You are currently viewing মার্সেল প্রুস্তের ‘হারানো সময়ের সন্ধানে’ স্মৃতির সুঁই-সুতোয় বোনা জীবনের নকশিকাঁথা >মুজিব রাহমান

মার্সেল প্রুস্তের ‘হারানো সময়ের সন্ধানে’ স্মৃতির সুঁই-সুতোয় বোনা জীবনের নকশিকাঁথা >মুজিব রাহমান

মার্সেল প্রুস্তের ‘হারানো সময়ের সন্ধানে’ স্মৃতির সুঁই-সুতোয় বোনা জীবনের নকশিকাঁথা

মুজিব রাহমান

ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রুস্ত (জন্ম: জুলাই ১০, ১৮৭১ – মৃত্যু: নভেম্বর ১৮, ১৯২২) বিশ্বনন্দিত তাঁর সাত খণ্ডে রচিত আত্মজৈবনিক উপন্যাস A la recherche du temps perdu (১৯১৩-১৯২৭) -এর জন্যে। ইংরেজিতে অনূদিত শিরোনাম In Search of Lost Time যে উপন্যাসকে বাংলায় বলা যেতে পারে ‘হারানো সময়ের সন্ধানে’। মা-বাবার মৃত্যুর পর ১৯০৫ সাল থেকে প্যারিসীয় কেতাদুরস্ত ও সুরুচিসম্পন্ন প্রতিভাবান লেখক ও শিল্প-সাহিত্যের সমঝদার এই অভিজাত যুবক ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন ব্যস্ত পৃথিবী থেকে এবং বেশি বেশি সময় কাটাতে থাকলেন কর্ক-বিন্যস্ত কক্ষের শয্যায় – ১০২ বুলেভার হাউসম্যানের বাসায়। সে-সময় ঘোড়ায় টানা গাড়ি পাথর বসানো রাস্তায় যে বিকট শব্দ তুলতো তা তাঁর রাতভর কাজের ব্যাঘাত ঘটাতো সে-জন্যেই শশব্দহীন নিরিবিলিতে লেখালেখি করার জন্যে ঘরের দেয়াগুলোকে শব্দনিরোধক কর্কের আস্তরণে মুড়িয়ে নিয়েছিলেন তিনি। বাষ্পশোধিত জীবাণুমুক্ত ঘরের নরম বিছানায় সারাদিন ঘুমোতেন আর ইলেকট্রিকের আলো জ্বেলে রাতভর লিখতেন প্রুস্ত। কারণ এই সময়টাতে তাঁর সারা জীবনের শত্রু-মিত্র হাঁপানি বা অ্যাজমা রোগ তীব্র হয়ে উঠেছিল। তারপর থেকে জীবনের একটা দীর্ঘ পর্ব তিনি খুব একটা বাইরে বেরুতেন না। বেরুতেন রাতে। দূষণমুক্ত রাতের হাওয়ায় নিশ্বাস নেওয়া সহজতর ছিল তাঁর পক্ষে। এবং কখনো সূর্য দেখতে চাইলে সূর্য দেখতেন কাচের ভেতর দিয়ে। মার্সেল প্রুস্তের অ্যাজমা তাঁর প্রতিভার মিত্র ছিল বললে ভুল হবে না। এ-রোগ তাঁর জন্যে যে নির্জনতা ও অখণ্ড সময় এনে দিয়েছিল তার ফলে তিনি ১৯২২ সালে মৃত্যুর আগ অবধি তাঁর বিখ্যাত বিপুলায়তন উপন্যাসটির ১৬টি খণ্ড যা ‘আরব্য রজনী’র মতোই দীর্ঘ তা রচনা করে উঠতে পেরেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে স্কট মনক্রিফের ইংরেজি অনুবাদেও তা হয়ে আছে দারুণ মূলানুগ ও সমান উপভোগ্য। মার্সেল প্রুস্তের জীবনের সর্বাপেক্ষা সুখের সময় কেটেছে তাঁর শৈশবে – কঁব্রেতে। কঁব্রে ছিল তাঁর শৈশবের স্বর্গ। কঁব্রে তাঁর কাছে ছিল প্রগাঢ় প্রশান্তি ও নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তার ঠিকানা। এই কঁব্রেতে মাকে ঘিরে, পরিবারের প্রত্যেককে নিয়ে তাঁর স্মৃতি লতিয়ে উঠেছে এই উপন্যাসের পাতায় পাতায়। কিন্তু জীবনে কোনো কিছুই থিতু নয়। কোনো পর্বই স্থির নয়। ক্রম জাগ্রত যৌবন-যৌনতা-সুখ, শক্তি-অহমিকা-উচ্চাকাঙ্ক্ষা অন্য আবহ তৈরি করে। অজস্র পথে অবাধ হয়ে উঠে জীবনের অগ্রগমন। প্রুস্তিয় শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির চাবি হচ্ছে এ বিশ্ব ধী-শক্তি নির্মিত নয়, স্মৃতি নির্মিত। কাহিনির শুরুতেই প্যারিসের উঠতি বয়েসী এই বালক – উপন্যাসের কথক যাকে এক