You are currently viewing দীলতাজ রহমান || কেড়াইল

দীলতাজ রহমান || কেড়াইল

দীলতাজ রহমান

কেড়াইল

রুবী বলল, একদিন আমার এক দাদা দুপুরবেলা পুকুর থেকে গোসল করে ভিজে গামছা ঘাড়ে করে বাড়ি উঠছিলে। মানে আমাদের হাওর এলাকা তো। বাড়ি ̧লো তাই বেশ উঁচু হয়। ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে বুকে হাঁফ ধরে যেত।

তো সে দাদা ওরকম হাঁফধরা বুক নিয়ে বাড়িতে উঠে তার ̄স্ত্রীকে দেখলো কেড়াইল দিয়ে উঠোনে নাড়া খড় উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে…।
‘কেড়াইল কী?’
কে একজন কথার ভেতরে বাম হাত ঢুকিয়ে দিল। রুবী রাগ করে বলল, কেড়াইল চেনো না! কোনখানকার লাটসাহেব তুমি? গ্রামে উঠোনসহ বাড়ির নিচ পর্যন্ত ভিজে খড় নেড়ে যেটা দিয়ে আবার উল্টেপাল্টে দেয়, তাকে কেড়াইল বলে!
এর ভেতর আরেকজন বলে উঠল, কেড়াইল দেখতে কেমন? কী দিয়ে বানায়?
রুবী এবার সতি ̈ই রাগ করল। বলল, যারা কেড়াইল চেনে না, এই গল্প তাদের জন ̈ না! তারা একপাশে গিয়ে বসো!
আমি এত ভূমিকা করে গল্প বলব না।
এর ভেতর আরেকজন বলে উঠল, চিনি হয়ত, কিন্তু একেক এলাকায় একেক জিনিসের একেকরকম নাম হওয়ায় বুঝতে পারছি না। দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারব!
ত্রিশ অতিক্রান্ত রুবী ঝামটা মেরে বলল, পাকা বাঁশের আগা, মানে চিকন অংশ থেকে পাঁচ/ছয় ফুটের মতো অংশ কেটে, তারপর আবার ছেঁটে-ছেঁচে সাইজ করা হয়। তবে ওই সাইজ করা বাঁশের মাথার অংশে কঞ্চির বিঘতখানেকের মতো রাখা হয়, যা আলের মতো। খড় উল্টেপাল্টে নাড়ার জন ̈ ওই আগার বিঘতখানেক কঞ্চিই কেড়াইলের মোক্ষম অংশ।
আবার কেউ বলল, তা কেড়াইল কি শুধু খড় উল্টাতে লাগে?
শহর-গ্রাম মিলিয়ে বেড়েওঠা রুবীর মুখের ভাষা বড় আলগা। সে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, তুমি কোন জমিদারের নাতি হে,কেড়াইল আর কী কাজে লাগে, তোমাকে তাও আমার বুঝিয়ে বলতে হবে!
কাজল বলল, পুরান ঢাকার মানুষ আমরা। আমাদের কাজকর্ম যন্ত্র নিয়ে। ছেলেরা একটুবড় হতেই বাড়ির সামনে হোক আর সিঁড়ির নিচে হোক একটুক্ষুদধ মেশিন দিয়ে বসিয়ে দেয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র উৎপাদন করতে। তারপর বিক্রি। অথবা বাপ-মা ঘাড় ধরে ঠেলে তুলে দিয়ে আসে মামা-চাচা গোছের কোনো উৎপাদকের সহকারী হতে! আমার প্রজন্মে এসেও আমাদের সবাই তাই করত।
জাহাঙ্গীর কাজলকে বলল, সেখান থেকে তুমি চার্টার্ড একাউন্ট হতে পারলে? তাও এক চান্সে পাস করে? যা খুব কম মানুষই পারে!
কাজল বলল, হাঁ পারলাম তো! এখন থেকে আমার সাথে বুঝে কথা বলবে! আমরা যদি জানি ধানগাছে কাঠ হয়, তাতেও দোষ নেই! যদিও আমার দাদা ধানমন্ডিতে ধান ফলিয়েছেন। বাবারও তা মনে আছে। কিন্ত জানতে চাইনি কখনো, ধান গাছ কেমন। ছবিতে যা দেখেছি!
আলোচনা থিতিয়ে যেতে সুরভী বলল, হায় হায়, যা নিয়ে এত বচসা তাই তো থেমে গেল?
ফাহিম বলল, কী?
সুরভী বলল, ওই যে রুবীর দাদার গল্প! দাদা-দাদিকে নিয়ে যখন গল্প, তখন তা মজারই হবে। বলে রুবীর কাছাকাছি বয়সী সুরভী পাশে বসে থাকা রুবীকে ধাক্কা দিয়ে বলল, আবার শুরু কর!
রুবী জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে বলল, শুরু করব, কিন্তু টগর, মানে তোমার বউ কই? বাড়িতে ডেকে এনে বউ লুকিয়ে রাখবে, তা হবে না ভাই!

জাহাঙ্গীর বলল, সে অনিবার্য কারণবশত অনুপস্থিত। কোথায় আছে তাও বলতে মানা। তবে তোমরা থাকতে থাকতে তিনি যেখানেই থাকুন, আবির্ভূত হবেন। তার সাথে আমার তেমনি কথা! তবে ভয় পেও না। আমি চায়ের পানি চুলোয় চাপিয়ে এসেছি। আর টগর তোমাদের জন ̈ টেবিল উপচে খাবার রেখেছে। বিকেল থেকে রাত অবধি যেন তোমাদের খিদে তেষ্টায় না ভুগতে হয়।
কাজল বলল, তাহলে এমন গুরুদশা অবস্থার ভেতর আমাদের ডাকলে কেন?
জাহাঙ্গীরে হেসে বলল, গুরুদশা মানে কী জানো তো? যা হোক, সেরকম না হলেও আমাদের শিষ্যদশা চলছে বলত পারো। আমরা দুজন জার্মানে যাচ্ছি। দুই বছরের জন ̈। ̄‹লারশিপ নিয়ে। বেশি বয়সে উচ্চতর শিক্ষা আর কি!
ফাহিম বলল, তোমাদের বাচ্চা দুটি?
জাহাঙ্গীর বলল, ওদের নিয়ে যেতে খুব ঝামেলা। আবার ওদের নিয়ে গেলে আমরা লেখাপড়া করব কখন! আমরা তো ফিরে আসার জন ̈ যাচ্ছি। তাই ওরা নানা-নানি, দাদা-দাদির কাছে থাকবে। এখন তো কিছুটা বড়ও হয়ে গেছে।
ঝামেলা হবে না। আর আমাদের দুজনের প্যারেন্টই শক্ত-সমর্থ আছে।
মারুফ বলল, মহারক্ষে। তবে তোমাদেরও মনের জোর আছে বলতে হবে। বেশিরভাগ মানুষই এই রিস্ক নেবে না।
জাহাঙ্গীরের ঘোষণা ও মারুফের মন্তব ̈ শেষ হলে সবাই বিলম্বে হাততালি দিল এবং সেই সূত্রে তারা জাহাঙ্গীরের পেছনে পেছনে টেবিলের দিকে আগাল বৈকালিক পর্বের চা-নাস্তা খেতে। অভ্যস্ত হাতে জাহাঙ্গীরই সবাইকে পরিবেশন করল চা। সারি সারি রাখা নাস্তা যে যার মতো খেয়ে চায়ের ভরা কাপ হাতে যে যার মতো আবার গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতে বসতে কাজল হিসেব করে বলল, আর কেউ আসতে বাকি নেই তো? বলে সে মাথা গোনা শুরু করে দিল।
ফার্মাসিস্ট ফাহিম বলল, রুবী, এবার শুরু করো তোমার দাদার কেড়াইলের গল্প!
