রোয়াল্ড ডালের দশ গল্প
অনুবাদ: মনিজা রহমান
রিমি রুম্মান
‘প্রতিটি বই হতে হবে একটি আলাদা দ্বীপ’ ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্প লেখক রোয়াল্ড ডালের উক্তিটি দারুণভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে। যদিও তিনি নিজেকে ঔপন্যাসিক হিসেবে ভাবেননি। বলেছেন, ‘একজন বিশুদ্ধ ছোটগল্প লেখক কখনো ঔপন্যাসিক হতে পারেন না’। রোয়াল্ড ডালের কিছু ছোটগল্প আগেই পড়েছিলাম। বিশেষ করে ‘বিনে ভাড়ার যাত্রী’ নামের একটি কল্পকাহিনী পড়ে বেশ মজা পেয়েছিলাম। এতে চরিত্র ছিল মাত্র ৩ জন। গল্পকথক, একজন হিচহাইকার ও পুলিশ। লন্ডনের দিকে যাওয়ার পথে হাইওয়ের পাশ থেকে গাড়িতে তুলে নেয়া হিচহাইকারের সঙ্গে চলতি পথের কথোপকথন, মজা করে গাড়ির স্পীড বাড়াতে বাড়াতে ১২০ মাইলে ওঠানো, হাইওয়ে পুলিশের কবলে পড়া, এবং জাদুকরির মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্গতি ঠেকানোর দুর্দান্ত এক গল্প ছিল। লেখকের ভাষার গতিশীলতা ও গল্পকথনের ধরণ আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছিল। কাহিনী কোথা থেকে কোথায় বাঁক নেবে, তা আগে থেকে অনুমান করা মুশকিল ছিল। এই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, কখনো কখনো গল্পের চেয়েও গল্পকথকের ভূমিকা পাঠককে অধিক মুগ্ধ করে।
বিদেশী গল্প বাংলাভাষাভাষী পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে সঠিক ও ঝরঝরে ভাষায় অনুবাদের গুরুত্ব অপরিসীম, যাতে পাঠক খুঁজে পায় চেনা স্বর। এই শহরের চেনা মুখ মনিজা রহমান। তাঁর নানাবিধ লেখার সঙ্গে আমরা পরিচিত। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ কিংবা কলাম। অধিকাংশই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বলা চলে, বরাবরই মনিজা রহমানের বুদ্ধিদীপ্ত লেখা পড়া আনন্দদায়ক। প্রথমবারের মতো তার অনুবাদ বই প্রকাশিত হয়েছে, বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক রোয়াল্ড ডালের গল্প নিয়ে। এর মাঝে ‘বিষ’ ‘খানসামা’ এবং ‘স্বর্গের পথে’ গল্প তিনটি ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ দুইভাবেই পড়া ছিল। তবুও মনিজা রহমানের অনুবাদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে আবারও পড়লাম। বাকি ৭ টি গল্প নতুন পড়া হলো অনুবাদকের কল্যাণে।
‘জন্ম ও প্রলয়ের এক সত্য কাহিনী’ গল্পটি সদ্য সন্তান জন্ম দেয়া এক মা, তার স্বামী ও ডাক্তারের কথোপকথনের এক মর্মস্পর্শী কাহিনী। পর পর তিন সন্তানের মৃত্যুর পর চতুর্থ সন্তান জন্মপরবর্তী সময়ে আবারও হারানোর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত মায়ের অজানা আশঙ্কার অনুভূতি তুলে ধরা হয়েছে এতে। যদিও গল্পটিতে কোনো বিস্ময়কর বাঁক ছিল না। ছিল সাদামাটা সমাপ্তি। অনুবাদক সুকৌশলে তার সহজবোধ্য ভাষা দিয়ে পাঠককে পরিচালিত করে এগিয়ে গিয়েছেন।
‘একটি শব্দযন্ত্র’ গল্পটি আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যাওয়া গল্প। গাছেরও যে প্রাণ আছে, আঘাত করলে সে ভয় পায়, কাঁদে, এমন বিষয় রোয়াল্ড ডাল কল্পকাহিনীর মাধ্যমে তুলে আনেন। পাঠক গল্পের গভীরে নিমজ্জিত হতে বাধ্য। যেমন, গল্পটি পড়ার পর আমি বাড়ির সামনে লনের একপাশে ফুটে থাকা গোলাপ গাছ থেকে আলতো করে ফুল ছিঁড়তে গিয়ে মনে হলো যেন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। তীক্ষ্ণ, অমানবিক, ভয়ানক কোনো চিৎকার শুনতে পেলাম! বোধকে নাড়া দিয়ে যাওয়া এই গল্পটিও বাঙালি পাঠকের জন্যে প্রাঞ্জল অনুবাদে তুলে এনেছেন মনিজা রহমান।
