You are currently viewing বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন/ঋতো আহমেদ 

বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন/ঋতো আহমেদ 

বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন/ঋতো আহমেদ  

বইমেলা নিয়ে মন-মানচিত্র আয়োজিত ‘বইমেলার খোলাচত্বরের কথোপকথনে’ এ যাবৎ অনেক কবি সাহিত্যিক, অনুবাদককে আমরা পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। আজকের  কথোপকথনে আমাদের সাথে আছেন লেখক ও অনুবাদক ঋতো আহমেদ। 

মন-মানচিত্র: গ্রন্থ মূলত দীর্ঘ একটা সময়ের সাধনার ফসল। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে আপনার কয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হওয়ায় আপনার অনুভূতি এবং বইটির ব্যাপারে জানতে চাই। 

ঋতো আহমেদ: মেলার শেষ পর্যায়ে এসে এই প্রশ্নটি আমার জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারবারই মনে হচ্ছে এই কথোপকথনের উপযুক্ত আমি নই। অন্তত এই মুহূর্তে। কারণ এ বছর আমার যে অনুবাদের বইটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল “পাউল সেলানের নির্বাচিত কবিতা” নামে। যার কিছু কবিতা এই মন-মানচিত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল গত বছর। দুঃখের বিষয় যে, প্রকাশক ‘বেহুলাবাংলা’ এখনও বইটি মেলায় আনতে পারেননি। এ ব্যাপারে কয়েকবার যোগাযোগ করার পরও প্রকাশকের কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচ্ছদ ফাইনাল হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে আর বই হয়ে যাওয়ার কথা ফেব্রুয়ারির শুরুতে। কিন্তু হয়নি শেষ পর্যন্ত। ঠিকই বলেছেন, গ্রন্থ মূলত দীর্ঘ একটা সময়ের সাধনার ফসল। প্রায় ৫/৬ বছর ধরে একটু একটু করে কবিতাগুলোর বাংলা অনুবাদ করেছি আমি। বইটি আমার এক স্বপ্নেরই সাধনা বলতে পারেন। 

মন-মানচিত্র: আপনার পূর্বে প্রকাশিত সাহিত্যকর্মও কি পাঠকরা গ্রন্থমেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন? 

ঋতো আহমেদ: হ্যাঁ, গত বছর প্রকাশিত “আদিরসাত্মক সংস্কৃত কবিতা” বইটি পাওয়া যাবে বেহুলাবাংলার স্টল থেকে। এ ছাড়া চৈতন্যর স্টলে পাওয়া যাবে কবি ফ্রাঞ্জ রাইটের পুলিত্‌জার পুরস্কার প্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ “ওয়াকিং টু মার্থাস ভিনিয়ার্ড ” বইটির বাংলা অনুবাদ। 

মন-মানচিত্র: অমর একুশে গ্রন্থমেলা লেখক-পাঠকদের মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনের কাজটিই যে করে তাই নয়, এইসময় গ্রন্থপ্রেমিকদের মধ্যে খুশির আমেজও পরিলক্ষিত হয়। গ্রন্থমেলাটিকে প্রাণবন্ত করার ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই। 