রুবী বলল, ভুলে গেছি, কোন পর্যন্ত এসেছিলাম।
সুরভী বলল, মাত্র তোর দাদা ঢাল বেয়ে বাড়ি উঠছিল। উঠে দেখল তো দাদি খড় ওল্টাচ্ছে।
এবার গল্পকথক রুবীর নিজের হাসির জন্যই শ্রোতাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। রুবীর হাসি দেখে তারাও তেমনি না
বুঝে হাসতে থাকে, আর বলতে থাকে, রুবী, ভাই তুই পারিসও। ভুলেই গিয়েছিলাম, আমরাও হাসতে পারি!’
হাস্যরত রুবীর চা ছলকে শাড়িতে পড়ল খানিকটা। এতে অনে ̈রা ভয়ে তার থেকে সরে বসল। রুবী নিজেকে অনে কষ্টে দমিয়ে আবার শুরু করল, দাদা, মানে আমাদের সেই পাড়াত দাদা বাড়িতে উঠে…।
কাজল বলল, তুমি তো বলেছ, তোমাদের বাড়ির ওপরের ঘটনা। তাহলে বাড়িত দাদা হবে!
আরমান বলল, বলতে দাও ওকে। পাড়াত থেকে বাড়িত-তে এসে ঠেকেছে। আর বাড়ির ওপরে যারা থাকে তারা সব রক্তের সম্পর্কের মানুষ থাকে। সেই হিসাবে ওর দাদার আপন ভাই না হোক, চাচাত ভাই হবে!
কাজল বলল, রুবী এবার নিজেই ধরা খাবে!
রুবী বলল, খেলে খাব! গল্প তো শেষ করি! শোনো তোমরা, দাদা তার স্ত্রীর হাতের সেই খড় নাড়া কেড়াইলটা নিয়ে কেড়ে নিয়ে, সেই মধ ̈ উঠোনেই তাকে সেই কেড়াইল দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে পেটাতে পেটাতে বলতে লাগল,
হারামজাদি মাগী, তোরে কয়দিন ধরে কী কচ্ছি তা শুনিস না ক্যান!
পাশাপাশি বসা ক’জন একসাথে রুবীর মুখের দিকে তাকাল। একজন বলল, কেন ওইভাবে পিটাচ্ছিল?
রুবি রসাল মুখে আবার শুরু করল, সেই দাদা-দাদির চার ছেলে, দুই মেয়ে। সব ছোট ছেলেরও তখন বিয়ে হয়েছে।
ক’মাস মাত্র আগে। দাদা দাদিকে বেধড়ক মারছে, আর ছেলের বউয়েরা যে যেখানে ছিল, আড়াল থেকে ইশ্ইশ্ করছে। শ্বশুর মারছে শাশুড়িকে এমন বুড়ো মানুষের মার কে যাবে ঠেকাতে! ছেলেরা কেউ বাড়ি থাকলেও তো আর এগিয়ে আসতে পারে না। বরং তাদেরও তখন বাড়ি ছেড়ে পালানোর কথা! এই অব ̄’ায় হাড্ডিসার বুড়ির কী দশা বোঝো!
জাহাঙ্গীর বলল, তুমি তখন কোথায় ছিলে?
রুবী বলল, একেবারে ওই উঠোনেই ছিলাম! আমরা এককোনায় চড়ুইভাতি খেলছিলাম। তারপর শোনো…।
কাজল বলল, তোমার বয়স তখন কত?
সাত-আট হবে! তারপর শোনোই না, শেষে সেই দাদা-দাদির ছোট ছেলের নতুন বউ একহাত ঘোমটা টেনে এগিয়ে গেল শ্বশুরের হাত থেকে কেড়াইল টেনে ধরতে। তাও কি শ্বশুর ছাড়ে! শেষে শ্বশুরকে আশ্ব ̄Í করতে নতুন বউ মন্ত্র পড়ার মতো শ্বশুরকে শুনিয়ে শাশুড়িকে কপট ভর্ৎসনা করতে লাগল, তয় আম্মা, আব্বা যা কয় আপনি তা শোনেন না ক্যান? য়্যা, শোনেন না ক্যান…! বিটা মানষির মর্জি বুইজে চলতি অয় না? আমরা বউ অইয়ে তা কি শাশুড়ি রে শিখাইয়া দিয়া লাগবে নাকি?
এসব বলে শাশুড়িকে শ্বশুরের কবল থেকে আগলে ঠেলে সে ছোট বউ রান্নাঘরে অন্য জা-দের ভেতর নিয়ে তুলল। যেন শ্বশুর আর তাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যেতে না পারে। তারপর নতুন-পুরাতন চার জা মিলে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল! আর বাকি সারাদিন ঢেঁকির পাশে বসে চিকন-চাকন গড়নের বুড়ির নাকি সুরে কান্না আর থামে না!
ফাহিম বলল, বুড়ির কান্না কি অভিমানের না অপমানের?
রুবী বলল, আগে তো এভাবে বুঝিনি। অভিমান, অপমান পরের পর্ব। এখন তো মনে হচ্ছে ওই যে হাড্ডিতে ঠনঠন বাড়ি লেগেছে, সেটা সেই কান্নাই!
কাজল বলল, চার জা মিলে ঠোঁট টিপে হাসার কারণ কী?
রুবী বলল, শোনোই না, চার বউয়ের এই শ্বশুর-শাশুড়ি এই দুজনের কারও সাথেই কারও রাত-দিন কখনো তেমন দেখা হওয়ার অবকাশ নেই। ওই বয়সেও বুড়ি খুব পরিশ্রমী ছিল। তাই তাদের দেখা হয় বুড়ি যদি বাড়ির নিচে সেই বিরাট জলাধারের এতটুকুবাঁধা কাঁচাঘাটে কোটা আনাজ-পাতি খালুইতে করে ধুতে বা কলস নিয়ে পানি আনতে যায়। আর বউদের শ্বশুর যদি সেখানে গামছা দিয়ে ঢলে-ঘষে সেই তখন গোসল করতে থাকে। বা পরে যায়। আর তাও যদি অই সময় সে ঘাটে আর কেউ না থাকে, তখনি বুড়ো বলতে পারে, ‘এই আজ রাতি বারান্দায় আসিস কিন্তুক…!’
আবার কোনোদিন দুজনের এমন মোক্ষম দেখা হলে বউদের শাশুড়িকে একা পেয়ে শ্বশুরের গলায় আবার, ঝাঁজ, ‘এই তোরে কী কইছিলাম? হারামজাদি মাগি তোর মাজা কলাম বাড়ৈ ভাইঙ্গা দিবানি!’
নিজের স্বামীকে ষন্ডা মনে করে, তার প্রস্তাবকে কুপ্রস্তাব মনে করে বউদের শাশুড়ি, মানে আমার সেই দাদি গাঁই ̧গুঁই করে দধুতই ঢাল বেয়ে বাড়িতে চলে আসে। ছাগল পালা বুড়ির ভয় হয়। কারণ পাঁঠার তেজ তো সে হরহামেশা দেখে। তাই সে মনে করে, বুড়ো ওখানেই না তাকে ওরকম করে ধরে ফেলে কাদার ভেতর শুইয়ে দেয়! বাড়িভরা বউ-ঝি, নাতিপুতি।
খুঁটোর দড়ি ছেঁড়া পাঁঠার মতো বুড়োর ওরকম ঘোঁত ঘোঁত আলাপের অংশবিশেষ একদুপুরে কেউ পেছন থেকে শুনে ফেলে সমবয়সী নতুন চাচি ওই বাড়ির ওই ছোট বউকে সে তা বলে দেয়। আর ছোট বউ তা বাকি তিন বউয়ের কাছে বলে মজা করেছে। আর এভাবে তা রটে গেছে পাড়ার সব জা’য়ের পাতে!
ক’জন বন্ধু-বান্ধব একত্র হয়ে গল্প করতে করতে রুবী তার ছোটবেলার এই স্মৃতি এভাবেই রসিয়ে ঝেড়ে দিল সবার ভেতরে। রুবী এও বলল, কিন্তু আমি আশ্চর্য হচ্ছি কেন জানো তোমরা?
হেসে গড়াগড়ি খাওয়া ক’জন বলল, কেন?
