You are currently viewing হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার> খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার> খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার

খালেদ হামিদী

 

কিস্তিঃএগারো

২১

তন্ময় খোকনকে কল দেয় ম্যাসেঞ্জারে, মাজে মাঝে ইমোতে, ‘একটু বেরোচ্ছি’ বা ‘দোকানে যাচিছ’ বলে বাসা থেকে বেরিয়ে, সন্ধ্যায়, রাতে। বাংলাদেশে কোভিড শনাক্ত হওয়ার বছরটির শেষ তিন মাস ডেকে আনে বুঝি তন্ময়ের সর্বনাশ। শান্তির অশান্তি অকল্পনীয় চরমতায় পৌঁছে। এর আগে তো মড়কের ভয়ে নিজে বাঁচতে ও পরিবারের সবাইকে বাঁচাতে তন্ময়ের সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়টা মাত্রা ছাড়ালে অসম্ভব বিরক্ত শান্তি মারমুখো হয়ে ওঠে। ওই সাবধানতার ফলে কিংবা সৌভাগ্যক্রমে তন্ময় সপরিবার এখনও সুস্থ থাকলেও শান্তি খোদ আগুনের পিরামিড হয়ে ওঠে অন্য ঘটনায়।

তন্ময়ের দুই ভগ্নিপতির ছোট জন রঞ্জন ম্যাসেঞ্জারে চন্দ্রিকার কল পাওয়ার খবর শোনায় সম্বন্ধিকে। ওর তিন কন্যার কলেজপড়ুয়া দুজন, হারানো মামাতো বোনকে প্রায় ষোলো বছর পর ফিরে পেয়ে কেঁদে ফেলে। তন্ময়ও এই ঘটনা শান্তিকে জানানোর সময় কাঁদে। এর আগে দু’তিন দিন তা গোপন রাখতে গিয়ে স্ত্রীকে সে বলে:

তোমাকে একটা বিষয় জানাবো। একটু সময় নিই।

কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়ায় এই কথাটাই। নির্বুদ্ধিতার অভিযোগ হেনে খোকন তন্ময়কে বলে:

তুমি বউকে বলতে গেলে কেন!

এতে শান্তির মনে ও মাথায় যে আগুন লাগে তা দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তিন মাস জুড়ে। রঞ্জন হয়ে ওঠে ওর ভয়ংকর দুশমন। শান্তি ধরেই নেয় যে চন্দ্রিকার মাকেও ফিরিয়ে আনতে চায় তন্ময়ের পিতৃপরিবারের সবাই। শাশুড়ি, ননদ, দেবর কারোরই ফোন সে ধরে না। অসম্ভব উদ্বেগের কণ্ঠে তন্ময় এসব জানায়। খোকনের ইচ্ছা হয় বৌদির সাথে কথা বলার। তন্ময়ই তাকে বারণ করে আরেকটা কারণে। সেবার সেপ্টেম্বরে এক সন্ধ্যায়, তন্ময় অফিস থেকে ফিরলে ওর মা পানি গরম করতে কিচেনে যান। তখন মহামারির কবল থেকে মুক্ত থাকার প্রয়াসে তন্ময়ের গরম পানিযোগে স্নান ও কাপড় কাচা অভ্যাসে পরিণত প্রায়। শান্তি বেড রুমে মোবাইল ফোনে নিবিষ্ট থাকায় ওর শাশুড়ি কিচেনে যান। কিন্তু অনতি পরেই রান্নাঘরের দরজায় এসে ‘পানি আমি দেবো, আমি দেবো’ বলায় তন্ময়ের মা একটু বিরক্তি ঝাড়েন এই বলে:

তুমি অমন করছো কেন, আমি দিচ্ছি তো!

তন্ময়ও বলে ওঠে:

তুমি অস্থির হচ্ছো কেন! পানি একজন গরম করলেই তো হলো।

তাতেই শাশুড়ির প্রতি শান্তির অসন্তোষ কুৎসিত বিক্ষোভে রূপান্তরিত হয় এবং সেই বালিশকান্ডের সময়কার ধরনে ক্ষুধার্ত হিংস্র পশুর মতো এ-ঘর থেকে ও-ঘরে ছোটে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় আর চিৎকারে তো ফেটে পড়েই। দোষারোপে ঝাঁজরা করে তোলে তন্ময়কে। এরপর রাতে, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শান্তি বাপের বাড়ি যাবে বলে জানায়, করোনার ভয়ে তন্ময় দূরযাত্রার অনুমোদন দেবে না জেনেও। যদিও, উপস্থিত বুদ্ধিহীন তার স্বামী তারই কক্সবাজার যাত্রার তারিখ আর ওই গরম পানিকেন্দ্রিক বিস্ফোরণের হেতুর কোনোটাই তৎক্ষণাৎ অনুমান করতে পারে না।

