You are currently viewing বিচিত্রা সেন || অন্যরকম শ্রোতা

বিচিত্রা সেন || অন্যরকম শ্রোতা

বিচিত্রা সেন
অন্যরকম শ্রোতা

হঠাৎ শোরগোল এবং বিলাপে এই মধ্যরাতে ঘুমটা ভেঙে যায় রেখার। চোখ খুলে দেখে পাশে তার স্বামী বাবুল নেই। মাথাটা কেমন চক্কর দিচ্ছে,তবু উঠে বসলো সে। নারীকণ্ঠের বিলাপ এবং পুরুষকণ্ঠের শোরগোলটা কোনদিক থেকে আসছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সে। ওমা! ওর সামনের বাড়ি থেকেই তো শোরগোলটা আসছে। ও বাড়িতে অনেক লোক দেখা যাচ্ছে। বাসায় কেউ নেই। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে গেছে বাবুল। বিলাপে মনে হচ্ছে কেউ একজন মারা গেছে। কিন্তু কে মারা গেলো? বাবুলকে একটা ফোন করা যাক। বেডরুমে এসে সে মোবাইলটা হাতে নিলো। ঠিক সে মুহূর্তে বাইরে থেকে দরজা খোলার আওয়াজ। দ্রুতপায়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো বাবুল ঢুকছে। রেখা উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চাইলো,
-ও বাড়িতে কী হয়েছে? কেউ মারা গেছে নাকি?
বাবুল সোফায় গাটা এলিয়ে দিয়ে রহস্য করে বললো,
-হ্যাঁ,মরেছে,সেইসাথে তোমার কপালও পুড়েছে। মহাবিপদ সামনে।
রেখা ভ্রু কুঁচকে আগুনঝরা দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চেয়ে বললো,
-মধ্যরাতে তোমার রঙ্গ করার সখ হয়েছে? ওদের বাড়িতে লোক মরার সাথে আমার কপাল পোড়ার কী সম্পর্ক?
বাবুল আবারও রহস্য করে বললো,
-কে মরেছে এটা শুনলে তুমিও এখন আর্তনাদ করবে। বললাম না,সামনে মহাবিপদ!
রাগে রেখার সারা শরীর জ্বলে উঠলো। একে তো মধ্যরাতে ঘুম ভাঙাতে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। তার ওপর বাবুলের এসব হেঁয়ালিপনা এ মুহূর্তে একদম সহ্য হচ্ছে না। সে চেঁচিয়ে বললো,
-এ মধ্যরাতে তুমি আমার সাথে শুধু শুধু ফাজলামো করছো? মানুষের মৃত্যু নিয়ে কেউ ফাজলামো করে?
রেখাকে রাগিয়ে বাবুল খুব মজা পায়। খুব অল্পেই রেগে যায় তার বউটি। রেগে গেলে ভারী মিষ্টি দেখায় বউটাকে। ফর্সা মুখটা গোলাপি হয়ে যায়৷ এখনো রেখার মুখটা গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। তবে এ মুহূর্তে আর রাগানো ঠিক হবে না। শেষে মাথা ব্যথাটা আরও বেড়ে গেলে তাকেই ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে। তাই সারেন্ডারের ভঙ্গিতে দুহাত মাথার ওপর তুলে বাবুল বলে,
-আরে বলছি বলছি। রেগে যেও না লক্ষ্মীটি। আসলে ছবির বাবা মারা গেছে। ছবির মার সাথে কথা বলে জানলাম,ওরা লাশ নিয়ে বাড়িতে চলে যাবে। তার মানে একমাসের আগে ছবির মা আসবে না। এবার বুঝলে তো কেন মহাবিপদ বললাম?