: আমার বয়স তখন সাত-আটের বেশি না। কিন্তু আমি এই ঘটনার ভাবার্থটা তখনি বুঝলাম কী করে? কেউ তো আমাকে খোলাসা করে বুঝিয়ে দেয়নি!
কিছুটা কম কথা বলা আরমান বলল, শোনো প্রতিটি মা-বাবা বিছানায় কী করে প্রতে ̈কটি শিশুই তা বুঝতে পারে। অথচ আমরা জানি যে আমাদের শিশুরা জানে তাদের মা-বাবা পাশাপাশি শুয়ে নাক ডেকে শুধু ঘুমায় আর সব ভালো চিন্তা করে!
কাজল বলল, বিষয়টা নিয়ে আমরা হাসাহাসি করছি, কিন্তু বিষয়টা কত করুণ, এই ঘটনার ভেতর নিজেরা ঢুকে আবার কল্পনা করো!
সুরভী বলল, সেটা আবার নিজের ওপর এনে কল্পনা করব কী করে?
মারুফ বলল, যেভাবে কোনো কোনো গল্প পড়ে বুক ভাসাও! ভেবে দেখো, ওই লোক বিয়ে করেছিল হয়ত উনিশ/বিশ বছর বয়সে। তারপর তার ছেলে-মেয়ে বড় হতে হতে মানে আবার তার ছেলেকে ওই বিশ/বাইশ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছে। তারপর একে একে অন্যগুলোর পালা। একখানা ঘরে সবার জন ̈ খোপ খোপ করে স্বেচ্ছায়-আনন্দে সে নিজে জায়গা বেছে নিয়েছে বারান্দার খোলা জায়গায়। আর বউ ঘরের ভেতর হাঁড়ি-পাতিলের কাছে একটা পাটি বিছিয়ে হয়ত পড়ে থাকত। তারপর নাতিপুতির সংখ্যা বাড়লে মায়ের দুধছাড়া ̧লো নিজের কাছে টেনে আনা। তখন কিন্তু সে বীর্যবান পুরুষটি বুঝতে পারেনি, বাড়িতে আরেকখানা ঘর না তুলে ছেলে বিয়ে দেওয়া মানে এ তার নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা! আমি গ্রামে সাধারণ পরিবারে জন্মেছি বলে জানি, তারপর কী হয়, শীত আসি আসি করলে পাটখড়ির বেড়া দিয়ে সে, মানে বাড়ির কর্তা বারান্দার দু’দিক ঘিরে নিল। আরেক দিক তো ঘর দিয়ে ঘেরা। অবস্থা মোটামুটি হলে হয়ত সে তিনদিকের আড়ালে একখান নড়বড়ে উদ্বৃত্ত চৌকিও ভাগে পেয়ে তাও সেখানে বেঁধে-ছেদে জুড়ে নিল। শীত বাড়তে থাকলে সে চৌকির খোলা দিকে বাড়ির কারও একখানা পুরনো শাড়ি টাঙিয়ে নিল। তাতে পর্দা হলেও শীত আর কতটা মানে! তার ভেতর যদি মাঝে মাঝেই স্ত্রীর অভাবটা প্রবল হয়ে ওঠে…।
রুবী মারুফকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ! আর এরা কিন্তু খুব গরিব ছিল না! এ গল্প অন্তত সারাবছর নিজের জমির ধানের ভাত খাওয়াদেরই গল্প। একখানা ঘর করতে যে উদ্ব…ত্ত অর্থের দরকার, তা অনেকেই ওই দাদার মতো গুছিয়ে উঠতে পারত না! তাই একেক ছেলে বিয়ে দিত আর ঘরের খোপের ভেতর আরেকটা খোপ তৈরি হত।
সুরভী বলল, আরেকখানা ঘর যারা করতে পারত, দেখা যেত তারা আরেকটা বিয়েই করে নিয়েছে! আর করলে তো কেউ বুড়ি বা মাঝ বয়সীকে করত না! দেখা যেত এমন একজনকে শ্বশুর নিয়ে আসছে, সে ওই বউ ঝিদেরই বয়সী।
এমন ঘটনা আমিও কিছুটা দেখেছি। আর পুরনো বউকে দেখেছি পুরোই ভাঙাকুলোর ভূমিকায়। যা দিয়ে ছাই ফেলার মতো তুচ্ছ অথচ ভারি কাজ করা হয়। পেটেধরা ছেলে-মেয়ের কাছেও মা ওই ভাঙা কুলো…। বিষয়-আশয় নিয়ে বাবার সাথে যার কোনো যোগসূত্র থাকে না, তাতে সন্তানের অবহেলা-অগ্রাহে ̈ মাটিতে মিশে যেতে তার আর সময় লাগে না। বাবার পারিবারিক ব ̈বসা প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত মারুফ রহমানকে ওরা বলে বিত্তবানের বেকার ছেলে। সেই বেকারের মুখের দিকে সবার কৌতূহলী চোখ, গল্পের মোড় কোনদিকে যায়, ভেবে। কিন্তু সুরভীর কথা আবার বানচাল করে দিল। কাজল বলে এই লোকটার, মানে রুবীর দাদার বয়স কিন্তু তখনো পঞ্চাশের বেশি না। অথচ দধুত তার স্ত্রীর সুখ তার কাছ থেকে শুধু অতীত হতে থাকে…।
রুবী কাজলের প্রতি ফুঁসে ওঠে। বলে, এই আবার তুমি আমার দাদা বললে কেন? এটা আমার দাদার ঘটনা হলে আমি তোমাদের বলব, এত বোকা তোমরা আমাকে ভেবেছ? তবে আমার দাদা চার-চারটে বিয়ে করেছিল হি হি হি…।
কাজল বলল, ‘তোমার দাদার যখন জ্ঞাতি ভাই, তো তোমার দাদাই তো বলব!’ কাজল রুবীকে তোয়াক্কা না করে পুরনো প্রসঙ্গে ফিরল। বলল, ওই রকম দাদাদের স্ত্রীদের তখন সংসারের টানাপড়েন সামাল আর ঘানি ঘোরাতে লবেজান অবস্থা। সারাদিনের খাটুনির পর দেখা যায়, খেয়েদেয়ে এশার নামাজ পড়তে জায়নামাজেই বেঘোর ঘুম চলে আসে তার। আর দিনে দিনে সরতে সরতে স্বামীর কাছে যাওয়া অনেক স্ত্রীরই স্বভাববিরুদ্ধ। তারা মনে করে ওটা, মানে যাওয়াটা পুরুষের একচেটিয়া কাজ। পুরুষই কাছে আসবে বা টেনে কাছে নেবে, যা করার পুরুষই করবে! তারপর আবার দরজা টপকে বারান্দায় নামা! খুঁট করে শব্দ হলে চোর এসেছে ভেবে একে একে সবাই জেগে সারাবাড়ি মাথায়! শরীরে শিহরণ যদি একটু খেলেও, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চালশে শরীর থেকে তা উবে যায়।
জাহাঙ্গীর বলল, এই তুমি যে তোমার আলোচনায় ধুয়ে-মুছে সব বুড়োবুড়ির আচরণকে এক করছ, তুমি জানো, আমি আমার বাবার দ্বিতীয় সন্তান। অথচ আমার সমান আমার চাচা আছে…! আমার বড়বোনের সমান আরেক চাচা আছে। তবে অজ-পাড়া গাঁ হলেও আমাদের পূর্বপুরুষের পাকা বাড়ি। ছেলে-মেয়ে উৎপাদনের জন্য তাদের কারও কোঠার অভাব ছিল না।
কাজল বলল, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। তবে সেটা তোমার দাদার মতো ছেলের বিয়ে দিয়েও যাদের নিজেদের ওরকম আয়েশ করে বউ নিয়ে থাকার জায়গা আছে, তাদের মেয়ে-জামাই, ছেলে-বউয়ের সাথেও উৎপাদন অব্যাহত থেকেছে। নাহলে মাসে নারীদের ডিম ফোটে একটা। তাও বার থেকে চব্বিশ ঘণ্টা সক্রিয় থাকে। এর ভেতর তো তোমার দাদাকে তার বীর্যটা দাদির ডিম্ব পর্যন্তপৌঁছে দিতে হয়েছে। তাতেই না তোমরা নিজের বয়সী চাচা-ফুপু পেয়েছ! তাই যাদের জায়গা নেই, তার ওপর আবার জীবনের সব আয়োজনই অপরিকল্পিত। প্র ̄‘তি ছাড়াই অসময়ে শখ করে যারা ছেলের দাড়ি শক্ত হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়েছে, সেই তারাই নিজের গড়া সংসারটা একসময় তাদের নিজেদের জন গ্যাঁড়াকল বানিয়ে ছেড়েছে!’