পরের দিন অফিসে থাকা তন্ময়কে ফোন কল দিয়ে শান্তি অল্প হেসে বলে:

গাড়িটা একটু পাঠাবেন? আমি ব্যাংকে যাবো।

কিন্তু ড্রাইভার অফিসে ফিরে এসে ‘স্যার, ওনাদেরকে কক্সবাজারের বাসে তুলে দিছি’ বলতেই তন্ময় মহাতঙ্কে কিছুটা উচ্চ কণ্ঠে বলে ওঠে:

‘হায় রাম!’

সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ওরা সবাই মাস্ক পরেছে কি না জানতে চায়। চালক, বিজয়, হাসিমুখে বলে:

তিনজনই তিনটা কইরা মাস্ক পরছে, স্যার।

তার কোভিডাতঙ্ক অস্বীকার এবং স্ত্রীর ওই মিথ্যাচারের আঘাতে তন্ময় ক্রমশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফোনে শাশুড়ির ওপর অনেকক্ষণ ধরে ঝাড়ে বহুদিনের না-বলা কথার ঝাঁজ। তার প্রতিবাদ সীমা ছাড়িয়ে যায়। এর আগে স্ত্রীকে ফোন করে ভীষণ বাঁকা উত্তর মেলায় শাশুড়ির সঙ্গে ওভাবে বেয়াদবি করতে বাধ্য হয় তন্ময়। এরপর বারো দিন যাবৎ সে অফিসে, মা একা বাসায়। শান্তি তো নয়ই, তার পরিবারের কেউই খবর নেয়নি বৃদ্ধা জননীর। পরে রঞ্জনকে ফোনে এটা-সেটা মিথ্যা গল্প শুনিয়ে তাকে নিয়ে আসতে রাজি করায় শান্তি। তন্ময়, শান্তিকে পাঠিয়ে দিতে বলায়, শাশুড়ি, কন্যার কথার অনুকরণে নেতিবাচক উত্তর দেয়। এতে, ফোন রাখা মাত্র ছেলে কেঁদে উঠলে, মাও তৎক্ষণাৎ অঝোরে কাঁদেন। তারপরও তন্ময়কে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়, রঞ্জনের সাথে। যেদিন যায় সেদিনই কোরমা-পোলাও খেয়ে পরিবার নিয়ে রাতে ফেরে সে। প্রথম সংসার ভেঙে পড়ার পরের ঘটনার ধরনে এবারও সে নিজের চিতার ওপর যেন গড়ে তোলে প্রমোদ-প্রাসাদ। অদ্ভুতভাবে নিজের জৈব-প্রকৃতিও তার অনুক‚লে আসে। প্রায় প্রতিদিনই সে স্ত্রীর সঙ্গে মিলনোৎসবে মাতে। কিন্তু এই ধারার প্রায় দু’মাসের মাথায় বাজ পড়ে তন্ময়ের মাথায়। ‘তোর মা- বোনদের কাছে আমার বদনাম করছস কেন?’ বলেই শান্তির ঘোষণা:

আজ থেকে চার মাস তুই আমাকে টাচ করবি না।

তন্ময় থমকে যায়। যুক্তি বুঝতে অক্ষম স্ত্রীর সাথে আর তর্কে জড়ায় না। দুয়েকজন কলিগ আর খোকনের সাথে বিষয়টা শেয়ার করে। ওদের পরামর্শে, দুই সন্তানের মনস্তাত্তি¡ক ক্ষতি না হবার জন্যে, তন্ময় ওসব মনে নিতে না পারলেও মেনে নেয়। আবার ফেরে ঠাকুরের কাছে। এক সন্ধ্যায় করজোড়ে প্রার্থনার সময় তার বুক নিংড়ে অশ্রু উঠে আসে চোখে, গড়িয়ে পড়ে। ঈশ্বর বলে:

ধর্মীয় রীতি মেনে বিয়ে-করা পত্নী কি পতিকে এভাবে অস্বীকার করতে পারে? তুমি ওকে সুমতি দাও হে ঠাকুর।

