয় তোমার রক্তে বয়ে যাওয়া হাজার বছরের বাঙলা সংস্কৃতি। কখনো এই সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করবে না।’
চিঠির খামের পাশেই রয়েছে ছোট একটা ছবির অ্যালবাম। সেই অ্যালবামে রয়েছে দাদির সঙ্গে আমার কত ছবি! অ্যালবামের নিচেই পাওয়া গেল একটা ভাঙা কালো ফ্রেমের চশমা। সেটার নিচে লেখা রয়েছে, ‘তোমার দাদার চশমা’। কাপড়ের একটি পুটলি। কী আছে এই পুটলিতে? সেটি খুলতেই দেখি একটা একটা চিঠি। সেই চিঠিতে লেখা, ‘নাবিল, এখানে খুব সামান্য কটা সোনার গয়না আছে। এই গয়নাগুলো তোর দাদা আমার বিয়েতে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। আমি তোকে এই গয়নাগুলো দিলাম। তুই যখন বিয়ে করবি, তখন তুই তোর বউকে উপহার হিসেবে এই গয়নাগুলো দিবি।’ আমি একে একে অলংকারগুলো দেখতে লাগলাম। খুব সুচারু কারুকাজ করা দাদির গলার হার, দুটো হাতের বালা, নাকের নথ, ছোট একটি আংটি। খুব সামান্য কটা অলংকার। প্রতিটা অলংকারে যেন দাদির চেহারা ভেসে উঠছে। আবার খুব যতেœর সঙ্গে কালো রঙের পুটলিটা বন্ধ করে যথাস্থানে রেখে দিলাম। স্যুটকেসের ডান পাশের একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। সুন্দর একটা সুরমাদানি। এই সুরমাদানিটার নিচে লেখা, ‘তোর দাদা আমার এক জন্মদিনে এই সুরমাদানিটা উপহার দিয়েছিলেন। তুই এটি যত্নের সঙ্গে তোর সঙ্গে রেখ দিবি।’ আমি সুন্দর নকশি করা কাসার সুরমাদানিটা অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে বসে রইলাম। নিচের দিকে আবিষ্কার করি ছোট একটা পুরোনো নোটবুক। নোটবুক তো নয়, সম্ভবত বাঁধাই করা একটি খাতা। সেই খাতাটি এতই পুরোনো যে মনে হয় কাগজগুলো খুলে পড়ে যাবে। সেই খাতার ওপর কালো রঙের কালি দিয়ে বড় করে লেখা ‘আমার সাহিত্য জগৎ’। বাহ! দাদিও গোপনে সাহিত্য চর্চা করতেন? কিন্তু কই, কেউতো আমাকে এই নিয়ে কোন দিন কিছু বলেনি? সম্ভবত আমার বাবাও সে খবর রাখতেন না।
নোটবুকটি খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই দেখতে পেলাম ছোট একটি কবিতা। আমি দাদির সাহিত্যকর্মে নিজেকে উজাড় করে দিলাম। কখনো কবিতা, কখনো গল্প আবার কখনো শুধুই কলম দিয়ে অযথা আঁকিবুঁকি। আহা! দাদির বুঝি কেউ ছিল না এই নিয়ে গল্প করার! এই সাহিত্য জগতে দাদিকে বুঝি একাই হাঁটতে হয়েছে! তিনি নিজের জন্য লিখেছেন। নিজের জন্যই তাঁর সাহিত্য। হয়তো আরও দশজনের সামনে তা পরিবেশন করার সাহস তিনি পাননি। হয়তো লজ্জায় তিনি কুঁকড়ে যেতেন। হয়তো দাদাও এ নিয়ে দাদিকে কখনো উৎসাহ দেখাননি। আহা দাদিটা আমার! কিন্তু দাদি তাঁর জীবদ্দশায় কাউকে তাঁর সাহিত্যরসের খবর জানাতে পারেননি। মনে পড়ে গেল, রাসসুন্দরী দেবীর কথা। তিনিও খুব গোপনে বাংলা সাহিত্যচর্চা করতেন। গোপনে গোপনে তিনিও বাংলা সাহিত্যের একজন লেখক হয়েছিলেন। কিন্তু আমার দাদিও রাসসুন্দরী কিংবা রোকেয়া থেকে কম কীসে? তিনিও তো একজন লেখক। দাদির জন্য গর্বে আমার বুকটা ফুলে উঠল।
স্যুটকেসের ঠিক বাম পাশে কিছু খবরের কাগজের স্তুপ দেখলাম। বেশ বোঝা যায়, কাগজগুলো দিয়ে তিনি কী যেন ঢাকতে চেয়েছেন। কী আছে নিচে? হাত দিয়ে একটু সরাতেই সেখানে বেশ মোটা পাঁচ-ছয়টি ডায়েরি বের হয়ে এল। কোন শহুরে চকমকে ঝকঝকে ডায়েরি নয়। বড়জোর, খুব সাদামাটা কয়েকটি মোটা ছোট খাতা বলা যায় এগুলোকে। খাতাগুলোর ওপর সিমেন্টের বস্তার মোটা খয়েরি কাগজ দিয়ে মলাট তৈরি করা হয়েছে। দাদি ডায়েরি লিখতেন? কী আছে ডায়েরিতে? মনে আমার তখন দাদিকে আবিষ্কারের নেশা। ওপরে রাখা প্রথম ডায়েরিটা হাতে নিলাম। প্রথম পাতার ভাঁজে একটা শুকনো খয়েরি রংয়ের গেঁদা ফুল। ফুলটা এমনভাবে ডায়েরির পাতায় মিশে আছে যে সেটির একটি জলছাপ ডায়েরির পাতায় সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। প্রথম পাতায় তারিখ লেখা রয়েছে জানুয়ারি ২৩, ১৯৬২। তার নিচে ছোট ছোট গুটি গুটি হাতে লেখা রয়েছে, ‘তিনি মানুষটা খারাপ না। তার সঙ্গেই আজ আমার বিবাহ। আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের জীবন যেন সুখের হয়।’ এ পর্যন্ত পড়ে আমি কিছুক্ষণ থেমে যাই। মনে হলো কী দরকার! দাদির ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করার? দাদির প্রাইভেসি রক্ষার দায়িত্ব আমারই। ডায়েরিটা রাখতে যাব, ঠিক তখনই চোখ পড়ল দ্বিতীয় ডায়েরিটার ওপর। খয়েরি কাগজের মলাটের ওপর বড় করে ফাউন্টেন পেন কলমে লেখা ‘১৯৭১’। আমি যেন হাতে চাঁদ খুঁজে পেলাম।
১৯৬২ সালে দাদির যখন বিয়ে হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল ২২। অর্থাৎ বিয়ের আট বছর পর ১৯৭১ সালে যুদ্ধের বছরে তাঁর বয়স হয়েছিল ৩০। এই বয়সে দাদি তার চোখ দিয়ে একাত্তরকে দেখেছিলেন। আমি আর লোভ সামলাতে পারছিলাম না। প্রথম পাতা উল্টাতেই আঁতকে উঠলাম। কাঁচা হাতে আঁকা বড় একটা দানবের ছবি। বোঝাই যায়, এটি দাদির হাতে আঁকা। ছবির নিচে লেখা ‘হায়ানা’। ডায়েরির লেখাও খুব বিক্ষিপ্ত। কোন ধারাবাহিকতা নেই। ডায়েরির বিক্ষিপ্ত আর এলেমেলো পাতা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেই সময় আমার দাদির জীবনটাও ছিল ডায়েরির পাতার মতোই এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। তখন তার জীবন ছিল হয়তো ভয়ের, শঙ্কার আবার স্বাপ্নিকও। হঠাৎ ডায়েরির পাতার একটা অংশ পড়ে আঁতকে উঠলাম। শেষ পর্যন্ত দাদিকেও! দাদিও নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না! এই লজ্জা নিয়েই বুঝি আমার দাদি সারা জীবন নীরবে অপমান আর লজ্জার গ্লানি বয়ে বেড়ালেন। এই সমাজ, এই সমাজের মানুষ, আমি, আমার বাবা, আমরা কেউ তা জানতে পারলাম না! হঠাৎ নাকে জবাকুসুম তেলের ঘ্রাণ পেলাম। লক্ষ্য করলাম, দাদি ঠিক আমার সামনেই বসে আছেন। তার চোখে তখন প্রতিশোধের আগুন দগ দগ করে জ্বলছে। আমাকে যেন তিনি বলছেন, ‘তোর দাদিকে যারা অপমান করেছিল, তুই তাদের প্রতিশোধ নিবি। তাদের কোনো ক্ষমা নেই। বল প্রতিশোধ নিবি?’ আমি দাদির ডায়েরিটাকে বুকের মধ্যে জোরে চেপে ধরি। হঠাৎ আবিষ্কার করি, আমার চোখে আর কোনো জল নেই। জলের পরিবর্তে সেখানে ঠাঁই করে নিয়েছে একদলা প্রতিশোধের আগুন।
আমি দাদির স্যুটকেসটা বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে বয়ে এনেছি। দাদির দেওয়া গয়নাগুলো আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রীর জন্য তুলে রেখেছি। দাদির প্রতিটি জিনিসপত্র খুব যত্নের সঙ্গে আমি আগলে রেখেছি। এই কয়েক দিন আগে দাদির পান্ডুলিপি ঠিকঠাক করে একজন প্রকাশককে দিয়েছি। আসছে বইমেলায় সেটি বই আকারে প্রকাশ পাবে আশা করি। আর ডায়েরির কথা বলছেন তো? হ্যাঁ, আমি অনেক ভেবেছি। প্রথম ভেবেছিলাম ডায়েরিগুলোকে নিউইয়র্কের ইস্ট রিভারের ঢেউয়ের সঙ্গে ভাসিয়ে দিলে কেমন হয়! দাদির সব অপমান এই ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে যাক। কিন্তু কেন জানি মনে হলো, তা হবে কেন? এত হবে পলায়ন! দাদির লেখা এই ছোট ডায়েরিটিইতো আমার স্বদেশ! আমার অংকারের ঠিকানা। তাই ডায়রিগুলো খুব যত্ন করে আমি আমার কাছেই রেখে দিয়েছি। যে নীল স্যুটকেসে এত দিন আমার দাদি নিজেকে বন্দী করে রেখেছিলেন, সেই বন্দিদশা থেকে তাঁকে আমার মুক্তি দিতে হবে! দাদির নীল স্যুটকেসটাই যে এখন আমার এক চিলতে বাংলাদেশ!
=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=