কুমার প্রীতীশ বল
দুইটি অনুগল্প
আওয়াজ
গভীর রাত। খাটে এপাশ ওপাশ করছিলাম। হঠাৎ যেন মেঝে থেকে উঠে এল আওয়াজটা। আমি একা শুনিনি। স্ত্রী-পুত্রও শুনেছে। আমি উঠে বসাতে ওরাও ভয় পেল। এতো রাতে কিসের আওয়াজ? কে আসল? ডাকাত? অন্যসময় হলে শংকিত হতাম না। ঘুমের মধ্যেই হারিয়ে যেত। এখন লডর-ফডর অবস্থা। নগরজুড়ে গণ-ডাকাতি হচ্ছে। ছিনতাইকারীরা এখন ডাকাত। মানুষ এখানে এখন নিশাচর প্রাণী বাদুরের মতো রাতজেগে পাহাড়ায় থাকে। পরাজয়ের উপকথা ঘিরে চলছে তুমুল সংঘাত। পিশাচ ক্রমে হয়ে ওঠেছে ধর্মরক্ষক। উপত্যকা জুড়ে বৈরী হরিণের আর্তনাদ।
স্ত্রী-পুত্র শব্দের উৎপত্তি জানতে আলো জ¦ালায়। ধমক দিয়ে নিগুঢ় অন্ধকারের সমস্ত আয়োজন নিঃশেষ করি। আবার সব কটি দরজা, জানলা ঠুকে ঠুকে দেখলাম। কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরেও দেখলাম, যতটুকু দেখা যায় সে-ই চৌহিদ্দি পর্যন্ত। দরজার আইহোল দিয়ে বাইরে লম্বা সিঁড়ির অনেকদূর দেখা যায়, তাও দেখলাম বিপন্ন বিস্ময়ে। উদ্দেশ্য তল্লাটে হিংসার যে আগুন লেগেছে, তার হলকা এ পর্যন্ত যাতে কায়েম না থাকে। ফিরে এসে আওয়াজের উৎপত্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা স্বীকার করি। শংকিত স্ত্রী-পুত্রকে মিথ্যা অভয় দিয়ে আবার ঘুমাতে গেলাম।
এসময় পুত্র পুরাতন দাবিটি আবারও উত্থাপন করল। বাড়ি বদল করতে হবে। পুত্রের কাছে এখানকার সমস্ত আয়োজন পরিত্যক্ত বোধ হচ্ছে। জন্মের পরে এ বাড়িতে কখন এসেছে সে, মনে করার সুতীব্র চেষ্টা করে। সে-ই নির্জন অতীতের স্বাক্ষর শাশ^ত রাত্রির বুকেও তুলে ধরে। না এলেই বড় বেশি ভালো হতো, এখন সে অনুভব করে। এসে কী গভীরতর লাভ হলো, মা বুঝানোর চেষ্টা করে।
মাতা-পুত্রের কথপোকথনে আমারই অন্তর্গত মগজের মধ্যে খেলা করে সে-ই আওয়াজ।
এমন ভাবনার ভেতরে এসে ঠাঁই নিলেন প্রতিবেশি অশীতিপর খালুজান। হাঁপানির সমস্যা তাঁর। নির্ঘুম রাত কাটে। তিনি সে-ই আওয়াজের উদগাতা? খালুর টানটা কি বেড়ে গেল? একবার জিজ্ঞেস করব? ছেলেটা বাসায় নেই। পুত্রবধু আছেন তিনবছরের কন্যা নিয়ে। মোবাইলটা হাতে নিয়েও রেখে দিলাম। আরেকবার হলে করব। তখনই করোটির ভিতর জেগে ওঠল অন্যএক বিপন্ন উপলব্ধি-সে উপলব্ধি সাম্প্রতিক পরিবর্তনে। পরিবর্তনটা বুঝিয়ে দিল, কার সঙ্গে আর কোনোদিন চা খাওয়া হবে না আড্ডায়। কাকে সামনে দেখলে হাস্যসম্ভাষণ আপনা থেকে আসবে না আর। যে পরিবর্তন আমাকে আরও যুথবদ্ধ থাকার প্রেরণা দিতে পারত, সে-ই পরিবর্তন নানান রকমের বন্ধুত্বের, শ্রদ্ধার সম্পর্ক নষ্ট করে দিল।
