পলি শাহিনা’র দু’টি গল্প
গোল্ডফিশের স্বপ্ন
শেষ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। এপাশ-ওপাশ করি বিছানায়, ঘুম আর আসে না। লম্বা হাতার জামা পরে ঘুমিয়েছিলাম। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে আছি। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিই। ঘুমের ঘোরে কী যেন স্বপ্ন দেখছিলাম? বালিশের পাশে রাখা চশমাটা পরে নিই। এতে চারপাশ স্বচ্ছ হলেও স্বপ্নটা তো মনে করতে পারছি না। বেশ লম্বা সময় ধরে স্বপ্ন দেখেছি, এখন কেন মনে পড়ছে না? স্বপ্নের খন্ড খন্ড দৃশ্যগুলো ধোঁয়ার মত চোখের সামনে উড়ছে, স্পষ্ট হচ্ছে না। যেমন, স্তব্ধ নির্জনে ধুলোপড়া উঁচু প্রাচীরের ওপাশ হতে একটা চাপা কান্নার স্বর, উঁকি দিয়ে দেখি ঘুমিয়ে পড়া এক বিমর্ষ মায়াবতী রাজকন্যার মুখ, নীলনদীর ধার ঘেঁষে অসংখ্য ঝরাপাতা উড়ছে, ইথারে ভেসে আসা এমন কিছু বিচ্ছিন্ন আবেগ মস্তিষ্কে উদিত হয়, পরমুহূর্তেই সব ঝাপসা লাগে। তন্দ্রাচ্যুত হওয়ার পর হতে স্বপ্নের দৃশ্যগুলো বদলে যেতে থাকে, না কী ভুলে যেতে থাকি, ঠিক বুঝতে পারি না। বাইরে ক্রমশ উজ্জ্বল আলো ফুটছে। মাথাটা ভারি ভারি লাগছে। মস্তিষ্কের খাঁজে খাঁজে খাবি খাওয়া অস্পষ্ট স্বপ্নের দৃশ্যগুলোকে দূরে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে জানালার পর্দা সরিয়ে আকাশ দেখতে থাকি। এখানেও নিস্তার নেই। এলোমেলো স্বপ্নের ছবিগুলো আকাশ হতে যেন আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমি একটা প্লাটফর্মে বসে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। ট্রেন আসে, কিন্তু খুব ভীড়, আমি উঠতে পারি না। পরের ট্রেনের অপেক্ষায় একাকী বসে আছি। এমতাবস্থায় আমার মোবাইলে অচেনা নম্বর হতে একজন নারীর কল আসে। ফোনে নারীটি অনর্গল কথা বলছে, কী বলছে মনে পড়ছে না। তবে তার কন্ঠে যে ভীতি ছিল তা মনে আছে। স্টেশন হতে সামনে দৃষ্টি যেতে দেখি চোখের সামনে শহরটা উল্টো হয়ে ঝুলে আছে। কোনভাবেই স্বপ্নের একটি দৃশ্যের সঙ্গে অন্য দৃশ্যটি মেলাতে পারছিলাম না। সব হযবরল ঠেকছে। তবে কী ধীরে ধীরে আমার স্মৃতি শক্তি, চিন্তা লোপ পাচ্ছে? স্বপ্নের স্মৃতি কেন বারবার আমাকে বিভ্রান্ত করছে? মনে করতে চাইলেই মুছে যাচ্ছে?
নাহ্, স্মৃতির ধোঁকায় আর সময় ব্যয় করতে চাই না। রাতের স্বপ্ন দিনের আলোয় ভুলে যাওয়াটাই নিয়ম, এ বলে মনকে প্রবোধ দিলাম। আকাশ হতে চোখ নামিয়ে রাস্তার দিকে তাকাই। গতরাতে কী বৃষ্টি হয়েছিল? ধ্যাৎ, এও তো মনে করতে পারছি না। যেদিন বৃষ্টি হয় বাড়ির উত্তর দিকের অন্ধকারাবৃত কামিনির ঝোপটিতে সবুজ থইথই করে। কচি সবুজ পাতাগুলো আরো গাঢ় সবুজ হয়ে উঠে। আউল বাউল বাতাসের তালে তালে ওদের দোল খাওয়ার ছন্দ আমার কানে পিয়ানোর মত সুর তুলছে। ওদের এ সুর সবাই শুনতে পায় না, আমি পাই। বৃষ্টি শেষে ঝোপের ডালে ডালে স্বাতী, অরুন্ধতী, কৃত্তিকা সহ আরো অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্ররা যেন ঝুলে থাকে। ওদেরও অনেকে হয়ত দেখতে পায় না, আমি পাই।
বাচ্চাদের সমবেত কলকাকলিতে চোখ যায় হলুদ রঙের স্কুল বাসটিতে। ওরা সারিবদ্ধভাবে স্কুল বাসে উঠছে। পিতা-মাতা হাত নেড়ে কপালে চুমু খাইয়ে কয়েক ঘন্টার জন্য ওদের শুভ বিদায় জানাচ্ছে। কী অপার্থিব এ দৃশ্য। ওদের দেখে আমার কন্যা দ্বয়ের কথা মনে পড়ে। ওরা বড় হয়েছে, দূরের শহরে থাকে। মনে মনে মমতার সঙ্গে আমি ওদের স্মরণ করি, আদর করি, ভালোবাসি। কর্ম জীবনের প্রয়োজনে ওরা দূরে থাকলেও শর্তহীনভাবে আমাকে ভালোবাসে, অসীম যত্নের চাদরে জড়িয়ে রাখে। আমার কন্যাদ্বয় জীবনে আমার অন্যতম প্রাপ্তি। ওদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে বড় করেছি, কন্যা হিসেবে নয়। ওরা আমার গর্ব, আমার অহংকার। ওদের কথা ভাবতেই গর্বে বুক স্ফীত হয়ে উঠে।