কাপ চা দেওয়া হয়েছিল, এবং সে চায়ে ডুবিয়ে ফরাসি মিষ্টি কেক মাদেলিন দু কামড় খেতে না খেতেই যাঁর ভেতরে নড়ে উঠেছিল অন্য এক স্মৃতি, অন্য এক আনন্দ। সে সচকিত হয়ে উঠেছিল তার স্মৃতির অন্তর্গত জাগৃতিতে। কতো কতো দিন আগে কঁব্রেতে থাকার সময় রোববার সকালে চার্চে যাওয়ার আগে যার সঙ্গে মার্সেল দেখা করতে যেতো সে-ই তো তখন তাকে শুকনো লেবু ফুলের লিকারে ভেজানো এই মাদেলিন কেকের টুকরো খেতে দিতে। এ ভাবেই স্মৃতি লতিয়ে ওঠে। এক স্মৃতির মিষ্টি সুতো এভাবে অতীতের আরেক স্মৃতির সঙ্গে এক অদৃশ্য অতিবাস্তব সংযোগ তৈরি করে দেয়। আর এ সংযোগ নিরন্তর যুক্ত করতে থাকে ঘটনার পরম্পরা, চলতে থাকে চেতন-অবচেতন প্রবাহ-প্রতিপ্রবাহে স্মৃতির অনিঃশেষ লোফালুফি। এই উপন্যাসের বিভিন্ন খণ্ডে, সময়ে নিমজ্জমান চরিত্রগুলোর মাঝে সোয়ান এবং ওদেত দে ক্রেসি, মঁসিয় দ্য চার্লাস, মরেল, ডাচেস অব গুয়েরমাঁতে, পরিচারিকা ফ্রাঁসোয়াজ, মার্সেল-আলবেরতিন, মাদাম সাঁ ল্যু এবং তাদের মতো আরও অনেক চরিত্র আছে। এই অজস্র চরিত্রের ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর দেখা পুরো সমাজকে তুলে আনেন নানা কাহিনির বেষ্টনে। রাগ-অনুরাগ প্রেম-কাম-সমকাম সব জড়াজড়ি করে আছে এই উপন্যাসে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া নারীর ক্ষেত্রে অন্য সব স্বাধীনতা কতোটা অসার এ-উপন্যাসে তা অনুপুঙ্খ চিত্রিত হয়ে আছে। মার্সেল প্রুস্ত সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, দার্শনিক বের্গসঁ-এর ছাত্র। আইন এবং দর্শনে স্নাতক। ছোটোবেলা থেকেই দুর্বল স্নায়ুতন্ত্রের কথা বিবেচনায় রেখে প্রুস্ত কর্মভারমুক্ত সময় কাটিয়েছেন। সখ্য গড়ে উঠেছে প্যারিসের অভিজাত-অনভিজাত প্রায় সকলের সঙ্গে। অভিজাতদের সান্ধ্য আসরে, পানশালায়। সকলের সঙ্গে প্রাণখোলা গল্পে সময় কাটতো প্রুস্তের। যৌনচেতনার উন্মেষকালে মানব-মানবীর ভ যে অতল প্রুস্তের রচনায় উদঘাটিত তা ফ্রয়েডের জন্মের আগে সম্ভব ছিলো না বলেই সমালোচকদের অভিমত। ফরাসি উপন্যাসের ঐতিহ্য যতটা না প্রুস্তের রচনাকর্মে অবদান রেখেছে তারচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে রাসিনের বিয়োগান্ত নাটক, বোদলেয়ারের কবিতা, এবং জন রাস্কিনের শিল্পসমালোচনা। খ্যাতকীর্তি সাহিত্য সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম প্রুস্ত বিষয়ক আলোচনায় প্রুস্তের শেক্সপিয়ার-ভক্ত মায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপনপূর্বক মন্তব্য করেছেন শেক্সপিয়রই প্রুস্তের গুরু। বিয়োগমিলনান্ত সাহিত্যকর্মে প্রুস্তের স্থান দ্বিতীয়। শেক্সপিয়রের পরের স্থানটিই তাঁর। মনস্তাত্ত্বিক ও রূপকাশ্রিত এ উপন্যাসে আমৃত্যু অ্যাজমা রোগী প্রুস্ত মানুষ যে কতটা প্রাহসনিক, কৌতুকপ্রদ ও মজার তা তুলে ধরেছেন অপূর্ব মুন্সিয়ানায়। প্রুস্ত তাঁর বর্ণনায় কোনো রায় প্রদান করেননি বরং যা যা দেখেছেন সে-সবের কাছেই নিজেকে সোপর্দ করেছেন। কোনো নৈতিক মূল্যবোধের প্রচার তিনি করেননি। তথাপি তাঁর অতীত অন্বিষ্ট এ বৃহদায়তন উপন্যাস জীবনকে যাবতীয় সংকীর্ণতার বিপরীতে আরও ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত বর্ণনায় অধিকতর