You are currently viewing মনিজা রহমান এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে : অনবদ্য দৃশ্য মধুরতা  পাঠপর্যালোচনাঃ এমরান হাসান

মনিজা রহমান এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে : অনবদ্য দৃশ্য মধুরতা পাঠপর্যালোচনাঃ এমরান হাসান

মনিজা রহমান

এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে :অনবদ্য দৃশ্য মধুরতা

পাঠপর্যালোচনাঃ এমরান হাসান

বিশ্ব সাহিত্যের উঠোনে বাংলাদেশ তথা বাংলা ছোটগল্প একদিকে যেমন নতুন আবহ নিয়ে হাজির সবসময় তেমনি, অপরদিকে তেমনি চির ঐতিহ্যিক এক মায়াবী আবহ ছড়িয়ে আপ্লুত করে মেধাস্বত্ত্বের মন ও মনন। ইতালীয় সাহিত্যে যেমন বহুল আলোচিত Gesta Romanorum, ইংরেজি সাহিত্যে যেমন বাইবেল, সংস্কৃতে বিষ্ণুশর্মার ‘হিতোপদেশ’ ও ‘পঞ্চতন্ত্র’, বৌদ্ধসাহিত্যের ‘জাতকের গল্প’ ইত্যাদি গল্পসাহিত্যে ছোটগল্পের চিরন্তন একই মনস্তাত্বিক আবেদনেরই সাক্ষ্য বহন করে।অস্বীকার করার পথ নেই যে, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ নতুন সৃষ্টি ছোটগল্প এবং তা পুরোনোসময়ের গল্পের মতো এরা যথেচ্ছবিহারী, প্রগলভ ও নিরুদ্দেশপন্থী নয়।আধুনিক গল্পলেখক বিষয়বস্তু, চরিত্র সৃষ্টি, কথোপকথন, পরিবেশ সৃষ্টি প্রভৃতি প্রত্যেকটি বিষয় সম্বন্ধে একান্তভাবে আত্মসচেতন। এমনই একজন গল্পকার মনিজা রহমান স্বতন্ত্র লেখকসত্ত্বার প্রমাণ দিতে সচেষ্ট হয়েছেন তার ছোটগল্প গ্রন্থ ‘এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’র গল্পগুলোতে।এই গ্রন্থে সূচিবদ্ধ- ‘বিয়েবাড়ির রোস্ট, সাদা রঙ পরলে সাবধানে থাকতে হয়! হারামজাদা, আইফোন ফোর অথবা ফোরটিন যুগের প্রেম, অবৈধ জীবনের কান্না, ধার করা খালাম্মা, স্পার্ম ডোনার আকাশে সূর্য নেই, আকাশ অন্ধকার, গলাকাটা পাসপোর্ট, বিড়ালের লোম, সেই রাতে গল্প আমার ওপরে ভর করেছিল, ফুটপাতের কয়েকজন বৃদ্ধ, এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে, শরীর নক্ষত্রময়.নিখোঁজ মেঘবিক্রেতা- এই পনেরটি গল্পের আলাদা মেজাজ এবং বৈচিত্রমুখী প্রেক্ষাপট বিভিন্ন ভাবে উঠে এসেছে যা তার লেখনীর এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনার প্রকাশের পরিচয় বহন করে। সূচিবদ্ধ পনেরটি গল্পের মধ্যে—বিয়ে বাড়ির রোস্ট, স্পার্ম ডোনার, গলাকাটা পাসপোর্ট, শরীর নক্ষত্রময়, নিখোঁজ মেঘবিক্রেতা একেবারেই আলাদা স্বরের অর্ন্তনিহিত বোধের মিথস্ক্রিয়ায় তৈরি।অনান্য লেখাগুলোয় তিনি সচেতনভাবেই প্রতিবেদনমুখী ভাষার ভাবধারা প্রকাশের চেষ্টা করেছেন যা স্বাভাবিক গদ্যভাষাকে পাঠকচিন্তার কাছাকাছি পৌঁছে দিতে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। মনিজা রহমানের ছোটগল্পের বিষয নির্নয় কৌশল এবং রুচি চমৎকার।  তিনি তার রচিত ছোটগল্পে ব্যতিক্রম দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন বিষয়বস্তু নির্বাচনের দিক থেকে।  তার ছোটগল্পের ভাবদৃষ্টি নয়, বাস্তবদৃষ্টিই গল্পের ভূষণরূপে পরিগণিত হয়েছে এবং মানুষ অপেক্ষা মানুষের সমাজ, যাপিত জীবনই লেখকের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। এরকম সুন্দরের পথেই হেঁটেছেন মনিজা রহমান।  আধুনিক জীবন ব্যবস্থার নানামুখী সমস্যাও ফুটে উঠেছে তার এই গ্রন্থের প্রায় সবগুলো ছোটগল্পে। বাংলাদেশের গল্পসাহিত্য নানাদিক থেকে বৈচিত্র্যময়। এই পথেই হেঁটেছেন গল্পকার মনিজা রহমান। তিনি স্পষ্ট করেছেন তার বক্তব্য এই গ্রন্থের ভূমিকায়-
‘সন্দিগ্ধ মানুষ অসহিষ্ণু কালের বেড়াজালে বৃত্তাবদ্ধ হলেও সময়ের অভিঘাত তার পরিবর্তনকে রোধ করতে পারে না। অস্তিত্ববাদী চেতনা তাকে ভেঙেচুরে নিরব বিবর্তনের ফল্গুধারায় প্রবহমান রাখে। স্বীকার করতে হবে, বাস্তবতার প্রতিকূলতায় কালিক ও স্থানিক বোধকে অভিযোজন করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর নাম ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’।
নতুন দেশে, নতুন সংস্কৃতির আর্দ্রতায়, অন্য মানচিত্রে, বিচিত্র মানুষের জীবনযাপনের সাথে নিজের গতিকে মিলিয়ে নিতে সচেতন বা অবচেতনভাবে যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়, সেই সংগ্রামমুখরতা সকলেই দেখতে পায় না। দেখতে পায় সমাজ পর্যবেক্ষক এবং শিল্পী…’

