You are currently viewing পিপুফিশু -৯ ||  আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু -৯ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু

আলী সিদ্দিকী

রক্তক্ষরণে আদিব-৯

দু’হাতে ঘরের সব কাজ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় আমাকে। উইক ডে-তে ঘরের দিকে তাকানোর ফুরসত মেলা ভার। মাঝরাতে কাজ থেকে ফিরে এসে কিছু খেয়ে কিংবা না খেয়ে শুতে না শুতেই ওর কাজে যাবার সময় হয়ে যায়। রাতের শেষ প্রহরের নিদ্রা থেকে ওঠা যে কি কষ্টের, তবু উঠতে হয়। ওকে নাস্তাটা তৈরী করে না দিলে হয়তো না খেয়েই চলে যাবে। তাছাড়া দিনমান তো দু’জনের দেখাই হয় না। ও সাড়ে তিনটায় বাচ্চাদের নিয়ে যখন ঘরে ঢোকে তখন আমি কাজে। বিকালটা তার কাটে বাচ্চাদের হোম ওয়ার্ক নিয়ে। (কাজের এ ধরণের সিডিউল না নিলে বাচ্চারা বখে যাবার সম্ভাবনা একশত ভাগ। এখানে যারা ডলারের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে, দুইটা ফুল টাইম জব করছে, তাদের ব্যাংক একাউন্ট ফুলে ফেঁপে উঠলেও বাচ্চারা যে বখে যাচ্ছে তা সকলেই জানে। পত্র পত্রিকায় লেখাও হচ্ছে আকচার। তাই আমরা নিজের কষ্টকে তুচ্ছ জ্ঞান করে দু’জন দুই শিফটে কাজ করছি।) যখন ঘরে আসি তখন সবাই ঘুমে অচেতন। ওকে বিদায় দেয়ার পর চোখ জোড়া আর এক হতে চায় না। জানালার বাইরে যখন দিনের আলো অন্ধকারকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় তখন বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আর ঘুমটা গাঢ় হতে না হতেই বাচ্চাদের স্কুলে যাবার সময় হয়ে যায়। অগত্যা আবার উঠতে হয়। বাচ্চাদের রেডি করে স্কুলে পাঠিয়ে দেবার পর একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। এটা ওটা করতে করতে সময় হয়ে যায় কাজের। এভাবেই তো চলে যাচ্ছে জীবন গত কয়েক বছর।

অবশ্য যে ধরণের উচ্চাশা পোষণ করে বাচ্চাদের নিয়ে এদেশে চলে এসেছি তেমন কিছুই করতে পারিনি আমরা। দু’জনে রাতদিন কাজ করে কোন রকম সচ্ছলভাবে দিন কাটাচ্ছি। ইচ্ছেমতো খরচ করার সুযোগ না থাকলেও বাচ্চাদের চাহিদা মোতাবেক সবকিছুই দিতে পারছি, এটাই আনন্দের। দেশে যা কোনভাবেই করা সম্ভব হতো না। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, এদেশে আসার পরই আমার পূর্ণাঙ্গ সংসার হয়েছে, বিয়ের প্রায় দশ বছর পর। ওকে সংসারে যতোটুকু পাচ্ছি আগে এর সিকি ভাগও পাওয়া যেতো না। সারাজীবন বহির্মুখী মানুষটাকে তিন তিনটে সন্তানের বাঁধন দিয়েও ঘরে ধরে রাখা যেতো না। সারাক্ষণ সামাজিক আচার বিচার, দেন দরবার নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। অথচ সংসারের অভাব অভিযোগ শোনার মতো ফুরসত মিলতো না। আর এই প্রবাসে সে-ই লোকটাই এখন সারাক্ষণ সংসারকে, বাচ্চাদেরকে আগলে রাখে। এর চে’ বড়ো পাওয়া আর কি হতে পারে আমার !