বোঝাপড়ার আওতায় নিয়ে এসেছে। ভালোবাসার রকমফের নানান ঘটনার ভেতর দিয়ে এ উপন্যাসে বিধৃত। উপরি উপরি যা মনে হয় সবটা যে তা নয়, যে-সব দিয়ে সম্পর্ক তৈরি হয় বলা হয়ে থাকে সে-সবেও যে যথেষ্ট খামতি আছে এ-উপন্যাস পাঠে তা উপলব্ধি করা যায়। সম্ভবত কেবল দাদী এবং মায়েরা জানে সেই ভালোবাসার হদিস যা বৃথা দেমাগ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা কামার্ত আসঙ্গলিপ্সার হতাশাব্যঞ্জক মিশেল নয়। আদতে মানুষ যতটা ক্যালিবান ঠিক ততোটা প্রসপেরো নয়। 
আদতে মানুষ যতটা ক্যালিবান ঠিক ততোটা প্রসপেরো নয়। অথচ মানুষের যাপিত জীবনের সময়, পরিপার্শ্ব এবং স্বভাব এ-সবের বিবিধ বৈচিত্র্যে, বিস্ময়ে ও সৌন্দর্যে দারুণ জাদুময়। ‘হারানো সময়ের খোঁজে’ উপন্যাসে একদিকে যেমন ফেলে আসা সময়কে খোঁজার আদ্যোপান্ত বিবরণ আছে অন্যদিকে আবার সমাজ ও মানুষের যাপিত বাস্তবতাকেও খতিয়ে দেখা খতিয়ান প্রদর্শিত হয়েছে আলোচনায়, বিশ্লেষণে ও অনুপুঙ্খ স্মৃতি অনুসন্ধানে। মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে প্রুস্তের বিশ্বজনীনবোধ ও গভীর সচেতনতা এ কথা বলে দেয় যে প্রুস্তের প্রতিভা তলস্তয়ের মতই আদিম ও মৌলিক এবং শেক্সপিয়রের মতই প্রজ্ঞাদীপ্ত। প্রায় সাড়ে বারো লক্ষ শব্দে রচিত সাতটি সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংযুক্ততা তৈরি করেছে মার্সেল প্রুস্তের মহাকাব্যিক মহা-অন্বেষণের এই মহাসড়ক। স্কট মনক্রিপের কালজয়ী অনুবাদে আখ্যানকথকের আত্ম-আবিষ্কার-পরিক্রমা, তার কালের দিগন্তবিসারী, সমৃদ্ধ ও কৌতুকাবহ চিত্রময় বর্ণনা, শিল্প, ভালোবাসা, সময়, স্মৃতি এবং মৃত্যুর প্রকৃতি নিয়ে প্রগাঢ় ও গভীর অনুধ্যান সবই মূর্ত হয়ে আছে উপন্যাসের বিপুলায়তন ক্যানভাসে। উপরি উপরি ঐতিহ্যগত বিল্ডুংযরোমান( Bildungsroman) মনে হলেও In Search of Lost Time সেই চশমা যার ভেতর দিয়ে প্রত্যেকে নিজেকে পড়বার চিনবার একটা উপায় পেয়ে যায়, পথ পেয়ে যায়। মার্সেল ও আলবেরতিন উপাখ্যান জীবনের একটি তিক্ত সত্য ও অপ্রীতিকর দিকের উন্মোচন। একজন রমণীকে ভুল করে ভুল পথে কামনা করা, পাওয়ার পরে তাকে না চাওয়া, সে সরে গেলে অধিকার হারানোর মর্মযাতনায় দগ্ধ হওয়া এই অপ্রীতিকর চক্রে এই উপন্যাসের নানা প্রেমকাহিনী সতত ঘুরপাক খেয়েছে। তারপরও সম্পর্কের সৌন্দর্যই, শিল্পের প্রতি ভালোবাসাই বিদ্বেষ ও ধ্বসের বিপরীতে সবচেয়ে বড়ো সুরক্ষা। সাংঘর্ষিক সমূহ মূল্যবোধ এবং নীতিবোধের জগাখিচুড়ি থেকেই বেরিয়ে আসে পরম কোনো মূল্যবোধ। এই উপন্যাসের বিষয় কোনো বিশেষ সমাজের চালচিত্র কিংবা ভালোবাসার নতুন বিশ্লেষণ নয় যে এটি ঊনবিংশ শতাব্দের শেষদিকের ফ্রান্সে পাওয়া যেতো বরং এটি হচ্ছে মানুষের চেতনাগত সংগ্রাম যে সংগ্রাম মানুষ লড়ছে সময়ের সঙ্গে। এটি হচ্ছে বাস্তব জীবনে ব্যক্তি মানুষ অবলম্বন করতে পারে এমন কোনো স্থির বিন্দুকে খুঁজে বের করার অসম্ভাব্যতার লড়াই। এটি হচ্ছে নিজের ভেতরে সেই স্থির বিন্দু আবিষ্কার করার দায়িত্ব , কোনো শিল্পকর্মে সেই সম্ভাবনা খুঁজে বের করার অভিযাত্রা।
Mujib Rahman
মুজিব রাহমানঃ
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
=====================