দীর্ঘশ^াসটা শেষ করতে পারলাম না। আবারও সে-আওয়াজটা শোনা গেল। পুত্রের আর্তনাদ! বাবা, আবার সে-ই আওয়াজ! বিপন্ন এক বিস্ময়ে আবারও ওঠে বসি। দরজা খুলে বের হই। আলো না জে¦লেও দেখতে পাচ্ছি। বাইরে অন্ধকার মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না। কোথাও কেউ নেই। বেল বাজালাম প্রতিবেশির বাসায়। দু’বার বেল বাজাতেই খালুজানের পুত্রবধু দরজা খুললেন। তাঁরাও নির্ঘুম রাত পার করছেন অনন্ত সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। তিনি আমাদের দেখে ভয়ার্ত কন্ঠে জানতে চাইলেন, আসন্ন কোনো বিপদের সংকেত পেয়েছি কিনা। স্ত্রী ক্ষাণিক আগের সে-ই আওয়াজটার কথা বলল। তাঁরাও শুনেছেন গা ছমছম সে-ই আওয়াজ।
আমি বললাম, খালুজানের টানটা আবার বাড়ল কিনা।
অশীতিপর খালু আমাদের বাক্যালাপ শুনে বললেন, এটা তেমন আওয়াজ নয় হে।
বুঝলাম, তাঁর মনোজগতও ছেদন করেছে আওয়াজটা। অশরীরি আওয়াজটা দু’বাড়ির মানুষগুলোকে সমভাবে উৎকন্ঠিত করেছে। খালুজানের প্রস্তাবে আশ্রয় নিলাম ওদের ঘরে। আরও ক্ষাণিকক্ষণ পরিবর্তনের পরিসমাপ্তি নিয়ে আলোচনা হয়।
সোফায় চোখটা বুজেছি মাত্র। স্ত্রী-পুত্রের আর্তনাদে জেগে ওঠি, আবার সে আওয়াজ। এবার মনে হলো নিচের গেইটের দিকে। আমি সমস্ত শক্তি নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম, আমার মৃত্যুই আমার অ¯্র। তারপরও আমাকে একা ছাড়ল না স্ত্রী। প্রলয়পথে আমার দীপশিখা হয়ে পিছু নিল। গেইটের সামনে কুকুরগুলো পূর্বের মতো শুয়ে আছে। গেইট খুলতে দেখে পথ ছেড়ে পালাল। নিশ্চল, নিঃশব্দ চারদিক। রাস্তায় নেমে দু’মুঠো বাতাস চোখ বুজে মাথা উঁচিয়ে টেনে নিলাম।
ফজরের আজানের পর দু’চোখে ঘুম নামে। ঘুমটা ভাঙল ডোরবেলের আওয়াজে। বুয়াটা আরেকটু দেরিতে আসলেই পারত। স্ত্রী আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই আওয়াজটা আবার এল। এবার একবার নয়, কয়েকবার। আরও গাঢ় কর্কশভাবে। দু’বাড়ির সবাই যুগবৎ বেরিয়ে আসি। সবাইকে একসঙ্গে দেখে বুয়াও অবাক। আওয়াজটা কিসের? বলতেই, সে আঙুল তুলল ঈশান কোণের দিকে। তাকালাম সে-দিকে। সবাই অবাক। ইঁদুরের তাড়া খেয়ে একটি বিড়াল সুড়ঙ্গে প্রবেশের চেষ্টা করছে। বিড়ালটা সুড়ঙ্গের ছোট্টমুখে মাথা ঢুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেই আওয়াজটা হয়। ইঁদুরটা সবই দেখছে ও বুঝছে। তবুও ভয় বিলোচ্ছে ক্ষণে-ক্ষণে অভ্যুত্থানকারীদের মতো। আমরাও শুধু দেখছি আর দেখছি। কাউকে বলছি না কিছুই।
