You are currently viewing কৃষ্ণের বহুবিবাহ প্রসঙ্গে / নান্টু রায়

কৃষ্ণের বহুবিবাহ প্রসঙ্গে / নান্টু রায়

কৃষ্ণের বহুবিবাহ প্রসঙ্গে

নান্টু রায়

আমরা জানি, দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণ অধর্মের বিপরীতে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য মথুরার রাজকন্যা দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বসুদেব কংসের দ্বারা প্রাণসংশয় হতে পারে আশঙ্কা করে সদ্যোজাত পুত্রকে রাতের অন্ধকারেই সেই ঝড়জলের মধ্যে যমুনার অপরপারে নন্দের গৃহে রেখে এলেন। সদ্য সন্তান হারানো যশোদাও তাঁকে পেয়ে পুত্রবোধে লালন-পালন করতে লাগলেন। সেখানে কৃষ্ণ ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন। সে-সময় ঘোষ নিবাসে নেকড়ে বাঘের উপদ্রব খুব বেড়ে গিয়েছিল। কৃষ্ণও নানা বিপদে পড়েছিলেন। তাই নন্দ ও অন্যান্য গোপেরা পূর্ব বাসস্থান ত্যাগ করে অধিকতর নিরাপদ সুখের জায়গা বৃন্দাবনে গিয়ে বসতি স্থাপন করলেন।

কৃষ্ণ-বলরাম অমিত বলশালী হয়ে উঠছেন, এখবর মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসের কাছে পৌঁছলে তিনি কৃষ্ণবধে অতি তৎপর হয়ে উঠলেন। কৃষ্ণ-বলরাম মথুরায় গিয়ে কংসকে হত্যা করে উগ্রসেনের রাজত্ব উগ্রসেনকেই ফিরিয়ে দিলেন। তারপর কৃষ্ণ-বলরাম কাশীতে সান্দীপনি মুনির কাছে চৌষট্টি দিন অস্ত্রশিক্ষার পর মথুরায় ফিরে এলেন। সান্দীপনি ঋষির কাছে ছাড়াও তিনি সমগ্র বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন এবং নিখিল বেদ-বেদাঙ্গ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আঙ্গিরসবংশীয় ঘোর ঋষির কাছে একাদিক্রমে ১০ বছর বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন বলে ছান্দ্যোগ্য উপনিষদে উল্লেখ আছে।

কৃষ্ণ বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্য রুক্মিণীকে বিবাহ করেন। রুক্মিণী অতিশয় রূপবতী ও গুণবতী শুনে কৃষ্ণ ভীষ্মকের কাছে গিয়ে রুক্মিণীকে বিবাহের জন্য প্রার্থনা করলেন। রুক্মিণীও কৃষ্ণের অনুরক্তা ছিলেন। কিন্তু ভীষ্মক কৃষ্ণের শত্রু জরাসন্ধের পরামর্শে রুক্মিণীকে কৃষ্ণের হাতে সমর্পণ করতে রাজি হলেন না। তিনি কৃষ্ণদ্বেষক চেদিরাজ শিশুপালের সঙ্গে রুক্মিণীর বিয়ে ঠিক করে সমস্ত রাজাদের নিমন্ত্রণ করলেন। যাদবদের এ বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হল না। কৃষ্ণ স্থির করলেন, যাদবদের সঙ্গে নিয়ে ভীষ্মকের রাজধানীতে যাবেন এবং রুক্মিণীকে বিয়ে করবেন।

বিয়ের দিন রুক্মিণী দেবমন্দিরে পূজা দিতে গেলে কৃষ্ণ সেখান থেকে তাঁকে রথে তুলে নিলেন। ভীষ্মক ও তার পুত্ররা এবং জরাসন্ধ প্রভৃতি ভীষ্মকের মিত্র রাজারা কৃষ্ণের আগমন সংবাদ শুনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে আশংকায় প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। তাঁরা সসৈন্যে কৃষ্ণের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। কিন্তু কেউই কৃষ্ণ ও যাদবদের পরাভূত করতে পারলেন না। কৃষ্ণ রুক্মিণীকে দ্বারকায় নিয়ে গিয়ে শাস্ত্রমতে বিয়ে করলেন।

এ ধরনের বিয়েকে ‘হরণ’ বলে। কিন্তু ‘হরণ’ কথাটা মৌলিক মহাভারতে কোথাও নেই। হরিবংশ ও পুরাণে আছে। শিশুপাল কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মকে তিরস্কারের সময় কাশিরাজের কন্যাহরণের জন্য তাঁকে গালি দিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণকে তিরস্কারের সময় রুক্মিণীহরণের কোনও কথা তোলেননি। অতএব মনে হয় না যে, রুক্ষ্মিণীকে হরণ করা হয়েছিল। রুক্ষ্মিণীকে শিশুপাল প্রার্থনা করেছিলেন বটে, কিন্তু ভীষ্মক রুক্ষ্মিণীকে কৃষ্ণকেই সম্প্রদান করেছিলেন বলে মনে হয়। রুক্ষ্মিণীর বড় ভাই রুক্মী এতে অপমানিত বোধ করলেন। তিনি শিশুপালের পক্ষ নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হলেন। তিনি অতিশয় কলহপ্রিয় ছিলেন। পরে অনিরুদ্ধর বিবাহকালে বলরামের হাতে পাশা খেলাজনিত বিবাদে তিনি প্রাণ হারান। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।

