You are currently viewing পিপুফিসু || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিসু || আলী সিদ্দিকী

 

পিপুফিসু 

আলী সিদ্দিকী

সমাপ্ত

পিপুফিসু 

এ্যাই শুনছো? বিশাখা হাত দিয়ে নাড়া দিলো আমাকে।
কি হলো আবার? ঘুম ছুটে যাওয়ায় মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে উঠলো।
আতিকের ফোন। বিশাখার কন্ঠস্বর কেমন যেন শোনালো।
ক’টা বাজছে? আমি চোখ খুলি না।
আটটা দশ।
কি বলছে সে? আমি কাঁথাটা টেনে নেয়ার জন্যে হাত বাড়ালাম।
আহা রাখো তো, বিশু কাঁথা নিয়ে নিলো, কথা বলো ওর সাথে-।
কি হয়েছে বলবে তো?
নিজে শোনো-। চোখ খুলে বিশুর দিকে তাকিয়ে ভড়কে গেলাম। ওর মুখটা থম থম করছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসে ওর হাত থেকে ফোনটা নিলাম।
হ্যালো আতিক-।
আমি শেষ হয়ে গেলাম আফসার ভাই- অন্যপ্রান্তে আতিকের কান্নাভেজা গলা শুনতে পেলাম।
কি হয়েছে বলবে তো? আমার পঞ্চেন্দ্রিয় হঠাৎ সজাগ হয়ে গেলো।
পুলিশ এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে, আপনি কি একটু আসবেন? আতিক যেনো ভেঙে পড়লো।
পুলিশ কেন ? প্রশ্ন করেই আমি যেন বোকা বনে গেলাম। ইউএস ইমিগ্রেশন আতিককে দু’বার ডিপোর্ট করেছে। সে আপীল করে সময় বাড়িয়ে লড়াই করে যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। উকিল শুধু কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়েছে কিন্তু ওর কেসের কোন হিল্লে করতে পারে নি। আমিও বার কয়েক উকিলের সাথে কথা বলেছি। উকিলের এক কথা, আতিককে অনেক আগেই কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে নতুনভাবে কেস মুভ করার জন্যে বলেছি, সে শোনেনি। এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আদালতে ওর মামলা খারিজ হয়ে গেছে। এখন আপীল করে হয়তো কিছুদিন সময় বাড়ানো যাবে কিন্তু আখেরে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
আমিও আতিককে একটা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করার জন্যে বহুবার বলেছি। সে রাজী হয়নি। তার এক কথা, মানুষ জীবনে বিয়ে একবার করে। নকল বিয়ে করে নকল জীবন মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না আফসার ভাই।
শেষমেষ লিনোরার সাথে ঘনিষ্টতা হবার পর আমি আর বিশু আতিকের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠি। মেয়েটার চাল চলন কথাবার্তায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি। আমরা বুঝতে পারছিলাম নিরহঙ্কারী মেয়েটা সত্যিই আতিককে ভারলোবেসে ফেলেছে। তার বাংলা শেখার আগ্রহ এবং বাঙালী মেয়েদের মতো শাড়ী পড়ার ইচ্ছে দেখে আমরা খুশী হয়েছি। বিশু তো রীতিমতো মাষ্টার সেজে ওকে বাংলা বর্ণমালা এবং শাড়ী পড়া, কপালে টিপ দেয়া প্রভৃতি শিখিয়েছে। ফ্লোরিডা থেকে ফেরার পর লিনোরা বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করতে থাকে। সে বাঙালীর বিয়ের ধরণ নিয়ে বিশুর সাথে কথাবার্তা বলে ধারণা নেয়। বিশুও ওকে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়। তার আশা এতেও যদি আতিকের এদেশে লিগ্যাল হবার একটা পথ বেরিয়ে আসে। তাই সে ঘটা করে বিয়ের আয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদিও আমি জানতাম ডিপোর্ট অর্ডারের বিরুদ্ধে করা আতিকের আপীল ঠিকবে না। আজ হোক কাল হোক তাকে দেশে যেতে হবে। তবে সেটা আজ ওর বিয়ের দিন হবে তা কল্পনাও করিনি। তাই কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম প্রথমে। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ধাতস্থ হলাম।
