You are currently viewing পিপুফিশু , কিস্তি- ২ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু , কিস্তি- ২ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু

আলী সিদ্দিকী

দাও বাড়িয়ে হাত

দূপুর না গড়াতেই এমন তুষারপাত শুরু হলো যে আমি গ্রোসারী স্টোর থেকে বেরিয়ে দশ মিনিটের বাসার রাস্তায় প্রায় দু’ঘন্টা লাগিয়ে দিলাম। লালচে আকাশ বেদমভাবে পেঁজা পেঁজা বরফ উগরে দেয়ার সাথে সাথে পিচ্ছিল বরফখন্ড ঝরাচ্ছে। আর তাতে গাড়ীগুলো স্পীড তূললেই স্লাইড করে হড়কে যাচ্ছে। বরফে আচ্ছাদিত হয়ে গেছে চরাচর। আকাশ ভীষণ রক্তাভ হয়ে উঠেছে। ঝুর ঝুর করে অবিরাম পড়ে চলেছে বরফ। সাথে সোঁ সোঁ শব্দে ডালপালাহীন গাছগুলোয় আছড়ে পড়ছে রাগী বাতাস। দূপুর আড়াইটাতে মনে হচ্ছে রাত এগিয়ে আসছে দ্রুত। রেডিওতে বার বার হেভী বরফ পড়ার কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। এই হারে বরফ পড়লে কাল যে পাহাড় ঠেলে পনের মাইল দূরে গিয়ে কিভাবে কাজে জয়েন করবো কে জানে। অবশ্য যতই বরফ পড়ুক না কেন তা থেমে আসার সাথে সাথে স্নো প্লাউয়াররা (Snow Plough) গাড়ী নিয়ে নেমে পড়ে। যতো দুর্যোগই হোক না কেন, মানুষের গতিরোধ করা যাবে না। সকাল হতে না হতেই মানুষজন গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়ে হুড়মুড় করে। কালও তার ব্যতয় ঘটবে না আশা করি।
রেডিওতে স্টর্ম এ্যালার্ট ঘোষণা করা হচ্ছে। ভার্জিনিয়া আর নর্থ ক্যারোলিনা অঞ্চলে স্টেট ইমার্জেন্সী ঘোষণা করা হয়েছে। দেলুয়ার ভ্যালীতে দুই ফুটের বেশী বরফ পড়ার কথা বলা হচ্ছে। আরো জানানো হচ্ছে, এক্সপ্রেস ওয়েতে অনেক গাড়ী দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে। নিউজার্সীতে দুর্ঘটনায় দু’জন চালক মারা গেছে। ইন্টারস্টেট নাইনটি ফাইভ সাউথে হাজার হাজার গাড়ী আটকে পড়েছে সীমাহীন জ্যামে। গত ক’বছর ধরে দেখছি, এদেশেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে পড়তে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে। যদিও এখানকার রিকভারী সিস্টেম খুবই উন্নত আর ত্বরিত হয় সবকিছু।
সামনে দেখতে পাচ্ছি রাস্তায় শ্নো-সল্ট ছিটানো হচ্ছে গাড়ী থেকে। আমি লবণগাড়ীর পাছ কেটে বাসার দিকে চলে এলাম। আমাদের বিশাল এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের মুখে ইতিমধ্যে জমে গেছে বরফের বিরাট স্তুপ। গাড়ী নিয়ে ঢোকা মুশকিল। অনেক কসরত করার পর কোন রকমে গাড়ী পার্ক করে গ্রোসারীর ব্যাগ হাতে একপ্রকার ছুট লাগালাম। জ্যাকেটের হুড অন করার আগেই কনকনে ঠান্ডায় একদম কাবু হয়ে গেলাম। বাতাসের তোড় থেকে নিজেকে আর হাতের ব্যাগ সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তীব্র হুইসেল বাজিয়ে প্রচন্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়া বাতাস বড্ড বেপরোয়া। কোন রকমে এপার্টমেন্টের সামনে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সশব্দে পা ঝেড়ে দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যাবো এ সময় কে যেন নাম ধরে ডাক দিলো। কিন্তু বাতাসের গর্জনে সে ডাকটা যেন ডুবে গেলো। বিভ্রম মনে করে আমি ভেতরে চলে এলাম। কিন্তু এবার স্পষ্ট শুনতে পেলাম কে যেন নাম ধরে ডাকছে আমাকে। ডাকটা কোন বিজাতীয় কন্ঠের।
হেই ম্যান, হেই আতিক, কাম অন, হেল্প মি – ।
গলাটা চেনা আবার অচেনা মনে হলো। হাতের ব্যাগগুলো দ্রুত সামলে রেখে আমি বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।
আতিক, প্লিজ কাম ওভার হিয়ার – ।
আমার ঘরের সামনের মাঠ পেরিয়ে জি বিল্ডিং। দেখলাম তার সামনে দাঁড়িয়ে জন অরসিনি আমাকে ডাকছে। সে দু’হাতে বরফে চাপা পড়া এক লোককে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। আর মিসেস রুথ বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার কিচকিচে গলায় বকবক করছে। লোকটাকে মনে হলো রুথের হ্যাজবেন্ড স্যাম। বেচারা ! এমনিতেই তার দশাসই শরীরটা নিয়ে চলতে পারে না, তার মধ্যে আটকে পড়েছে বরফের পাহাড়ে! ওকে টেনে তোলা ভীষণ কঠিন কাজ। তবে হেল্প তো করতেই হয়। কিন্তু অরসিনি এখানে কি করছে? ও তো পোটসটাউনে চলে যাবার কথা?