জাহাঙ্গীর বলল, তা শ্রোতারা না একপেশে করে ফেলে ভাবতে। তাই স্পষ্ট করে দেওয়া ভালো!
রুবী বলল, তোমরা যার যা বলার বলো, কিন্তুশ্রোতাদের বোঝার ক্ষমতার ওপর ভরসা রেখো। তাদের স্থান-কাল- পাত্রজ্ঞান আছে।
তুষার বলল, কিন্তু এটা কি জানো, এরকম করে আলাদা থাকতে থাকতে দুজন মানুষের ভেতর এমন দেয়াল সৃষ্টি হয়, মানে জড়তা সৃষ্টি হয়, যে পুরনো এই মানুষ দু’টি পরস্পর পরস্পরের কাছে উন্মোচিত হওয়ার থেকে অনে ̈র কাছে উন্মোচিত হওয়া তাদের আরও সহজ! এই কারণেও কিন্তু পুরুষরা সুযোগ পেলে আরেকবার বিয়ে করে। দুই-চারজন নারীও নাতি-নাতনিদের লজিং মাস্টারকে বাড়তি যত্ন আত্তি করে করে মনের মরকুট আবেগকে পরিতৃপ্ত করার চেষ্টা করে! তবে রুবীর সেই দাদা-দাদির মতো অধিকাংশেরই সীমাবদ্ধতা প্রকট। তাই স্বাভাবিকভাবেই ছেলের বউদেরভেতর তা জানাজানি হয়। বউয়েরা আবার যার যার খিকখিক করে হাসতে হাসতে তাদের শ্বশুর-শাশুড়ির কথা স্বামীদের কাছে বলছে। বিষয়টা হাসতে হাসতে পাড়া ভেসে যায়। কিন্তু ওই শ্রেণির জোয়ান শ্রোতা যারা, মানে ওইরকম সীমাবদ্ধতায় জর্জরিত জীবন যাদের, তারাও যদি আগের থেকে তাদের জায়গা ধরে না রেখে ছেলেদের ছেড়ে দেয়, তাদেরও কিন্তু কপালে ওই একই দশা ঘটবে, ওই কেড়াইল!
জাহাঙ্গীর বলল, শোনো তোমরা, স্বামী- স্ত্রীর যে দৈহিক সম্পর্ক এটাও কিন্তু চর্চার বিষয়। এর চর্চা ছেড়ে দিলে বিশেষ করে গ্রাম ̈ নারীরা। এদের তো অযত্নের শরীর। ঠিকমতো খাওয়া নেই তার ওপর আবার খাটুনি বেশি। এদের চল্লিশ না ছুঁতেই গিরায় গিরায় ব ̈থা শুরু হয়ে যায়। তারপর নড়েচড়ে শুতেও ভয়। সেখানে স্বামীর কাছে গিয়ে পা দুটো ফাঁক করে নিজেকে ক্ষুধার্ত স্বামীর কাছে শরীর মেলে দেওয়া কী ভয়ডর, তা তোমরা জানো…?
রুবী বলল, ’এই কথা হচ্ছিল কি নিয়ে, সেখানে জাহাঙ্গীর কী অসভ্য কথা শুরু করেছে। এই এ প্রসঙ্গ ক্লোজ…।’
কাজল বলল, জাহাঙ্গীর ডাক্তার। এই বিষয় সেই ভালো জানলে তার মুখ আটকানোর ক্ষমতা আমাদের কারও নেই!
জাহাঙ্গীর বলল, প্রসঙ্গ ক্লোজ করো। কিন্তু মেয়েমানুষ দু’পা ফাঁক করে না দিলে সব সৃষ্টি থেকে শিল্প-সাহিত্য থেমে যাবে। মানে মানুষই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তারপরও ফাঁক কথাটা শুনতে কানে লাগে!
আরমান বলল, যার যার কাজ ফেলে জাহাঙ্গীরের আমন্ত্রণে আমরা একত্র হলাম। এসে পেলাম বাসায় গিন্নিনেই। আর মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছি রুবীর দাদা-দাদির কেড়াইলের কিচ্ছা!
জাহাঙ্গীর বলল, যা-ই শিখলাম না শিখলাম, রুবীকে আর ডাকা যাবে না। ও শুধু নিষিদ্ধ গল্প টেনে আনে। একদিন আরেক আড্ডায় সে এর থেকে ভয়ের গল্প টেনে এনেছিল! বিশ্বাস করো তোমরা, আমি বিবধত হয়েছিলাম সেখানে।
কাজল বলল, সে গল্পও কি ওর আরেক দাদার? নাকি নিজের নানার? যারই হোক ভুলে যেও না। আরেকদিন আজকের
মতো মজা করে শোনা যাবে!
রুবী জাহাঙ্গীরকে বলল, আমাকে আর না ডাকো, তবে আজকের আলোচনায় যে বিষয়টা পাড়া হল, বাড়ি গিয়ে যার যার হাজব্যান্ড এবং স্ত্রীকে বোলো কিন্তু! ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’র মতো আমার দাদার অভিজ্ঞতা যত্ন করে রেখে দিও যারা দীর্ঘ যৌনজীবন চাও!
রুবীর কথায় আবার সবার একচোট হাসি হল। সুরভী রুবীকে বলল, তুই বলতে পারবি তামজিদ সাহেবকে!
রুবী বলল, আরে কবেই বলেছি। তবে দেরিতে বলেছি। প্রথমে তো আমার তার সাথে এতকথা হত না!
সুরভি বলল, কেন রে? তোর সাথে কি তার সম্পর্ক প্রথম দিকে ভালো ছিল না?
রুবী চোখ ট্যারা করে বলল, তত দিনে ওই দাদা আর দাদি তো আরও বুড়ো হয়ে গিয়েছিল, তাই।
আরমান বলল, তোরা একই বাড়িতে বড় হয়েছিস। বিয়ের আগে তোদের দেখা সাক্ষাৎ হত?
আরে, অনেকদিন ধরে বিয়ের কথা হয়নি। যখন তখন ধরে কলমা পড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কেউ ওঠার জন্য উশখুশ করছিল। রুবীর শেষের কথায় আবার সবাই গেঁড়ে বসল। প্রায় সবাই সমস্বরে বলল, ঘটনাটা দ্রুত বল!
রুবী শুরু করে। যেন নিজের নয়, অন্যের গল্প শুরু করেছে সে। বলল তামজিদ তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত।
আমাদের অত বড় বাড়ি থেকে ও-ই একা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। আমাদের আগের প্রজন্মের কেউ অত শিক্ষিত ছিল না। পরের প্রজন্মের ও-ই পালের গোদা। ওর সময়ে ও একাই ঢাকা থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়ত।
তখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভালো ছিল না ঢাকার সাথে যশোরের। তখন ঢাকা থেকে কারও যশোর যাওয়াওত আজ লন্ডন-আমেরিকা থেকে যশোর যাওয়ার অধিক ছিল। আর ওর ভেতর খুব একটা নায়ক নায়ক ভাব ছিল। ও বাড়ি গেলে বাড়ির সব সোমত্ত মেয়ে সেজে ̧জে ঘুরত। সেই মেয়েদের মা-বাবারা ওর মা-বাবাকে খুব দাম দিয়ে চলত!
আর ওকে সবাই মনে করত দেবতা! কিন্তু আমি তো তখন সোমত্ত না অনেক ছোট। কিন্তু বুঝতাম, আমার মাও চাইত তামজিদ যে কোনো মূলে ̈ তার জামাতা হোক। আর এতেই যেন আমারও কেমন লাগত।
কাজল বলল, তুই তখন কোন ক্লাসে পড়িস?
