সেকাল একাল অথবা হারিয়ে যাওয়া দিনের গল্প
মেহনাজ মুস্তারিন
জীবনের অনেকটা সময় কেটে গেল রাজশাহী নামের এই শহরে। ফেলে আসা সময়, বিশেষ করে শৈশব কৈশোরের স্মৃতিমাখানো সময়গুলো এখনও পিছু টানে। আমাদের মতো যারা এই শহরে বেড়ে উঠেছি তাদেরকে এই শহরের পথঘাট, অলিগলি আলো-বাতাস সবকিছু কেমন যেন পেছন থেকে টেনে ধরে। আপনারা একে পিছুটান বলে ডাকেন। আমি বলি স্মৃতিটান। আসলে স্মৃতিই টানে, টানার ক্ষমতা রাখে। যার স্মৃতি নাই, তার আসলে কোন টান নাই। তো, সেই স্মৃতিগুলো মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে উদাস হয়ে উঠলে আমার খুব ইচ্ছে করে এই শহরে চুপি চুপি পা ফেলে খুঁজে বের করি কোথায় যত্ন করে রাখা আছে আমার ছেলেবেলা।
হলফ করে বলতে পারি, সে সময় শহরটা এত অলংকারে জড়ানো ছিল না। নিরিবিলি শান্ত এই শহরে ছিল একরাশ মায়া। রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য পুরনো গাছ পথচারীদের ক্লান্তি দূর করতো, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে যে সকল শ্রমিক কাজের সন্ধানে আসতো, তাদের দেখেছি গাছের নিচে হাত পা ছড়িয়ে জিরিয়ে নিতে। রাস্তার দু-ধারে অসংখ্য কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য রূপেগুনে পথচারিদের মুগ্ধ করে রাখতো। এখনকার মতো বিদেশি ফুলের ছড়াছড়ি তখন ছিল না। স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমনকী সকলের বাড়ির উঠোন কত ধরনের দেশি ফুল যে সুশোভিত করে রাখতো, তা বলাই বাহুল্য সেসব ফুলের নাম আমাদের মুখেমুখে ফিরতো আর কখন কোন সময় কোন ফুল ফোটে সেটাও বলে দিতে পারতাম। এখন যেসব ফুল দিয়ে সাজিয়ে শহরকে রূপসী করে তোলা হচ্ছে, তার কয়টার নামই-বা জানি? আমাদের মতো মধ্যবয়স্কদের কথা বাদ, এযুগের বাচ্চারাও দু’একটা ফুলের নাম বলতে পারবে বলে মনে হয় না। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ আর নাই যার অপার সৌন্দর্যে পুরো শহরটা অহংকারী হয়ে উঠতো। এখন কালেভদ্রে দু’একটা চোখে পড়ে। রাস্তার দু’পাশের বড়বড় গাছগুলো কেটে বিদায় করা হয়েছে, সেখানে ছোট ছোট গাছের সমারোহে বেশ সেজে উঠেছে শহর। আবার দেখা যাচ্ছে, যে রাস্তা এত সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে মাস ছয় না যেতেই ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখনকার সরু রাস্তাগুলোকে এখনকার মতো এভাবে পটাপট ভেঙে যেতে দেখিনি। তখন শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি তেমন চোখে পড়তো না। রিকশার আধিপত্য ছিল অনেকটা একচেটিয়া। শহরে এত মানুষের সমাগম তখন ছিল না। শহরের দক্ষিণে বয়ে চলা পদ্মা তখন কুলকুল করে আপন নেশায় বয়ে যেত। মনে পড়ে বন্যার সময় নদীর কিনারে বসে একধরণের মুগ্ধতা নিয়ে স্রোতের তান্ডব দেখতাম। তখন কুমির দেখা যেত, শুশুকদের টুপটুপ করে ডুব দেয়া আর উঠে যাওয়া দেখতাম চোখদুটো গোলগোল করে। সেই নদীর কিনারে এখন অসংখ্য মানুষের সমাগম সকালে কি সন্ধ্যায়। কিন্তু সেই বহমান স্রোতধারা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এখন নদীর চারপাশ বালুতে ভরপুর। ছোট্ট হয়ে এসেছে নদীর শরীর, সেখানে কোন আবেগ নেই, শুধু শুকিয়ে যাবার কষ্ট বুকে চেপে কোনরকমে বেঁচে আছে যেন। ঠিক যেভাবে আমাদের ডিজিটাল জীবনকে