এ সময় আধুনিক বাঙলা দেশের পশ্চিমভাগে পৌন্ড্রক বাসুদেব নামে একজন অনার্য রাজা ছিলেন। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের অবতার ও দ্বারকা নিবাসী কৃষ্ণকে জাল বাসুদেব বলে প্রচার করতে শুরু করেন। তিনি কৃষ্ণকে বলে পাঠালেন, শঙ্খ-চক্র-পদ্ম প্রভৃতি যে-সব চিহ্নে আমার প্রকৃত অধিকার, তুমি নিজে এসে সে-সব আমাকে দিয়ে যাবে। কৃষ্ণ ‘তথাস্তু’ বলে পৌন্ড্ররাজ্যে গিয়ে চক্র প্রভৃতি অস্ত্র নিক্ষেপ করে পৌন্ড্রকের প্রাণনাশ করলেন। বারাণসীর অধিপতিরা পৌন্ড্রকের পক্ষাবলম্বন করেছিল। পৌন্ড্রকের মৃত্যুর পরেও তারা কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। কৃষ্ণ বারাণসী আক্রমণ করে শত্রুদের সংহার করেন এবং বারাণসীতে আগুন ধরিয়ে দেন।

দ্বারকায় কৃষ্ণ রাজা ছিলেন না। যাদববীরেরা সমাজের অধিনায়ক ছিলেন, পরস্পরের প্রতিস্পর্ধী ছিলেন। তাঁরা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রধান বিবেচনা করতেন, সে জন্য উগ্রসেনের রাজা নাম। কিন্তু এ ধরনের প্রধান ব্যক্তির কার্যত তেমন কর্তৃত্ব থাকত না। যে বুদ্ধিবিক্রমে প্রধান, নেতৃত্ব তার হাতেই থাকত। কৃষ্ণ যাদবদের মধ্যে বলবীর্য বুদ্ধিবিক্রমে সর্বশ্রেষ্ঠ, এজন্যই তিনি যাদবদের নেতাস্বরূপ ছিলেন। তাঁর অগ্রজ বলরাম, কৃতবর্মা প্রভৃতি বয়োজ্যেষ্ঠ যাদবেরা তাঁর বশীভূত ছিলেন। কৃষ্ণ সবসময় তাঁদের মঙ্গল কামনা করতেন। কৃষ্ণই তাঁদের রক্ষা করতেন এবং তিনি বহু রাজ্য জয় করলেও জ্ঞাতিদের না দিয়ে নিজে কোনও ঐশ্বর্য ভোগ করতেন না। তিনি সবাইকে সমান ভালবাসতেন; সকলেরই কল্যাণ সাধনে নিযুক্ত থাকতেন। জ্ঞাতিদের প্রতি আদর্শ মানুষের যেমন ব্যবহার কর্তব্য, কৃষ্ণ সবসময় তা করতেন। কিন্তু জ্ঞাতিভাব চিরকালই সমান। তাঁর বলবিক্রমের ভয়ে জ্ঞাতিরা তাঁর বশীভূত ছিল বটে, কিন্তু তাঁর প্রতি হিংসাশূন্য ছিল না। এ বিষয়ে কৃষ্ণ নিজে নারদকে যা বলেছিলেন, ভীষ্ম তা নারদের মুখে শুনে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, কথাগুলো সত্য হোক মিথ্যা হোক, লোকশিক্ষার জন্য আমরা শান্তিপর্ব থেকে তা উদ্ধৃত করছি:

‘জ্ঞাতিদের ঐশ্বর্যের অর্ধেক প্রদান ও তাদের কটুবাক্য শুনে তাদের দাসের মত অবস্থান করছি। আগুনের জন্য যেমন লোকে অরণিকাঠ ঘষে, তেমনি জ্ঞাতিদের দুর্বাক্য আমার হৃদয়কে পোড়ায়। বলদেব গদাকুশলতায় এবং  আমার আত্মজ প্রদ্যুম্ন অতুল সৌন্দর্যে লোকসমাজে অদ্বিতীয় বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন। আর অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়রাও মহাবলশালী, উৎসাহী ও অধ্যবসায়ী; তাঁরা যার সহায়তা না করেন, সে বিনষ্ট হয় এবং যার সহায়তা করেন, সে অনায়াসে অসামান্য ঐশ্বর্য লাভ করে থাকে। ঐসব ব্যক্তি আমার পক্ষে থাকতেও আমি অসহায়ের মত কাল কাটাচ্ছি। আহুক ও অক্রূর আমার পরম সুহৃৎ, কিন্তু তাদের একজনকে ¯েœহ করলে, অন্যে রেগে যায়; সেজন্য আমি কারও প্রতি ¯েœহ প্রকাশ করি না। আবার প্রীতিবশত তাদের ত্যাগ করতেও পারি না। তারপর আমি ঠিক করলাম যে, আহুক ও অক্রূর যার পক্ষে, তার দুঃখের সীমা নেই, আর তাঁরা যার পক্ষ নন, তার চেয়েও দুঃখী আর কেউ নেই। যাহোক, এখন আমি উভয়েরই জয় প্রার্র্থনা করছি। হে নারদ! আমি ঐ দুই মিত্রকে আয়ত্ত করার জন্য এমন কষ্ট পাচ্ছি।’