‘ছাতাওয়ালা বুড়া’ গল্পটি এক নির্লজ্জ, মিথ্যেবাদী, ধুরন্ধর বুড়োর গল্প। যে প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে পাউন্ড হাতিয়ে নিয়ে মদের বারে তা খরচ করে। রোয়াল্ড ডালের গল্প আক্ষরিক অর্থে পাঠককে একরকম ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। কিছু গল্প বাস্তবতার সাথে এমনভাবে পাঠককে সংযুক্ত করবে যে মনে হবে পাঠক নিজেই এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে জীবনের কোনো না কোনো এক সময়ে।
‘বিষ’ গল্পটির মাধ্যমে মূলত পরোক্ষভাবে বর্ণবাদ ও ঘৃণার বিষবৃক্ষ বোঝানো হয়েছে। গল্পে একজন ভারতীয় ডাক্তার, ভারতে বসবাসকারী ইংরেজ গল্পকথক ও তার সঙ্গীর অস্তিত্ব ফুটে উঠেছে। এর কাহিনী পাঠককে যে বার্তা দিয়ে যায়, তা আমাকে গভীরভাবে স্মৃতিকাতরতায় ডুবিয়ে রেখেছে। ছোটবেলায় নানার বাড়ি বেড়াতে গেলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মনিজা রহমানের অনুবাদে ‘বিষ’ গল্পটি পড়তে গিয়ে পূর্বে পড়া অনুবাদগল্পের মতো দুর্বোধ্য ঠেকেনি। বেশ অকপটভাবে ভাষার কারুকার্যে পড়ে গিয়েছি।
স্বর্গের পথে’ গল্পটি উত্তেজনায় ঠাঁসা একটি মর্মস্পর্শী গল্প। ম্যানহাটনের বাসার লিফটে স্বামীকে বন্দী রেখে স্ত্রী ছয় সপ্তাহের জন্যে প্যারিস ঘুরতে যায়। গল্পের সমাপ্তিটা অসমাপ্তের মতন। নিশ্চিত করে কী ঘটেছিল সেটা পাঠককে অনুমান করে নেবার ভাবনায় ফেলে দেন লেখক। সম্ভবত এমন কিছু গল্পের কারণে অনেকে লেখক রোয়াল্ড ডালকে হৃদয়হীন বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। এই গল্পের অনুবাদ পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, প্রথম অনুবাদগ্রন্থ বলেই হয়ত একটু বেশি যত্ন নিতে গিয়ে একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুবাদ করতে চেয়েছেন অনুবাদক। আমার একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত হলো, এই গল্পের কিছু কিছু জায়গায় আরেকটু সাবলীল, অকপট বাক্য হলে কিংবা ভাষার নিপুণ কারুকাজ হলে পড়তে শতভাগ আরাম হতো।
তবে অনুবাদের জন্যে গল্প নির্বাচনে মনিজা রহমান সচেতনভাবেই এগিয়েছেন বলা যায়। গল্পগুলো শেষ অব্দি পাঠককে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দিয়ে গেছে। এর বাইরে বোনাস হিসেবে পাওয়া সাক্ষাৎকার অংশটুকু অনেকখানি ভিন্নতা এনে দেবে পাঠককে। বড় লেখকদের সাক্ষাৎকার বরাবরই অনুপ্রেরণা দেয় আমায়। মুগ্ধকরা কিছু কথা মার্ক করে রেখেছি আরও বেশ কয়বার পড়বো বলে।
বন্ধু মনিজা, এক চমৎকার বিকেলে তোমার বাড়ির পাশের ইষ্ট রিভারের বিশুদ্ধ হাওয়ায় বসে আমরা বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক রোয়াল্ড ডালের গল্প নিয়ে আরও অনেক কথা বলব। বড় লেখকদের সাক্ষাৎকারের অনুবাদগ্রন্থ কিংবা বিশ্ব সাহিত্যের অনুবাদ নিয়ে সামনে আরও বই প্রকাশিত হবে এমন আশার কথা শুনবো। গল্পে গল্পে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে, তবুও আমাদের কথা ফুরাবে।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র