প্রথম গল্প-‘বিয়েবাড়ির রোস্ট’।এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রবিউল এক অদ্ভুত মানুষের আইকন হয়ে পাঠকের সামনে এসেছে।সে ছোটবেলায় বাবার সাথে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পণ করে নিজেকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাবে যেখানে সবাই তাকে বিয়ের দাওয়াত দেবে। গল্পের শেষ দিকে সে তার বাবাকে এই কথাই বলে দেয় সরাসরি-
‘মনে থাকতো নাইনি বাবা।এ খতা আমার দিনে দুই বার মনে । ওইদিন যদি কোস্টার থাকি আরো কাউকে নামায়া দিতো আমার এতো খারাপ লাগলো নানে।কিন্তু খালি আমারে নামায়া দিল।ওইদিন আমার ইগোত বড় লাগা লাগছে বাবা। তখন আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম, আল্লাহ আমারে এমন মানুষ বানাও, যেন সবে আমারে খালি বিয়াত দাওয়াত দেয়।’
এই ধরণের গল্পের বিষয় ভাবনা বর্তমান বাংলাদেশের ছোটগল্পে একেবারে অভিনব না হলেও ব্যতিক্রম। অনেকেই মনে করতেই পারেন ‘এই ছোট্ট বিষয় নিয়ে গল্প!’ সত্যি এটিই যে, কোন একটি ছোট্ট বিষয় নিয়েই লেখক লিখতে পারেন, তৈরি হতে পারে বৃহৎ কোন সাহিত্য। ‘সাদা রঙ পরলে সাবধানে থাকতে হয়!’ একটি মনস্তাত্ত্বিক বোধের গল্প ।  এই গল্পের পরতে পরতে পাঠক মেলাতে পারেন আত্মবোধের অন্তর্মুখী চিন্তাকে।এই গল্পের প্লট স্বাভাবিক মনে হলেও বস্তুত একটু বেশিই জটিল। এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ইচ্ছে করলে তিনি সরাসরিই বলে ফেলতে পারতেন তার কথাগুলো কিন্তু তিনি সেটি না করে সরে এসেছেন বলয় থেকে‌। তার পৃথক চিন্তার প্রকাশভঙ্গির কারণেই অনন্য হয়ে উঠেছে এই গল্প সহ হারামজাদা, আইফোন ফোর অথবা ফোরটিন মুখের প্রেম, অবৈধ জীবনের কান্না, ধার করা খালাম্মা, স্পার্ম ডোনার, শিরোনামের গল্পগুলো। এক সুবিশাল ভাবনার মঞ্চ তৈরি করতে পেরেছেন মনিজা রহমান তার ছোটগল্পের এই গ্রন্থে। তার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক একপেশে নয় বরং এক ঐশ্বরিক আলোকচ্ছটায় পরিপূর্ণ। তিনি যেদিকেই চোখ মেলেছেন সেদিকেই তৈরি হয়েছে আশ্চর্য সব কথার মায়াজাল যা পাঠকের মগজকে সহজেই চির তীব্র কিছু মুহূর্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে সহজেই।