ঋতো আহমেদ: অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে গেছে এখন। লেখক পাঠক প্রকাশক সবার জন্যই এই মেলা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গত বছর কোভিড পরিস্থিতি নাজুক থাকায় মেলার সময় কমিয়ে দেয়া হয়েছিল যা সবার জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক প্রকাশকের লোকসান গুণতে হয়েছে সেবার। সে তুলনায় এ বছর দেরীতে শুরু হলেও মেলা বেশ জমজমাটই মনে হয়েছে। ঢাকার অন্য প্রান্তে থাকায় প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব হয়নি, তবে প্রতিটি ছুটির দিনই গিয়েছি। আগের চাইতে অনেকটা অরগানাইজ্‌ড এবারের মেলা। বইও প্রচুর বিক্রি হয়েছে শুনেছি। বিভিন্ন জায়গায় পাঠকদের জন্য বসার ব্যবস্থা রাখাটা ভালো লেগেছে। তবে রোদে ভুগেছেন অনেকে। পরের বার ছাউনি করে দেয়া যেতে পারে। লিটিলম্যাগ কর্নারে লেখক/পাঠকের আড্ডার একটা ব্যবস্থা রাখা যেত। মেলায় ঢুকতে গিয়ে এবারও নিরাপত্তা-কর্মী(পুলিশ)দের সাথে পাঠকের বাকবিতণ্ডা হতে দেখা গেছে। এ ব্যাপারে মেলা কর্তৃপক্ষ যদি সজাগ দৃষ্টি দেন তাহলে ভালো হয়। এসব ঘটনা পাঠককে মেলায় যেতে নিরুৎসাহিত করে। যা কারও কাম্য নয়। আবার দেখা গেছে মেলায় বই কিনতে যাওয়া একদল শিশুকিশোরকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করা হচ্ছে তাদের ইংরেজি-বলা নিয়ে। এটাও একটা খারাপ দিক। তাদেরকে মাতৃভাষা বাংলার দিকে আকৃষ্ট করা যায় কীভাবে সেটা ভেবে দেখতে হবে। ব্যাঙ্গ/ট্রোল কোনও কাজের কথা না। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে অনেকের খিদে লেগেছে। আইসক্রিম/পানীয়ের ব্যবস্থাপনা আর দাম সহনীয় কিন্তু যেসব রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে তাদের খাবারের মান অতি জঘন্য। তার উপর দাম আকাশ ছোঁয়া। মেলার বাইরে যে ফুচকা ৪০ টাকা প্লেট সেটা মেলার ভেতরে নিচ্ছিল ৮০ টাকা। প্রকাশকের চাইতে এরাই ভালো ব্যাবসা করেছে। বইয়ে তাও ২৫% ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। কিন্তু খাবারে ডাবল পে করতে হয়। কেন? খাবারেও ২৫% ডিসকাউন্ট দেয়া উচিৎ। বই বিক্রির উছিলায়ইতো খাবার বিক্রি। 

মন-মানচিত্র: গ্রন্থমেলার সাথে প্রকাশনার সাথে জড়িত মানুষের রুটিরুজির সংস্থানের ব্যাপারটিও জড়িত। এই ব্যাপারে আপনি যদি আপনার মতামত শেয়ার করতেন। 

ঋতো আহমেদ: প্রকাশনাকে শুধু বই ছাপানো আর বিক্রি/ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করলে এখানে এগোনোর কিছু নেই। কারণ, বানিজ্যমেলার মতো এটা কেবল ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড নয়। এটা একটা শিল্প। অবশ্য আমাদের দেশে এখন অনেক কম প্রকাশকই একে শিল্প মনে করেন। তাই বলবো, পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। আমরা চাইলেই অন্য দেশের অন্য ভাষার প্রকাশনা সংস্থাগুলোর দিকে তাকাতে পারি। শেখার কোনও শেষ নাই। একটা বই, বই হয়ে ওঠার পেছনে অনেক মানুষের শ্রম জড়িত। তাদের প্রত্যেকেই একেক জন শিল্পী। সেই সাথে এটা তাদের অন্ন-সংস্থানও। মেলার স্টলগুলির সাথেও সাময়িকভাবে অনেকে জড়িত থাকেন। কলেজ/ইউনিভার্সিটির ছাত্ররাও থাকেন এর সাথে। যেমন উৎসব তেমন রুটিরুজিও। তাই প্রত্যেকের প্রতি সম্মান রেখে আমাদের ভাবতে হবে কী করে এই শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। ব্যাক্তিগতভাবে এবং সেই সাথে সরকারিভাবেও আমরা ভাবতে পারি, বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। গত বছর প্রকাশকরা যে ধাক্কা খেয়েছেন, সেটা কাটিয়ে উঠতেও কিছু করা যেতে পারে। আবার নতুনদেরকেও আর্থিক সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে প্রকাশনা শিল্পে এগিয়ে আসার জন্য। এবারেও অনেক মান সম্মত বই এবং লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। তালিকা করে সাধ্যমতো একে একে সংগ্রহ করছি। এর মধ্যে রয়েছে নিসর্গ, পেপারব্যাক, বিন্দু, বিন্দু(উৎপলকুমার সংখ্যা), ঘুংঘুর, মাদুলি(আবিদ আজাদ সংখ্যা) ইত্যাদি।

মন-মানচিত্র: বইমেলার পর প্রকাশিত বইয়ের আর বিশেষ খোঁজ থাকে না। আমাদের দেশে বইয়ের দোকানও স্বল্প। এই পরিস্থিতিতে বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে আপনার ভাবনা যদি জানাতেন। 

