সহসা সাগরে এক নিম্নচাপ থেকে মহা শক্তিধর এক সিত্রাং পুরুষের জন্ম হয়। সিত্রাং আকাশে উঠে তার শরীর নিংড়ানো বীর্য ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে- বৃষ্টি হয়ে পড়ছে যখন বাতাসের সংঘর্ষে তীব্রভাবে একটি শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ শব্দ আছড়ে পড়ে। ইউটিউব জ¦র- কঁকিয়ে উঠে দেহ। শরীরের লোম সিকিউরিটি- তবু ঘুর্নায়মান আতংকের ঘানি।
* বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি আরও ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এরপর তা আরও ঘনীভূত হয়ে ক্রমান্বয়ে গভীর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে।
*নিম্নচাপটি পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিপথ ৪০ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত রৃদ্ধি পাচ্ছে।
* আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে আন্দামান সাগরে অবস্থানরত নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে রূপ নিতে পারে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাত হতে পারে। নিম্নচাপের প্রভাবে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর উত্তাল হয়ে উঠছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে।
কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল পাড়ার যুবকদের সাথে। এখন সে কী না খুশি। সরকার কী সমাধানটাইনা করছে। প্রতি মাসে যে ভাতা দেয় সরকার তাতে বাজারে প্রতিদিন চা-টা খেয়ে অন্যকে খাওয়ানোর পরও তার চলতে আর কোনো অসুবিধাই নেই। আফসোস তার একটাও ছেলে মেয়েকে সে লেখাপড়া শিখাতে পারেনি। কতো সহজেইনা একটা চাকরি হয়ে যেতো। যহোক কতোজনকে টপকিয়ে সে একটি বিল্ডিং পেয়েছে সরকারী অনুদান হিসাবে। ওটা হয়ে গেলে তার আর কোনো চিন্তা নেই। চিন্তা একটা সে করে- যার কোনো শেষ নেই। আবার তার কিছু করারও নেই। কন্টাক্টরের হাতের কাজ- কীভাবে বিশ্বাস করা যায়! শোনা যায়, কাজটা পেতে কন্টাক্টরকে নাকি টু-পাইস খরচ করতে হয়েছে।
আজ, আজকের দিনটা মনে হয় ফকফকা। মন প্রাণও খুবই সুপ্রসন্ন। চোখেমুখে চাঁদসূর্যের ফকফকা জন্মলগ্ন হাসি। ভিতরটা ফুরফুরা থাকলে চোখেমুখে খই ফোটে। সন্ধ্যা রাতের আবছা শ্যামলা রংয়ের মানুষটারে তখন হলুদমাখা শরীরের মত ফর্সা ফর্সা লাগে। মনে হয় যেন হলুদমাখা শরীরে ভালোমত গোসল দেয়ার পরের যে ফর্সা উজ্জ্বল রংটা বেরুই সেটাই তার চোখেমুখে আজ ভালোমত ফোটে উঠেছে। মৃদু বাতাসে হলুদফর্সা ঢেউ বয়ে যায়- হলুদ মেখেছে গায় অঙ্গে লেগেছে বায় নেচে নেচে প্রজাপতি পেখম তুলে পাখায়। তার দিকে তাকালেই, যারই তার সাথে মোলাকাত ঘটছে সেই আক্রান্ত হচ্ছে প্রজাপতির নাচে- বাজারের মানুষ কেউ কেউ তার আনন্দে সংক্রামিত হয়ে জানতে