বাচ্চাদের বাস ছেড়ে গেছে বেশ আগে। ইতিমধ্যে আমি ফ্রেশ হয়ে ডুপ্লেক্স বাড়িটির নিচের তলায় এসে চা হাতে খোলা বারান্দায় এসে বসেছি। চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতেই মেঘদূতের মত আমার পাশে এসে শিউলি দাঁড়ায়। ওকে দেখে যারপরনাই খুশি হই। আমার নিসঙ্গ জীবনে ও প্রায়শই এসে গল্প করে, সঙ্গ দেয়। আমার ধূসর সময়গুলো রাঙিয়ে তোলে, গান শোনায়। ও চুপচাপ বহতা নদীর মত শান্ত হলেও আমার সঙ্গে খুব হাসিখুশি, জমিয়ে আড্ডা দেয়। গত কয়েক বছর হতে ওকে চিনি। খুলনার মেয়ে, ভারি মিষ্টি করে কথা বলে। ওকে দেখলেই বুকের ভেতর প্রিয় বেলি ফুলের ঘ্রাণ পাই। ওর অনুপস্থিতিতেও আমি ওকে ভাবি। আসলে আমার প্রতি ওর যত্ন, ভালোবাসা, মনোযোগ, আমার বুকের জাজিমে ওকে জায়গা করে দিয়েছে। শিউলিকে দেখে আমি নস্টালজিক, কিংবা আনন্দে টগবগ করলেও ওর মুখে অমাবস্যার আঁধার টের পেলাম। ওর অস্বাভাবিক মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা অজানা আশংকায় দাপাতে থাকে। টেবিলের অন্য পাশ হতে চেয়ার টেনে ওকে বসতে দিলাম। আজ ও আগের মত হাসছে না, কথা বলছে না। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে আমরা দু’জন নিশ্চুপ মুখোমুখি বসে আছি। ওর দুধের মত ফরসা মুখে একপ্রস্ত অন্ধকার পুকুর তলের কাদার মত লেপ্টে আছে।
– কী হয়েছে, শিউলি?
আমার আশঙ্কা মিশ্রিত জানতে চাওয়ার জবাব না দিয়ে মাথার উপর লাটিমের মত চক্রাকারে ঘুরতে থাকা দলবদ্ধ পাখিদের দিকে অন্যমনস্কভাবে ও তাকিয়ে থাকে। ওর নির্লিপ্ত চাহনির দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে মনে হলো, যেন ও নিঃশ্বাস আটকে বসে আছে। ওর এমন করুণ অবস্থা আমার মন খারাপ করে দেয়। ঝলমলে আলোকিত সকালটা ঘোলাটে হয়ে আসে।
শিউলিকে পাথরের মত নির্বিকার আর পাহাড়ের মত স্থানু থাকতে দেখে আর কোন প্রশ্ন করি না। ওকে একাকী থাকতে দিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে গিয়ে অন্যসব দিনের মতোই চা বানিয়ে ছোট প্লেটে কিছু বিস্কুট নিয়ে পুনরায় ওর সামনে এসে বসি। ওকে মুখে আর কোন প্রশ্ন না করলেও আমার নীরব প্রশ্নবোধক চাহনি বারবার ওর মুখের দিকে তীর্যকভাবে পড়ছিলো। চায়ের কাপ দু’হাতে চেপে ধরে বারান্দার মেঝের দিকে তাকিয়ে শিউলি নিজ হতেই এবার বলতে থাকে।
– কখনো সখনো সুন্দর হওয়াটা, সুন্দর করে কথা বলাটাও মেয়েদের জীবনে অভিশাপ বয়ে আনে। বিয়ের পর বেশীরভাগ মেয়েরাই না বুঝে চরম অবহেলা করে নিজেকে। নিজের শখ, আহ্লাদ, ভালোলাগা কিছুই যেন আর মূল্য পায় না বিয়ের পর। একসময় গলা ছেড়ে গান গাইতাম, ছেড়েছি। বই পড়া ভুলে গেছি। বাগান করার শখ ছিল, সময় পাই না। নিজের পছন্দের খাবার কবে রেঁধেছি মনে নেই। বেড়াতে যাওয়া সে তো স্বপ্নের মত। নিজের আত্মাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছি সে কবে। মন বলে যে কিছু আছে তাও ভুলে গেছি। দায়িত্বের নিচে চাপা পড়ে নিজের সমস্ত ভালোলাগা জলাঞ্জলি দিয়েছি। এখন মনে হয় বিয়ে মানে সকলের নয়, কারো কারো নিজেকে পরোক্ষভাবে হত্যা করার প্রজেক্ট ছাড়া আর কিছু নয়। বাচ্চা, সংসার নিয়ে অনেকগুলো বছর গৃহবন্দী হয়েই কাটিয়ে দিলাম। বিদেশে বাবা-মা, আপনজন বলতে তো কেউ নেই পাশে। বাচ্চারা এখন বড় হয়েছে। হারুন ১৬/১৭ ঘন্টা কাজ করে। আমার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলারও সময় পায় না। কিছু জিজ্ঞেস করলে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দেয়। স্থির হয়ে কথা শোনার পর্যন্ত সময় নেই। অবসর সময়ে নিসঙ্গ জীবনে বুকের গহীনে আচমকা ছোটবেলার শখ গান গাওয়া মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। গান গাইতে কিংবা খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার জন্য মাঝেমধ্যে বের হই। ইটের চার দেয়াল ভেতর ব্যথায় মাথা আমার টনটন করে। বলতে পারেন এটি আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগার বিষয়। একাকী জীবনে বেঁচে থাকার আশ্রয়। গতকাল এক বন্ধুর সঙ্গে একটা আয়োজনে গান গাওয়ার বিষয়ে কথা বলছিলাম দেখে হারুন রেগে যায়। অশালীন মন্তব্য করে। ঘর এবং বাইরের প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাকি সবকিছুই খারাপ তার কাছে। তার ভাষায়, বিয়ের পর আমার ব্যক্তিগত জীবন বা ভালোলাগা বলে কিছুই থাকতে পারবেনা। তার ইচ্ছেমতো উঠতে হবে, বসতে হবে। ভীষণ হাঁপিয়ে উঠে গতরাতে বলেছি, আমি তো কোন অন্যায় করছি না। প্রতিটি মানুষের জীবনে নিজের সময় থাকা জরুরি। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। এই একঘেঁয়ে চরম স্বাধীনতা হীন জীবন আর চাই না। সে উত্তর দিয়েছে, তার সঙ্গে এভাবে চলা যাবে না। আমি তার অধীন। সংসার করতে হবে তার ইচ্ছায়। সে যেভাবে যা চাইবে তাই করতে হবে। গোটা রাত আর ঘুম আসে নি। বুকের তাপ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে অন্ধকারে উড়িয়ে দিয়েছি।
শিউলির কথাগুলো যেন জগদ্দল পাথরের মতো বুকে চেপে বসেছে। ওর কষ্টের ঘণ কুয়াশায় হিম শীতল বাতাস ভেদ করে অন্য আরেকটি গল্প এসে হৈ-হুল্লোড় শুরু করে আমার মস্তিষ্কে।
সে অনেক বছর আগের কথা। তখন আমি কোন ক্লাশে পড়ি তাও মনে নেই আজ আর। আমার দূর সম্পর্কের এক খালা ঢাকায় থাকেন। পেশায় শিক্ষিকা। গ্রামে বাপের বাড়ীতে বেড়াতে এলে বিকাল বেলা আম্মার সঙ্গে এসে গল্প করেন। একদিন বিকেলে আম্মার সঙ্গে খালার কথাগুলো শুনে ভীষণ ধাক্কা খাই মনে মনে। কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝি না। ছোট ছিলাম বলে আম্মাকে জিজ্ঞাসা করার সাহসও পাই নি। কিন্তু প্রশ্নগুলো আমার মনের অন্দরমহলে থেকে যায়। আম্মার সঙ্গে খালার কথাগুলো ছিল এমন,
‘ বুবু মাঝেমধ্যে বুকভরে শ্বাস নিতে ছুটে আসি গ্রামে, বাপের বাড়ীতে। জানেন তো একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়ে কতটা খুঁতখুঁতে ছিলাম। মেয়ের ব্যক্তিগত পছন্দ ছিলা না বলে অনেক ছেলে দেখেছি, বাদও দিয়েছি। অসম্ভব স্বপ্নবিলাসী মেয়েটির জন্য একদিন আমরা রুপকথার ডালিম কুমারের মত ছেলে পেয়ে যাই। মহা ধুমধাম, হৈ-হুল্লোড়ে বিয়ে হয়। জানিনা বুবু, কীভাবে কি হলো? মেয়ে এখন বাসায় চলে এসেছে আমার কাছে। মেয়ের অভিযোগ জামাই ঘরের কুনোব্যাঙের মত সারাদিন তার কানের কাছে ঘ্যাংগর ঘ্যাংগর করে। জামাই এর এমন হ্যাংলামি ভাব মেয়ের পছন্দ নয়। জামাই সারাক্ষণ পেছনে লেগে থাকে। একাকী বই পড়তে মেয়ের ভালো লাগে। ঠিক বই পড়ার সময় জামাই এসে বলবে চা খেতে। হয়ত বাবা-মায়ের সাথে মেয়ে কথা বলছে তখন জামাই এসে চুলে বিনুনি কাটবে। বন্ধুর সাথে শপিং এ যাবে, একটু সময় কাটাবে তখনো জামাই চায় সঙ্গে থাকতে। রান্নাঘরেও গাব গাছের আঠার মত লেগে থাকবে। পছন্দের গান শোনা, মুভি দেখতেও পারে না। নিরিবিলি থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করা চুপচাপ মেয়েটার কাছে এগুলো অস্বস্তিকর লাগছে। জামাই এর ভালোবাসার যন্ত্রণায় মেয়ের জীবনে ব্যক্তিগত কোন সময় নেই বললেই চলে। মেয়ের ভাষায় এগুলো ভালোবাসার যন্ত্রণা। ভালোবাসার নামে আসলে এসব শৃঙ্খলেরই নামান্তর। জামাইকে অনেক বুজিয়েও কোন ফল পায় নি। মেয়ে এমন বন্দিদশা থেকে পরিত্রাণ পেতে একদিন বিকেলে ব্যাগ গুছিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে আসে।’