রুবী বলল, সেভেনে!
কাজল বলল, তুই তখন শিহরণ বুঝতি?
রুবী অকপটে বলল, হ্যাঁ! না হলে আর ওকে অত রাতে খোঁচাতে গেছি কেন?
আরমান বলল, কী বললি?
রুবী বলল, কী বলি শুনতে থাকো। ওদের ঘর আর আমাদের ঘর দূরে হলেও ওদের কাছারি ঘরটা আমাদের ঘরের লাগোয়া। ও ঢাকা থেকে গেলে ওই ঘরেই থাকত। ও বাড়িতে যাবে খবর পাঠালেই ঘর-উঠোন লেপে সাজ সাজ রবে সব সাজানো হত। সেবারও তাই হয়েছিল। সেবার ও যখন গেল, মানে ঘটনা যে রাতে ঘটালাম, বাড়ির বড়রা সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়ার মতো। মাঘের শীতের রাত। আমি দুষ্টুমি করে টিনের বেড়ার ছিদধদিয়ে চুপি দিয়ে দেখি ও হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ছে। আমি একটা পাটখড়ির মাথায় একটা খেজুরের কাঁটা ঢুকিয়ে বেড়ার নিচে দিয়ে ওর পায়ে খোঁচা দিই। খোঁচাটা ওর পায়ে ভালোই লাগে। আর ওই টিনের বেড়ার ছিদধদিয়ে চোখ সরু করেই দেখছি, ও মনে করেছিল ওকে সাপ কামড় দিয়েছে। ভয়ে ও মেঝেতে পড়ে যায়। আমার তখনই জানা ছিল, সাপে কাটা মানুষ অধিকাংশই মারা যায় হার্টফেল করে! আমি বেঘোর অব ̄’ায় হিতাহিত জ্ঞানশূন ̈ হয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বললাম, ‘দাদাভাই, আমি রুবী, আপনাকে খেজুরের কাঁটা দিয়ে খোঁচা দিয়েছি আমি! আমি রুবী, দাদাভাই!! আপনাকে সাপে কামড়ায়নি,
দাদাভাই! ভয় পাবেন না!’
: বাহ্ বাহ্ বাহ্, বলে যাও! দাদার পরে দাদাভাই! আরমান বলল।
রুবী বলল, তারপর ও দরজা খুলে আমাকে হেঁচকা টানে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে ঠাসঠাস মুখের দুদিকে কয়েকটা করে থাপ্পড় মারল। আমি চেঁচিয়ে উঠতেই আমাকে বিছানায় ফিকে মেরে ফেলে লেপ দিয়ে ঢেকে মুখে হাত চাপা দিয়ে রাখল।
সুরভী বলল, তারপর?
রুবী শুরু করল আবার, আমি আর জানি না। শেষরাতে দেখি আমাকে ঘিরে তখনকার দাদাভাইয়ের ঘরে শোরগোল।
আমার ছোট চাচা আমাকে বিছানা ঠেকে টেনে তুলতেই দেখল বিছানায় রক্ত। সবার ধারণা দাদাভাই আমাকে রক্তাক্ করেছে। হি হি হি !
আরমান বলল, সবাই যে শেষরাতে তোমার দাদাভাইয়ের ঘরে হামলা করল, ওরা জানল কী করে, যে তুমি ওখানে?
রুবী বলল, পরে জেনেছি, দাদাভাই যে আমাকে হেঁচকা টান দিয়েছিল, তাতে এক পায়ের চকচকে নতুন গোলাপ স্যান্ডেল ঘর পর্যন্ত এগোলেও আরেক পায়ের স্যান্ডেল বাইরে ছিটকে ছিল আমার অস্তিত্ব জাহির করতে। পাটখড়িত আগুন জ্বালিয়ে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ওই স্যান্ডেলখানাই নীরব ইশারা দিয়েছিল। আর তাতেই সবার সন্দেহ, এই ঘরেই আছে। যদিও ভব্যতাজ্ঞান সম্পন্ন দাদাভাই তার দরজা কিছুটা খোলাই ছিল। আমি কাত ধরে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লে, দাদাভাই নিজেকে নিরাপদ মনে করে বিছানা ছেড়ে চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে ঘুমাচ্ছিলেন।
সুরভী বলল, তারপর তোরা কী করলি তাই ক!
আরে আমি আর কী করব? আমাকে আর কেউ কিছুজিজ্ঞেস করলে তো! বিছানার রক্তই যা করার করেছে। সকাল সূর্য ওঠার সাথে সাথে ওকে চেপে ধরে, ফজরের নামাজ পড়া মুয়াজ্জিনকে তুলে এনে কলমাটা পড়ানো হল।
মারুফ বলল, তোমার তখনকার দাদাভাইয়ের পরিবার বিদ্রোহ করেনি?
রুবী বলল, না। তার কারণ আছে। আমি তো একা! বাপের যা আছে সব আমার। গ্রামের মানুষ তো, চোখ তুলে তো এরা অট্টালিকার দিকে তাকানোর অবকাশ পেত না। জমি পেলে সব শোক সয়ে যায়। আর ওই সাদা চাদরের
রক্ত অস্বীকার করে সাধ ̈ কার! ঘাড়ে তো কারও একাধিক মাথা নেই! গ্রাম ̈ শালিস বোঝ?
জাহাঙ্গীর বলল, তোমার দাদাভাই তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে চেয়ারে বসে ছিলেন। তাহলে বিছানায় রক্ত এল কী করে?
রুবী বলল, আমি জানি না ভয়ের চোটে কি না। ওই রাতেই প্রথম আমার মাসিক শুরু হয়ে গিয়েছিল। সারাবাড়ি সবার মাথায় যখন বিছানার চাদর আর আমার জামা-প্যান্টের রক্ত চেপে আছে, তখন আমি কিন্তু বুঝছিলাম কী সন্দেহ করে সবাই কথা বলছে, কিন্তু আমার তখন বোবায় ধরা মানুষের মতো দশা হয়েছিল। মানে আমি যে বিষয়টা বুঝি, কী করলে রক্ত বেরোয়, কিন্তু এ যে সে রক্ত নয়। কিন্তু তা সবাইকে বোঝাই কী করে?
কাজল ধীরকণ্ঠে বলল, তারপর তোমরা সুখে-শান্তিতে সংসার করতে লাগলে?
রুবী বলল, আরে না! উনি তো কোন ফাঁকে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা চলে এলেন। তারপর রাগ করে বাড়ির কারও সাথে আর যোগাযোগ করেননি! বছরখানেক পর, ততদিনে তার চাকরিটাও হয়ে গেছে, তখন আমার শ্বশুর, মানে আমার আব্বার চাচাত ভাই তো আমার শ্বশুর। তিনি আমাকে ঢাকায় ওর কাছে নিয়ে আসে। সে তো আমার শ্বশুরসহই আমাকে বের করে দিয়েছিল। তারপর উনি অফিসে চলে গেলে আমার শ্বশুর আমাকে ফি ছাবিলিল্লাহ করে দরজার বাইরেই রেখে পালিয়ে যান। আমি বিড়ালও নই, ইঁদুরের অধম হয়ে বাসার এখানে ওখানে পড়ে থাকলাম। এর ভেতর উনি যাকে পছন্দ করতেন, তাকে বাড়িতে ডেকে এনে আমাকে দেখালেন। বললেন, তার দ্বারা আমাকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই তাকে দধুত সিদ্ধান্ত নিতে বলল বিয়ের। মানে তাকে বিয়ে করে ঘর বোঝাই করে ফেললে আমাকে বাড়িতে চালান দিয়ে দিত। তখন বাড়ির কেউ আমাকে ফেরত পাঠাতে জায়গা পেত না!