চায় সূর্য আজ কোনদিক দিয়ে উঠেছে! সারা শরীর জুড়ে রঙধনু। আজ তার বিল্ডিংয়ের ছাদ উন্মুক্ত হবে- সকল খুঁটি খোলে দেয়া হবে। ছাদের নিচে সবার খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। একটা গরু জবাই করে খাওয়াবে বলে অগ্রিম দাওয়াত দিয়ে রাখছে। তার আজ আনন্দ আর ধরে না। আজই সে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠবে- ছাদে। ছাদ থেকে সে তার শৈশব দেখতে পাবে- মুক্তিযুদ্ধের সময় ষ্ট্যানগানটা কাঁধে ঝুলিয়ে কোন চিপা-চাপা দিয়ে দৌড়েছিল দেখবে। ছাদে উঠে সে আজ আনন্দে আত্মহারা হবে।
একটা হাঁসগলা লাঠি তার বহুদিন ধরেই নিত্যসঙ্গি। চলতে গিয়ে লাঠি তার যতটুকু কাজেই লাগুক না কেন কিন্তু বন্ধু হিসেবে সে মন্দ নয়। একটা লাঠি তার জীবনে বন্ধু হয়ে উঠতে পারে কোনোদিন কল্পনায়ও আসেনি। জীবনের মোবাইলও একজন বন্ধু বটে। কিন্তু সে অনেক টাকা খসায়ে ফেলে। সময় দ্রুত অজগরের পেটে চলে যায়। তবু এন্ড্রয়েট মোবাইল থাকার কারণে বহুকিছু যেমন জানা যায়- সময়কে সময় সময় উপভোগও করা যায়। লাঠিটার গলায় হাত রাখলে ভরসা বাড়ে। তখন সে অনায়েসে চলতে ফিরতে পারে। কখনো কখনো লাঠিটাকে মনে হয় লম্বা গলার হাঁস। চলার সময় মনে হয় হাঁস তার বাহন। হাঁস তার পিঠে বসিয়ে জীবনকে নিয়ে চলেছে।
সেই বাহনে চড়ে জীবন এসে নামে তার বিল্ডিংয়ের সামনে। এই বিল্ডিং তার স্বপ্নের ফসল, মুক্তিযুদ্ধের ফসল। একটু একটু কওে অপলক দৃষ্টিতে বিল্ডিংটা সে দেখে। মনে হয় যেন পাখির মতো ঠোঁটে করে খড়কুটো এনে বাসাটা সে বানিয়েছে। হাঁসের গলায় একটা হাত রেখে ছোট ছোট ®েটপে সামনের দিকে আগায়- কাছিমের গতিতে। এভাবে তার বাসার চতুর্দিক ঘুরে ঘুরে সে দেখে। এমন অবস্থায় তার পরিবারের সদস্যদের দেখার কৌতুহলটা বেশি পরিমাণে তাদের মুক্তিযুদ্ধা কর্তার দিকে। তার সুখদুখ। সুবিধা অসুবিধা। সবকিছুই তারা খেয়াল রাখে যত্নের সাথে- মুক্তিযুদ্ধা যে এখন সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
ইতিমধ্যে তার প্রতিবেশী কিছু লোকজন এসে জড়ো হয়েছে উঠোনে। তার দৃষ্টির ভিতর কে যেন ইউটিউব চ্যানেল চালু করে দেয়- ইউটিউবের পর্দায় তার টোটাল মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি একে একে প্লেয়িং হতে থাকে। তাকিয়ে আছে এক মনে বিল্ডিংয়ের ওয়ালে-স্থির তাকানো নয়-চলমান তাকানো- বিল্ডিংয়ের ওয়াল যেন এখন ইউটিউবের পর্দা। সে সেই স্মৃতির ঢেউয়ে ঢেউয়ে সামনের দিকে ভেসে যায় আর কেমন জানি সেই নিম্নচাপ থেকে পাওয়া সেই শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। আজ বিশেষভাবে মনে পড়ে তার নিজের এলাকা শত্রুমুক্ত হওয়ার দিনের দৃশ্যগুলো। সবই ঝাপসা তবুও ঝড়ো হাওয়ার প্রবল বৃষ্টির ভিতর মাঠ ঘাট বৃক্ষের মতো বিমূর্ত হয়ে ভেসে উঠে চলে দৃশ্যগুলো।