আম্মা একঝলক তৃপ্তির হাসি দিয়ে খালাকে বললেন, এটি তো খুবি আনন্দের বিষয়। জামাই মেয়েকে অনেক ভালোবাসে, যত্ন নেয়। খালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কি জানি বুবু, মেয়েতো বলে এসব ভালোবাসার নামে মানুষিক অত্যাচার বৈকি অন্য কিছু নয়। মেয়ের কথা হলো, সম্পর্কে স্পেস থাকা জরুরি। খালা চা-বিস্কুট খেয়ে সেদিন বিদায় নিলেন।
আমার অবুঝ মস্তিষ্কে ঘুরতে থাকে, সম্পর্কে স্পেস থাকা জরুরি মানে কি? অনেক ভেবেচিন্তেও কোন উত্তর পেলাম না সেদিন।
বহুবছর ধরে মনের মধ্যে ছেঁটে থাকা প্রশ্নের উত্তর পেলাম শিউলির দীর্ঘ বিষাদের কথাগুলো শুনে। যে কষ্টে খালার মেয়ে ঘর ছেড়ে মায়ের কোলে আশ্রয় নেয়, একই ধরণের কষ্টে শিউলিও আজ দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। খালার মেয়ের যাওয়ার জায়গা ছিল, শিউলির নেই। শিউলি আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে কাঁদে, এছাড়া ওর কান্না করার জন্য যে এ ভিনদেশে অন্য কোন জায়গাও নেই। দুই নারীর অভিন্ন আর্তনাদ, একইরকমের হাহাকার মিশে যায় আমার বুকের গহীনে।
চেয়ারের হাতলে বারবার ঠুনঠুন শব্দ হতেই চোখ মেলে দেখি শার্লি দাঁড়িয়ে আছে।
– রোদের মধ্যে চেয়ারে ঘুমাও কেন?
– রোদ ছিল না, ছায়া ছিল।
– বুঝলাম, ভেতরে গিয়ে ঘুমাও।
– শিউলি এসেছিল।
– কই সে?
– চলে গেছে বোধহয়।
আমার কথা শুনে শার্লি খিলখিল হাসছে, আর আমি ভাবছি শিউলির কথা। মনে মনে রাস্তার দিকে বিড়ালের মতো দৃষ্টি দিয়ে ওকে খুঁজতে থাকি। শিউলি কী এসছিল? না কী আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? উদভ্রান্তের মত ভাবতে থাকি, কিন্তু মনে পড়ছে না কিছুই।
শার্লির পরায় হালকা গোলাপি রঙের একটি জামা। ওকে দেখতে ভারি মিষ্টি লাগে। আমার আশি তম জন্মদিনটিকে গল্প, আড্ডা, গানে ও মাতিয়ে রেখেছিল। আমার মেয়েরাও ওকে দারুণ পছন্দ করে। যতটা না ওর জন্য পছন্দ করে তারচেয়েও বেশি পছন্দ করে আমাকে দেখেশুনে রাখা সহ মজার মজার খাবার বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য। আমার মেয়ে রুমা এবং তমা শার্লিকে দেখলেই বলে, ‘ তুমি ভাগ্যবান, আমার মা তোমাকে ভালোবাসে। আমাদের তো ভালোবাসে না, তাই শত চেষ্টা করেও আমাদের কাছে নিয়ে রাখতে পারি না। এ জায়গায় গেঁড়ে বসেছে আর কোথাও যেতে চায় না, মা।’ ওদের কথোপকথন শুনে হাসি। মনে মনে আওড়াতে থাকি, এ বাড়ি আমার বাড়ি। এ বাড়ির প্রতিটি ইটকাঠের সঙ্গে আমার আনন্দ -বেদনা লেপ্টে আছে। চার দশক ধরে এ বাড়িতে আছি। এ বাড়ি আমার আনন্দ। এ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। একাকী ভালোই আছি আমি এ বাড়িতে।
শার্লির হাতে ওর বাগান থেকে সদ্য তোলা হলুদ রঙের একগুচ্ছ টিউলিপ ফুল দেখে মন আমার প্রফুল্ল হয়ে উঠে। পুষ্প গুচ্ছ হাতে তুলে দিয়ে ও আমাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বসবার ঘরে নিয়ে যায়। সোফায় বসতে দিয়ে ওর হাতে বেইক করা চকলেট কুকিজ খেতে দেয়। যেখানে আজকের সকাল নিজেকেই আর মনে রাখবে না আগামীকাল সকালে, সেখানে শার্লি মনে রেখেছে আমার প্রিয় কুকিজের কথা। কেউ এমন ভালোবাসে, ভাবতেই মনে আনন্দ লাগে। আমার বসবার ঘরে প্রচুর বই রয়েছে। ও এগুলো মনোযোগ দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। শার্লি বই দেখে আমি শার্লিকে দেখি। কী যে মায়া ওর মধ্যে। ভালোবাসা, অর্থ, খ্যাতি নয়, জগতে মানুষ বেঁধে থাকে এ মায়ায়। মানুষের দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস আলাদা, কিন্তু মায়ার বহিঃপ্রকাশ সকলের একই। নিয়ম মাফিক কিছুসময় আমাকে মায়ায় ভিজিয়ে দিয়ে আবার আসবে বলে শার্লি চলে যায়। ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে আমি চেয়ে থাকি।
