কুমার প্রীতীশ বল, জন্ম চট্টগ্রামে। পুত্র প্রীণন আর স্ত্রী সোমাকে নিয়ে পারিবারিক জীবন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে কর্মসূত্রে জড়িত। জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লেখক।
প্রকাশিত গ্রন্থ
শিশু-কিশোর: টুটু ঘোড়া, যতো হাসি তত কান্না ( দ্বিভাষিক), বন্ধুর খোঁজে পশুরাজ, এক বিকেলে এক প্রজাপতি, খরগোশ ছানার কথা, আগামীর জন্য ভালোবাসা (কিশোর গল্প সংকলন), এক ঝুড়ি কিশোর গল্প, গল্পগুলো রাসেলের
আদিবাসী বিষয়ক গ্রন্থ : বাংলাদেশের আদিবাসী, আদিবাসী রূপকথা, চাকমা জাতির কথা, মারমা জাতির কথা, ত্রিপুরা জাতির কথা, ত ঙ্গ্যা জাতির কথা, চাক জাতির কথা, লুসাই জাতির কথা, খুমী জাতির কথা, বম জাতির কথা, ম্রো জাতির কথা, পাংখুয়া ও খ্যাং জাতির কথা, লাল পাহাড়ির দেশের কথা (প্রবন্ধ সংকলন)
উপন্যাস : জনক ও তাঁর সন্তানেরা, বাগানিয়া, আমি কোথায় পাব তারে
কিশোর উপন্যাস: বীরপুত্র, আমার বন্ধু রাসেল, টিটোর স্বাধীনতা
নাটক : জাতির পিতা এবং রাসেলের জীবনভিত্তিক দুটি ডক্যুড্রামা, মুক্তিযুদ্ধের ১০ নাটক, হাসি (শিশু-কিশোরদের), ইউনির্ভাসিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের সেই ছাত্রটি(শিশু-কিশোরদের), একজন তারামন, কথা ৭১ , গ্রহ বিচার, জাগবার দিন আজ, বিলুপ্ত এক সভ্যতার কথা, নুরুন্নাহার পালা
সম্পাদিত গ্রন্থ : মাস্টারদা সূর্য সেন(যৌথ), শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ (যৌথ)।
পুরষ্কার : মুক্তধারা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯০।
২টি অণুগল্প > কুমার প্রীতীশ বল
ঠুস
দূরে কোথাও একটা ঠুস করে শব্দ হয়। কানুগাঁও’র মানুষগুলো হুড়–মুড় করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মানুষগুলো দিনে পাহাড়ে থাকে। সন্ধ্যা নামলে বাড়ি ফিরে।
পাঞ্জাবির ভয়। ওরা তো মানুষ না। সাক্ষাৎ আজরাইল।
হীরেণ খুড়ো প্রতিদিন যাওয়ার সময় বলেন, আজ শেষ যাওয়া। কাল আর যাব না। মরলে বাড়িতে মরব।
পরদিন সকালবেলা, সবাই যখন শব্দ শুনে বাক্স পেটরা নিয়ে ছুটে, আবার তিনিও ছুটেন।
প্রতিদিন এমনই হয়। ঐ ঠুস পর্যন্ত। পাঞ্জাবি আসে না।
হীরেণ খুড়োর ছেলে যতীন। যতীন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।
যতীন বলেছে, এটা রাইফেলের আওয়াজ। জাকিরা শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছে। সে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে অপারেশনে যায়। সেই গুলি ফুটায়।
এরপরে আরও কদিন ঠুস শব্দটা হয়। শব্দ শুনলে কানুগাঁও’র মানুষগুলো বাড়ি ছেড়ে পালায়। হীরেণ খুড়ো যান না।
একদিন, ঠুস–ঠুস–ঠুস। তিনটা শব্দ হলো। প্রথম শব্দে সবাই পালালো। পরে আরও দুটো শব্দ হয়। হীরেণ খুড়োর মনে সন্দেহ হলো, আজ সত্যি কি পাঞ্জাবি আসছে?