সাহিত্যের অত্যাচার্য সাহিত্য মাধ্যম ছোটগল্প। কেবলমাত্র সুক্ষ্ম একটা বোধ কী করে ছোটগল্প হয়ে ওঠে? ছোটগল্প লিখতে এমন এক শক্তির প্রয়োজন হয় যার ভেতর দিয়ে লেখকের কোনো পর্যবেক্ষণ, অনুভব একটি আকার পায়। কখনো সেটা একটা পরিসমাপ্তি লাভ করে, কখনো এর অভিমুখ মুক্তই থেকে যায়। অর্থাৎ অসমাপ্তই রয়ে যায়। এরকম বোধ থেকেই মনিজা রহমান তার স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গির ধারা তৈরি করেছেন তার লেখায়। তার লেখা গল্পগুলো যেমন সাবলীল ঘরানার তেমনি সমকালীন সময়কে ধারণ করে তৈরি হওয়া এক নান্দনিক উপাখ্যান।’অবৈধ জীবনের কান্না’ শীর্ষক গল্পের কার্লোস এক অসাধারণ চরিত্র।মনিজা তাকে উপস্থিত করেছেন ব্যতিক্রমী আবহের ভেতর দিয়ে। আবার প্রবাসে জীবনযাপন করার কারণে প্রবাস জীবনের দৃশ্যপট ভর করেছিল মনিজা রহমানের গল্পে । তার এই গ্রন্থের সূচিবদ্ধ গল্পগুলো পড়লে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় চোখের সামনে।

ছোটগল্প আকারে ছোট বলেই যে এতে জীবনের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা থাকতে পারে না—এমন ধারণা অমূলক । এই মন্তব্যের অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে বাংলাদেশ ও বিশ্বসাহিত্যের আনাচে কানাচে। বস্তুত যাপিত জীবনের খণ্ডাংশগুলোকে লেখক যখন তার আপন রসনিবিড় করে ফোটাতে পারেন তখনই এর সার্থকতা। জীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত কোনো বিশেষ পরিবেশের মধ্য দিয়ে কেমনভাবে লেখকের কাছে প্রত্যক্ষ হয়েছে এটা তারই রূপায়ণ। এতে অনাবশ্যক কথা, অনাবশ্যক ভাষা, অনাবশ্যক চরিত্র ও ঘটনা প্রভৃতিকে বর্জন করে লেখক শুধু একটি রসঘন নিবিড় মুহূর্তের পরিস্ফুটন ঘটান—এমন ভাবনাও অবান্তর। ছোটগল্পের আরম্ভ ও উপসংহার নাটকীয় হয়ে থাকে। কোথায় আরম্ভ হবে এবং কোথায় সমাপ্তির রেখা টানতে হবে এ শিল্পদৃষ্টি যার নেই তার পক্ষে ছোটগল্প লেখা অসম্ভব। ছোটগল্পে ইঙ্গিত-মধুরতা আছে।অথচ এ ক্ষুদ্র কলেবরের মধ্যে নিগূঢ় সত্যের ব্যঞ্জনাই এর সার্থকতা। ছোটগল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ একপ্রকার শিল্পসমষ্টি। এর পৌর্বাপর্ব কোন গৌরব জ্ঞনেই, এটি জীবনের খণ্ডাংশের মহিমাজ্জ্বল কান্তি।  তবে উপন্যাসের মতো এখানেও বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা হতে পারে, কিন্তু সংযত ও ছোট পরিধির মধ্যে। উপন্যাস যেখানে পাঠককে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়, ছোটগল্প সেখানে তাকে বোঝার অবকাশ দেয়। এ কারণে যারা আত্মভাবপরায়ণ তাদের ছোট’গল্প রসনিবিড় হয়ে ওঠে। মনিজা রহমানের সাহিত্য সাধনা এইপেথেইে এগুচ্ছে ধীরে ধীরে। তিনি তার ছোটগল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচনে বেশ মনযোগী কিন্তুমনিজা রহমান তার ছোটগল্পগুলোর প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে সরাসরি বলে দেয়ার পথকে এড়িয়ে যেতে পারেননি, যে কারণেই তার এই গল্পগ্রন্থের সূচিবদ্ধ প্রতিটি গল্পের ভাষায় একধরণের তথাকথিত সাধারণ্যের ছাপ রেখে গেছেন অজান্তেই, এই বিষয়টিতে তার গভীর মনোনিবেশ জরুরি। একজন লেখককে (তিনি হতে পারেন গল্পকার কিংবা কবি) তাকে হতে হয় অনন্য সাধারণ ভাষীক দ্যোতনার কারিগর। গল্পের বিষয়বস্তু, ভাষাশৈলীর নিখাদ বুননে লেখক তার সমকালকে ছাড়িয়ে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। মনিজা রহমানের গল্পের নান্দনিকতায় এই প্রকাশভঙ্গি বাঁধা পাচ্ছে সহসাই, তিনি তার লেখনীতে যেমন নিবেদিত তেমনি বিষয়বস্তু বেছে নেয়ার বিষয়েও পারদর্শীতা দেখিয়েছেন এটি প্রশংসার দাবী রাখে। সেই সাথে তার প্রকাশভঙ্গি প্রতিবেদনমুখী না হয়ে শিল্পমুখী হয়ে উঠলে তার লেখার আড়ালে লুকোনো মনোভাব খুব সহজেই আরো বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে ধরা পড়বে পাঠকের চিন্তায়, কেননা শেষব্দি যে কোন সাহিত্যকর্মেরই সবিশেষ বিচারক পাঠক এবং মহাকাল।

