প্রসঙ্গ: দ্বিতীয় স্বাধীনতা
নুসরাত সুলতানা
বাঙালি জাতির গঠন ও বিকাশ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সেই হাজার বছর আগে কোল, ভীল, মুন্ডা, সাঁওতাল, কৈবর্ত জাতির সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির জন্ম। অর্থাৎ অনার্যরাই আমাদের পূর্ব পুরুষ। এরপর এই জাতিকে সইতে হয়েছে আর্যদের দখল, নিপীড়ন। যেসব শাসকগোষ্ঠী বাংলা শাসন করেছে এর ভেতর পাল, সেন, সুলতানী সালতানাত উল্লেখযোগ্য জাতিগোষ্ঠী। এরপর এই বাংলা দখল করেছে মোঘল শাসকরা। মোঘল শাসকদের আমলেই এদেশে আসে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর বনিকরা। এদের ভেতর ইংরেজরা আমাদের শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলার কাছ থেকে পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয় ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর এবং তার সৈনিকরা পুতুলের মতো পলাশীর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকে। সেনাপতি এবং নবাবের আত্মীয়দের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মূল্য চুকাতে এরপর দুইশো বছর আমাদের ইংরেজদের দাসত্ব করতে হয়।
ক্ষুধিরাম, প্রফুল্ল চাকী, সূর্যসেন, তিতুমীর সহ অসংখ্য শহীদদের আত্মত্যাগে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। শুধু মাত্র ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। দুই দেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য, ভৌগোলিক অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্ব ১২০০ মাইল। যদিও আবুল কাশেম ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী দুই বাংলা, বিহার এবং আসাম নিয়ে আলাদা একটা রাষ্ট্র হবার ব্যপক সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব হালে পানি পায়নি তখন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব বৃটিশদের খুব আকর্ষণ করে।
১৯৪৭ সালে যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ সালেই সেই রাষ্ট্রে ভাষা নিয়ে সংঘাত শুরু হয়। যার চুড়ান্ত পরিনতি ৫২ এর ভাষা আন্দোলন। ৫২ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল- আমরা বাঙালি। পাকিস্তানি নই। সেই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মধ্যবিত্তের সন্তানরাই বেশি ছিল। কারণ উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে তাদের চাকরি -বাকরি পেতে ব্যাপক অসুবিধা ছিল। তাছাড়া বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াইও ছিল বটে।
এরপর ধীরে ধীরে আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একটি মুখ পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গন অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। যদিও ২৭ শে মার্চ থেকে ১৬ ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সফল সংগঠক এবং পরিচালক তাজউদ্দীন আহমেদ এবং মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি এম এ জি ওসমানী। কিন্তু যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামেই। একটা সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর সাথে একটা দেশের সাধারণ মানুষের অসম যুদ্ধে আমাদের টিকতে পারার কথা ছিল না। কিন্তু আমরা মরতে শিখে গিয়েছিলাম। ভারত আমাদের শেষের দিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে কিন্তু তখন ঢাকার চারপাশ প্রায় আমাদের গেরিলাদের দখলে। কিন্তু সেই যুদ্ধে আমাদের জানমালের যে ক্ষতি হয়েছে তা বিশ্বে আর কটা যুদ্ধে হয়েছে তা খুব বড় বিবেচ্য বিষয়। তারপরও ভারত শররনার্থীদের আশ্রয় যেভাবে দিয়েছে তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং আছে ইতিহাসের পাতায়।
১৬ ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন আসলে পোড়ামাটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তিনি একবছরের মাথায় সংবিধান দিয়েছেন, জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স গড়ে তোলেন। হ্যাঁ তাঁর আমলেও সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেশকে পুনর্গঠন করেন। রাস্তা, ব্রীজ, কালভার্ট, বৈদ্যুতিক লাইন সবই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু সব আবার পর্যায়ক্রমে নির্মাণ করেন। নারী শিক্ষা এবং নারীদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি নারী কোটা প্রবর্তন করেন। দেশ অচল থাকাকালীন শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ করেন এবং শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করেন। তিনি তাঁর পরিবারের লোককে সামলাতে পারেননি। আর দূর্নীতিও জেঁকে বসেছিল। তিনি নিজেই বলেছেন – আমি চাইয়া চিন্তা আনি। চাটার দলে সব চাইট্টা খাইয়া ফালায়। আবার বলেছেন – সাত কোটি কম্বল আনলাম আমারটা গেল কই! বঙ্গবন্ধুর চুড়ান্ত বিপর্যয়ের সময় চলে আসে যখন তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুই শুধু স্বপরিবারে নিহত হননি। বরং তখনই দেশে হত্যা এবং ক্যু এর রাজনীতি শুরু হয়। খালেদ মোশাররফ, কর্নেল তাহের সহ আরও অভ্যুত্থানের পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। এসেই বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তখনই তিনি ৭১ এর পরাজিত শক্তি জামাতকে রাজনীতির সুযোগ করে দেন। কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। সমালোচকদের মতে তিনি জাতীয় পতাকার লাল রঙের পরিবর্তে কমলা করতে চেয়েছিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে অসংখ্য মানুষকে ফাঁসি দিয়েছেন। সমালোচকদের মতে ছাত্রদের হাতে জিয়া অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। তারপরও জিয়াউর রহমান একটা কঠিন সময়ে রাজনীতিতে স্থিরতা এনেছিলেন। অর্থনীতি চাঙ্গা করেছিলেন।