রেখার হাত পা অসার হয়ে আসে বাবুলের কথা শুনে। হায়! ছবির মা একমাস না আসা মানে রেখার সংসার তছনছ হয়ে যাওয়া। বলতে গেলে ওর সংসারের পুরো দায়িত্ব ছবির মায়ের ওপর। রান্না থেকে শুরু করে কাপড় ধোওয়া,ঘর গুছানো,বাসন মাজা সব ছবির মা সামলায়। ও একমাস না থাকলে রেখার সংসারের কী হবে? হতাশায় সে যেন ডুবে যেতে থাকে। বাবুল আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,
-আরে,এত চিন্তা করো না তো। চলো,শুতে চলো। আমি তোমাকে হেল্প করবো।
এতরাতে ভেবে আর কী হবে? নিজেকে বুঝ দিয়ে রেখা বেডরুমের দিকে পা বাড়ায়। ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে ছবির মাকে মনে পড়ে রেখার। ছবির বাবাই তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিল পাঁচবছর আগে রেখার সংসারে। বাবুল ছবির বাবাকে বলেছিল একটা বুয়া ঠিক করে দিতে। এক বিকেলে ছবির মাকে নিয়ে হাজির ছবির বাবা। ডাক্তারের পরামর্শে তখন রেখা পূর্ণ বিশ্রামে। মারাত্মক একটা এক্সিডেন্ট করেছিল সে। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাও ছিল না তার। সেইসময় ছবির মাকে পেয়ে সে যেন অমাবস্যার রাতে আকাশে একফালি চাঁদ পেয়েছিল। ছবির মা সকাল সাতটায় চলে আসতো। তারপর কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতো রেখার সাথে আড্ডা। বাবুল খেয়ে চলে যেতো অফিসে। ছবির মা-ই সব গুছিয়ে দিতো। ছবির মায়ের ব্যবহারে কেমন একটা ঘরোয়া ব্যাপার ছিল। তাই রেখা কখনো তাকে বুয়া হিসেবে ভাবতো না। বরং কথা বলার একটা সঙ্গী পেয়ে তার বেশ ভালোই লাগতো। গল্পে গল্পে সে জেনে গিয়েছিল ছবির মা অতীতের কথা। গল্পটা শুরু করতো ছবির মা এভাবে–
-জানেন গো দিদি,এই হাতে একসময় ভিক্ষাও করসি। ক্ষুধার জ্বালায় বাজারে গিয়া খাড়াই থাকতাম। পরথম পরথম হাত পাততে খুব লজ্জা লাগতো গো দিদি। একসময় লজ্জা জানি কই পলাইলো । হাত পাইতা যা পাইতাম,বাপ-মারে আনি দিতাম। দিনের পর দিন হুদা আলু সিদ্ধ আর ভাত খাইয়া থাকসি। কতজনে কত কুপ্রস্তাব দিতো। তবুও শরীর বেচি নাই গো দিদি।

ছবির মায়ের বর্ণনাগুণে সবকিছু যেন রেখা চোখের সামনে দেখতে পেতো। একদিন কৌতূহলবশত রেখা জানতে চেয়েছিল,
-আচ্ছা, ছবির মা,তোমার স্বামী তো তোমার চেয়ে কমপক্ষে বিশ/ পঁচিশ বছরের বড় হবে। এত বয়স্ক একটা লোককে তুমি বিয়ে করলে কেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছবির মা বলে,
-দিদি গো,আছিলাম ভিখারি। ভিখারিরে কেডা বিয়া করবো কন? সে যে আমারে দয়া কইরা বিয়া করসে,একখান সংসার দিসে,হেডাই তো অনেক বেশি। হের বউ মরণের পরে তিনডা পোলার আর হের ভাত রান্ধনের লাইগা একডা কামের মানুষ দরকার আছিল। সবাই মিইলা আমারে দেখাই দিলো। একদিন মন্দিরে নিয়া আমারে বিয়া কইরা ঘরে তুললো।
রেখার কৌতূহল আরও বাড়ে,বলে,
-ওর ছেলেরা তখন কত বড় ছিল?
ছবির মায়ের দীর্ঘশ্বাস আরও গাঢ় হয়। বলে,
-ওর বড় ছেলে আমার দুই বছরের বড়। মেজটা আমার সমান,আর ছোটটা আমার তিন বছরের ছোড। ওরা আমারে কোনোদিনও মা ডাকে নাই গো দিদি। ঘরের বান্দি হিসাবেই আমারে দেখতো। হের লাইগাই তো হেগো বাপ গেরামের সবকিছু হেগোরে দিয়া আমারে শহরে লইয়া আইলো।