বিভিন্ন লীলাবিস্তার ও রাধিকাবিলাস ছাড়াও স্যমন্তক মণি প্রসঙ্গে কৃষ্ণের বহুবিবাহের কথা এসে পড়ে। এটি একটি বহু চর্চিত লোকপ্রবাদ যে, কৃষ্ণের ষোল হাজার একশো এক মহিষী ছিলেন। মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত অংশ, বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশে তাঁর বহুবিবাহ বিষয়ে নানা অনৈসর্গিক অলীক ব্যাপারের অবতারণা করা হয়েছে। কৃষ্ণ একাধিক বিবাহ করেছিলেন কি না, সে বিষয়ে কোনও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। ভল্লুকদৌহিত্র শাম্বর কথা বাদ দিলে রুক্মিণী ছাড়া আর কোনও কৃষ্ণ-মহিষীর পুত্র-পৌত্রকে কার্যক্ষেত্রে কোথাও দেখা যায় না। রুক্মিণীরই একটি পুত্রসন্তানের উল্লেখ পাই, যার নাম প্রদ্যুম্ন। রুক্মিণী বংশই রাজা হল, আর কারও বংশের কেউ কোথাও রইল না। শাম্বর মায়ের নাম জাম্ববতী, তিনি ভল্লুক জাম্ববানের কন্যা। কৃষ্ণ স্যমন্তক মণি উদ্ধারকালে জাম্ববতীকে বিবাহ করেছিলেন বলে বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশে উল্লেখ আছে। কিন্তু কৃষ্ণ ভল্লুককন্যাকে বিবাহ করেছিলেন, একথা বিশ্বাস করা কঠিন। বলা হচ্ছে, এই জাম্ববান ত্রেতাযুগে রামচন্দ্রের বানরসেনাদের সঙ্গে থেকে রামের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। ত্রেতাযুগের ভল্লুক দ্বাপরে এসে পড়ল! এমন হতে পারে, এই জাম্ববান কোনও প্রান্তিক বনবাসী মানুষ, গায়ে প্রভূত লোম থাকায় সবাই তাকে ব্যঙ্গ করে জাম্ববান বলে ডাকত।

কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং- এই যদি বাঙালির বিশ্বাস, তবে কৃষ্ণকে বাল্যে ননীচোর, কৈশোরে পারদারিক, পরিণত বয়সে বঞ্চক ও শঠ- এমন ভাবনায় কী পাপস্রোত বৃদ্ধি পায় না? পুরাণ-ইতিহাস আলোচনা করে দেখেছি, কৃষ্ণসম্বন্ধীয় যে-সব পাপ-উপাখ্যান জনসমাজে প্রচলিত- সবই অমূলক কুনাট্য ছাড়া কিছু নয়। এসব বাদ দিলে বাকি যা থাকে, তা অতি বিশুদ্ধ, পরম পবিত্র, অতিশয় মহৎ। তাঁর মত সর্বগুণান্বিত, সর্বপাপসংস্পর্শশূন্য আদর্শ চরিত্র আর কোথাও নেই। কোনও দেশীয় ইতিহাসে না, কোনও দেশীয় কাব্যেও না।

বৃন্দাবনে বসবাসকালে কৃষ্ণের রাসলীলা বা হল্লীষক্রীড়া বা বস্ত্রহরণ অথবা শ্রীরাধিকার সঙ্গে প্রেমলীলা নিতান্তই কবিকল্পনা। এইসব লীলাবিস্তার করে কৃষ্ণের মহিমান্বিত চরিত্রকে অযথা কলঙ্কিত করার চেষ্টা হয়েছে। কংসবধের কথাপ্রসঙ্গে তাঁর নিজের কথা থেকে মনে হয়, কংসবধের আগে থেকেই তিনি মথুরায় বাস করতেন। ভাবুন একবার, যদি বৃন্দাবনেই না গিয়ে থাকেন, তাহলে বৃন্দাবনলীলা আসে কোথা থেকে? আসুন, পুরুষোত্তম কৃষ্ণ সম্পর্কে সবধরনের অপপ্রচার বন্ধ করি।

[বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র-এর আলোকে]