কাল থানা শহর ঘেরাও হবে চতুর্দিক থেকে। এখানে যদিও কোনো পাক আর্মি নেই, প্রচুর রাজাকার বাহিনী দিয়ে দখল করে রেখেছে এই পুরো এলাকা। প্রায় প্রতিদিনই তারা কোনো না কোনো গ্রাম এলাকায় ঢুকে মুক্তিযুদ্ধা খোঁজে ঘর বাড়িতে আগুন দেয়, খাশি মুরগীর সাথে কিশোরি ও যুবতীদের ধরে নিয়ে যায়। রাতে জড়ো হয় মুক্তিযুদ্ধারা। এরিয়া কমাণ্ডার ব্রিফিং করে। একইভাবে পূর্ব উত্তর পশ্চিম দিক থেকেও আক্রমণ করা হবে।
পরেরদিন থানাশহরকে মাঝে রেখে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে জীবন দেখে ইউটিউবের পর্দায়- তার কাঁধে একটি স্ট্যানগান, ডান হাতে ধরা সেই এসএলআর, শরীরে বুলেটের জাল পেঁচানো। সে কী উত্তেজনা! একবার কল্পনায়ও আসেনি নিজেরও মৃত্যু হতে পারে। থানা ক্যাম্পের খুব কাছাকাছি একটা বড় ঝোপের ভিতর ওরা। টাইগার এম্বুস নিয়ে প্রস্তুত। সংকেত এলেই ফায়ার ওপেন।
ফায়ার। জীবন ফায়ার ওপেন করেই ক্রলিং করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। চতুর্দিক থেকে গোলাগুলির শব্দে স্বাভাবিক জীবন স্থবির, গোলাগুলির শব্দে সবকিছু জলোচ্ছ্বাসের মতো তল হয়ে গেছে- ৯১ জলোচ্ছ্বাসের মতো এখানে উত্তাল হয়ে উঠেছে শব্দের সাগর। চতুর্দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ ফোলে উঠে জনজীবন সবকিছু থলিয়ে দিচ্ছে। প্রথম দিকে পাল্টা ফায়ার এলেও পরক্ষণেই সব থেমে যায়। মুক্তিযুদ্ধারা সবাই উঠে আসে চতুর্দিক থেকে- জয়বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে অস্ত্র উঁচিয়ে সবাই থানার ভিতরে ঢুকে পড়ে। চতুর্দিক থেকে এতো গোলা এতো গ্র্যানেড চার্জ হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুপক্ষের প্রায় সবাই মারা পড়ে। অনেকেই পালাতে চেয়ে সাথে সাথেই গুলিবিদ্ধ হয়। আত্মসমর্পণ করার কোনো সময়ই পায়নি তারা। মুহূর্তে থানার অস্ত্রাগার লুট হয়ে যায়। আগুন যেন অপেক্ষায় ছিল কখন সুযোগ আসবে। পুরো থানা ক্যাম্প এক আগুনের গোলায় পরিণত হয়। হাজার হাজার মানুষ থানার চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে যায়।ঁ জীবনের বয়স তখনও কিশোর। কৌতুহল তাকে দলচ্যুত করে বাজার ও বাজারের আশপাশে টেনে নিয়ে যায়। মানুষ একদিকে আনন্দ মিছিল করছে- শত্রুমুক্ত হওয়ার মিছিল, অন্যদিকে বাজারের সকল দোকান-পাটে হাজার হাজার ঈদুর ঢুকে গেছে। নিমিষে বাজারের সকল দোকান খালি হয়ে যায়। থাকে শুধু মেঝে- ধর্ষিতা নারীর লাশ। এলাকাটা শত্রুমুক্ত হয় ঠিকই কিন্তু পুরো এলাকা দেখলে মনে হবে একটা প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড় মুচড়ে দিয়ে গেছে। আগুনের লেলিহান ছোবল মারছে- একটা তীব্র গতির শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ শব্দ তার মস্তিস্কের ভিতর নিম্নচাপ তৈরি করছে, উত্তাল করে তুলছে সাগর, শিকড়শুদ্ধ মাটি থেকে তাকে উপড়ে ফেলছে।