প্রকৃতিতে এখন শীত ও উষ্ণতার খুনসুটি চলছে তীব্রভাবে। এই শীত তো এই গরম। এপ্রিল মাস যাই যাই করছে, শীতের আধিপত্য কমছে না। ঠান্ডা -গরমের এমন গাঢ় প্রণয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষগুলো ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আজ বেশ নরম হাওয়া বইছে। স্বচ্ছ নীলাকাশের বুক হতে যেন রুপা গলে গলে পড়ছে। রুপার নুপুর পায়ে সবুজ পাতারা ছন্দে ছন্দে দুলছে। সামনের বাড়ির প্রশস্থ সবুজ লনে একজোড়া কবুতর পাশাপাশি হাঁটছে। খানিক বাদে একসঙ্গে উড়ে যায় মুক্ত আকাশে। ওদের উড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবি, ওরা পাখি কত স্বাধীন, মানুষ খাঁচায় বন্দী কত পরাধীন। খাঁচাই তো। মানুষের আসলে কী কোন ঘর আছে? জন্ম হতে মৃত্যু অবধি পুরোটাই ডানা ঝাপটানো একটা বন্ধুর পথ বৈকি আর কিছুই নয়। ঘরের নামে মানুষ নিজেই নিজের জন্য খাঁচা তৈরি করে।
প্রকৃতির গভীর প্রশান্তি জড়ানো বুকে ডুবে থেকেও শিউলির কথাগুলো বারবার মর্মে বেজে উঠছে। যে কোন সম্পর্কে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, টানাহেঁচড়া ভালো না। সকল মানুষ আলাদা, তাদের ভালোলাগা, ইইচ্ছেগুলোও তো আলাদা, এবং এটাই স্বাভাবিক। মানুষকে বাইর হতে যা দেখা যায় সে আসলে ওইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ না। একটা পিঁপড়ের জীবন পর্যন্ত মানুষ ভালোভাবে জানে না, কেমন করে জানবে মানুষের জীবন। নিজের ভূবনে সকলে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কেন যে মানুষ এ সহজ বিষয়গুলো বুঝে না? কি জানি।
আজকাল আমার ঘুমের কোন নিয়ম নেই। হয়ত সারারাত জেগে থাকি, সারাদিন ঘুমাই। কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ভোরে ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুরের শরীরে হেলান দিয়ে যে সোফাটায় বসা ছিলাম সে সোফায় শুয়ে পড়ি। মধ্যদুপুরের খানিকটা রোদ এসে গায়ে পড়ছে, ভালো লাগছে। ঠান্ডা বাতাসে গালের উপর পাটের আঁশের মত কয়েকটা চুল এলোমেলো উড়ছে। ছোটকালে নানু বলতেন, আমার মাথায় নাকি সব গোবর, তাই মাথায় এত চুল আমার। আজ চিরুনি দিয়ে আঁচড়াবার চুল খুঁজে পাই না। নানুর কথা মনে করে হাসি পায়। বয়সের ভারে শুধু চুল নয় শরীরের সবকটি অঙ্গ ক্ষয়ে যেতে বসেছে। প্রকৃতির কাছে মানুষ বড় ক্ষুদ্র। প্রকৃতির নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কোন উপায়ও নেই।
বিবিধ ভাবনায় ডুবে চোখের সামনে দেখি, টিমটিমে কুপির আলোয় কোন এক প্রাচীন পাথরে শিউলির মুখখানা ম্যাজেন্টা রঙের গোলাপ ফুলের মতো ফুটে আছে। আচমকা ঝমঝম বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে কাক ভেজা শহর, কোন মানুষ দেখি না, একটা হিজল গাছ সহ আরো কিছু গাছ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মনোযোগ যায় হিজলের দিকে। দেখি হিজলের ছায়ায় মানুষের ছায়া দুলছে। একসময় দেখি হিজলের ছায়া সরে গেছে, সঙ্গে বৃষ্টিও থেমে গেছে। অবাক বিষয়। ঝড়োবৃষ্টি থেমে যেতে দেখি পাথরের গায়ে শিউলির ছবি নয়, আমার মুখ স্পষ্ট আঁকা। অঘোর ঘুম হতে আমি চিৎকার দিয়ে উঠে পড়ি। দুপুরের সূর্য ততক্ষণে ঢলে পড়েছে। আমি সোফা হতে উঠে জানালার পাশে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ভেতরের কাঁপন ভুলে, আবারও স্বপ্নের দৃশ্যগুলো মনে করার চেষ্টা করি। দৃশ্যগুলো পুনরায় এলোমেলো। গুছিয়ে কিছুই মনে করতে পারছি না। যে নক্ষত্র আকাশ থেকে খসে পড়ে মাটিতে তখন তার অন্য জন্মের অন্যরকম টান।