কিন্তু বিষয়টা বোঝার পরে সেই তিনি থতমত খেলেন। আমি বুঝতে পারলাম তার চোখ ভরে এসেছিল জলে! একঘরের তিনদিকে তিনজন মানুষ ̧ম হয়ে বসে রইলাম। তারপর সেই তিনি চলে যেতে উদ ̈ত হলে তোমাদের তামজিদ ভাই হাত টেনে ধরলেন। বললেন, কিছুবলবে না! কিন্তু তিনি হাত ছাড়িয়ে রাগী চোখে তামজিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা হয়েছে মেনে নাও তামজিদ! তুমি তো এসেই আমাকে বলেছ। শুনেছি। কিন্তু শোনা আর দেখার ভেতর অনেক ব্যবধান! আর ও নিশ্চয় ̄‹ুলে পড়ে। ওকে তোমার কাছে রেখে স্কুলে ভর্তি করে দাও। এটা তোমার প্রতি আমার পরামর্শ। এরকম যে হয় না তা তো নয়!
তামজিদ বললেন, ‘এইটুকু একটা গ্রাম্য-গেছো মেয়ের জন্য আমাদের দুজনের জীবন নষ্ট হবে?’ তারপর তিনি মানে তার নাম তামান্না খন্দকার। তামান্না খন্দকার বললেন, আমরা লেখাপড়া করেছি শুধুতোমাকে আমি পাওয়ার জন্য আর তুমি আমাকে পাওয়ার জন ̈ তা তো নয়। জীবনের আরও লক্ষ ̈ আছে!
তামজিদ বলেছিলেন, তুমি কি আমাকে ভালোবাসোনি এতদিন?
তামান্না বলেছিলেন, ‘সব ভালো রক্ষা করে যা, তাই ভালোবাসা!’ বলে তিনি চলে ক্ষিপ্র বেগে ছুটে বেরিয়ে গেলেন! পরবর্তী সময়ে বুঝতে পারতাম, তামজিদ তামান্নাকে পাওয়ার আশা না ছাড়লেও তাকে আর টলাতে পারেননি। তামজিদের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকদিন যাবত ভয়েরই ছিল। তাই তার বাইরের জগত সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা থাকত না!
সুরভী বলল, তোমার ছেলে-মেয়ের জন্ম কি ওই ভয়ের ভেতরই হয়েছে? নাকি ভয় কাটলে?
সুরভী সেনের কথায় সবাই হো হো করে উঠলেও রুবী গম্ভীর হয়েই বলে গেল, ‘তবু আমি যখন হোম ইকোনমিক্স কলেজে ভর্তি হলাম, তখন জানতে পারলাম তামান্না তখনো বিয়ে করেননি। করবেনও না! বাইরের মানুষের চোখে সব ঠিকঠাক থাকলেও তামজিদের সাথে আমার একরকম নিস্তরঙ্গ জীবন কাটছিল। শরীরে-মনে ওকে আমি আরও পেতে চাইতাম কিন্তু খটকা ওই তামান্না খন্দকার! কোলে বাচ্চা বড় হতে লাগল। শ্বশুরবাড়ি-বাবার বাড়ি দুই বাড়ি এক হলেও পরিবার তো দুটো। দুই পরিবারের মানুষই এসে এসে সংসারে থাকত সহযোগিতা করতে। কিন্তু তামান্নার বিয়ে না করাটা আমার কাছে একটা খটকার মতো ছিল। সে কথা কাউকে বলতেও পারতাম না। মনে হত তামজিদ ওর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে।’
‘এর বেশি কিছুভাবতে না?’ মারুফ বলল।
রুবী বলল, ওই কুআমার মনে কখনো ডাকেনি। কারণ সেই যে তাকে একঝলক দেখেছি, ওইটুকু নৈতিক স্খলন ঘটানোর মতো হলেও তো আমি প্রথমেই ধুলোর মতো উড়ে যেতাম! যা-ই হোক, ওকে খটকা মনে হলেও ওই খটকার কারণেই অসম বয়স ও যোগ ̈তার দুজন মানুষের সংসারটা টিকে গেছে খুলে না পড়ে। তবু নিজেকে খুব পরাজিত মনে হত। মনে হত আমি আরেকজনের ছেড়ে দেওয়া জায়গায় বসবাস করছি! একদিন তাই সেই তামান্না খন্দকারকে খুঁজে বের করলাম। তখন তিনি একটা কলেজের তখন ডিপার্টমেন্টাল হেড। অনেকদিনের ভেবে রাখা কথা নিয়ে তার সামনে গিয়ে যখন বসলাম, তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। তার কাছে কেন গিয়েছি, জানতে চাইলে বললাম, ‘একদিন আপনি আপনার জায়গাটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলেন বলে আমি যেমন হোক একটা সংসার করছি। কিন্তু আপনি আজও কেন বিয়ে করেননি?’
রুবী তার পাড়াত দাদা-দাদির গল্পটি যেভাবে পরিবেশন করেছিল, ঠিক তার ভেতরে নিজের ডানপিটে জীবনের কাহিনি একাকার করে ফেললেও এ গল্প ওর সেদিন ওইখানে ওইভাবে পরিবেশন করে যা বুঝিয়েছে তার বন্ধু শ্রোতাদের, তা সে না বললেই ভালো করত!
তামান্না খন্দকার সেদিন রুবীকে শান্ত কিন্তু ধারালো কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, কেন বিয়ে করিনি তাও কি তোমাকে বলতে হবে নাকি!
রুবী বলেছিল, ওভাবে ভাবলে বলতে হবে না! কিন্তু আপনি যার সংসারটা রক্ষা করতে নিজে সম্পর্কভেঙে বেরিয়ে এসেছেন, সে আপনাকে নিয়ে না ভেবে পারে!
তামান্না বলেছিলেন, তা কী ভাবো আমাকে নিয়ে?
রুবী না ভেবেই বলল, মাঝে মাঝে মনে হয়, সংসারটা আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আমিও দেখিয়ে দিই, আমি পারি!
: তোমার মনে হয়, আমি তোমার পুরনো সংসারে ঢুকব? আচ্ছা বলো, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?
: আমার মনে হয় আপনি বিয়ে করলে আমি সুখী হতাম! শুধু এই কথাটি বলতে আপনার কাছে আসা!
: তুমি দেখছি আমার ভালোই খোঁজ-খবর রাখো!
: না সেরকম নয়। তবে তামজিদকে ওর বন্ধুরা, মানে আপনাদের পুরনো বন্ধুরা এইসব জানতে চায়, তাতে ও নিচু স্বর যে কথা বলে উঁচুকণ্ঠে বলা কথা ̧লো সব কানে না ঢুকলেও নিচুকণ্ঠের সব কথা কানে ঢুকে যায়! আর সেখানেই আমার হার!
: আমাদের থেকে তোমার বয়স অনেক কম। তাই তোমার সাথে এ নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক হচ্ছে না!
: দেখেন, একদিন যাকে দয়া দেখানো যায়, তারও দয়ার বয়স হয়। অবস্থান সৃষ্টি হয়। বড় যারা তাদের বয়স বাড়ে আর ছোটদের বয়সও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। আমি হোম ইকোনমিক্স কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছি। সবচেয়ে বড় কথা আপনাকে সেই কিছুক্ষণ দেখার ভেতর দিয়ে নিজের প্রতি আপনার নিষ্ঠুর উদারতা দেখে আমার সম ̄Í জীবন পরিবর্তিত হয়ে তো গেছেই, যা আমি নিজেও ঠিকঠাক বুঝতে পারি না! অথচ এই জীবনটা নরকের পর্যায়ে চলে যেতে পারত। কিন্তু তা যায়নি। সে ধসও আপনিই রক্ষা করে চলেছেন বলে আমার মনে হয়। আমি তাই বিশ্বাস করি। মিস্টার তামজিদ আমাকে মেনে হয়ত নিতেন, কিন্তুসে মানার ভেতর কোনো মাধুর্য থাকত না, যদি না আপনি তার পাশে থাকতেন!
: আমি তার পাশে আছি বলতে?
: কথা তো আপনার সাথে তার হয়ই। আর হলেই তো আপনি আমার সাথে মানিয়েই নিতে বলেন…।
: সে তুমি কী করে জানো?
: কারও শেখানো মানাটা বোঝা যায়!
