শেষরাত্রির লেগুনা
বিচিত্রা সেন
ঘর থেকে বেরিয়ে পকেট থেকে টাকাটা বের করে আরেকবার গুণে দেখে লোকমান মিয়া। ঠিকই আছে। বরাবর পাঁচহাজার টাকা। মাছের আড়তে যাবে সে। ওখান থেকে মাছ কিনে প্রতিদিন ভোরে মাছের বাজারে বসে পড়ে লোকমান। সূর্যের আলো ফোটার পর একজন দুজন করে মানুষ আসতে থাকে বাজারে। সাতটার দিকে জমজমাট হয়ে পড়ে বাজার। এই বাজারে মাছ বিক্রি করে যা পায়,তা দিয়ে তার সংসারটাকে টেনে নিচ্ছে সে। মেয়ে দুটোকে স্কুলেও পড়াচ্ছে। স্বপ্ন দেখে লোকমান,একদিন মেয়েগুলো শিক্ষিত হয়ে মানুষের মতো মানুষ হবে। হয়তো তখন আর তাকে এ পেশায় থাকতে হবে না। মধ্যরাতে টাকাপয়সা নিয়ে আড়তে যেতে তার আর ভালো লাগে না। কেমন একটা ভয়ও লাগে। রাত মানেই তো অন্ধকার। আর অন্ধকার মানেই অশুভ শক্তির জাগরণ। যত খারাপ মানুষ আছে দুনিয়ায়, তারা রাত হলে গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। রাতের পর রাত রাস্তায় থেকে থেকে এ অভিজ্ঞতা হয়েছে লোকমানের।
আজকেও রাস্তায় নেমে তার মনটা কেমন পিছু টানে। শীতও পড়েছে এবার জেঁকে। এমন শীতের রাতে কম্বলের নিচে বউকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতে কত যে সুখ! অথচ তার এমনই পেশা, প্রতিরাতে তাকে বউকে একলা ঘরে রেখে আড়তে যেতে হয়। অথচ শিক্ষিত মানুষগুলো সবকাজ সন্ধ্যার মধ্যে শেষ করে রাতে কী সুন্দর বউ বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটায়! সে যে বাসায় থাকে তার পাশেই খুব সুন্দর একটা দালান। সেই দালানে সব শিক্ষিত মানুষরাই থাকে। সে দূর থেকে ওদের দেখে আর ভাবে,ওর মেয়েগুলোও যেন একদিন ওই মানুষগুলোর মতো জীবন পায়।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে লোকমান যাত্রাবাড়ির মোড়ে এসে পৌঁছায়। তাকে যেতে হবে মাছের আড়তে,কিন্তু আজকে তো কোনো গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে কেমন কুয়াশা কুয়াশা। কয়েকটা লেগুনা তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সে হাত দেখিয়েও ওদের থামাতে পারে না। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। আজ কী হলো! এমন তো কখনো হয় না। সবসময় সে গাড়ি পেয়ে যায়। রাত এখন তিনটা বেজে বিশ মিনিট। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ঘড়ি দেখে সে। তার এ মোবাইলটা মেয়েদের একদম পছন্দ না। এখানে কিছু দেখা যায় না,গেম খেলা যায় না,ইউটিউব নেই। এটা আবার কেমন মোবাইল!এখনকার মোবাইলগুলোতে নাকি পুরো পৃথিবী একসাথে দেখা যায়। এটা তার ছোট মেয়ের কথা। মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে। অনেক মেধাবী। স্কুল থেকে প্রতিবছর পুরস্কার নিয়ে আসে। বড় মেয়েটি বেশি মেধাবী না,তবে খুব সংসারী। ক্লাস নাইনে পড়ে। মেয়ে দুটো মানুষ করতে পারলে তার জীবনে আর কোনো দুঃখই থাকবে না।