বাংলাদেশ তথা বাংলাসাহিত্যের ছোটগল্প বিনির্মাণের কলাকৌশল বিশ্লেষণ করলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় লেখক ছোটগল্পের আঙ্গিক, কলাকৌশলকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গল্প উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হন, যে কারণেই লেখক ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত ও সংযত রস-গাঢ়তার সাথে উপন্যাসের লক্ষণ সংযোজিত করে আখ্যানবস্তু বা চরিত্রের বিকাশ সাধনের পথে যাত্রা শুরু করেন। ছোটগল্পের আকার ছোট হতেই হবে এই শর্ত অনেকেই গ্রহণ করেন না, করেননি মনিজা রহমানও।যেখানে তিনি ছোটগল্পের ইতি টানতে চাইবেন, সেখানেই মূলত ছোটগল্প আকার পাবে।ছোটগল্প কী অগণিত শব্দে লেখা হতে পারে? বা উপন্যাসের মতো এর অসংখ্য কেন্দ্র তৈরি করতে পারে না? তা নিশ্চয়ই নয়। এই বিষয়টি কিছুটা হলেও সমর্থন করেছেন মনিজা রহমান তার এই গ্রন্থের সূচিবদ্ধ গল্পগুলোতে। এখানেই তার ছোটগল্পের একটি ব্যতিক্রমী দিক।