: সে তোমার মনের প্রশান্তি!
: সেটুকুই তো অমূল ̈! জানেন, আপনাকে সেই কিছুক্ষণের জন ̈, একঝলকই বলা যায় দেখেছিলাম। কী আপনি আমার প্রাণে রেখে এসেছিলেন, আমার ভেতর সেই থেকে কী এক তোলপাড়, দুয়ে দুয়ে চার মেলানো, গতানুগতিক জীবনে যা থাকে না। মিস্টার তামজিদ পুরোটাই আমার। আইনি লড়াইয়েও নিশ্চয় আমি হারতাম না! তবু আমার মনে হয় আমি কারও ক্ষমার জলে ফোটা এক পদ্ম!
: আইনি লড়াইয়ে তুমি জিততে না! আমি অবশ ̈ এর ভেতর আর কোনোভাবেই থাকতামই না। তবু তামজিদ যদি তোমাকে না রাখতে চাইত, প্রথমত তখন তুমি না বালিকা। দ্বিতীয়ত তখনও তোমাদের কাবিন হয়নি। আর ও তোমাকে রেপ বা ধর্ষণও করেনি, যা নিয়ে তুমি ওকে দোষী করতে পারতে!
: আপনি এত কিছুজানেন?
এটুকু তো তামজিদেরই কৈফিয়ত ছিল আমাদের দেওয়া। এটা জানতে আমার চেষ্টা করতে হয়নি। তোমাদের কাবিন হয়েছে অনেক পরে। তা আমারই কথায়। তোমাকে তার টাকাপয়সা নমিনি করতে, পাসপোর্ট করতে কাবিন ছাড়া তো হবে না! তাছাড়া কাবিন ছাড়া বিয়ে হলেও বিয়ে তো আর অবৈধ হয় না। কাবিনটা হচ্ছে বৈধতার প্রত্যক্ষ চুক্তিনামা মাত্র।
: সে আমি জানি!
: তুমি চাকরি-বাকরি করোনি কেন?
: তিন-তিনটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাহস করিনি। রেজাল্টও খুব ভালো ছিল না। আর তামজিদ বলেনি, আমার একটা বুটিক হাউজ আছে। আর একটা একটা ̄‹ুলও আছে। ̄‹ুলটা আমরা বেশ ক’জন মিলে চালাই। সেখানে আমাদের বেশ সময় দিতে হয়।
: কী স্কুল?
: নিম্নবিত্ত এলাকায় একটা বড় কিন্ডারগার্টেন। যেখানে সাধারণ পরিবারের ছেলে-মেয়ে সব বিষয়ে ভালো শিক্ষা পায়, এটাই আমাদের উদ্দেশ ̈। বিষয়টা কৈয়ের তেল দিয়ে কৈ ভাজার মতো। মুনাফা আমাদের কারও লক্ষ্য নয়। বরং মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে খরচ করতে হয়।
: বাহ, এ তো খুব ভালো উদ্যোগ!
: আপনাকে বলেছি না, সেই একঝলক দেখায় কী এক আগুন আপনি আমার জন ̈ রেখে এসেছিলেন, তেমন কোনো সৃষ্টিশীলতা আমার ভেতরে নেই, যে সে আ ̧ন শব্দে আঁকি, রঙে ফোটাই বা ভা ̄‹র্যতৈরি করি। কিন্তু কিছুআলো, কিছু অন্তরের শুভ্রতা আমারও এই পৃথিবীতে রাখার ইচ্ছে হল। তাই এই পথে এগোলাম। পরিকল্পনা আমারই ছিল। তারপর আরও যারা মানুষের জন ̈ কিছুকরতে চায়, মানে সময় ও অর্থ ভালো কাজে ব ̈য় করতে চায় তাদের খুঁজে খুঁজে সহযাত্রী করেছি। সেটাই বড় আনন্দের হয়েছে। একা করতে হলে হয়ত একঘেয়েমি চলে আসত।
তামান্না গভীর চোখে চেয়ে থাকে রুবীর মুখের ওপর। ভীষণ অনুরাগ হয় ওর। কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করে। তার মনে হয়, যেটুকুছাড় সে দিয়েছে, তার থেকে বেশিই যেন তার সব কেড়ে নেওয়া এই ডানপিটে মেয়েটি তাকে ফেরত দিয়েছে! ডানপিটে না হলে তের-চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে তার থেকে দ্বি ̧ণ বয়সী, ইউনিভার্সিটির সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একটা যুবককে মাঝরাতে কাঁটার খোঁচা দিতে সাহস করে! উপচেওঠা চোখের পানিকে কঠিন চেষ্টায় ভেতরে ঠেলে পাঠাল তামান্না! তারপর কণ্ঠ স্বাভাবিক করতে এক ঢোক পানি গলায় ঢেলে বলল, তুমি আমার কাছে কেন এসেছিলে?
: এসেছি বলে রাগ করেছেন?
একটু দেরিতেই উত্তর দিল তামান্না, না! তুমি আরেক কাপ চা খাবে?
: না। আমি আপনার কাছে এসেছিলাম এমনি। কোনো কিছুনা ভেবে। অথবা আমি আসিনি, একটা মানুষের ভেতর তো সে একা বাস করে না! তাই অন ̈ কেউ হয়ত আপনার মুখোমুখি করতে আমাকে ঠেলে এনেছে! কিন্তু যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে ওই অনুরোধটা আবার করে যাই!
: কী বলো তো!
: আপনি বিয়ে করেন!
: কেন? আর এই বয়সে বিয়ে করলে তাকেই করতে হবে, যার বউ মরে গেছে। বা ছেড়ে গেছে।বা সে-ই বউকে ছেড়েছে!
: অথবা আমার সম্পর্কের মতো অনে ̈র প্রহসনমূলক সম্পর্ক টিকিয়ে দিতে আপনার মতো নীরবে সরে গেছে তেমন মহৎ কাউকেও তো পেতে পারেন!
: তোমার সম্পর্ক একেবারেই প্রহসন ছিল না। কারণ একটুদূরের হলেও তোমরা কাজিন। যদিও তোমার চাচার, মানে তামজিদের বাবা রক্ষাকবচ হিসেবে দেখেছেন তোমার বাবার দশ বিঘে জমিকে। মা-বাবার একলা মেয়ে তুমি!
: জানেন একজন পুরুষের মানে যাকে নিয়ে সংসার করছি, সংসারের বয়সও কম হল না। তবুসে পুরুষের পুরো মন জুড়ে আমি নেই। আছি মনের একটু কোনায় পড়ে। তাতেও আমার দুঃখ নেই। যে তার মনের সবটুকুজুড়ে আপনিইমআছেন!
: দুঃখ কী তবে?
: আপনার একাকিত্ব! প্লিজ, আপনি বিয়ে করেন! আপনি আমার স্বামীর মন জুড়ে আছেন, তাই আপনাকে তার মন থেকে তাড়াতে নয়। আপনি বিয়ে করলে আমি সুখী হব। আমার সব আছে। তবু আমার মনে হয় আমি এক অন্ধকার প্রাসাদে একা আর আপনি দূরের একটি অগ্নিশিখা। ওই আলোটুকুআমার সব। ওটুকুতেই যা দেখা যায়, সেই যেন আমার পৃথিবী! কারণ আপনাকে আমি অগ্নিশিখার মতো জ্বলতে দিয়ে আমি সুখী হই কী করে?
: কলেজ কিন্তু অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে। আজ আমরা উঠি। নাকি?
: আমি কী উত্তর নিয়ে যাব আপনার থেকে!