পোড়া বত্রিশ
হঠাৎ পোড়া জমিনের গন্ধে জেগে ওঠে তবারক। জলের গানের সোনার সংসারের পোড়া ছাইয়ের গন্ধ। বাদ্যযন্ত্রের পোড়া কয়লার গন্ধ। সে আগুনের হলকায় কেঁপে ওঠে কবরের মাটিও। মাটি ভিজে গেছে। বোধকরি কাঁদছে। এমনই মনে হলো কবরবাসী তবারকের।
তবারক কবরবাসী হয়েছে ৪৭ বছর। তার কিঞ্চিৎ জুনিয়র কবরবাসী শাহাদাৎ, ফারুকও জেগে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধা জালাল, মুনীর, জুয়েল, তপন শত-শত মুন্ডহারা, রগ কাটা, গলা কাটা শব জেগে ওঠে ঘুম ভেঙ্গে। সবার গায়ে নাকি লেগেছে আগুনের হলকা।
গুপ্তবেশে জেগে ওঠেছে দানবগুলো আবার! উপত্যকার স্থাপনাগুলোতে আগুন জ¦লছে। গাছগুলো দুলছে। এখানকার মানুষগুলো হাওয়ার গানে আরও দূরে, আরও দূরে গুরুগম্ভীর একটি তারার দেশে কেমন জানি বিলীন হয়ে গেছে। হাজার তারার দেশটি এখন মরা-জমিন, পোড়া মাটি, নষ্ট ফসল, ক্যাকটাস জমিন। তারার দেশের ঝিকিমিকি বিলীন হয়ে গেছে মৃত্যু-উপত্যকায়। মানুষগুলো মরা পাথর হয়ে গেছে।
এ যদি অবস্থা হয়, তাহলে কি বত্রিশেও আগুন দিয়েছে? সবার এমন প্রশ্নে তবারকের কেমন সন্দেহ হলো। বত্রিশ জ¦লছে!
তারার দেশের একটা মরা মানুষের পোড়া হাতের মিনতি দেখে তবারক সেদিকে এগিয়ে গেল। লোকটা কাঁপছিল। মানুষটার চোখ দুটো বন্ধ। সাহস করছে না কবরেও চোখ মেলবার। আবার যদি দানবগুলো ওখানে আবির্ভূত হয়।
তবারক তখন স্মরণে আনে ৪৭ বছর আগের সে-ই মৃত্যু উপত্যকার কথা। পুরো নাম তবারক হোসেন। নির্মমভাবে খুন হয়। সেদিন চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের মিছিলে রক্ত-পিপাসু দানব হামলা চালায়। আহত তবারক হোসেনকে তুলে নিয়ে লিচু তলায় জবাই করে। তবারক পানি…পানি করছিল। ওরা তার মুখে প্রশ্রাব করে দিল। তবারক হত্যার মাধ্যমে শুরু হয় রগ-কাটার রক্তাক্ত উল্লাস। সমস্ত জমিনজুড়ে রাজত্ব কায়েম করে রগ-কাটা বাহিনী। প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের চলাফেরা সীমিত হয়ে যায়। আস্তিনের নিচে ধারালো ছুরি নিয়ে তাড়া করে রক্তপিপাসুর দল। তারপর শাহাদাৎ, ফারুক এবং বর্শার ফলার মতো থোকা থোকা কী বিষন্ন আরও ১১৭ খানা নাম এসে জড়ো হয় কবরে তবারকের পাশে। তারপর ঝিকিমিকি তারার দেশে থেকে গেল কিছু ফাঁপা মানুষ, ঠুঁশো মানুষ। তাদের আঙ্গিকহীন আদলখানা, ছায়ার মতো রঙহীন তেজ, পক্ষাঘাতগ্রস্থ চলনহীন দেহ।