আমি এখুনি আসছি, তুমি ঝটপট দরকারী কাগজপত্র গুছিয়ে নাও। ফোন রেখে ফিরে দেখি বিশুর পেছনে লিনোরা দাঁড়িয়ে। লিনোরা যে বিষয়টি জানে না তা নয়। তার লেখাপড়ার চাপের কারণে সে বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেছে। এজন্যে ওকে কোনভাবে দোষ দেয়া যায় না। তাছাড়া ডিপোর্ট অর্ডার হবার পর বিয়ে করলেও কেস মুভ করা সম্ভব হতো না। তবে হ্যাঁ, একমাত্র লিনোরাই পারে আতিককে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে। যদি সে বাংলাদেশে গিয়ে আতিককে বিয়ে করে তাহলে আতিকের ফিরে আসা সম্ভব হবে। আমি ওকে সে কথা বলার পর সে একটু চিন্তা করলো।
ওকে তো কিছুদিন পুলিশ কাস্টডিতে রাখবে আফসার, আমি এটর্নী দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারবো। দৃঢ় কন্ঠে বললো সে।
তাহলে তো অনেক ঝামেলা কমে যাবে। আমি গায়ে জামা চাপালাম।
আমি যাচ্ছি তোমার সাথে, লিনোরা ভেতরে চলে গেলো।
চলো, আমিও যাই- বিশু বেরিয়ে এলো আমার সাথে।
বাইরে পা দিয়ে দেখি আদিব, আবির আর অর্পি দাঁড়িয়ে। সবার মুখ থমথমে। দরোজা লাগিয়ে আমারা আতিকের বাসার দিকে এগোলাম। এতটুকু পথ। ভারাক্রান্ত ছয়টি মনের ভারে এই পথটুকুকেও অনেক দীর্ঘ মনে হলো। ওর বাসার সামনে তিনজর পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখে ওরা গুডমর্ণিং বললো।
গুডমর্ণিং।
নীরবে সবাই আতিকের বাসায় ঢুকলাম। অফিসাররা লিনোরাকে খুঁটিয়ে দেখলো। সে কোন ভ্রƒক্ষেপ না করে আমাদের অনুসরণ করলো। ঘরে দু’জন অফিসার সোফায় বসে আছে। আতিক টেবিলে বসে দ্রুত হাতে কাগজপত্র গোছাচ্ছে। লিনোরাকে দেখে তার চোখ ঝোড়া ছল ছল করে উঠলো। লিনোরা ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলো, সব ঠিক হয়ে যাবে আতিক। আমার ওপর আস্থা রাখো।
উই আর লেট মি. আতিক, অফিসারদ্বয় উঠে দাঁড়ালো।
ফাইভ মোর মিনিটস প্লিজ, লিনোরা অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললো।
আফসার ভাই-।
আতিকের ডাক শুনে আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। সে আমাকে রেন্টের চেক, গাড়ীর চাবি, ঘরের চাবি, কিছু ব্ল্যাঙ্ক চেক, দেশের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার এবং কিছু বিল বুঝিয়ে দিলো।
আমাকে তো কাউন্টি জেলে রাখবে ক’দিন যোগাযোগ করবেন, ধরা গলায় বললো আতিক, আমার হয়ে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন।
তুমি চিন্তা করো না আতিক, লিনোরা বললো, আমি আসছি সেখানে। দেখি কিভাবে কি করা যায়।
হোয়াট হ্যাপেন আতিক, লিনো? এসময় জন, সিন্ডি আর পল এসে ঢুকলো ঘরে। তাদের চোখে মুখে বিস্ময়।
আতিক ডিপোর্টেড বাই আইএনএস, লিনোরা বললো।
তাহলে আজ বিয়ের কি হবে? পল অবাক কন্ঠে বললো।
আজ না হয় কাল হবে, হাসি ফোটাতে চাইলো লিনোরা।
ওর বিয়ে নাকি? মধ্যবয়েসী অফিসারের গলায় বিস্ময় ফোটে।
হ্যাঁ, আজ।
কনেটা কি উনি? লিনোরার দিকে ইঙ্গিত করলেন অন্যজন।
হ্যাঁ আমি. লিনোরা সপ্রতিভ ভাবে বললো।