সেই দুঃসময়ে এক রাতে, তন্ময়ের মা আর ভাই ইমোতে কল দিয়ে পিপাসা আর চিন্ময়ের সাথে কথা বলছে। সে-সময় তন্ময় একটা প্রসঙ্গে পিপাসাকে ‘এই, মিথ্যা বলছো কেন!’ বলায়, কন্যারই নালিশ পেয়ে সত্যিই মারমুখো হয়ে ওঠে শান্তি। শুধু তন্ময়ের দিকে সে কুঁদে আসে বা ওকে ধাক্কা দেয় না, ওর দুই গালে দুই হাতে কয়েক জোড়া চড়ও মারে। এতে তার স্বামীর চশমা খসে পড়ে। তখন সে বিছানার উত্তর-পূর্ব কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকায় তা পড়ে বিয়ের পালঙ্কে। লুঙ্গি পরা, খালি গায়ের তন্ময়ের বুকে ও বাহুতে তখন অনেক আঁচড়। শান্তির ধাক্কায় ওর পিঠ দেয়ালে ঠেকলে এক ইি  লম্বা, দেয়াল থেকে বের হয়ে-থাকা একটা প্লাগ দেয়ালেই ঢুকে যায়। অদূরে দাঁড়িয়ে নিরবে কাঁদতে থাকা পিপাসা ‘বাবা!’ চিৎকারে এগিয়ে এসে ওকে বাঁচাতে চায়। সব শুনে খোকন আঁৎকে ওঠে আর বলে:

তোমার বউ তো সিজোফ্রিনিক পেশেন্ট! ডাক্তার দেখাও। মেয়ে বড় হচ্ছে। চুপচাপ থাকো। ধৈর্য ধরো।খোকন ভেবে পায় না শাশুড়ির বাঁকা কথায় রেগে উঠে তন্ময় ম্যাসেঞ্জারে শান্তিকে সালিশ বসানোর হুমকি দিলে কীভাবে উত্তর মেলে:

তোমার যে সেক্স পাওয়ার নাই তা সবাইকে বলে দেবো।

শান্তি অল্প শিক্ষিত বলেই কি অমন নিম্ন স্তরের কথা বলতে পেরেছে? নাকি ওই দক্ষিণা লের মানুষ ক্ষেপে উঠলে অসম্ভব দুর্মুখ এবং প্রায় জঙ্গি হয়ে ওঠে বলেই অমন জবাব তন্ময়কে পেতে হয়?

কিন্তু, তন্ময়, নিজেকেই বলে:

আমার বন্ধুটার মনে কারও বিরুদ্ধেই স্থায়ী কোনও ঘৃণা নেই বলেই অমন বউয়ের সাথে পরে সঙ্গমলিপ্ত হতে পেরেছে। তাই বলে কি সে আগেকার দিনের প্রতিবাদহীন সর্বংসহা নারীর মতো? একেবারেই তা নয়। নইলে স্ত্রী চার-পাঁচ আছাড়ে তার মোবাইল ফোন সেট ভেঙে ফেলার পর, প্রথমবারের মতো, ক্রোধে সরব হয়ে উঠতে পারতো না। এটি শান্তির প্রথম আক্রমণের পরের তান্ডব। কী করুণ, সাংঘাতিক বৈপরীত্যময় কাকতাল যে সেদিন ছিলো চন্দ্রিকার জন্মদিন! তন্ময়কে অফিস আওয়ারে কেউ কল করেছিলো কি না জানতে চেয়ে নেতিবাচক উত্তর পাওয়ায় শান্তির এই ভয়াবহ সন্ত্রাস। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে নাশতা খাওয়ার সময় স্বামীর ফোন হাতে নিয়ে সে বলে:

কেউ ফোন করে নাই, না? রঞ্জইন্যা তো ফোন করছে। মিথ্যা বলছস কেন! ফোন ভেঙে ফেলি?

তন্ময়েরও জেদ চাপে। বলে:

ভাঙো দেখি, ভেঙে ফেলো!

