শিশির আজম
প্রতিকৃতি (১৯৩৫) / রেনে ম্যাগরিত্তে
সীমানা অতিক্রম করাই শিল্পের কাজ। অর্থাৎ নিজেকে অস্বীকার করা, অতিক্রম করা এমন কি নিজের প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়াটাও শিল্প করে অহরহ। আর যারা গতানুগতিকতায় আবদ্ধ তারা এই রিস্কটা নেয় না, নিতে ভয় পায়। দেখুন এই চিত্রকর্মটা। ম্যাগরিত্তে এই ছবি আঁকেন ১৯৩৫ সালে। শিরোনাম দিয়েছেন ‘প্রতিকৃতি’। শিল্পে পরাবাস্তবাদের যে উত্থান আর বিবর্তন এর অন্যতম কান্ডারী রেনে ম্যাগরিত্তে। ব্র্যাক-পিকাসো-দালির সঙ্গে আর্টের অন্যতম আলোড়ন সঞ্চারী মুভমেন্ট স্যুরিয়ালিজমের রং-জ্যামিতি-টেক্সচারের হোলি খেলেছেন। সেই সঙ্গে উপরোক্ত তিন আগ্রাসী আর্ট-মাস্টারের সঙ্গে নিজের স্বকীয়তাও দেখিয়েছেন, এবং তা সম্পূর্ণ আলাদা জাতের করে। পেইন্টিংয়ে নিজেকে তিনি আলাদা করেই নিয়েছেন, স্বকীয় ঢং-রুচি অক্ষুন্ন রেখে। এই চিত্রকর্মকে যে কেউ ‘স্টিল লাইফ’ বলে নামকরণ করতে স্বস্তিবোধ করবেন। এটাই রীতি। কিন্তু ম্যাগরিত্তের দেখাটাই আলাদা। বলা যায়, উনি ‘স্টিল লাইফে’র কাঠামোকে অস্বীকার করেছেন। অন্যভাবে বলা যায়, পোর্ট্রেটের সীমানাকে উনি ভেঙে ফেলেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কাজটা করার পর নতুন এই ফর্মকে মানতে কারো দ্বিধা হয়নি। ম্যগরিত্তেও সহজে নামকরণ করতে পেরেছেন ‘প্রতিকৃতি’। আর্টিস্ট এটাই চান। শিল্প আসলে নিজেই নিজেকে ভাংতে চায়। কবিতার ভেতর গল্প থাকে, গল্পের ভেতর কবিতা। কবিতা গান হয়ে ওঠে। গল্প সিনেমা হয়ে ওঠে। পোর্ট্রেটকে কখনো কখনো ল্যান্ডস্কেপ বলে মনে হয়। আবার শিল্পী কখনো কখনো বা মিডিয়ামের ভেতরের এই বিভাজন ভেঙে দেন। যেমন তথাকথিত নিরস বিষয় অর্থনীতির মানুষ হয়েও অমর্ত্য সেন রবীন্দ্র গবেষক ও রবীন্দ্র সংগীতের সমঝদার। জা কঁকতো কবি এবং ফিল্মমেকার। পিয়্যের পাওলো পাসোলিনির ক্ষেত্রেও শিল্প এমন। পোয়েট্রি, মিউজিক, সিনেমা বিশেষ পরিস্থিতে নিজেদের পরিবর্তিত রূপে উপস্থাপন করে। রবীন্দ্রনাথের কথা বলাই বাহুল্য। উনি শিশুদের জন্য লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে কবিতা আর গল্পকে কেবল যৌবন দিয়েছেন তাই না, এদেরকে বিশ্বমঞ্চে দাঁড় করিয়েছেন। পয়ষট্টি বছর বয়সে যখন প্রৌঢ়ত্বের ক্লান্তিতে মানুষ নুয়ে পড়ে তখন রবি মেতেছেন ছবি আঁকার খেলায়। সে খেলা এমনই যে ভারতবর্ষের চিত্রকলার ইতিহাসই ওলোটপালোট হয়ে গেছে। এ এক নতুন রবি। রবীন্দ্রনাথ নিজেকেই হয় তো নতুন করে চিনেছেন। অথবা নিজে কী, এটা প্রকাশ করবার জন্য উনি নতুন একটা মাধ্যম খুঁজছিলেন। সেটা চিত্রকলা। এটা আর্টের ম্যাজিক। সত্যজিৎ রায় তো মাস্টারক্লাস। বিশ্বব্যাপী ওনার ফিল্মমেকারের পরিচিতি রয়েছে। চিত্রকলায় ও সাহিত্যে গর্ব করবার মতো কাজ রয়েছে। আমরা জানি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মিউজিকে ওনার দখল কীরকম, উনি কীরকম সমঝদার। ‘অপু ত্রয়ী’তে মিউজিকের যে কাজ উনি দেখিয়েছেন তার প্রভাব আমাদের সিনেমায় রয়ে গেছে। অর্থাৎ শিল্পের সীমানা শিল্পই ভেঙে ফেলে। চিত্রকলায় দালি-পিকাসো-ফিদা হুসেনের মতো ম্যাগরিত্তেও রাক্ষস। আর্টের সব আবেগ-ট্র্যাডিশনকে উনি অবজ্ঞা করেছেন বা ছেলেখেলা করেছেন। কিন্তু এসবই শেষ অব্দি গড়িয়েছে নান্দনিকতায়।
****************************