একটু লেট হয়ে গেলো মনে হয়, প্রথমজন বললো, বাট স্টীল দেয়ার ইজ এ ওয়ে টু মেক আ ফ্যামিলি।
আই হোপ, জন বললো।
বাট নাউ উই হ্যাভ টু লিভ, অফিসার দোর গোড়ায় এসে দাঁড়ালো। মানে তোমরা বেরিয়ে পড়ো।
আমরা সবাই একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে আতিক যখন আবিরের কাছে এলো। অমনি ছেলেটা ওকে ঝাপটে ধরলো।
তুমি যেয়ো না আঙ্কেল, তুমি যেয়ো না।
আমি আবার আসবো বাবা, বাকরুদ্ধ গলায় আতিক অশ্রু সংবরন করার চেষ্টা করতে লাগলো। অর্পি, আদিব আর বিশু গিয়ে ওর হাত ধরলো। সবার চোখ অশ্রুসিক্ত। এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে অফিসাররা একটু যেনো হতভম্ব হয়ে গেলো। লিনোরা, সিন্ডি, পল আর জন সবার চোখ ভিজে উঠলো।
সকালের সোনাঝরা রোদ মাড়িয়ে আতিক পুলিশের গাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলো। অফিসার দরোজা খুলে তাকে নিয়ে ভেতরে বসলো। সবাই হাত তুলে বিদায় জানালো। গাড়ী চলতে শুরু করলো ধীর গতিতে।
ড্রীমল্যান্ড না ছাই, জন রাগে গর গর করে উঠলো, দিস্ ইজ আ ফাকিং কান্ট্রি, ওরা আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে কেড়ে নিলো।
এভরিথিং উইল বি ওকে জন, সিন্ডি ওকে জড়িয়ে ধরলো।
নাথিং উইল বি ওকে সিন্ডি, জন শিশুর মতো কেঁদে ফেললো, আই লস্ট মাই ফ্রেন্ড।
ট্রাস্ট মি জন, লিনোরা দৃঢ় গলায় বললো, আই উইল ব্রিং হিম ব্যাক।
তাই যেন হয় লিনো, বিশু লিনোরাকে টেনে নিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ায়, তাহলে তোকে আমি বোন বানিয়ে নেবো।
গাঢ় নীল আকাশ রোদের বন্যায় ভেসে গিয়ে সুন্দর একটি দিনের জানান দিচ্ছে। চারদিকে ঝকঝকে বাড়ীঘর, বিচিত্র ফুলের বাগান আর সবুজের সমাহার। সুখী আমেরিকানদের অনেকে এমন দিনকে বলে, এনাদার ডে ইন প্যারাডাইস। কিন্তু বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের মানুষগুলোও নাইন-ইলেভেনের পর থেকে রুক্ষ্ম, রূঢ়, চরম বর্ণবাদী ও ধর্মান্ধ হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে আরো দুঃসময় অপেক্ষা করছে প্রবাসী মানুষগুলোর জন্য, এতে কোন সন্দেহ নেই।
একটি জীবন পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে এই ডিপোর্টে কিন্তু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশটির আইন অন্ধ, নিষ্ঠুর। আমেরিকা হলো অভিবাসীদের দেশ। এদেশে সারা বিশ্ব থেকে অবৈধ ভাবেই মানুষ এসেছে। সাদারা এদেশে আগে এসেছে এবং রেড ইন্ডিয়ানদের বিতড়িত করে আমেরিকাকে আবাদ করেছে। এক্ষেত্রে যতো না সাদাদের অবদান তার চেয়ে বেশি কালো মানুষদের অবদান। কিন্তু অর্থবিত্ত, শিক্ষা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ওরা কাউকেই তোয়াক্কা করে না। অভিবাসন আইন থেকে শুরু করে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা তাদের অনুকূলে করে রেখেছে। এ যেনো লোকগল্পের পিপুফিসু (পিঠ পোড়ে= পিপু, ফিরে শোয়= ফিসু) । আগুনে যখন একজনের পিঠ পোড়ে আর অন্যজন পাশ ফিরে শোয়। এরা মানুষের চোখের কান্না দেখেনা।
হুস্ করে একটা দীর্ঘশ্বাস আমার বুক চিরে বেরিয়ে এলো। স্বপ্নের এই দেশে এসে কতো আতিকের যে স্বপ্ন ভস্ম হয়ে গেছে তার হিসেব কে রাখে? লিনোরা কি রাখবে? জানি না।

***************************

Leave a Reply