অমনি শুরু হয় সেই আছাড় মারার পালা। অনেক টুকরায় চুরমায় হয় বন্ধুর সম্পদ। রাতে প্রথমবারের মতো অনুতপ্তও হয় শান্তি। তন্ময়কে বুকে জড়িয়ে কাঁদে। এতে আমার সহজ-সরল বন্ধুটাও কেঁদে ফেলে। আর, প্রথমবারের মতো পাশের ঘরে একা ঘুমানোর সময় স্বপ্নে দেখে, ড্রয়িং রুমে রাখা আইপিএস-এর লাল আলোর ছোট বৃত্তটি সারা বাসায় ঘুরছে আর কে যেন তাকে বলছে:

তোমার মৃত্যু ঘুরছে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে।

শোনার পরপরই সে দেখে, শান্তি তার বুকে কুড়াল হানছে একের পর এক। এই অবস্থায় হঠাৎ ওর ঘুম ভেঙে যায়। ওয়াশ রুমে হিসু করে সে একটু আগে দেখা খুনিকেই ঘুম থেকে ডেকে তোলে। শান্তি আবারও বুকে জড়ায় পতিকে। অভয় দেয়। কিন্তু সে যা-ই হোক, ওই মেয়েটার কী দোষ! মা দ্বিতীয় সংসারে থিতু, বাবা থেকেও নেই! তার মতো দুঃখী তো আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। যদিও, সে বেড়ে ওঠে তারই বড় মামার সংসারে। রঞ্জনের কাছ থেকে নাম্বার পেয়ে ফোন করায় এসব জানতে পারে তন্ময়। প্রথম কলে পিতা কাঁদলেও কন্যা থাকে অবিচল। চন্দ্রিকা ঠিকই বলে:

আমার মামীর মতো মানুষ হয় না। তিনি আমার কোনও অভাব রাখেননি। একই শহরে থাকলে আপনার সঙ্গে হয়তো দেখা হয়ে যেতো, বাবা। আমার স্কুল, কলেজ সবই তো ঢাকায়। আপনাকে সাত বছর ধরে খুঁজেছি, বাবা। মা শুনলে খুব রেগে যাবেন। তবু, আমি আর কিছু চাই না, শুধু মাঝে-মাঝে আপনার সাথে ফোনে একটু কথা বলবো।

স্মার্ট ফোন ধ্বংস হওয়ার পর কীভাবে প্রতিবাদমুখর হয় তন্ময়? শান্তিকে সে বলেই ফেলে:

তোর কোনও বিদ্যা নাই। তুই আস্ত একটা জঙ্গি। তুই গাড়ি নিয়ে কোথায় যাস না যাস সব আমি জানি। এই শহরটা ছোট। এসব জানতে পারা আমার জন্য কঠিন কিছু না।

এই কথায়ই কি ভয় পেয়ে সেই রাতে অনুশোচনা প্রকাশ করে শান্তি? কই, যেই লাউ, সেই কদু! নইলে সেই ডিসেম্বরের এক বিকেলে আগের চেয়ে আরও ভয়ংকররূপে কীভাবে আক্রান্ত হয় তন্ময়? স্বামী সন্তানদের নিয়ে রঞ্জনের বাসায়, ভগ্নিপতি বলাতে, যেতে চাওয়ায় আগ্নেয়গিরির ওই অগ্ন্যৎপাত, লাভা নিঃসরণ। নদীতীরে বেড়িয়ে আসার পর হামলার ঘটনাটা ঘটে। এবার একেক টানে তন্ময়ের স্যান্ডো গেঞ্জি আর প্যান্ট ছিঁড়ে ফেলে শান্তি। এও অলিখিত ইতিহাসের আরেক মর্মভেদী বাঁক যে, দেশে সেদিন ছিলো বিজয় দিবস।

এক সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ভাঙা হয়। এদিকে আরেক সেপ্টেম্বরে তন্ময় দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার না হতে দেয়ার জন্যে বেপরোয়া স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। সে  শ্বশুর বাড়ি যেতে চায়নি। তার যুক্তি থাকে এই:

আমি তো তাড়িয়ে দেইনি। সংসার করতে চাইলে সে-ই আসবে। আমি কেন আনতে যাবো!

তবু তাকে যেতে হয়।

স্বগত কথনে খোকনের দীর্ঘশ্বাস

কে বোঝে পুরুষের এই আপাত পরাজয়?

রক্তে শর্করার হেরফেরের প্রভাবে তন্ময় অনেকদিন মিলনে অপারগ থাকলেও শান্তি তো ওর কারণে আর বুড়ি হয়নি!