১৯৮১ সালের ৩০ শে মে জিয়াউর রহমান খুন হলে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। এরশাদ নিয়োগ ছাড়া উন্নয়ন কাজ ভালোই করেছিলেন। বিশেষ করে ব্রীজ, কালভার্ট, রাস্তা এসব প্রচুর নির্মাণ হয়েছিল দেশে। স্থানীয় প্রশাসন বা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও এরশাদের উল্লেখযোগ্য কাজ।কিন্তু এরশাদ ও ১৯৮৩ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি জয়নাল, দীপালি, জাফর সহ ছয়জনকে হত্যা করেন। এরপ্র নূর হোসেন, ডাক্তার মিলন সহ ১৬ জনকে হত্যা করে ১৯৯০ এর ৬ ই ডিসেম্বর গন অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।
এরপর আবার ক্ষমতায় বি এন পি ও আওয়ামী লীগ। যথাক্রমে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। বি এন পি প্রথম মেয়াদে তবু ভালো ছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থাৎ ২০০১- ২০০৬ হাওয়া ভবন, ২১ শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা, বাংলা ভাইয়ের উত্থান ইত্যাদি আমাদের জনজীবন বিষিয়ে তুলেছিল। যদিও বি এন পি গার্মেন্টস সেক্টরকে প্রসারিত করেছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছিল, কৃষি পণ্যের দাম কমিয়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রেখেছিল বেশ। কিন্তু দু: শাসন, মৌলবাদ এবং হত্যা লুটপাটে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়েও তারা কূটকৌশল শুরু করেছিল।
আওয়ামীলীগ ২০০ ৭ এ বিরোধী দলে থাকতেই লগি বৈঠার আন্দোলনে তাদের ফ্যাসিবাদী চেহারা দেখিয়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। আর জনপ্রিয়তাই বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের কাল হয়ে দাঁড়ালো। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তারা মাসের আন্দোলন করলো সেই ব্যবস্থা তারাই বাতিল করলো। নিজেরা নির্বাচন করে টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে লুটপাট, দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিনত করলো বাংলাদেশকে। আর সেই কাজে ব্যবহার করলো- মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসমাজের কোটা আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও দলটির সভানেত্রীর ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেতেই থাকে। ছাত্র -জনতার বিপ্লবে সহস্রাধিক মানুষ খুন করে ৫ আগষ্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান হাসিনা। যদিও হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, ইলেকট্রিসির পর্যাপ্ত উৎপাদন এগুলো করেছিলেন। কিন্তু সুশাসন এবং গনতন্ত্র ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তারা কাজেও ধরে রাখতে পারেনি। মৌলবাদ ও ব্যপক ভাবে ডালপালা ছড়ায় বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনার শাসন আমলে।
একটা বিষয় লক্ষনীয় – সব প্রধানমন্ত্রী বা নেতাই ক্ষমতা আর দেশকে নিজের ভেবে নিয়েছেন। দেশকে জনগণের ভাবেননি এবং জনগণকে ক্ষমতার উৎস শুধু মুখেই বলেছেন। তারপর ও বলব- এই সকলের ভেতর বঙ্গবন্ধুই অনেকটা আলাদা। তিনি বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বলেছেন – আপনারা সব জানেন ও বোঝেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনে ৪৬৮২ দিন জেল খেটেছেন। পাকিস্তানের কারাগারে শেষ মুহূর্তে ও ভুট্টো আপোষের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন – আমি আমার জনগণের সাথে কথা না বলে আমি কিছু বলতে পারবো না। বাঙালি এবং বাংলাদেশের প্রশ্নে তিনি আমৃত্যু আপোষহীন ছিলেন। তাই তিনিই আমাদের জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্থপতি।
আর মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ভুলে গিয়েছিলাম কে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নারী, পুরুষ। আমরা সবাই বাঙালি হয়ে উঠেছিলাম। সাত সমুদ্র রক্ত দিয়ে বাঙালি লাল- সবুজ পতাকা কিনেছে। তাই ২৪ এর ছাত্র- জনতার বিপ্লবকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে মুক্তিযুদ্ধ এবং এই বিপ্লবকে কলুষিত করবেন না দোহাই।
একটা দেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় স্থাপনা, জাতির পিতা এগুলোকে সংরক্ষণ করতে হয় সবার আগে। এগুলোতে হাত দিতে আসবেন না বাঙালির সহ্য হবে না ভায়া। ২৪ এর বিপ্লবের আপামর ছাত্র- জনতাকে আবারও অভিনন্দন। এটা প্রমাণিত – এই দেশ স্বৈরাচার এবং মৌলবাদের কাছে কখনো মাথা নোয়াবে না।
নুসরাত সুলতানা
কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।
তথসূত্র: উইকিপিডিয়া, বাঙ্গালির ইতিহাস – আদিপর্ব – নীহার রঞ্জন রায়, মূলধারার -৭১ – মঈদুল হাসান
বাংলাদেশের রক্তঋণ- এন্থানি মাসকারেনহাস
আমি সিরাজুল আলম খান বলছি- শামসুদ্দিন পেয়ারা
বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় ( ১৯৭৫-৮১) – ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)
**********************************