বাংলাসাহিত্যের বিস্মৃত এবং বিস্ময়কর সাহিত্যপরিসর, বৈচিত্রপূর্ণ জীবনযাত্রার সাথে ছোটগল্পের একটি স্বাভাবিক সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য চোখে পড়ে। এখানকার জীবনের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে গল্পের বিষয়েও বৈচিত্র্য এসেছে। এই বিষয়গুলো মনিজা রহমান নিয়ে এসেছেন তার ছোটগল্পগ্রন্থ এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’র সবগুলো গল্পে।আধুনিক যুগের মানুষের জীবনযাপনের আড়ালে নয় বরং জীবন ঘনিষ্ঠ কিছু জলজ্যান্ত উপমা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন তার এই গ্রন্থে।মানুষের জীবনের মানবসম্পর্ক এবং মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কে খতিয়ে দেখার কাজটি করার চেষ্টা করেছেন মনিজা রহমান তার ছোটগল্পের গ্রন্থ এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’র অধিকাংশ গল্পে।  একজন দায়িত্ববান গল্পকারের দায় মোটেও ছোট নয় এবং সেই দায় বহন করা খুব সহজসাধ্য বিষয়ও নয়। সাহিত্যের ইতিহাসের পরম্পরায় ছোটগল্পের ধরন ও ধারণায় তিনি স্নাত হয়ে তৈরি করবেন এমন এক পথ যা তার নিজস্ব, কিন্তু নিজস্ব হয়েও তিনি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারবেন তার গল্পের বীজ, যে বীজ তিনি সংগ্রহ করে তার নিজের মনের জমিতে পুঁতে জন্ম দিয়েছিলেন গল্পবৃক্ষ, সেই বৃক্ষ থেকে ফের ফল থেকে তৈরি হবে যে বীজ- পাঠক তা গ্রহণ করে নিজের মনোভূমি তৈরি করবেন জীবনকে দেখার বোঝার বোধ করার চোখ। এই দেখতে পাওয়ার ভেতর দিয়েই ছোটগল্পকার পাবেন তার দেখানোর সার্থকতা।  এমন কাজ করার সাধনাতেই ব্রত হয়েছেন মনিজা রহমান, সেটি তার ছোটগল্পের গ্রন্থ থেকে সহজেই অনুমেয়।যদিও তার ছোটগল্পের ভাষার গতিময়তা আনকোড়া। বিষয়টি আরো খোলাসা করলে বলা যায়, তিনি তার গল্পের ভাষাকে পরিপুষ্ট করে তুলতে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।মনিজা রহমানের ছোটগল্প নিবিড় ভাবে পাঠ করলে বোঝা যায় গল্পের ভাষায় এক ধরনের অনিচ্ছুক বক্রতা উপস্থিত হয়েছে যা কিনা সত্যিকার অর্থেই একজন সচেতন লেখক কখনোই কাম্য করেন না।এই বক্রতাটুকু এড়িয়ে যেতে পারলেই গল্পের ভাব-চিন্তা-বার্তা এবং ভাষা এক অনবদ্য অবস্থানে গিয়ে পৌঁছুবে এ বিশ্বাস খুব সহজেই রাখা যায় । মনিজা তার গল্পগ্রন্থে চেষ্টা করেছেন স্বতন্ত্র এক ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করার এবং এই কাজটিতে তিনি সাবলীলতার আশ্রয় না নিয়ে টুকরো এবং ভগ্নাংশ মূলক বোধের আশ্রয় নিয়েছেন যে বিষয়টি তার গল্প রচনার গতিময়তাকে শ্লথ করেছে। বিষয় প্রকরণের দিক থেকে তার ছোটগল্পের একটা স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি হবে ধীরে ধীরে এই কথা খুব সরাসরি বলে ফেলা যায়, কিন্তু ভাষার মাধ্যমে সেই ভাবনা প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হলে লেখকের মুন্সিয়ানা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং এটিই স্বাভাবিক।ছোটগল্প তথা বাংলা ছোটগল্পের চিরায়ত নিজস্ব শরীর, অবয়ব, প্রকাশশৈলী রয়েছে যাকে বহির্বিশ্বের ছোটগল্পের সাথে মিলানো একেবারেই বোকামি এবং বহির্বিশ্বের ছোটগল্পের সাথে বাংলা ভাষা তথা বাংলাদেশের ছোটগল্পকে শিল্পবোধের জায়গা থেকে এক কাতারে দাঁড় করানোর চেষ্টা করাটাও নিতান্ত অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।এজন্যই একজন বাংলা ভাষাভাষীর লেখক এর উচিত সবসময় প্রথমেই তার কাজের লক্ষ্য স্থির করে নেয়া যে তিনি কোন কাজটি করবেন এবং কোন কাজটি বর্জন করবেন। যদি তিনি বিদেশী ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন তাহলে তার চিন্তা একভাবে তৈরি হবে আবার যদি তিনি বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে বিদেশি সংস্কৃতি এবং বাঙালি সংস্কৃতি একসাথে মিশিয়ে গল্প রচনা করতে চান সেটির ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হবে তো অবশ্যই। মনিজা রহমান বোধকরি এই গ্রন্থের গল্পগুলোয় দ্বিতীয় চেষ্টাটিই করে গেছেন। তার গল্পগ্রন্থের অধিকাংশ গল্পে এমন কিছু ভাবধারা চোখে পড়ে যাতে করে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কী সেই বার্তা? সেই বিষয়টি খুব বেশি স্পষ্ট হয়নি ঐই গ্রন্থের গল্পগুলোর ভেতরে। এই অস্পষ্টতার জন্য অনেকটাই দায়ী তার গল্পভাষা। বোধকরি এই বিষয়টি উঠতে যেতে পারলেই তিনি সার্থক ছোটগল্প রচনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবেন খুব সহজেই।মনিজা রহমানের ছোটগল্পের বোধ ও প্লট নিঃসন্দেহে অনেকটাই ব্যতিক্রম, এ মন্তব্য খুব সহজে করা যায় তার গল্পগুলো পড়ে।বর্তমান সময়ের বাংলাভাষী ছোটগল্পের আঙিনায় মনিজা রহমানের এই ছোটগল্পগ্রন্থ এক নতুন চিহ্ন হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা সর্বসময়ের।

    মনিজা রহমান

=====================