আসলে এভাবে দীর্ঘদিন কাজ করাও সম্ভব না। এদেশে পড়ালেখার পেছনে ভীষণ খরচ। ছেলেমেয়েরা কলেজে গেলে আমাদের বিস্তর খরচ করতে হবে। না হলে সব আশাই মাটি হয়ে যাবে। আর সেজন্যে দরকার সঞ্চয়। কিন্তু আওয়ারলি কাজ করে কোনভাবেই তা সম্ভব নয়। তাছাড়া বাবা-মা আর অসুস্থ ছোট ভাইকে রেগুলার টাকা না পাঠালে ওদের না খেয়ে থাকতে হবে। এটা তো আমি হতে দিতে পারি না। অন্যদিকে ওকে বড়ো ভাইয়ের সংসারের দিকে তাকাতে হয়। জীবনে কিছুই করতে পারেনি বড়ো ভাই। বাবা বেঁচে থাকতে বাবা আর তিনি গত হবার পর শ্বাশুড়ী আর মেজো ভাইয়ের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া তিনি সংসার চালাতে পারতেন না। পাঁচটা ছেলে মেয়ে নিয়ে বড়ো ভাই কষ্ট পাবে এটা ও কোনভাবেই সহ্য করতে পারে না। অগত্যা সেদিকেও খরচ করতে হয়। ঈদে পার্বণে তো খরচ আছেই। সবদিক সামাল দিয়ে বাচ্চাদের ভবিষ্যতের জন্যে সঞ্চয় করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। আসলে ব্যবসা করতে পারলে নতুবা এখানে পড়ালেখা করে ভালো চাকরী করতে পারলে সচ্ছলভাবে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু সংসার চালিয়ে পড়ালেখা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। সেজন্যে ওর মনে অনেক কষ্ট। তার ইচ্ছে ছিলো এদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া। কিন্তু তার কোন সম্ভাবনাই নেই। ব্যবসার জন্যেও সে নানাভাবে চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কমিউনিটি বেইসড বিজনেসে ও কোন আগ্রহ দেখায় না। বলে, নিজস্ব লোকজন না থাকলে অন্যের ওপর নির্ভর করে এসব ব্যবসা সম্ভব নয়। আসলে সে কিভাবে কি করবে তার কোন দিশা পাচ্ছে না। ছেলেমেয়েদের সাথে সারাক্ষণ হাসিখুশী থাকলেও আমি জানি ভেতরে ভেতরে সে কতো টেনশনে থাকে। এজন্যে আমার চিন্তা হয়। এই এখন সওদা আনতে গেলো গ্রোসারীতে। যাবার আগে বললো, আসলে আমি এক মহা অকম্মা।
কেন বললো সে একথা ? যদিও মনে হচ্ছিল সে দুষ্টুমী করেছে। কিন্তু সে যেনো প্রচ্ছন্নভাবে নিজের কষ্টটুকু আমার কাছে প্রকাশ করেছে। ওর স্বপ্ন ছিলো তাদের পরিবারটাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দেবে। কিন্তু ভাইরা নিজেদের পরিবর্তন করার ব্যাপারে সিরিয়াস নয়। একার পক্ষে সবকিছু করাও সম্ভব নয়। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, মানুষের স্বপ্ন থাকে। কিন্তু সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। এজন্যে আক্ষেপ করার কোন মানে হয় না – এমন করেই বলে সকলে। আসলে কেউই নিজের অন্তর্গত আক্ষেপ থেকে মুক্তি পায় না। আমারও কি সব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ? আমার বোনগুলো বেশ ভালো অবস্থানেই আছে। ওদের মধ্যে একটা বোন একটু কষ্টে থাকলেও অন্য তিনজন বহাল তবিয়তেই আছে। অথচ সবাই ভেবেছিলো আমিই সবার চেয়ে ভালো থাকবো। আমার