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ঝরাপাতা
চিত্রশিল্পী স্টুয়ার্টের বাড়ি এটি। লাল ইটের দোতলা বাড়ি। বাড়িটির দোতলায় প্রশস্ত ঝুলবারান্দা। দূর হতে ঝুলবারান্দাটিকে ফুলের বাগান মনে হয়। হরেক রকমের ফুল রয়েছে এ বাগানে। এ বাড়ির পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাওয়ার সময় পথিকের গায়ে এক অন্যরকম নতুন হাওয়া আচঁড়ে পড়ে, নাকে ফুলের সুবাস লাগে। বারান্দায় বসে স্টুয়ার্ট যখন ধ্যানমগ্ন হয়ে ছবি আঁকে বাগানটিও যেন চুপ হয়ে থাকে। পাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখেছি বহুবার।
একদিন গোধুলির আলো-আঁধারে স্টুয়ার্ট ছবি আঁকছে। তাঁর মুখ হতে এক অপার্থিব আলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঝিরিঝিরি শান্ত হাওয়া বইছে। আমার ঘোর লাগে। আমি আনন্দে ভিজতে থাকি। চেনা একটি গান আমাকে বারবার হাত নাড়াতে থাকে। অবচেতন মনে গুনগুনিয়ে উঠি –
‘ দে দোল দোল দোল, তোল পাল তোল
চল ভাসি সবকিছু থাইগ্যা,
দে দোল দোল দোল, তোল পাল তোল
চল ভাসি সবকিছু থাইগ্যা,
মোর পানিতে ঘর,
বন্দরে আসি তোর লাইগ্যা
দে দোল দোল দোল, তোল পাল তোল
চল ভাসি সব কিছু থাইগ্যা… ‘ ।
আমার গানের ভাষা স্টুয়ার্টের বুঝবার কথা নয়। সুর শুনে চোখ খুলে দেখি ক্যানভাস ফেলে স্টুয়ার্ট বাঁশিতে বিভোর। বাঁশি হাতে তাঁকে আগে কখনো দেখি নি। মনে মনে বলি, ভাষা না বুঝলেও গানের সুর দুনিয়া ব্যাপি সকল মানুষের মনে একইভাবে দোল খেয়ে যায়। তাঁর বাঁশির সুর হাওয়ার শরীর বেয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর জাদুকরী সুরের মূর্চ্ছনায় ফুলের ঘ্রাণ আরো তীব্র হয়ে উঠে। পাতারা হয় গাঢ় সবুজ। বাগানের ফাঁক গলে আমাদের গায়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে। চাঁদের আলোয় ফুলেদের ফিসফাস শব্দে, আকাশ যেন ঝুঁকে পড়েছে ওদের দিকে। ফুলের গায়ে আকাশ, এক আশ্চর্য সুধায় মন ভরে উঠে। ইচ্ছে করে স্টুয়ার্টের রঙ পেন্সিল চুরি করে ক্যানভাসে সবুজ পাতা, ফুলের ছবি আঁকি। ছবি আঁকা? আমার জন্য সে দূরাশা। আমার প্রতি তাঁর মতো বিখ্যাত লোকের স্নেহ, সাহচর্য, এ তাঁর ঔদার্য। বিখ্যাতদের বৃত্ত হতে সাধারণত দূরে থাকি, এতে শরীর – মনের উপর চাপ কিছুটা কম পড়ে। তাঁর অসীম আন্তরিকতা বেঁধে রেখেছে আমাকে। রোজ নয়টা – পাঁচটার একঘেয়ে জীবন আমার ছন্দময় হয়ে উঠে এ মহান চিত্রশিল্পীর সান্নিধ্যে।
উপরোল্লিখিত দৃশ্যটি প্রায় পনেরো বছর আগের।
এইভাবে হাসি – আনন্দে ডুবে আমাদের বহুদিন কেটে গেছে। সময়ের কাটাকুটি খেলায় এরমধ্যে পৃথিবীর শরীর অনেক বদলেছে, বদলেছে স্টুয়ার্টের শরীরও। সে এখন অশিতীপর এক বৃদ্ধ। তাঁর ঝুলবারান্দা হতে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে না, সবুজ পাতা উড়ে এসে পড়ে না পথিকের গায়ে। তাঁকে ছবি আঁকতে দেখি না বহুদিন। স্টুয়ার্ট বলতো, ক্যানভাসের আড়ালে তাঁর প্রাণ লুকিয়ে আছে। রঙহীন ক্যানভাসের মতো বিবর্ণ স্টুয়ার্ট যেন রাতদিন এখন প্রাণ বাঁচাতে যুদ্ধে রত। তাঁর বাড়ির বাইরে আকাশছোঁয়া এক দীর্ঘ গাছ। ঝরাপাতারা উড়ে এসে ঝুপঝাপ পড়ছে তাঁর বারান্দায়। কালো পোষা বেড়ালটি তাঁর পায়ের কাছে চুপচাপ শুয়ে আছে। কাজ শেষে আমি কিছু ফুল হাতে তাঁকে দেখতে যাই। ফুলগুলো তাঁর হাতে দিয়ে ঘুরে ঘুরে কথা বলতে থাকি। স্টুয়ার্ড কোন কথার উত্তর দেয় না, তাকিয়ে থাকে অনন্তের দিকে। আমার কথা শুনছে বলেও মনে হয় না। আমি থমকে যাই। জীবন সায়াহ্নে বাইরের কোলাহল ছাপিয়ে মানুষ কী শুধু অন্তর্গত কোলাহলে ডুবে যায়? বুঝতে পারি না। ক্যানভাসের পাশে পড়ে থাকা বাঁশিটার দিকে চোখ যায়। বাঁশিটিকে আগে কখনো এখানে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। হাওয়ার গতি বাড়ছে। দূরন্ত হাওয়ায় বাঁশিটির চারপাশে ঝরাপাতা উড়ছে। বিড়ালটির চোখে জল। দূর থেকে ভেসে আসা ঘুঘুর ডাকে হু হু কান্নার শব্দ। আমার গা ছমছম করে উঠে। আমি দ্রুত বারান্দা হতে প্রস্থান করে রাস্তায় নেমে পড়ি। একদা যে বারান্দাটির পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাওয়ার সময় ফুলের ঘ্রাণে আকুল হোতাম, আজ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে বারান্দা হতে শুধু ঝরাপাতার মর্মরিত ধ্বনি বুকে এসে বিঁধছে। ঝরাপাতার হাহাকারে আমি কেঁপে উঠি। দুই কানে হাত চেপে আমি দ্রুত পায়ে ঝরাপাতার হইচই ফেলে সামনে এগুতে থাকি।
জীবন নামক খেলাঘরে জয়ী হওয়ার তাগিদে সময়ের সাথে তুমুল প্রতিযোগীতায় লিপ্ত আমি, অবসন্ন শরীরে দিনশেষে ঘরের পথ ধরে হাঁটছি। ক্লান্ত পা জোড়া যেন সামনে এগুতেই চাইছে না। প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল, পাতা ঝরার দিন চলছে। পাতাঝরার দিনগুলোতে অদ্ভূত এক বিষন্নতা পেয়ে বসে। সবুজ প্রকৃতি স্টুয়ার্টের ক্যানভাসের মতো ধূসর হয়ে উঠেছে। চৌদিকে কেমন যেন একটা যাই – যাই ভাব। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বুক হু হু করে উঠে। সবুজ পাতারা ধূসর হয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে। বাতাসের কোষে কোষে নানান রঙের ঝরাপাতা উড়ছে। বৈকালিক এমন বিষন্নতায় পাতা ঝরার শব্দ একদম ভালো লাগে না। এসময় শরীর, মন, আরো দূর্বল লাগে। তীব্র একটা অবসাদ পেয়ে বসে। কুয়াশাবৃত চারপাশ জুড়ে যেন সেতারে করুণ সুর বেজে চলছে। আকাশের শরীর ঘণ মেঘে ঢাকা।
চলতি পথে হঠাৎ মনে হলো কারা যেন আমার পা জোড়া জড়িয়ে ধরেছে, চলার পথ রোধ করে সামনে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে দেখি প্রবল বাতাসের সাথে উড়ে যাওয়া ঝরাপাতারা, ভীষণ কাকুতি-মিনতি করে ধরেছে আমাকে, ওদের কথা শোনার জন্য। কিন্তু আমার তো সময় নাই। আমি তীব্রভাবে দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছি। ঝরাপাতার সমবেত কন্ঠ শূন্যতার তরঙ্গ সাঁতরে কানে ভেসে আসে। ওরা করুন স্বরে বলছে –
‘যেদিন আমাদের বর্ণ ছিল, গন্ধ ছিল, যৌবন ছিল, স্পন্দন ছিল, সেদিনতো আমাদের পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে। আসা যাওয়ার পথে রোজ আমাদের পানে অপলক মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকতে। কত নিশি জেগে আমাদের রুপ, রস, ছন্দ, মর্মরে শিহরিত হতে, প্রাণভরে শ্বাস নিতে। আমাদের স্নিগ্ধতা, উচ্ছলতা ধার করে গল্প, কবিতা লিখতে। আমাদের শীতল বাতাসে দু’চোখ বুঁজে সুখস্বপ্নে বিভোর থেকেছো। আমাদের সান্নিধ্য ছাড়া তোমার দম আটকে আসতো – মনে আছে? আজ আমাদেরকে কত সহজে দু’পায়ে মাড়িয়ে সম্মুখে এগিয়ে চলছো। ‘
পই পই হিসেব কষে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো স্বার্থান্ধ আমি, ঝরাপাতাদের আহ্বানে কর্ণপাত না করে সামনে পা বাড়াই। এবার ওদের আর্তচিৎকারে আকাশ- বাতাস প্রকম্পিত হতে লাগলো। আমি স্পষ্ট শুনছিলাম ওদের কথোপকথন,