দৃষ্টিহীন, ব¯্রহীন ঠুঁশো মানুষগুলোর, ফাঁপা মানুষগুলোর লক্ষ্যহীন পাক খাওয়া দেখে এসেছি, এই কিছুদিন আগেও। বললেন, মস্তকহারানো, খুলি ওড়ে যাওয়া গোপাল মুহুরী।
তবারক বলল, সেও-তো চব্বিশ বছর আগে।
তবারক আবার কিছু একটা বলবে তখনই ক্ষাণিকক্ষণ আগে মৃত্য-উপত্যকা থেকে আসা মস্তকাংশ খড়ে ভরা ঠুঁশো মানুষদের একজন হেলান দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শুকনো স্বরে কী সব বলল।
মানুষটি বলল, আবার ফিরে এসেছে একাত্তর! আক্রান্ত হয়েছে বত্রিশ! দাউ-দাউ করে জ¦লছে বত্রিশ। শুকনো জমিন জুড়ে উগ্র-হাওয়া। লাল-সবুজের পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত বদলে দিতে চলছে রক্তাক্ত উল্লাসে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে একাত্তরের বর্বরতা।
শাহাদাৎ বলল, একাত্তরে পুড়েনি। পঁচাত্তরে পুড়েনি। চব্বিশে পুড়ল! হায় বত্রিশ! রক্তাক্ত বত্রিশ!
ফারুক বলল, বত্রিশ আর শ্রাবণ মেঘের ভেজা দুপুরে মুক্তির বার্তা ছড়াবে না!
ছবিটা স্পষ্ট হতেই তবারক বলল, সবকটি প্রজন্মকে আফিনের নেশা আর মদের ভাঁড়ারেতে আটকে ফেলতে পারল?
ঠুঁশো মানুষখানা আবারও ফিসফিসিয়ে বলল, তারার দেশের ঝিকিমিকির গোধূলী উপত্যকায় এখন কারো বিবেক আর জাগ্রত হয় না। শুধু উত্তোলিত হয় পাথুরেমুখগুলো।
দাঁত-মুখ কিটমিটিয়ে তবারক বলল, তাহলে ঝিকিমিকি তারার দেশের ভাঙা চোয়ালে কোনো চোখ নেই!
বাস্তব ও কাজের মাঝে, শক্তি ও অস্তিত্বের মাঝে, আবেগ ও সাড়ার মাঝে এখনও সে-ই ছায়া নেমে আসে। কেননা ওখানে এখন আর মেধা ও মননের পরিচর্যা নেই। কেননা ওখানে এখন স্বপ্নের নয়, আফিনের চাষ হয়। কেননা ওখানে শিক্ষক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, পেশাজীবীরা এখন আর স্বপ্ন দেখে না। এখন ওখানে কোনো মুখ নেই। শুধুই মুখোশ। সদ্য পুশ-ইন হওয়া মুন্ডুহারা এক বে-নামী মানুষ এভাবেই বলতে বলতে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আরও বির-বির করছিল, এভাবে সভ্যতা ধ্বংস হয়। ঠিক এভাবেই।
তবারক সামনে দাঁড়াতে বে-নামী মানুষটা অতপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থমকে দাঁড়াল।
ততক্ষণে ক্ষুব্ধ তবারকও উত্তেজিত। সে বলল, মানুষ জাগবে ফের এই ধ্বংসস্তুপ থেকে। জেগে ওঠবে আগুনে পোড়া বত্রিশ থেকে। জেগে ওঠবে নিভে যাওয়া ছাই-ভস্ম থেকে আবার আগুন হয়ে ফিনিক্স পাখির মতো!
==========================