জন্যে সবসময় উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে প্রস্তাব এসেছিলো – ডাক্তর, ইঞ্জিনিয়ার, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। অথচ পড়ালেখার জন্যে আম্মা কখনো রাজী হয়নি। আর শেষমেষ আমার পছন্দ হয়ে গেলো তুখোড় এক ছাত্রনেতাকে। যার পরিবারিক স্ট্যাটাস আমার আত্মীয়স্বজনরা মেনেই নিতে পারেনি। শুধুমাত্র আব্বার সম্মতিতেই আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো। আসলে মানুষের কোনকিছুই নিখুঁত হয় না। বিয়ের আয়োজনটাও আমাদের আশানুরূপ হয়নি। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে, সমস্ত অপ্রাপ্তি আর অসন্তোষের পরও আমি সুখী হয়েছি। একজন সচেতন আর দরদী হৃদয়ের মানুষ পেয়েছি। ও এতো স্পষ্টভাষী যে, কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। একধরণের একরোখামি ওর স্বভাবজাত। ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলতে ও একটু দ্বিধা করে না। যাকে ভালো লাগে তার জন্যে সাতখুন মাফ কিন্তু যাকে পছন্দ করে না তার ধারে কাছেও ঘেঁষে না। ও টেকনিকেলের চেয়েও মানবিক বেশী। এজন্যে বন্ধু সংখ্যা হাতে গোণা। ওসব সে কেয়ার করে না। আমি লক্ষ্য করেছি, প্রভাবশালীদের চেয়ে প্রভাবহীনদের প্রতি ওর আনুপাতিক দুর্বলতা বেশী। বড়োদের প্রতি যেমন ছোটদের প্রতি আরো বেশী। ওর মতো স্নেহবৎসল মানুষ কমই দেখা যায়। বাচ্চাদের নিয়ে এমন মেতে থাকতে পারে, যা আমার ধাঁতে সয় না। বাচ্চারা যে সব জিনিসে আনন্দ বেশী পায় যেভাবেই হোক না কেন তা কেনা চাই। আর্থিক অবস্থার চেয়ে আনন্দ লাভটাই বড়ো করে দেখে সে। তার একটাই যুক্তি, আমি ছেলেবেলায় যা পাইনি – আমার বাবা আমাকে দিতে পারেনি – আমার ছেলেমেয়েরা তা থেকে কেন বঞ্চিত হবে ? ওরা উন্নত দেশে বেড়ে উঠছে, ওদের এখানকার বাস্তবতায় সমর্থ করে না তুললে ভবিষ্যতে হাবলা বলে খ্যাতি কুড়াবে। গার্ডিয়ানদের কিপটেমির জন্যে বাচ্চারা সারাজীবন সাফার করুক তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অতএব, ওর কাজে বাধা দেয়ার মতো যুক্তি খুঁজে পাই না।

এই তো গতকাল তিন ছেলেমেয়ের জন্যে ত্রিশ ডলার খরচ করে ওয়াটার গান কিনে দিয়েছে। ছেলেমেয়েদের একটা কিছু দিতে পারার আনন্দ যে কি রকম তা ওকে অই মুহূর্তে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। প্রথমে মিটমিট করে হাসবে, পরে বাচ্চাদের নিয়ে নিজেই মেতে উঠবে হল্লাতে। আর আবদারের জিনিস পেয়ে ছেলেমেয়েরা বাবাকে ভরে দেয় চুমোয় চুমোয়। সে এক অপার্থিব দৃশ্য। আমি ভেবে অবাক হই, কি মানুষটা দিনে দিনে কেমন বদলে গেলো। তার উচ্ছ্বাস আমাকে স্পর্শ করলেও চাপা স্বভাবের বলেই হয়তো ওর মতো হল্লা করতে পারি না। কিন্তু উপভোগ করি। পুলকিত হই। এরকম দৃশ্য যখন দেখি তখন আমার ভেতর আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায়। ভাবি, এরচেয়ে সুখ আর কি হতে পারে ? আমার তো বিশাল কোন চাওয়া নেই। আমি আমার সংসার নিয়ে সুখী হতে চাই। আর এ সবইতো সুখ। মানুষ সুখ খোঁজে অতিরিক্ত বিলাস ব্যসনে, আর আমি সুখ খুঁজি সংসারের আনন্দময় পরিবেশে। প্রবাসে এসে আমি তার পুরোটাই পেয়েছি। এজন্যে নীরবে খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।