‘আমাদের একটু সময় দাও, দুটো কথা শোন। তুমি এতটা আত্মকেন্দ্রিক। আজ আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলে আমাদের কথাগুলো শুনার সময় পর্যন্ত নেই? ‘
রাগান্বিত আমি উল্টো ঝরাপাতাদের ধমক দিয়ে বলি,
‘জীবনের গতি কারো জন্য থেমে থাকেনা। জীবন বহমান নদীর মতো। সময় ও নদীর স্রোত শুধু সামনে এগিয়ে যায়। আমাকেও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমার অনেক কাজ বাকি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাকে সব কাজ শেষ করতে হবে। একদম সময় নেই তোমাদের কথা শোনার ‘ বলেই দ্রুতগতিতে গন্তব্যের পথে সামনে পা বাড়াই।
পুরো পথ পাড়ি দিয়ে শ্রান্ত আমি বাসায় এসে হাত- পা ছড়িয়ে বাদামি কাঠের মেঝেতে বসে পড়ি, ভাবনার অতল সমুদ্রে ডুবে যেতে শুরু করি। এদিকে অন্ধকারের বেগুনি চাদর মুড়ি দিয়ে একটু একটু করে পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ছে রাতের উষ্ণ বুকে। খানিক আগের আলোকিত পৃথিবীর সঙ্গে অন্ধকারের এমন গভীর প্রণয়, আমার সবকিছু শূন্য শূন্য লাগে। আপনা হতেই মাথা নিচু হয়ে আসে, এবং পরাজিত বোধ করি। প্রকৃতির কোলে পিঠে বেড়ে উঠা মানুষ আমি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো, অবহেলায় ফেলে আসা ঝরাপাতাদের কথা ভেবে।
ঝরাপাতারা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? মানুষের জীবন আর ওদের মাঝে পার্থক্য কোথায়? প্রয়োজন শেষে মানুষও ঝরে যায়, চলে যায়? প্রশ্নবাণে জর্জরিত আমি বেসামাল দুলছি আর মনে হচ্ছে, আমি একটা শুকনো সুপারি পাতার ডালে বসে আছি, কেউ আমায় টানছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে দূরে- বহুদূরে, যেখান থেকে আর ফেরা হবে না আমারও, ঝরাপাতার মতো।
ঝরাপাতাদের দীর্ঘশ্বাস বুকে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছি। স্টুয়ার্টের নিষ্প্রাণ মুখটি চোখের সামনে ঝুলে আছে। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যকার অন্ত্যমিল এসে ভীড় করছে অন্তরে। ভাবছি, স্টুয়ার্টের মতো, ঝরাপাতার মতো, আমিও তো একদিন ফুরিয়ে যাবো, এই মায়ার ফাঁদ পাতা ভুবন হতে। পাতা ঝরে, মানুষ ঝরে। মানুষের দীর্ঘ ছায়া ক্রমশ হেমন্তের বিকেলের মতো ছোট হয়ে আসে। পৃথিবীর প্রয়োজন শেষে ঝরাপাতার মতো আমিও মিশে যাব থকথকে অন্ধকারে। আমাকে মাড়িয়ে পথিক ফিরে যাবে নিজের ঘরে। চোখের লেন্সে যেন মহাকাল এসে ভর করেছে।
জীবনের অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসে আঁধারের পাশ ঘেঁষে আমিও স্টুয়ার্টের মতো তাকিয়ে থাকি নিঃসীম শূন্যতার পানে। জানালা হতে দেখছি এক এক করে সব পাতা ঝরে পড়ছে। আমার সামনে আমি উদাস দাঁড়িয়ে। আপনমনে ভাবছি- কবে কখন কোথায় আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? কী জানি। শরীর ঘেঁষে ছুঁয়ে থাকা কাছের মানুষগুলো একদিন আমাকেও ছুঁড়ে ফেলবে অন্ধকার গহ্বরে। যেমনি করে আমি দ্রুত ছেড়ে এসেছি আজ স্টুয়ার্টকে। অথৈ ভাবনার সাগরে ডুবে থাকা আমি আচমকা দেখি, একটা ছাই বর্ণের ঝরাপাতা এসে পড়ে জানালার শার্সিতে। মেঝে হতে উঠে গিয়ে আলতো করে ওকে হাতে নিয়ে প্রশ্ন করলাম – তুমি জীবনের প্রতীক? নাকি মৃত্যুর? দূর হতে গমগম ভেসে এলো হা হা হাসি। ঠিক তখনই চঞ্চল বাতাস এসে ঝরাপাতাটিকে উড়িয়ে নিয়ে যায় শূন্যে। নতমস্তকে আমি ওর হেলেদুলে চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থাকি।
*****************************