তাহলে তো মহাবিপদ। হীরেণ খুড়ো ভাবতে ভাবতে দেরি করে ফেলেন। অবশেষে বের হলেন।
যতীনের পোষা ময়নাটা ডানা ঝাপটিয়ে চিৎকার শুরু করল, যতীন। ও যতীন। হীরেণ খুড়ো। ও হীরেণ খুড়ো।
আগে যে কদিন পালিয়েছিলেন ওকে নিয়েই গিয়েছিলেন। আজ কেন জানি নিলেন না। ময়নার আত্মচিৎকার খুড়োর সহ্য হলো না। উঠানটা পার হয়ে সদর রাস্তায় উঠেও ছিলেন। তারপর আবার ফিরে আসেন। ছাদের টপ বারান্দা থেকে ময়নার খাঁচাটা নিয়ে হীরেণ খুড়ো উঠানের মাঝ বরাবর আসেন।
আবার শব্দ হলো, ঠুস–ঠুস। জাকিরা এবার আর ফাঁকা আওয়াজ করেনি।
মুক্তিযোদ্ধা যতীনের বাবা হীরেণ খুড়োর হাত থেকে ময়নার খাঁচা মাটিতে পড়ে যায়। খুড়ো লুটিয়ে পড়েন খাঁচার উপর। তাঁর শরীরের চাপে খাঁচার দরজা খুলে যায়। ময়নাটা উড়ে পালিয়ে যায়।
ময়না
প্রতিদিন বিকালে পরাণবাবু দুই বছরের নাতি বাবানকে নিয়ে দোতলার বেলকনিতে ইজিচেয়ারে
বসেন। বেলকনির গ্রিলে লাগোয়া পোষা ময়নার খাঁচাটা আছে। পরাণবাবু বসে বসে ময়নাকে কথা
শেখান। খাবার দেন।
একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা পরাণবাবু বলেন, ও ময়না জয়বাংলা বল। জয়বাংলা বল।
কখনও কখনও পরাণবাবু বলেন, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!!
পরাণবাবুর কথা ময়না কান পেতে শুনে। বাবানও শুনে। বলতে পারে না।
পরাণবাবুর নিত্যদিনের কাজটি দেখে বাড়ির অন্যরা আড়ালে হাসে।
বলাবলি করে, ছেলে-মানুষি আর কাকে বলে!
একদিন সত্যি সত্যি ময়না কথা বলে।
ময়না বলে, ও ময়না জয়বাংলা বল। জয়বাংলা। জয়বাংলা।
পরাণবাবু খুশিতে চিৎকার করে ডাকেন, কে কোথায় আছিস! শুনে যা। ময়না কথা বলছে।
বাড়ির যে যেখানে আছে ছুটে আসে। সবাই শুনে।
বাবানের মা বলে, বাবা আপনার চেষ্টা সার্থক হয়েছে।
পরাণবাবু হেসে বলেন, মা, চেষ্টা অন্তে দুঃখ ঘুচে। হাজার বছরের পুরাণো প্রবাদ।
ময়না বলছে, ও ময়না জয়বাংলা বল। জয়বাংলা। জয়বাংলা।
পরাণবাবু বলেন, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!!
ময়নাও বলে, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!!
পরাণবাবু ময়নাকে আরও কথা শেখান।
ওর সামনে দাঁড়িয়ে বাবানকে কোলে নিয়ে বলেন, বাবান। ও বাবান। দাদু ভাই। ও দাদু ভাই।
ময়নাও বলে, বাবান। ও বাবান। দাদু ভাই। ও দাদু ভাই।
বাবান ফিক করে হাসে।
একদিন দুপুরবেলা।
ময়নাটা খাঁচার ভেতর উতাল-পাতাল করে ডানা ঝাপ্টাচ্ছে।
ময়নাটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বিদঘুটে স্বরে বলছে, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!! ও ময়না জয়বাংলা
বল। জয়বাংলা। জয়বাংলা। বাবান। ও বাবান। দাদু ভাই। ও দাদু ভাই।
ময়নার অস্বাভাবিক চেঁচামেচিতে পরাণবাবু ছুটে আসেন।
মস্ত বড় একটা কেঁদো বাঘ। বাবানের বিছানার একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে।
পরাণবাবু চিৎকার করেন, বাঘ। বাঘ। মস্ত বড় একটা কেঁদো বাঘ।
ময়নাটাও চেঁচাচ্ছে, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!! বাবান। ও বাবান। দাদু ভাই। ও দাদু ভাই।
বাবানের মা, বাড়ির অন্যরা ছুটে আসে।
একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা পরাণবাবু হাতের কাছে একটা চেয়ার পেলেন। শরীরের সমস্ত শক্তি
একত্র করে চেয়ারটা ছুঁড়ে মারলেন। কেঁদো বাঘটা পালিয়ে গেল।
বাবানের মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকেন। ভয় পেয়ে বাবানও কাঁদে।
পরাণবাবু বললেন, ময়নাটা আজ আমার নাতিকে কেঁদো বাঘের থাবা থেকে বাঁচিয়ে দিল।
ময়না বাবানকে মায়ের কোলে দেখে বলল, বাবান, ও বাবান। দাদু ভাই। ও দাদু ভাই। জয়বাংলা
বল।
বাবান আবার ফিক করে হাসে।