ঋতো আহমেদ: হ্যাঁ, এই একটা ব্যাপার আমাকে খুব আহত করে। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প হয়ে গেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা কেন্দ্রিক। এই একটি ইভেন্টকে কেন্দ্র করেই প্রকাশকরা সরব হয়ে ওঠেন বই প্রকাশনায়। বছরের অন্য মাসগুলোয় নিভে যান। যত ছাপা আর বিক্রি যেন এই একটি মাসেই। এটাও বই কম বিক্রি হওয়ার একটা কারণ। আমাদের প্রকাশকদের বিলি/বণ্টন আর বিপণন কোন স্ট্রাটেজিতে চলে তা স্পষ্ট নয়। হয়তো সেটা বিপণন বিমুখ। নয়তো বই পাওয়া যাবে না কেন? প্রকাশিত সব বইইতো চলে যাওয়ার কথা প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত। দেশে বইয়ের দোকান স্বল্প। কিন্তু সেই অল্প কয়েকটি দোকানেও হাতে গোণা বিখ্যাত কয়েকজনের বই ছাড়া আর কোনও বই পাওয়া যায় না। পৌঁছায়ই না ওই পর্যন্ত। কেবলমাত্র অনলাইন বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা করে বসে থাকায় আজ আমাদের প্রকাশনা শুধু মেলা কেন্দ্রিক। অথচ পাশের দেশ, পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশিত বইগুলো অবলীলায় চলে আসছে আমাদের হাতের কাছে। আপনি তক্ষশিলা, প্রথমা, পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র, বাতিঘর কিংবা আজিজের যে কোনও বইয়ের দোকানে যান, কোলকাতার সদ্য প্রকাশিত বইও পেয়ে যাবেন চোখের সামনে। পাবেন না আপনার বই। অনুসন্ধিৎসু পাঠক, যে কিনা বইয়ের দোকান ঘুরে ঘুরে খুঁজে খুঁজে বই আবিষ্কার করে, সে কীভাবে পাবে আপনার বই! পাবে না। কারণ, আপনার বই মেলা পর্যন্ত। এরপর ব্ল্যাকহোলে ঢুকে যায়। যে লোকটা বইটির খবরই জানে না, সে কখনও খুঁজে পাবে না। যে জানে, খুব আগ্রহ জন্মালে হয়তো অনলাইনে অর্ডার করতে পারবে, এই পর্যন্ত। বিভিন্ন বইয়ের দোকানে বই হাতাতে হাতাতে দেশ/বিদেশের অনেক অপরিচিত লেখককে আবিস্কারের আনন্দে খুঁজে পেয়েছি আমি। কিন্তু এ দেশে প্রকাশিত আপনার বইয়ের ক্ষেত্রে সে সুযোগ কম। তাই আমি মনে করি প্রকাশকদের শুধু বইয়ের ছাপক হয়ে বসে থাকলে চলবে না। প্রচার, বিলি/বণ্টন আর বিপণনে আধুনিক ও ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দিন শেষে বিনিয়োগ তো উঠে আসতে হবে তারই। তাই যে বইয়ের পাঠক যিনি, সে বই সেই পাঠকের সামনে পৌঁছানোর উপযুক্ত ব্যবস্থাও করতে হবে। তবেই হবে বই বিক্রি। সচল প্রকাশনা। মান সম্মত বই। ও কাঙ্ক্ষিত শিল্প।

মন-মানচিত্র: কোভিড পরিস্থিতিতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, পাঠকদের প্রতি আপনার বার্তা যদি শেয়ার করতেন।

ঋতো আহমেদ: কোভিড পরিস্থিতি একটা সাময়িক পরিস্থিতি। প্যানিক সৃষ্টি না করে একে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে শিখুন। সাবধানতা অবলম্বন করুন। যারা এখনও টীকা নেননি। তারা দ্রুত রেজিস্ট্রেশন করে টীকা নিয়ে ফেলুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সঠিকভাবে মাস্ক পরুন। ভিড় এড়িয়ে চলুন। বই ছাড়া অন্য কিছুতে হাত দিবেন না। হাতে হাতে মেলানো আপাতত বন্ধ রাখুন। আর বই কিনুন এবং বই কিনুন।