রোদ একটু চড়া হতেই সবগুলো বাচ্চা বেরিয়ে গেলো ওয়াটার গানে পানি ভরে নিয়ে। এপার্টমেন্ট কম্পাউন্ডের মাঠে নানা জাতের বাচ্চাদের হইচই শোনা যাচ্ছে। একটু পরে হয়তো ভিজে জবজবে হয়ে আসবে তিনটা। সকালের নাস্তার এঁটোগুলো ধুয়ে চা-টা নিয়ে টিভির সামনে বসলাম। সবগুলো ইংরেজী চ্যানেল। শোনা যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে আমেরিকায় বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেল চালু হবে। এটা খুবই দরকার। এই বিজাতীয় পরিবেশে মাঝেমধ্যে একেবারে হাঁফ ধরে আসে। ভারতীয় বাংলা, বাংলাদেশের নাটক আর বলিউডের হিন্দি ছবিই বিনোদনের একমাত্র উপায় এখানে। তাও আবার সব সময় ভালো কিছু পাওয়া যায় না। ধুমধাড়াক্কা জাতীয় কিছুই আমাদের পছন্দ হয় না। তাছাড়া সারাক্ষণ প্যানপ্যানানির কদর্য রুচিসম্পন্ন মুভি বা নাটকও দেখতে চাই না। ইদানীং অবশ্য ঋতুপর্ণ ঘোষ বেশ কিছু ভালো ছবি তৈরী করেছেন। নাড়া দেয়ার মতো ছবি। সত্যজিৎ, মৃণাল সেন আর গৌতম ঘোষের ছবি প্রায় সব দেখা হয়ে গেছে। তারেক মাসুদ সম্প্রতি কয়েকটা সুন্দর শর্টফিল্ম তৈরী করেছেন। আফসার এসব খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসে। অবশ্য সপ্তাহান্তে ছাড়া এসব দেখার ফুরসতও আমাদের হয় না। টিভি র‌্যাকে দেখলাম কয়েকটা নতুন ডিভিডি। গৌতম ঘোষের ’দেখা’ ছবিটা বের করে অন করলাম।

প্রথম দৃশ্যটা শেষ হতে না হতেই ছুটে ঘরে ঢুকলো আদিব। ভিজে একেবারে জবজবে। টসটসে ঠোঁটজোড়া ফোলা আর মুখটা ভীষণ রক্তাভ। আমি ওর দিকে তাকালাম।
কিরে কি হয়েছে ?
আবিরকে মেরে ব্লাড বের করে দিয়েছে – সে কাঁপা গলায় বললো।
বলিস কি ? আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াই, কে মেরেছে ? আবির কোথায় ? টিভিটা অফ করে আমি বাইরে চলে এলাম।
আবির বিল্ডিংয়ের আড়ালে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার কাছে আলেক্স, কেনি, টনি আর ডেলিয়ন দাঁড়িয়ে আছে মুখ কালো করে। আমি ছুটে গেলাম।
কে মেরেছে তোকে, কোথায় মেরেছে ? ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে মুখটা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। ওর দুই গালে পাঁচ আঙুলের দগদগে দাগ, থুতনির নিচে ক্ষত। আর সেখান থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছে। রক্ত দেখে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। আমি হুঙ্কার দিয়ে উঠলাম।
কে মেরেছে এ ভাবে ?
মুকুল, কেনি আস্তে করে বললো।
কেন মেরেছে ?