যাহোক অনেক কষ্টে রাস্তা ঘুরে আমি জি বিল্ডিংয়ের সামনে এলাম।
হাই আতিক, মিসেস রুথ ব্যাজার মুখে বললেন, দেখো না বুড়োর কান্ড!
মি. স্যাম তার কষ্ট লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন।
মাই আন্ট এন্ড আন্টি – চোখাচোখি হতেই অরসিনি পরিচয় দিলো ঝট করে, আমি মাঝে মধ্যে আসি এখানে, অবশ্য কখনো তোমাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যাহোক, এখন ওকে বের করো। বেচারা বরফে জমে যাচ্ছে।
দু’জনে বেশ কসরত করে স্যামকে টেনে তুলে ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম। মিসেস রুথ স্যামের জ্যাকেট খুলে হ্যাঙ্গারে ঝোলালো, তারপর স্যামকে নিয়ে গজ গজ করতে করতে চলে গেলো ভেতরে।
থ্যাঙ্ক ইউ আতিক, যেতে যেতে ঘাড় ফেরালেন মি. স্যাম, এসো ভেতরে এসো।
ইউ ওয়েলকাম, আমি হাসিমুখে বললাম।
জন নিজের জ্যাকেট দু’হাতে ঝেড়ে নিয়ে সপ্রতিভ হাসে, কফি চলবে তো?
আপত্তি নেই, আমি সোফায় বসে সিএনএন অন করে দিলাম।
ইচ্ছে হলে বিয়ার নিতে পারো- জন হেঁটে ফ্রিজের দিকে গেলো। দরোজা খুলে উঁকি দিলো ভেতরে।
ব্ল্যাক এন্ড ট্যান আছে, নেবে?
নাও।
দু’টো বিয়ার আর চিপসের প্যাকেট নিয়ে জন এসে সোফায় বসলো। পা দু’টো টি টেবিলে তুলে গা ডুবিয়ে বসে জন। বিয়ারটায় চুমুক দিয়ে আমি হাত বাড়িয়ে চিপস নিলাম। একা একা জীবন কাটাচ্ছি গত পাঁচটি বছর। সম্পূর্ণ বিজাতীয় পরিবেশে। কাজ আর নিঃসঙ্গতাই হলো এখানকার জীবন। বাংলাভাষী লোকজন যে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু কারো সাথে তেমন এডজাষ্ট করতে পারি না। তাই নিজের মধ্যে মগ্ন থাকি। কাজ, বাসা, টিভি, ঘুম, লন্ড্রী, বিয়ার আর সিগারেটই হলো আমার যাপিত জীবনের মৌলিক উপকরণ। বিয়ারের মধ্যে ব্ল্যাক এন্ড ট্যান, ল্যাগার, হ্যানিকেন, বাডলাইট আমার প্রিয়। তাই জনের হাত থেকে বিয়ারটা নিয়েই চুমুক দিয়ে দিলাম। তা দেখে জন হাসলো।
বোঝা যাচ্ছে বিয়ারে তুমি অভ্যস্ত-।
মোটামুটি।
একদিনেই আমাদের দু’বার দেখা হলো, ব্যাপারটা বেশ মজার, তাই না আতিক? একটু খুশীমাখা গলায় বললো জন।
কাকতালীয় বলতে পারো-।
তা ঠিক, জন একটু সোজা হয়ে বসলো, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবো?
করতে যখন চাইছো, করো, আমি সায় দিলাম।
আই য়্যাম সিঙ্গেল, আর য়্যু?