সে এখন উপরে উঠবে, ছাদে গিয়ে মুক্ত বাতাসে খোলাসা হবে। আত্মহারা হওয়ার জন্য খোলা জায়গা দরকার, মুক্ত বাতাস দরকার। সে আগেই একটা জাতীয় পতাকা রেডি করে রেখেছিল ছাদে উঠে পতাকাটা তুলে ধরবে। এ মায়াভরা ইমোশন। এখন তার এক হাতে হাঁসগলা বন্ধু লাঠি অন্য হাতে পতাকা। প্রথম সিঁড়ির ধাপে পা রাখা মাত্র শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ শব্দটা যুদ্ধবিমানের মতো মাথার উপর ঘুর্ণি পাক খায়। সিঁড়ির ধাপগুলো একে একে মাড়িয়ে যেতে যেতে কখনো মনে হয় সে যাচ্ছে না, সে স্থির- সিঁড়ি যাচ্ছে। সিঁড়িই যেন তাকে মাড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি চলন্ত হয়ে যেতে যেতে ছাদ এসে হাজির হয় তার পায়ের নিচে। ছাদ ঘুরে ঘুরে তাকে চতুর্পাশে নিয়ে যায়। তার আত্মহারা হওয়ার সুযোগ ক্ষণে ক্ষণে হাতছাড়া হয়ে যায়। মনে হয় নাগালের ভিতর কিন্তু ছোঁয়া যায় না- শোঁ শোঁ শব্দটা বাড়তে থাকে। একটা নিম্নচাপ অনুভব করে নিজের ভিতরই। এই শোঁ শোঁ শব্দটাই কী বয়ে নিয়ে আসে নিম্নচাপটি! নাকি নিম্নচাপের গতি কান মন প্রাণ তালা লাগা শোঁ শোঁ শব্দকে নিয়ে আসে! সে হিতাহিত হারিয়ে যায়- স্থান শূন্য করে উপরে উঠে যায়……৭১ এর সকল স্মৃতিদৃশ্য শোঁ শোঁ শব্দের সাথে ঘুর্ণিজলের গতিতে ঘুরতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এর গতি বাড়ে। নিম্নচাপ এখন তার শরীরের ভিতর, পায়ের নিচে। ১০ নম্বর বিপদ সংকেত- চিন্তা ও চেতনার গতি বাতাসের সাথে সাথে বাএেক পর্যায়ে তার উপস্থিতি, অস্তিত্ব, চেতনালব্ধ পারিপার্শ্বিক অবস্থান সব যেন গতির সাথে একাকার হয়ে ঘুরতে থাকে। শোঁ শোঁ শব্দ আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। তার পায়ের নিচে বিল্ডিংয়ের ছাদ মটমট শব্দে কেঁপে ওঠে। শোঁ শোঁ শব্দটা সাপের ছোবলের অবয়বে কানে এসে অনবরত বাঁধ ভাঙা জলের ন্যায় ঢুকতে থাকে- সারা শরীর পেঁচিয়ে দম আটকে দেয়। ছাদটা আরও কাঁপতে থাকে, মটমট শব্দটা আরও বাড়তে থাকে- ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের ভয়ংকর রূপের কাছে বিল্ডিংটা একটা ঠুনকো কাচের ঘর। আয়নায় ঢিল পড়লে চতুর্দিকে যেভাবে ফেটে যায় কাচ, জীবনের পায়ের নিচ থেকে ছাদটা সেভাবে ফেটে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝে ছাদটা ভেঙে পড়বে….. এক হাতে তার বাহন হাঁসের উপর চড়ে সে শান্ত হয়ে দাঁড়ায় আর এক হাতে শক্ত করে পতাকাটি উপরের দিকে তুলে ধরে…..ঠিক তখনি মটমট করে অত্যুগ্র ঠাডা ভাঙার শব্দে বিল্ডিংয়ের ছাদটা ভেঙে পড়ে। ধ্বংসস্তুপে মোঠ করে জীবনের হাতে ধরা পতাকাটাই শুধু তখন জীবন্ত মনে হয়। কারণ কোমল বাতাসে সে তখন শান্ত মৃদু স্বভাবে নড়ছিলো।