আমরা খেলছিলাম, টনি বললো, মুকুল এসে বললো আমাকে পানি মার। তখন আমরা সবাই পানি মারলাম। আবিরের গানটা বড়ো। ও একটু বেশী পানি মেরেছে।
আর অমনি মুকুল আবিরকে চড় দিয়ে মাটিতে ফেলে গলা টিপে ধরেছে, ডেলিয়েন নামের শেতাঙ্গ ছেলেটা বললো।
কিন্তু মুকুল কে ? আমি এ নামে কোন বাচ্চাকে চিনি বলে মনে পড়লো না।
জি ফাইভে থাকে, অর্পিতা খেলছিলো চেলসিদের সাথে, ও হইচই শুনে ছুটে এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরে, বাঙালী লোক।
লোক ? আমি অবাক হলাম, লোকটা তোমাদের সাথে কেন খেলছিলো ?
ওরা কেউ কথা বললো না। এখন আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। ডাক্তারের কাছে নেবো না পুলিশ কল করবো কিছু বুঝতে পারছি না। এদেশে একটা জিনিস আছে, সেটা আইনের বিচার। বাবা মাও বাচ্চাদের গায়ে হাত তুলে পার পায় না। এইতো কয়েকদিন আগের ঘটনা। এক মা নাকি ওয়ালমাটের পার্কিংলটে রাখা গাড়ীর ভেতরে বাচ্চাকে চড় দিয়েছে। আর সিকিউরিটি ক্যামেরায় তা দেখে সিকিউরিটিরা পুলিশ কল করেছে। পুলিশ মাকে এরেস্ট করেছে আর বাচ্চাকে কাস্টডিতে নিয়ে গেছে। এমন কি স্কুলে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ফ্যামিলিতে বাচ্চাদের কিভাবে ট্রিট করা হয় তা খুঁজে বের করে বাবা-মাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। নিউইয়র্কে কয়েকটা বাঙালী পরিবার এ কারনে নানা ভোগান্তির শিকার হয়েছে বলে পত্রিকায় বেরিয়েছে। আর এতো অপরিচিত ব্যক্তি।
আম্মু পুলিশ কল করো – অর্পিতা রাগতঃ গলায় বললো।
আব্বু আসুক – আমি আবিরকে নিয়ে ঘরের দিকে এগোলাম।
কি হয়েছে ? আফসারের গলা শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। আবির হাত ছাড়িয়ে ছুটে বাবার কাছে চলে গেলো। আফসার বাজারের ব্যাগগুলো অর্পিতা আর আমার হাতে দিয়ে ছেলেকে কাছে টেনে নিলো।
কি হয়েছেরে আব্বু ?
আবির এতোক্ষণ পর চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আফসার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলেকে দেখলো। তার কপালে ভাঁজ পড়লো। থমথমে হয়ে উঠলো ওর মুখটা। বুঝতে পারছি ও ভীষণ রেগে গেছে।
চলো – বলে ছেলের হাত ধরে সে আমাকে ইশারা করলো।
বাজারের ব্যাগটা ঘরে রেখে অর্পিতা আর আদিবকে থাকতে বলে আমিও জি বিল্ডিংয়ের দিকে রওনা হলাম।
আমাদের পেছনের দুই বিল্ডিংয়ের পরে হলো জি বিল্ডিং। হনহনিয়ে হেঁটে আফসার আবিরকে নিয়ে আগেই পৌঁছে গেলো। সে বেশ কয়েকবার কলিংবেল চাপার পরেও কেউ দরোজা খুললো না। অতঃপর সে দরোজা ধাক্কাতে লাগলো। একটু পরে যে দরোজা খুললো সে আমার মুখ চেনা। প্রায় দেখি বিকেলে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। সাইকেল বা স্কুটার চালাচ্ছে। কখনো কথা হয়নি। তবে কানাঘুষা আছে, এ ছেলে নিউইয়র্কে হিস্পানিক ছেলেদের সঙ্গে ভিড়ে গ্যাংবাজি করতো। পুলিশও এরেস্ট করেছিলো বারকয়েক। অগত্যা বুড়ো মা আর বড়ো ভাই বাঁচানোর জন্যে এখানে চলে এসেছে। বড়ো ভাইকে দেখলে বেশ ভদ্র মনে হয়।
আপনি মুকুল ? আফসার যথাসম্ভব সংযত গলায় বললো।
হ্যাঁ – আমাদের দেখে ওর চেহারায় সন্ত্রস্তভাব ফুটে উঠলো।
আপনি ওকে মেরেছেন ?