সাজিয়ে গুছিয়ে ছোট করে এনেছি, নদীর অবস্থাও তাই। নদীর যে তান্ডব নগরের মানুষকে জাগিয়ে রাখতো বর্ষাকালে, তা হারিয়ে গেছে দাড়টানা নৌকার সৌন্দর্যে হারিয়ে যাওয়ার সাথে তাল রেখে। এখন তো নৌকার ঘাড়ে সিন্দেবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে আছে শ্যালো মেশিন, যার খটখট শব্দ যে আপনার মনোজগতের ছন্দকে ছাপিয়ে যায়, সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একইভাবে নানা রকমের উটকো ব্যস্ততায় আমরা হারাতে বসেছি প্রকৃত ভালোলাগার উপকরণগুলো; সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে আনন্দ মেশানো গল্পের সম্ভার।
ছোটবেলায় শুনতাম ইউরোপ- আমেরিকার কথা, সেখানে নাকি কেউ কাওকে চেনে না, দেখা হলে হাই হ্যালো বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সেখানে কোন সমাজ নেই, প্রত্যেকে আপন আপন জীবন নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে কেউ কারো পিছুটান হয়ে বাঁচে না। এমনকি বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের কাছ থেকে সেবা পাবার প্রত্যাশাও তারা করে না। শুনে অবাক হতাম। মনে হতো কোন রূপকথার গল্প শুনছি। ভাবতাম, এও কী সম্ভব! বিস্ময় যেন কাটতো না। রূপকথার সেই বাস্তবতা আজ আমাদের জীবনকেও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে। যা কল্পনাও করতে পারতাম না, যা ভাবলে কষ্ট পেতাম, আজ সেই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা। কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের স্বর্ণালী দিন! একটু একটু করে হারিয়ে যেতে দিলাম “সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”-র মতো প্রত্যয়গুলো।
এই শতকের শুরু থেকেই মফস্বল শহরগুলো বদলে যেতে শুরু করে। চারিদিকে নতুন নতুন বহুতল ভবন। এখন এমন কোন এলাকা নেই যেখানে উঁচু ভবন চোখে পড়ে না। সেই গাছ আর লতাপাতায় ঘেরা ছোট্ট উঠোনের একপাশজুড়ে দুই-তিন কামরার টিনের বাড়ি এখন আর চোখে পড়ে না। মধ্যবিত্ত হওয়ার দৌড়েই হোক কি সন্তানদের মানুষ করবার আশায়, গ্রাম থেকে শহরে এসে বসতি গড়েছে অনেক মানুষ। অর্থনীতির দৌড়ের সাথে তাল রেখে ব্যাংক থেকে শুরু করে নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের শাখা-প্রশাখাকে বিস্তৃত করছে শহর থেকে শহরান্তে, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এসে যোগ দিচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানে। এসব ছোটবড় নানা কারনে বাড়ির চাহিদা বেড়েই চলেছে। শুধু কি তাই, মধ্যবিত্তের হাতে টাকা জমছে, সেই টাকার একটা অংশ তারা খরচ করছে ঘর-বাড়ির সুবিধা ও সৌন্দর্য বাড়াতে। এসব নানাবিধ চাহিদা মেটাতে শহর এখন চকচকে রূপ ধারন করছে। একদিকে যেমন বাইরের মানুষ বাড়ছে, আবার অন্যদিকে ঠিক একইভাবে জীবনের নতুন নতুন আহ্বানে স্থানীয়রা ছুটে যাচ্ছে অন্যকোন শহরে বা দেশের বাইরে। এতে করে মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধন দিন-কে-দিন কমে আসছে। পথে-ঘাটে এখন অনেক নতুন-নতুন মুখ দেখি, যাদের কাওকে চিনি না, জানি না, বা কখনো দেখেছি বলে মনেও পড়ে না। চোখে চোখ পড়লে ঠোঁটের কোনায় কৃপণ হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয় অচেনার বাস্তবতা!
পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় যেন জ্বলজ্বল করছে ফেলে আসা দিনগুলো। তখন ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গের মতো, কোন ভয় আমাদের তাড়া করতো না। ইশকুলে যেতাম বান্ধবীরা এক সাথে। মার হাত ধরে কখনো ইশকুলে গেছি বলে মনে হয় না । কখনো কাঁধে ব্যাগ কখনোবা হাতে বই নিয়ে চলে গেছি; কীভাবে বইপত্র সাথে নিব, সে সব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না। স্কুলের পুরো সময় আমরা দারুন মজা করে কাটাতাম! কত খেলার উপকরন, আর বিস্তির্ণ সবুজ মাঠ। ক্লাসের ফাঁকে টিফিনের জন্য উম্মুখ হয়ে থাকতাম সকলে, কখন ঘন্টা বাজবে, আর আমরা এক ছুটে চলে যাবো মাঠে। ইশকুলে কত ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গুনে শেষ করা যাবে না। জাতীয় দিবসগুলো পালন হতো কত চমৎকারভাবে। সেখানে অনেক কিছু জানতে পারতাম, শিখতে পারতাম। এসব করতে গিয়ে দেশের জন্য মানুষে জন্য মনের ভেতরে একটা অন্যরকম অনুভূতির জন্ম হতো। কোন আড়ম্বর ছিলো না সে সব অনুষ্ঠানে। আমরা জানতাম ফেব্রুয়ারি, মার্চ, ডিসেম্বর মানেই আবেগ ছুঁয়ে যাওয়া গভীরতর এক চেতনা। এই দিনগুলোর জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম সারাবছরজুড়ে। ইশকুল কিংবা পাড়ার কোন সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো, আমরা তাতে হাজির হতাম দলবেঁধে। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে যে যা পরে থাকি না কেন, সে অবস্থাতেই ছুটে যেতাম শহীদ মিনারে। সারারাত ডালা সাজানোর কাজটা করতো পাড়ার বিভিন্ন বয়সি ছেলেরা। এর -ওর বাড়ি থেকে ফুল সংগ্রহ করতো আর তা দিয়ে চমৎকার ডালা বানাতো। তারপর খুব ভোরে পাখিদের জেগে ওঠার আগেই এলাকার সকল ছেলেমেয়ে এক হয়ে খালিপায়ে শহীদ মিনারে হাজির হতাম। এক ভিন্ন শিহরণ তখন মন জুড়ে খেলা করতো, ভাষা শহীদদের উপস্থিতি আমরা অনুভব করতে পারতাম, সেজন্য নিঃশব্দে কাফেলাকে অনুসরণ করতাম। কেবল সকলের গলায় একটানা বেজে চলতো “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানটি।
সে জায়গায় এখনকার প্রস্তুতিটা একেবারেই ভিন্নরকম। কয়েকদিন আগে থেকেই তৈরি হতে হয় দিনটির জন্য; কারন, এখন সব অনুষ্ঠানে ড্রেসকোড ব্যবহার করাটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। কে কোন পোষাকে আসবে তা আয়োজকদের পক্ষ থেকে কয়েক সপ্তাহ আগেই বলে দেয়া হয়। আবার কখনো কখনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্পন্সরের উসিলায় তাদের পোশাক চাপিয়ে দেয়। রঙিন শাড়ি, ম্যাচিং গয়না, পাঞ্জাবি, ডিজিটাল ব্যানার, ডালা সবকিছু ঠিকমত গুছিয়ে নিতে হয়। এসব করতে বেশ সময় লাগে। লাগুক। সকলের আগ্রহ ছবি তোলার দিকে। স্মৃতিতে কিছু জমা পড়লো কি না তা নিয়ে কারোরই মাথা ব্যাথা নাই, সবার আগ্রহ ক্যামেরাবন্দি হওয়ার দিকে। তারপর সমবেত হওয়ার পর আমাদের গলার বদলে মাইক তার নিজের গরজে গেয়ে চলে “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভুলিতে পারি”। একে বরাবরই কৃত্রিম মনে হয়েছে। এর মাঝে জানি না শহীদদের আত্নত্যাগের মহিমা কতটা বেঁচে আছে, তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ! এসব দেখলে কষ্টের চেয়ে মাঝে মাঝে লজ্জা লাগে! কোথায় চলেছি?