এভাবে প্রতিদিন গল্প করতে করতে ছবির মায়ের একেক কাহিনি জেনে নিতো রেখা। ছবির জন্মের তিনবছর পরেই ওরা শহরে চলে আসে। এখন ছবির বয়স দশ। ছবির বাবা রেখাদের সামনের বাড়িতেই দারোয়ানের কাজ করতো। ছবির মা রেখাদের বাসায় কাজটা নেওয়ার পর সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা এসেছিল। বয়সের ব্যবধান থাকলেও মোটামুটি ওরা সুখেই ছিল। ছবির মায়ের চলাফেরা, সাজপোশাক ছিল গৃহস্থ ঘরের বউদের মতোই। প্রথম নজরে কেউ তাকে বুয়া ভাবতে পারবে না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওদের জীবনকাহিনী শুনতে বেশ ভালোই লাগতো রেখার। তো,সেই ছবির মা গত কয়েকদিন যাবৎ একদম কথা বলে না। কোনো কথা জিজ্ঞেস করলে শুধু হু হাঁ বলেই চুপ হয়ে যায়। রেখা বুঝতে পারছিল কিছু একটা হয়েছে,কিন্তু কী হয়েছে সেটাই বের করতে পারছিল না। শেষমেষ ছবির মা নিজেই মুখ খুললো এক বিকেলে–
-বুঝলেন গো দিদি,মন চায় সবকিছু ফেলাই এক্কেবারে দূর হয়ে যাই। এই সংসার আর ভাল্লাগে না।
রেখা অবাক হয়ে বললো,
-এটা কী বললে তুমি? স্বামী,সন্তান ফেলে কোথায় যাবে তুমি?
ছবির মা মুখ বিকৃত করে বললো,
-ঝাঁটা মারি এমন স্বামীর কপালে। সে তার তিন পোলা ছাড়া কিছুই বোঝে না। আমারে সে বান্দি ভাবে। মাইয়াটার লাইগা সংসারটা ছাড়তে পারি না গো দিদি।
রেখা হেসে বললো,
-এই বয়সে যাবে আর কোথায়? রাগ অভিমান ভুলে মন দিয়ে সংসার করো।
ছবির মা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
-যাবো কোথায় মানে? আমি অহনই যামু কইলে কতজনে আমারে নিবার চায় জানেন? রানীর মতো রাখবো আমারে।
রেখা অবাক হয়ে বলে,
-কী বলো এসব? তোমাকে এখনো অনেকে নিতে চায়?
ছবির মা একটু লাজুক হেসে বলে,
-আমার এক দেবর তো কত মাস ধইরা ধর্না দিয়া আছে। আমি একবার হুম কইলেই আমারে আইসা লইয়া যাইবো। কিন্তু ছবিরে নিবো না। হের লাইগাই তো আমি রাজি না।

রেখা হা করে তাকিয়ে থাকে। ছবির মায়েদের জীবনেও পরকীয়া আছে? ওরাও দাম্পত্যজীবনের অপূর্ণতার ফাঁকে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে? ওর নিজের জীবনে একটা সন্তানের জন্য কত হাহাকার। অথচ ও তো কখনো এ অপূর্ণতা অন্যভাবে মেটাতে চায় না। ও জানে বাবুলের কারণেই ও মা হতে পারছে না। তবুও সে বাবুলকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো মাথায় আনেনি। আর ছবির মা কী অনায়াসে ছবিকে নিয়ে দেবরের হাত ধরতে চায়! সত্যি জীবন যেখানে যেমন। কয়েকদিন ধরে ছবির মা অনবরত সংসার ছাড়ার কথা ভাবছিল। আজ কিনা ওর স্বামীই ওকে মুক্তি দিয়ে চলে গেলো। এখন কি তাহলে ছবির মা সেই দেবরের হাতই ধরবে? ছবির মা নতুন সংসারে চলে গেলে রেখার সংসারের কী হবে? ভাবতে ভাবতে তীব্র দুশ্চিন্তায় ঘুমটাই ভেঙে যায় রেখার। কেমন এক বিপন্নতা নিয়ে উঠে বসে সে। জানালার পর্দা সরাতেই ঝলমলে রোদ মনটা ভালো করে দেয়। বাবুল ঘুমাচ্ছে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দায় রকিং চেয়ারটাতে বসে রেখা। অন্যদিন হলে এতক্ষণে ছবির মা চলে আসতো। তারপর তাকে চা-নাস্তা দিয়ে শুরু হতো অনর্গল গল্প। অথচ একটি রাত,একটি মৃত্যু কীভাবে সব পাল্টে দিলো! আজ গ্রামের বাড়িতে ছবির মা সদ্যবিধবা এক নারী। তার পক্ষে কথা বলার আজ আর কেউ নেই। তার সতীনের ছেলেরা তার সাথে কেমন করছে কে জানে! সবকিছু সেরে যদি সে আবার ফিরে আসে এই শহরে, তবে রেখার জন্য নিয়ে আসবে আরও অনেক অনেক গল্প। আবার হয়তো নাও ফিরতে পারে। ছবির হাত ধরে সে হয়তো চলে যাবে অন্য কোনো শহরে,অন্য কোনো সংসারে। সেখানে হয়তো অন্য কোনো রেখা হবে তার গল্পের একনিষ্ঠ শ্রোতা। আর প্রতিদিন নতুন নতুন গল্পের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হবে ছবির মা।
***********************************

Leave a Reply