হ্যাঁ, ভয় ধরা গলায় বললো সে, কিন্তু – ।
যা বলার পুলিশকে বলবেন – বলে আফসার দ্রুত পা ফেলে ঘরে চলে এলো। আবিরকে পাশে বসিয়ে সাথে সাথে পুলিশে কল করলো। তারপর ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বসে রইলো চুপচাপ। ছোট সন্তানের প্রতি সব বাবা মায়েরই আলাদা টান থাকে। মেডিকেল কলেজে আবির যেদিন ভুমিষ্ট হয় সেদিন সারারাত বারান্দায় শুয়েছিলো আফসার। ব্যাথায় যখন আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম তখন তার তড়পানি দেখে সবাই হাসাহাসি করছিলো। ছেলেটাও হয়েছিলো খুব ছোট আর দুর্বল। আর আফসারও ওর প্রতি বেশী খেয়াল রাখতো। অর্পিতা কিংবা আদিব আবিরকে কিছু বললে আফসার এখনো ওদের বকা দেয়। যদি কোন কারনে আবিরকে রাগবশতঃ মেরে বসে পরক্ষণে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ’ সরি বাবা, সরি’ বলতে থাকে। আজ যেভাবে ছেলেটা মার খেলো তা সত্যি সহ্য করার মতো নয়। ছোট একটা ছেলেকে একমাত্র অমানুষই এভাবে মারতে পারে।

দশমিনিট না পেরোতেই পুলিশ এসে হাজির। এরই নাম আমেরিকার পুলিশ। যখনি যেখানে ডাকা হোক চোখের পলকে পুলিশ হাজির। আমেরিকার এই সামাজিক নিরাপত্তা যদি আমাদের দেশের রাজনৈতিকরা দিতে পারতো তাহলে সিংহভাগ প্রবাসীই দেশে ফিরে যেতো।
হ্যালো, মি. আফসার – । দু’জন অফিসার দরোজায় নক করলো।
ইয়েস, আফসার এগিয়ে গেলো, প্লিজ কাম অন ইন -।
হোয়াট হ্যাপেন, বুকে টিন্যানী লেখা লম্বা মতো অফিসার সরাসরি প্রশ্ন করলো আফসারকে।
ইউ আসক্ হিম অফিসার, সে আবিরকে এগিয়ে দিলো।
দু’জন অফিসার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবিরকে পুরো ঘটনা জিজ্ঞেস করলো। কেন মেরেছে, কিভাবে মেরেছে, কে কে দেখেছে ইত্যাদি। প্রথমে সংকুচিত হলেও পরক্ষণে পট পট করে পুরো ঘটনা খুলে বললো আবির। পাশে বসা অফিসার নীরবে নোট নিলো।
অফিসার টিন্যানী আবিরের বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো। তারপর বললো, ছেলেকে পুলিশ অফিসে নিয়ে আসতে হবে সন্ধেয়। কোন ভয় নেই। উই উইল টেক কেয়ার হিম। তারপর পকেট থেকে একটা ললিপপ বের করে আবিরের হাতে দিলো।
থ্যাঙ্ক ইউ, নিতে নিতে বললো আবির।
ইউ ওয়েলকাম।
অফিসারদ্বয় চলে গেলো।
আফসার ছেলের মুখ বরফ জলে ধুয়ে নসপিরিন লাগিয়ে দিলো।
বিকেলে দেখা গেলো মুকুলকে নিয়ে পুলিশ গাড়ীতে তুললো।
সঙ্গীদের নিয়ে আবির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো।

******************************************