পাড়া-মহল্লার সাংস্কৃতিক চর্চা কোন জাদুর ছোঁয়ায় অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেল বলতে পারবো না। শুধু চেয়ে দেখি, তারা নাই। কোথাও নাই। এখন বাচ্চাদের ঘরবন্দী জীবন, আর খুব বেশি হলে কফিশপে ঘন্টাখানেক আড্ডা। সেই সময়টুকু ছাড়া ঘুরেফিরে ল্যাপটপ আর মোবাইল। জীবনের নানা বৈচিত্র্য যে কতটা আনন্দদায়ক হতে পারে, কতটা উপভোগ্য হতে পারে তার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া এরা পাচ্ছে না। আমাদের কিশোরবেলায় পাড়ায় “কিশোরকুঁড়ি’ নামে একটা সংগঠন ছিল। আমরা সেই সময় এই সংগঠনের সাথে কাটিয়েছি। কত ধরনের কার্যক্রম যে ছিল! জাতীয় দিবস উৎযাপন ছাড়াও এক সময় দেয়ালিকা বের হত সেখান থেকে, তাতে আমাদের নিজেদের লেখা গল্প এবং ছোট-ছোট কবিতা থাকতো। বিভিন্ন রঙে পেন্সিল দিয়ে যাঁর হাতের লেখা ভালো তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হত। এতে করে সবার মধ্যে যে চিন্তন এবং সৃজনশীলতার জন্ম হতো, তাতে সন্দেহ পোষণ করা চলে না। সংগঠনটি যারা পরিচালনা করতেন, তাঁরা প্রত্যেকেই গান-কবিতা-নাটকসহ নানা সাংস্কৃতিক গুনাবলীতে ভরপুর ছিলেন। প্রতিবছর শীতে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেখানে নাটিকা, গান, নাচ,মুখাভিনয়, কবিতা পাঠ সব থাকতো। অনুষ্ঠানটি যেন সফল হয়, সেজন্য একমাস ধরে মহড়া চলতো। সে সময় আমার একমাত্র ভাই বর্ণর ব্যস্ততা দেখে কে! যেদিন প্রথম এনামুল করিম নির্ঝর ভাইয়ের মুখাভিনয় দেখেছিলাম, সেদিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। এক কথায় অসাধারণ! উনি গানও খুব ভালো গাইতে পারতেন। সত্যি বলতে কী, উনি আমাদের গানের রিহার্সালও করাতেন। অসাধারণ এবং গভীর গলার হিরো ভাই ছিলেন উপস্থাপক। বর্ণ সবকিছু খুব ভালোভাবে অর্গানাইজ করতে পারতো, সেই সাথে অভিনয়, উপস্থাপনা সবই করতো। অন্যান্য বয়সি ছেলে-মেয়ে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকে নানা গুনাবলীতে সমৃদ্ধ ছিলেন, সেজন্য তাঁদের উপস্থিতিতে অনবদ্য হয়ে উঠতো প্রতিটি অনুষ্ঠান। এসব আমাদের জীবন প্রকৃত অর্থেই অনন্য করে তুলেছিল। সেসব দিন আজ বড্ড বেশি পেছনে টানে, ভালোলাগার আঁচলে জড়িয়ে তারা আমাকে আবেশিত করে! আমার তো মনে হয়, যে যেখানে থাকি না কেন, এই সংগঠনের সাথে যাঁরা জড়িত ছিলেন প্রত্যেকেই একটা আদর্শ, সুস্থ চিন্তাশীল মনন, এবং সাংস্কৃতিক চেতনা ধারণ করেন এখনো। দুঃখ একটাই, আমাদের সম্মিলিত স্মৃতিসম্ভারে এত ঐশ্বর্য থাকা সত্বেও আমরা হারাতে বসেছি সবকিছু– চেতনা, সৃষ্টিশীল মন, মানবিক উদারতা, সততা, নীতি ও নৈতিকতা।
মনে পড়ে শীত এলেই পাড়ায় পাড়ায় ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন হতো, আর চলতো কয়েক সপ্তাহজুড়ে। সমস্ত এলাকাজুড়ে সাজসাজ রব পড়ে যেত। একেকটা খেলার মাঠ তরুণদের উচ্ছ্বসে উৎসবমুখর হয়ে উঠতো। এখন সেই সব মাঠে উঁচু দালান, তারা দাঁত কেলিয়ে এই প্রজন্মের তরুণদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।