এসব ভাবতে ভাবতে সে হয়তো কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কারো ডাকে তার সংবিৎ ফেরে। একটা লেগুনা তার সামনে দাঁড়ানো। ভেতরে দুজন যাত্রী বসে আছে। হেলপার তাকে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করছে। সে যেন হাতে চাঁদ পায়। সে তার মাছের আড়তটির নাম বলে জানতে চায় ওদিকে যাবে কিনা। ড্রাইভার চিৎকার দিয়ে বলে ওইদিকেই যাচ্ছে তারা। লোকমান হাতের বড় পাতিলটা নিয়ে লেগুনায় উঠে পড়ে। এ পাতিলটা তার বড় প্রিয়। এটাতে করে আড়ত থেকে মাছ আনে সে। খুব পয়মন্ত পাতিল এটা। কখনো এ পাতিলে মাছ পড়ে থাকে না। সব মাছ বিক্রি হয়ে যায়। এসব ভাবনার সাথে সাথে গাড়ির দুলুনিতে চোখ লেগে আসতে চায় তার। জোর করে চোখ দুটো খুলে রাখতে গিয়ে হঠাৎ সে বুঝতে পারে গাড়টি ফ্লাইওভারের দিকে ছুটছে। লোকমান মিয়া হৈ হৈ করে ওঠে। বলে,
– কই যাও তোমরা? আমি তো নিচের দিকে যামু।
হেলপার মুচকি হেসে বলে,
-চুপ কইরা বইয়া থাক্।
লোকমান কিছু বোঝার আগেই লেগুনাটি প্রচণ্ড গতিতে ফ্লাইওভারের ওপরে উঠে আসে। কেমন ভয় ভয় লাগে তার। হেলপারটা এভাবে কথা বলছে কেন তার সাথে? হঠাৎ তার পাশের যাত্রীটি তার গা ঘেঁষে বসে। সাথে সাথে পেটে সূঁচালো কিছুর গুঁতো খায় সে। গুঁতোর উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার চোখ পিংপং বলের মতো হয়ে ওঠে। একটি চকচকে চাকু তার নাভির কাছে ধরে রেখেছে পাশের যাত্রী। সামনের যাত্রী আর হেলপার এ দৃশ্য দেখে হাসছে। সে কি ঘোরের মধ্যে আছে? স্বপ্ন দেখছে না তো সে? পাশের যাত্রী তার পেটে চাকু ধরবে কেন শুধু শুধু? সে ভয়ে ভয়ে বলে,
-কী হইছে ভাই? আমারে চাকু ধরলেন ক্যান?
সামনের যাত্রী খ্যাঁ খ্যাঁ করে হেসে বলে,
-তোমার কাছে যা আছে দিয়া দাও জাদু। নাইলে এই চাক্কু তোমার নাড়িভুঁড়িরে টাইনা বাইর করবো।
তার কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে ওঠে হেলপার। সাথে ড্রাইভারও যোগ দেয়। লোকমানের খুব শীত লাগে। থরথর করে সে কাঁপছে। সে বুঝতে পারে ও যাদের যাত্রী ভেবেছিল তারা আসলে যাত্রী না। এরা সবাই ছিনতাইকারী। বড় ভুল হয়ে গেছে এ গাড়িতে উঠে। এখন আর কিছু করার নেই। ততক্ষণে ওরা ওর দেহতল্লাশি শুরু করেছে। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে সে। বিড়বিড় করে বলে,
-হে মাবুদ,আমারে বাঁচাও।
আল্লাহ কি সে ডাক শুনতে পান? বোধ হয় না। কেননা এর পরমুহূর্তেই একজন আবিষ্কার করে ফেলে লোকমানের লুঙ্গির গাঁটের মধ্যে লুকিয়ে রাখা টাকা। পাঁচহাজার টাকা পেয়ে ওদেরকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হয়। টাকাটা নিয়েই হেলপারটা ড্রাইভারকে চিৎকার দিয়ে বলে,
-ওস্তাদ,মালটারে কী করুম?
ড্রাইভার বিরক্তি নিয়ে বলে,
-কী করবি আবার? জামাই আদর করবার চাস? ধাক্কা দিয়ে ফেলাই দে।
বলেই সে লেগুনার গতি বাড়িয়ে দেয়। ওস্তাদের বাধ্য শিষ্য এরপরেই সজোরে ধাক্কা মারে লোকমানকে। রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময় লোকমানের মাথাটাই আগে পড়ে। প্রচণ্ড গতিতে মাথাটা রাস্তার কালো পিচকে আঘাত করে।মুহূর্তেই খুলি ফেটে গলগল করে বেরিয়ে আসে লাল তাজা রক্ত। হাতপাগুলোও হয়তো ভেঙে যায়। জ্ঞান হারাতে হারাতে লোকমানের মনে পড়ে তার বউ আর মেয়ে দুটোর কথা। নিয়ন বাতিগুলোর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় লোকমানের দুচোখে গভীর অন্ধকার নেমে আসে।