You are currently viewing লিট্টিরাণী বড়ি সেয়ানী || ময়ূরী মিত্র

লিট্টিরাণী বড়ি সেয়ানী || ময়ূরী মিত্র

লিট্টিরাণী বড়ি সেয়ানী

ময়ূরী মিত্র

মিশনারি স্কুলে পড়তাম তো ৷ পুজোয় টানা ছুটি পেতাম না ৷ লক্ষীপূজোর পর একবার স্কুল খুলত ৷ কদিন ক্লাস হয়ে আবার ঠিক কালীপুজোর আগের দিন ছুটি ৷

মনে আছে — দুটো ছুটির মাঝের ওই সময়টায় স্কুল যেতে বিরাট বাঁদরামি করতাম ৷ কালো বুট পরা পা দুটোকে ঘষে ঘষে বেঢপ সব শব্দ বের করতাম ৷ শরীরটাকে হেলিয়ে দিতাম মাম্মীর গায়ে ৷ একটা হাত তুলে রাখতাম ডানার মতো ৷ এই বিটকেল শরীর নাচানো বোধহয় স্কুল যাওয়ার অনিচ্ছা ও প্রতিবাদ বোঝাতে ৷ আমাকে ভোলাতে মা বিডিন স্ট্রিটের বিখ্যাত লিটটি কিনে দিতেন ৷ রোজ রোজ এবং সবুজ চাটনিওয়ালা ৷ হেব্বি মহব্বত লাগত লিট্টি খেতে ৷

কিন্তু ওই —একদিন ! আঙুলশুদ্ধ লিট্টি গিলে আবার শুরু হত ভ্যানতাড়া —

সবাই এখনো পুজো করছে ৷ এখনো মেলায় নাগরদোলা ঘুরছে ! দোলনার হাত পা গুলোই বাক্স বুঝলে মা ! দূর আমি ঐ বাক্সে বসব ৷ বসে নীচে দাঁড়ানো তোমাকর খুঁজব মাম্মী ৷ তুমি তখন ঘাসে মিশে ছোট পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ! দূর যাব না স্কুলে ৷ —

প্যান্ডেলের প্রতিমা ছেড়ে কোথাও যেতে মন চাইত না এসময়টায় ৷ তাদের চলে যাবার সময় এগিয়ে আসত বলেই হয়ত বাড়তি একটা টান হত ৷ দেবদেবী কখনো আমার কাছে ঈশ্বর নয় কিন্তু ৷ দেবীমূর্তিগুলো ছিল আমার বন্ধু ৷ আমার থেকে সামান্য বড় ও আমার থেকে সামান্য সুন্দর কয়েকটা জরি শাড়ি পরা বন্ধু ৷ বন্ধুগুলো যে আমার থেকে সামান্য নয় , অনেকটাখানিই সুন্দর — এ সত্য জমা থাকত কেবল মনে ৷ বাইরে দেখাতাম –এই দেবী তুই আমি সমান প্রায় ৷

সত্য নিজে নিজে টের পাওয়ার একটা ফূর্তি থাকে ৷ সে ফুর্তি ভাগ করতাম দেবীবন্ধুর গলা জড়িয়ে ৷ বিশেষত পাড়ার প্যান্ডেলের লক্ষী আর সরস্বতীর ৷ আকারে ছোট হত তো ৷ দশমীতে টুল ম্যানেজ করে ওটুকু অব্দি হাত পেতাম আরকি ৷

সন্ধে নামত অতি শীঘ্র ৷ ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণিতে বসে লিট্টির চাটনি চাটতে চাটতে দেখতাম — বিডিন স্ট্রিট জুড়ে একটার পর একটা প্যান্ডেল ভাঙা চলছে ৷ দুমদাম বাঁশের আওয়াজে না ফোটা বুকে কেমন ব্যাথা ধরত ৷

দেবীগুলো রেডি হত লরিতে উঠবার জন্য ৷ হারিয়ে যাবে নাকি ওরা ? কাঁদতাম ৷ খুব কাঁদতাম ৷ সুন্দর হারাবার দুখে কাঁদতাম ৷ আমার শহর খালি হয়ে যাবার ক্রোধে কাঁদতাম ৷ ফেলে দিতে চাইতাম প্রিয় লিট্টি ৷ মা বলতেন —

খেয়ে নে ৷ দেখবি কদিন বাদে এই ভাঙা পান্ডেলেই বসবে নতুন প্রতিমা ৷ কালো কিন্তু ভারী সুন্দর দেখতে ৷ সে হবে তোর নতুন বন্ধু ৷ তার আরো জমক ৷

কালী চলে গেলে ?—- আমার প্রশ্ন ৷

—–” চলে গেলে যাবে ৷ ওরে তাতেও কি থামে দেবীর আসা ! আরো কত কত আসবে ৷ ঋতুতে ঋতুতে — প্রত্যেকটা আগেরটার থেকে সুন্দর ৷ “

মায়ের উত্তর বাচ্চা মেয়েটাকে আরো ভাবুক করত ৷ বলতাম —
সেই তো ! জরিপুতুল না এলে সব মানুষের ভালো হবে কী করে ? সবাই লিট্টি খেতে পাবে কী করে ? না মা ?

সবাই লিট্টি খাবে এই ভেবে সুক সুক করে নিজেই চাটনি টানতাম ৷ সুন্দর ফিরে পাবার সুখে বিভোর হয়ে খেতাম !

জরিশাড়ি পুতুল !
চলেই গেল ৷
কতক ল্যাংটা দৌড়োয় রাস্তায় ৷
শিক্ষক রাস্তায় ৷
ফাঁকা শিক্ষালয়ে শুধু ঘন্টা বেজে যায় ৷
রিক্ত স্বদেশ ৷
আকাল ৷
অকালের বোধন হয়ত হবে কোনোদিন !

Really ?

****************************