পাড়ায় এখন কোন খেলার মাঠ নাই যেখানে বাচ্চারা একটু দৌঁড়াবে, বয়স্করা হাওয়া খাবে, বা খোস মেজাজে গল্প করবে। সত্যি বলতে কী, পাড়া থেকে একটু দূরে যে দু’একটা মাঠ চোখে পড়ে, সেখানেও খেলার কেউ নাই। বাচ্চারা এখন জানেই না একই সাথে পড়াশোনা, খেলাধুলা সাংস্কৃতিকচর্চা সবই সম্ভব। নইলে, এত খেলা ধূলা বা সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যেও আমাদের সময় এত ভালো রেজাল্ট কীভাবে করতো ছেলেমেয়েরা? আমাদের প্রজন্মই বড় হয়ে এযুগের অভিভাবক হয়েছে, তাদের দেখলে অচেনা লাগে, অভিভাবক হিসেবে তারা নিজেদের কী যে ভাবেন জানি না, শুধু দেখি প্রত্যেকেই চাচ্ছেন তাদের বাচ্চারা সবসময় প্রথম হবে, কখনোই দ্বিতীয় না। আমাদের অভিভাবকদের কাছে অমন চাপ আমরা পাইনি, সেজন্য কোন চাপ না নিয়ে আমরা প্রাণবন্ত শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কাটিয়েছি। তখন ছেলে-মেয়ে বলে কোন তফাত ছিল না। পাড়ায় একই সাথে আমরা খেলতাম, গল্প করতাম। সে এক অন্য পরিবেশ। পাড়ার প্রত্যেক বাড়িতে আমাদের যাতায়াত ছিল, অভিভাবকদের সাথে ছিল হৃদ্যতা। প্রত্যেকে আমরা সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতাম, যেন একই পরিবারের সদস্য।
কত বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল আমাদের সারাবেলা!
এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ। আসলে এটি হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, কম্পিউটার আর মোবাইল ফোনের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ। এই সমাজ কোন ভূগোলের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে না। পুরো পৃথিবী এখন মানুষের হাতের নাগালে। ডিজিটাল কেবল যে শূণ্য আর এক সংখ্যার বাইনারি তাতো না, এই ডিজিটাল এখন এক সময়, যার আগমনে আমাদের ভৌগলিকভাবে সীমাবদ্ধ আগের সামজিক জীবনের আনন্দগুলোকে একটু একটু করে কেড়ে নিয়েছে, আমরা হারাচ্ছি নির্মলতা, সামাজিকভাবে সমৃদ্ধ মায়ার বন্ধন। সীমান্তবিহীন সমাজ গড়তে গিয়ে আমরা ক্রমশ অসামাজিক হয়ে উঠছি। দিনদিন আত্নীয়, প্রতিবেশী, পরিজন থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলছি। কিছুদিন আগেও ইচ্ছে হলেই প্রতিবেশীদের বাড়িতে চলে গেছি, তারাও এসেছেন। সন্ধ্যার পরে রাস্তায় হেঁটেছি, কত জনের সাথে কথা হয়েছে । কিন্তু, হঠাৎ এক আজব পরিবর্তন আমাকে বড্ড ভাবিয়ে তুলেছে।
এবারের ঈদের কথাই ধরা যাক। বন্ধু, আত্নীয়পরিজন সকলেই ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ঈদের দিন ফোনেও অনেকের সাথে কথা হলো, শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঈদশুভেচ্ছা বেশ সুন্দরভাবে দেয়া-নেয়া হলো; কিন্ত যা হলো না, তা হচ্ছে প্রতিবছরের মত আত্নীয় বা প্রতিবেশীর বাসায় যাওয়া। শরীরটা ভালো ছিল না বিধায় ইচ্ছে থাকলেও কোথাও যেতে পারিনি। তা আমি না হয় যেতে পারলাম না, তাই বলে কেউ কি আসতে পারতো না? কেও এলো না! কারো হয়তো এসে দেখা করার কথা মনেই হয়নি। আসলে সময়টাই হয়েছে নিজেদের মত করে নিজেরা বসবাস করার মতো। প্রয়োজনে দর্শনীয় স্থানে চলে যাবো, তবু বন্ধু কিংবা আত্মীয়দের সাথে সশরীরে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করবো না। ঈদ শেষ হয়ে গেলে ঘটা করে ঈদ পূর্ণমিলনী করবো, সেখানে গল্প এবং আড্ডা মারতে মারতে ভালো-মন্দ খেয়ে নেব। আর ফেসবুক তো আছেই, সে হচ্ছে সবচেয়ে বড় বন্ধু; সেখানে আমার দেয়ালে আমি জানিয়ে দেব কতটা ভালো ঈদ কাটলো সেই কথা। ব্যাস আর কী চাই! এভাবেই সামাজিক পরিবেশটা বদলে যাচ্ছে। কখন কীভাবে এমন পরিবর্তন ঘটে গেল তা খুঁজতে জীবনের ব্যস্ততাকে দায়ী করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। এক সময় যে পাড়া গমগম করতো, আনন্দে মুখরিত থাকতো, সেই পাড়ায় এখন সুনসান নিরবতা। চেনা মানুষের সাথে দেখা হলে ঠোঁটের কোনায় হাসি দিয়ে জানতে চাওয়া, ভালো আছেন তো? ব্যাস!