মি টু।
কিন্তু আমি জানি এখানে সিঙ্গেল মম আর ড্যাডের ছড়াছড়ি। ওরা কিছুদিন একজনের সাথে থাকে স্বামী স্ত্রীর মতো, ছেলেমেয়েও নেয় আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে সিঙ্গেলে পরিণত হয়। পরে আবার নতুন বন্ধুর সাথে নতুনভাবে জীবন যাপন শুরু করলেও আগের ছেলেমেয়েদের দায়িত্বও বর্তায় বাবা মা’র ওপর। জনেরও ছেলেমেয়ে আছে কিনা প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলাম। ভাবলাম, কি দরকার এতো জেনে। একদিনেরই তো পরিচয়। গত পাঁচ বছরে এমন পরিচয় তো কতোজনের সাথে হয়েছে, আবার সময়ের স্রোতে তা ভেসেও গেছে। জন কি আর ব্যতিক্রম হবে?
দেখো, দেখো আতিক- সিএনএন এখন জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের লাইভ কভারেজ দেখাচ্ছে, জন আমাকে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। দেখা গেলো ফরেন সেক্রেটারী কলিন পাওয়েল পরিষদের সদস্যদের একটা ছোট্ট টিউব দেখিয়ে বলছেন, ইরাকের কাছে যে ডব্লিউএমডি ( উইপন্স অব মাস ডেস্ট্রাকশন) আছে তার সচিত্র প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করেছি। আর সাদ্দাম যেহেতু এসব বিপজ্জনক মারণাস্ত্র ধ্বংস না করে মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে তখন তাকে ধ্বংস করা ছাড়া সভ্য জগতের বিকল্প কোন পথ নেই। এখন আপনাদের আহবান জানাই, আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে বিশ্বকে সন্ত্রাসী হুমকি থেকে মুক্ত করি।
তোমার কি মনে হয় সাদ্দামের কাছে ডব্লিউএমডি আছে? জন টিভির ভলিউম কমিয়ে আমার দিকে তাকায়।
হ্যান্স ব্লিক্স কি বলেছেন এ ব্যাপারে? তিনি তো এক্ষুণি ইরাকেই আছেন। তিনি কি কোন বাস্তব প্রমাণ পেয়েছেন? আমি প্রশ্ন করি।
আসলে এ মুহূর্তে আমি কনফিউজড আতিক, চিন্তিতভাবে বলে জন, তবে এটা আমি জানি আমাদের লীডাররা শত্রুদের সাথেই ঘুমুচ্ছে। তুমি দেখো, সেপ্টেম্বরের হামলাকারীদের প্রায় সবাই হলো সৌদি। হামলার পর পর দেশের সকল বিমানবন্দর বন্ধ করা হলেও সৌদিদের নির্বিঘ্নে আমেরিকা ত্যাগ করতে দেয়া হলো বিশেষ তত্ত্বাবধানে। সৌদিকে কিছু না করে আমরা কেন ইরাককে নিয়ে পড়লাম? কারণ সৌদিদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এদেশের বড়ো বড়ো কর্পোরেটগুলোতে ইনভেস্ট করা আছে। আর সেগুলো চালায় এদেশের জায়ান্টরা, বুশ পরিবার তাদের মধ্যে অন্যতম। তারা সৌদিকে আঘাত করলে নিজেদের পায়েই কুঠরাঘাত করা হবে। তাই সবচে’ শক্তিহীন সাদ্দামকে আঘাত করলে নিজেদের তেমন ক্ষতি হবেই না বরং ইরাকী তেল সম্পদ হাতিয়ে যেমন নেয়া যাবে তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ীভাবে আধিপত্য বজায় রাখা যাবে।
তোমার কথা হয়তো ঠিক, আমি বিয়ারে শেষ চুমুক দিয়ে বোতলটা ট্র্যাশক্যানে (Trash Cane) ফেলে সোফার হাতলে এসে বসলাম। আসলে এ মুহূর্তে আমার ধুমপান করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাছাড়া ঘরে ফেরাও দরকার। রান্না করতে হবে। কথা সংক্ষিপ্ত করার জন্যে আমি বললাম, যুদ্ধ করতে হলে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানেই করা উচিত। কিন্তু মনে হচ্ছে জাতিসঙ্ঘের এখন কানাকড়িও মূল্য নেই।
কিন্তু যুদ্ধইতো সমাধান নয় আতিক, জন জোরালো কন্ঠে বললো, তুমি দেখছো না সারাবিশ্বে মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে কেমন সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আমেরিকার সচেতন মানুষও বসে নেই। সানডে চলো সেন্টার সিটিতে, দেখবে হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ হয়ে উঠেছে, যাবে?
সানডে কখন?
সকাল এগারোটায়।
আগে কাল চলো কাজে জয়েন করি, তারপর দেখা যাবে, আমি উঠে দাঁড়ালাম, এখন চলি- ।
যাবে? জন লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো, কাল আটটায় আমি এখান থেকেই যাবো।
ঠিক আছে আমি তোমাকে নক করবো।
তোমাকে ধন্যবাদ।
আজকের এ সময়ের জন্যে তোমাকেও ধন্যবাদ জন, গুডনাইট।

*****************************