 

২২

প্রায় বছর খানেকের বিরতির পর শান্তির সাথে তার শ^শুর বাড়ির লোকদের সম্পর্ক বা ফোনালাপ, দেখা-সাক্ষাৎ ইত্যাদি পুনঃস্থাপিত হয়। স্বামীর মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটির মতো কুৎসিত চর্চাও বন্ধ হয় ওর। শুনে খোকন জানতে চায়:

কীভাবে?

জবাবে তন্ময় বলে:

আমি পরীক্ষায় পাশ করেছি, তাই।

এতে খোকনের কৌত‚হল ত্বরান্বিত হলে তন্ময় ম্যাসেঞ্জারে লিখতে থাকে:

আমি আমার মা-ভাই-বোন এবং রঞ্জনকে অফিস টাইমে কল দিতে পারবো না। দিলে বাসায় ফেরার পর তার সামনেই দিতে হবে। শান্তির সে-কথা আমি শতভাগ শুনেছি। ওদিকে চন্দ্রিকাকে মাঝে মাঝে ফোন করেছি অফিসের ল্যান্ড ফোন থেকে। শান্তির নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ওরও খোঁজ আর নেইনি। দুটি লক্ষ্যে আমি এই কাপুরুষোচিত অবস্থায় বছর কাটিয়ে দেই। সেই বিজয় দিবসের হামলার সময় পিপাসার, বিশেষ করে, চিন্ময়ের মর্মভেদী অশ্রুসজল আর্তনাদ দ্বিতীয়বার শুনতে চাইনি বলে এবং শান্তির সাথে দৈহিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আশায়। কিন্তু দ্বিতীয় লক্ষ্যটি এখনও পূরণ হয়নি। একবার সে সাড়া দেয়। কিন্তু শুরুতেই আমি রোমাি ত থেকেও নেতিয়ে পড়ি। নিজের ব্লাড শুগার টেস্টও করাই অনেক দেরিতে। ডাক্তার বলেন, ট্যাবলেট রেডিমেট-এ তো অমন হওয়ার কথা নয়। তাহলে কি থায়রয়েড গ্ল্যান্ডের পরীক্ষাও ফের করাতে হবে? আট-নয় মাস আগের টেস্টে তো টিএইচএস স্বাভাবিক দেখা যায়। যাক, খোকন, আমি নির্বিকার হয়ে পড়েছি। সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার না হতে দেয়ার জন্য সব মনে নিতে না পারলেও মেনে নিচ্ছি। ঈশ^রকে বলছি তিনি যাতে আমার এই মেনে নেয়ার মূল উদ্দেশ্য পূরণ করিয়ে দেন। আমার এই স্ত্রী-সংক্রান্ত অনেক সূ² প্রার্থনা তিনি গত এক বছরে শুনেছেন। শান্তির সাথে মিলনের জন্য প্রার্থনা আর করি না। কেননা আমার সেদিনের ব্যর্থতায় সে সজোরে হাসে।

তন্ময় আরও একটি বিষয় খোকনকে জানায় যা যে-কোনও পতির কাছেই মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক প্রকাশ্যে গোপনীয়তা বজায় রাখার মাধ্যমে শান্তি এক বা একাধিক পুরুষের সাথে নিবিড় আলাপে মাতে এমনকি স্বামী, শাশুড়ি কেবল নয়, বেড়াতে আসা নিজের মা-বোনের সামনেও। এই বেপরোয়া চর্চা যে নির্লজ্জতার পরিচয় তা বুঝতে পারার সুমতি ঠাকুর তাকে দিক, এও প্রার্থনা তন্ময়ের। ফোনের ওপারের ব্যক্তিটা যে পুরুষ তা প্রমাণিত করে শান্তি নিজেই। গাড়িতে এবং লিফট-এ আলাপের সময় কণ্ঠ শুনতে পায় তন্ময়। কিন্তু তার পত্নী ঠুনকো বিষয়েও তেলে-বেগুনে জ¦লে উঠলে এখনও ভয়ে কেঁপে ওঠে সে। তন্ময় একদিন হাসিমুখে ওই পুরুষকণ্ঠের কথা পরোক্ষে উল্লেখ করায় ব্লু টুথ ও হ্যাডফোনের ব্যবহার শুরু হয়। কিছুটা আপত্তিকর ভঙ্গিতে রাত দুটো অব্দি ভিডিও কলে শান্তির নিবিষ্ট থাকাও অব্যাহত থাকে। কোথাও বেড়িয়ে এসে এক ঘণ্টা ধরে সেলফি তোলে সে। ফটোগুলো কি ওই ছেলেটাকেই দেখায়? তন্ময় এই দুঃসহ কষ্টে একা ছটফট করে। আতঙ্কে ঈশ্বরমুখি হয়। নিজেই বুঝতে পারে যে, অন্য কেউ হলে পরকীয়া সন্দেহে এই সংসার ভেঙে দিতো। কিন্তু দ্বিতীয় ভাঙনে ওরই দুর্নাম রটবে বলে তন্ময়, যে সহে সে রহে- এই বিশ্বাসে, দিনাতিপাত করে। আর, পিপাসা আর চিন্ময়ও বিষয়টা যাতে বুঝতে না পারে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হয় ওকে। সন্তানদের সামনে নিজের সম্মান খোয়াতে চায় না সে। কেননা এই প্রসঙ্গে ওর আপত্তির প্রতিক্রিয়ায় জঘন্যরূপে বিস্ফোরিত হয় শান্তি, কয়েকবার। এতে তন্ময় চুপ মেরে যায়। আজকাল ঠাকুরের কাছেও আর নত হয় না। কখনও হঠাৎ পূজা-অর্চনাও অর্থহীন ঠেকে। সে শূন্যে তাকিয়ে যেন বাতাসকেই শুধু শোনায়:

আমি তো কারও ক্ষতি করিনি। আমার বউভাগ্য কেন এতো খারাপ! দুই দফায় আমার সংসার কেন হয় এমন অভিশপ্ত!!

তবু ওর আশার প্রদীপ নেভে না, শান্তির সাংসারিকতায় জোরালোতর নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়ায়। তন্ময় দশ বছর ধরে মাসিক কিস্তি পরিশোধের মাধ্যমে এরই মধ্যে যে ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে ওঠে সে-আবাসনের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাজ তত্ত্বাবধানে নিবিষ্ট থাকে শান্তি। এই সংশ্লিষ্টতা অদৃশ্যপূর্ব, তন্ময়ের পিতৃ ও মাতৃপরিবারের নারীগণের পক্ষে যা অসম্ভব। স্ত্রীর জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে দেয়া ফেসবুক পোস্টে তন্ময় এর লিখিত স্বীকৃতি দেয়। শুধু তা-ই নয়, প্রতি বিজয়া দশমীতে শান্তি যে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে তন্ময় তাও খোকনকে জানায়। আবার এও বলে:

মাঝে মাঝে ওই ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে করে। চুদির পুতেরটা না দেখেও আমারটা উত্থিত হয় প্রায়। এ এক অদ্ভুত নোনা অনুভূতি বউকে যা জানানো যায় না। মানুষ কি মূলত আইন, সমাজ ও অন্যান্য প্রথার বিরুদ্ধেই বাঁচতে চায়?

শিক্ষিত কিংবা ইউনিভার্সিটির প্রথম কি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের মধ্যকার ছিমছাম আবেদনময় জনেরা তন্ময়কে তার যৌবনকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। কয়েক মুহূর্তের শিহরণে ওর উরুসন্ধির স্বল্পপ্রাণটা মহাপ্রাণ হয়ে উঠতে চায়। ব্যস, ঐটুকুই। কখনও সে ভাবে:

চুয়াল্লিশ বছর বয়সেই কেন যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে! ভাগ্যিস হাইপার! যদিও, এ নিয়ে দুই কি তিনবার শুগার লেভেল কমে ৪ হয়, তবুও শান্তির সাথে মিলন তো একেবারেই বন্ধ হয় না! সেবার সে কক্সবাজার থেকে ফেরার পর তো আমার বয়স একুশে নেমে আসে। সেই উদ্দীপনা ও ক্ষিপ্রতা কি আর ফিরে পাবো না! এতো কষ্টে কেনা ফ্ল্যাটে কি শান্তিকে নিজের করে পাবো না? না, সে এ নিয়ে কয়েকবার হাসিমুখে নিশ্চয়তা দিয়েছে। তবুও আমার সংশয় থেকে যায় কেন! কোভিডকালের দ্বিতীয় বছরের দ্বিতীয় মাসের এক সকালে, বিবাহ বার্ষিকীর দিন, অফিসে যাবার সময় তাকে চুমু খাই, লিপ কিসিং করি কী গভীরভাবে! কথা দেয় রাতে হবে পারস্পরিক বিনিময়। কিন্তু না! মেলে প্রত্যাখ্যান! ঠাকুরের দিকে দুই হাত তুলে কাঁদি। সেই অশ্রু উঠে আসে আমার বুক নিংড়ে। এই তো সেদিনও, নিজে নিস্তেজ হওয়া সত্ত্বেও, তার দেহে স্পর্শ বুলিয়ে দিই। ইঙ্গিত দিই একত্র হবার। এক মিথ্যা অজুহাতে সে আবার আমাকে এড়িয়ে যায় হাসিমুখে ছুরি মারার ধরনে। কেননা স্পর্শের সময় ম্যাসেঞ্জারে তার সেই কলটা এলে সে কেটে দেয়। কিন্তু আমাকে প্রত্যাখ্যানের পরপরই কল ব্যাক করে রসালাপে মাতে! আমি এই আঘাত যে নিরবে সয়ে গেছি তাও নয়। শান্ত মেজাজে বিষয়টা উল্লেখ করতেই শান্তি বলে ওঠে:

সংসারের এতো কিছু যে একা ম্যানেজ করছি সেসব কিছু না, তাই না? একটা দোষ পেলেই সেটা নিয়ে মাতামাতি!

আমি তৎক্ষণাৎ চুপ হয়ে যাই। নিজের মনে একটা সান্ত¡না পাই:

ওটা যে দোষ তা সে নিজেই স্বীকার করেছে।

যদিও, চন্দ্রিকার আবির্ভাবকে ঘিরে চলা ঘোরতর সংকটের সময়টায়, এর আগেও, শান্তি ওই কলারকে আমার বিরুদ্ধে নালিশ দেয়, তুচ্ছ বিষয়ে, আমার সামনেই।

তন্ময়ের স্বগত সংলাপও আরও এগোয়:

তিলকের মতো আমিও, অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে, পিতৃপরিবারের কাউকে না জানিয়ে, সরকারি মেডিকেলে খৎনা করাই। অনেক বছরের প্র¯্রাবকালীন সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। পর্নোগ্রাফির হিরো হয়ে উঠতে পারবো বলে মনে হয় তখন। আহা, সেই বয়স যে কী! সেই তিলকই, চার সন্তানের বাবা, সাড়ে পাঁচ বছর আগের এক ঘটনা নির্দি¦ধায় আমাকে জানায়। এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের এক ছাত্র, তার পরিচিত, একদিন হঠাৎ এক জায়গায় এক রুমে একা পেয়ে তিলকের গালে ও গলায় চুমু খেতে শুরু করে। লিপ কিসিং শেষে জোর করে মাস্টারবেটও করে দেয়। অল্প কিছুক্ষণ ওরালও করতে দেয়। কিন্তু ছেলেটা নিজের প্যান্ট দূরে থাক, শার্টও খোলে না। তিলক অন্যরকম মজা পায়। ওয়াশ রুম থেকে ফেরার পরও ওরটা স্বাভাবিক আকার পেতে অনেক সময় নেয়। বন্ধুরও রক্তে ডায়াবেটিস আবিষ্কৃত হবার মাত্র তিন দিন পরের ঘটনা নাকি ওটা। তাই সে আমাকে অভয় দেয়। বলে:

সঙ্গমের আগে তোর দরকার ওরাল লাভ।

হায়, আমার তো তেমন কেউও নেই! অবশ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি তো আর তিলকের মতো, সে যেমন জানায়, বাসায় থাকলে যে-কোনও সময় বা অবস্থায় লুঙ্গি তুলে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেরটা দেখি না, ওভাবে দেখাই না বউকেও!

যদিও, সেই ফোনালাপ বিষয়ে আপত্তির মুখে শান্তি ওকে বলেছে:

ছি-ছি! আমি অতো নীচু লেভেল থেকে আসি নাই যে আরেক বেটার সাথে পালিয়ে যাবো।তন্ময় নিজেকে আরও বলে:

সে আমাকে ভালো না বাসলে আমার জন্যে শার্ট কিনে আনা, প্যান্ট সেলাই করতে দেয়া কিংবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওর পছন্দে জুতা-স্যান্ডেল কেনার ব্যাপারগুলি কন্টিনিউ করতো না। কে যেন বলে:

নারীকে বেশি বুঝতে গেলে হয় তার প্রেমে পড়বেন, নয় তো বদ্ধ পাগল হয়ে যাবেন।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~