এক কৃপন এবং আজব সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের আগামী প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। কীভাবে ওরা আত্নত্যাগ করতে শিখবে, কীভাবে ওরা অন্যের বিপদে ঝাপিয়ে পড়বে, কীভাবে ওরা বুঝবে মা -বাবা এবং সেই সাথে সমাজের নিরন্ন ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব? জানি, পাশ্চাত্য থেকে টেকনলজির হাত দিয়ে অনেক ভালো ভালো জিনিষ আমরা আহরণ করছি। গণতন্ত্র, মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোতে কেউই আপত্তি করবে না; কিন্তু, ঢালাওভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আহরণ করার বিপদটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। প্রাচ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ কখনোই সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি।
আমাদের সংস্কৃতির শক্তিশালী দিক হচ্ছে মানবসেবা। আরো পরিষ্কার করে বললে সামাজিক উদ্যোগে মানবসেবা এবং আত্মত্যাগ। আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেটিও আমাদের পাড়ার কয়েকজন যুবকের সামাজিক উদ্যোগের ফসল, যেখানে আমার স্বামী সারওয়ার জাহান বাবু ছিলেন অন্যতম সংগঠক। সরকারি কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি এখনো তিনি এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাস থেকে জানি, হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে শিক্ষার প্রচলন ও বিস্তার লাভ করেছিল এক সামাজিক উদ্যোগের ফসল হিসেবে, যেখানে ইশকুলের ছাত্ররা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি হাজির হতো, যে কারণে তাদের নাম হয়েছিল ভিক্ষু। সেই ভিক্ষা ছিল গৌরবের। এখনও আমাদের ‘মানবসেবা অভিযান’ চলছে সেই ভিক্ষার গৌরব নিয়ে। সুমহান এমনতর নানা সামাজিক উদ্যোগের ঐতিহ্য থাকার পরেও পাশ্চাত্যের ধারায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ মাথা চাড়া দিলে সমাজকে ঠিক রাখতে সামাজিক সংগঠনের পরিবর্তে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির খবরদারি বাড়বে। সেটাই হচ্ছে। আমি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিরোধী না; কিন্তু তার সীমারেখাটা বিবেচনায় নিতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার সাথে তার মিলন ঘটাতে হবে। একে কোনভাবেই পাশ্চাত্যের মতো অবাধ হতে দেয়া যাবে না। চারপাশের সমাজ এখন নানাবিধ অসুখে জর্জরিত, পারস্পরিক অবিশ্বাস সন্দেহ, মিথ্যাচার ঘিরে ফেলেছে আমাদেরকে, সহনশীলতার বড়ই অভাব। নিঃসঙ্গতাসহ নানা কারনে আত্নহত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। কারণে অকারণে যে যাকে পারছে ঠকাচ্ছে। প্রেমের নামে প্রতারণার মতো জঘন্য মানসিকতা তৈরি হচ্ছে ঘরে ঘরে। আর এসব ঘটনায় বাহক হিসেবে কাজ করছে স্মার্টফোন। এভাবেই সমাজ প্রতিনিয়ত ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজ ব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রগুলোকে সমূলে বদলে যখন অপসংস্কৃতির অন্ধকারে মানুষ হারিয়ে যায়, তখন বিবেক নির্বাসিত হয়, আর তখনই বিবেকবিবর্জিত কাজগুলো খুব সহজে ঘটতে থাকে।