: আমার এতদিনের ধারণা ছিল নারীতে নারীতে এরকম বন্ধুত্ব-বোঝাপড়া হয় না, ঠিক ত…ষ্ণা ও জলের যেমন সম্পর্ক। সম্পূর্ণ বৈপরীত্য নিয়েও নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব বা প্রেমের ভেতর এমন কিছুথাকে যা জীবন ভারহীন, নেশাতুর করে রাখে। কিন্তু আমি যা দিয়েছি, তুমি যেন তার বহু ̧ণ আমাকে ফিরিয়ে দিলে! আমার সতি ̈ই এই এখন মনে হচ্ছে স্বামী সংসার সন্তান সতি ̈ই একজন নারীর জীবনে জরুরি। আর অন ̈সব জীবনে তোমার ওই কল্পিত শিখার মতোই রাখতে পারলে ভালো…! তুমি যেমন তোমার অর্জিত কিছুআলো, কিছুশুভ্রতা রেখে যেতে চাও। কিন্তু আমি তো কখনো আমার ভেতরে তা খুঁজে পাইনি!
: আমি কি আপনার হাতটা একটু ছোঁব?
: আরে ধুর, আমাকে নিয়ে সবই তোমার কল্পনা…।
রুবী যেন আরেকটুপ্রশ্রয় পেয়ে গেল। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে তামান্না খন্দকারের পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। তারপর আর আপেক্ষা না করে, পেছনের ফিরে না তাকিয়ে সে বেরিয়ে গেল। সারাপথ সেদিন ডধাইভারের সাথে একটিও কথা আর বলতে পারল না! ইউটিউবে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনল না। তার মনে হচ্ছিলো দেবীর পায়ে পুষ্পাঞ্জলি রেখে গেল।
এটুকুতেই অনেকটা ভারমুক্ত ও প্রসন্ন লাগল তার নিজেকে।
কিছুদিন পর তামজিদ চৌধুরী তার স্ত্রী রুবীকে বললেন, ‘তামান্না বিয়ে করেছে। তবে খবরটা সে তোমাকে জানাতেই বুঝি আমাকে বলল!’
স্বামীর এ কথার উত্তরে রুবী কিছু বলেনি। কারণ কখনো তো তামান্নাকে নিয়ে দুজনের কোনো কথা হয়নি। নামটিই উচ্চারিত হয়নি! আজই এইটুকু হল।
তামজিদ চৌধুরী সরকারি চাকুরে। আমলা তবে সৎ ও মিতব ̈য়ী। তিনি ডায়েরি লেখেন। একসময় নাকি কবিতাও লিখতেন। কিন্তু তার কবিতা হয় না শুনে তিনি দমে গেছেন। তবে ডায়েরি লেখা ছাড়েননি। সাদামাটা বা গভীর আবেগেরও কোনো কথা তাতে থাকে না। রুবী পাতার পর পাতা উল্টে দেখেছে। হয়ত সে সময়টাকে এঁকে রাখে।
আর তা জেনেও রুবী সেদিন ঘুম ভেঙে উঠে গিয়ে তামজিদের ডায়েরির শেষ পাতাটা দেখল। তার মনে হল তামজিদের জীবনের এত বড় ঘটনার পর তিনি কী লিখতে পারেন, এটা দেখতে রুবীর ইচ্ছে হল। সে ডায়েরি খুলে দেখল তাতে লেখা, তামান্না বিয়ে করে আমাকে ভারমুক্ত করেছে। কিন্তু এর আগে সে ঘুণাক্ষরে যেমন আমাকে জানায়নি, তেমনি বিয়ের পরও আমাকে বলার জন ̈ খবরটি বলেনি। রুবীকেই কেন জানাতে বলল, রুবীকেই সে কেন এত বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করল, তা আমার বোধগম ̈ হচ্ছে না। আমার জীবনে যা ছিল দুর্ঘটনা, তা সহনীয় করে তুলতে তামান্নারই সবটুকু ভূমিকা ছিল। ওর সহযোগিতা ছাড়া আমার আজকের যে সুখের সংসার, তা আমি কল্পনাও করতে পারি না!
তামান্নাকে জীবনে পেলে কতটুকু পেতাম সে আমি জানি না! কিন্তু ওই যে আমার আকাশের নীল, বাতাসে ভেসে আস ফুলের সুরভী, জানালার হু হু বাতাস, আকাশ-পৃথিবীর মিশে যাওয়ার রেখা দিকচμবাল, যা কেবল কল্পনায়ই থাকে…।
আগেও তামান্না কম কথাই বলত। পরে যা হয়েছে, টুকটাক। ওর সাথে কথা বলতে আমার নিঃশ্বাস ভারী হলেও ও দীর্ঘশ্বাসে আমার জীবন ভারী করেনি। কখনো অভিযোগ করেনি। কটুকথা বলেনি! প্রায় দেড় যুগ পর ও বিয়ে করেছে। ও সুখে থাকবে। কিন্তু আমার তাতে কষ্ট হচ্ছে কেন…।’
তামান্নার জন ̈ তামজিদের কষ্ট হচ্ছে জেনেও রুবীর কষ্ট হল না। ও মনে মনে সে কষ্টটাকে সম্মান করল এবং তার ঈর্ষা হতে লাগল তার কখনো সুযোগ হবে না তার ̄^ামীর মনে তার ওই অতখানি কষ্ট হতে। সংসারে তার শেকড় এখন শক্ত। বিয়ের প্রথমেই যা কয়েকদিন তামজিদ তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। পরে শীত মনোভাবে তাকে মেনে নিয়েছে। তাকে ̄‹ুলে ভর্তি করে দিয়েছে। বাসায় এসে পড়াতে স্কুলের এক শিক্ষত্রীকে ঠিক করে দিয়েছিলেন। তারপর এসএসসির পর সে নিজেই সব করেছে। কিন্তু সার্বিক সহযোগিতা তামজিদেরই ছিল। রুবী তাই মনে সাহস সঞ্চয় করে তামজিদের ডায়েরির পরের পৃষ্ঠায় লিখে রাখল, একটু একটু করে গড়ে/ যাকে চেয়েছ মনের মতো করে/ যে তোমাকে ছেড়ে যাবে না/ চেয়ে দেখো আমি সে-ই, যাকে ফুল দিয়ে যায় কেনা!
সন্ধ্যা আসন্ন হতে জাহাঙ্গীরের ডাক্তার স্ত্রী টগর নিজে হাতে সবার জন ̈ চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে উদয় হলে সবাই রে র করে ধরল, আরে আপনি বাসায়? আমরা তো ভাবছি, আপনি বাসায় নেই, তাই যা নয় তাই বলে গেছি!
জাহাঙ্গীরের পর পেয়ালায় দ্বিতীয় ধাপে চা ঢালতে ঢালতে টগর বলল, আমি থাকলে বুঝি আপনারা যা নয় তা-ই বলতে ছাড় দেন! স্কুলের সম্ভাবনা-সমস্যা, পরিকল্পনা নিয়ে যা বলেন, তার থেকে আপনাদের এইসব আদি রসাত্মক কথাবার্তাই বেশি থাকে। আপনাদের কাছাকাছি থেকেও কেবল আমার মেধায় কুলাল না এসব শিখে রাখতে!
আরমান বলল, ঠিক বলেছ টগর! এইসব যারা শোনে তারাও এক পর্যায়ে ভাঁড়ামো শুরু করে। আমি কিন্তু এরকম ছিলাম না। এরা আমাকে নষ্ট করেছে।
কাজল বলল, ভাঁড়ামিকে বিদূষকের আচরণ বলা হয়!
আরমান বলল, জানি তো! বিদূষী মানে উচ্চশিক্ষিতা। বিদ্যাবতী নারী। আর বিদূষক হচ্ছে যারা ঠাট্টা পরিহাস করতে ভালোবাসে!
কাজল বলল, ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখো, ঠাট্টা-পরিহাসে মেধার ছাপ যে রাখতে পারে, তাকেই বিদূষক বলা হয়। আর তা যদি নাও হয়, আমরা ক’জন আন্দোলন করব, শব্দটি মেধাবীদের জন্য নির্দিষ্ট করতে!
টগর বলল, সে হবে। এখন চা নেন তো। আপনাদের কাজের কথা শেষ তো? রাতে খেয়ে যাবেন কিন্তু…!
একটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সুরভী সেন টগরকে উদ্দেশ ̈ করে বলল, আপনাকে তো রান্নাঘরে টের পেলাম না।
খাবার কী জাদু দিয়ে বানাবেন?
রুবী বলল, কিন্তু আপনি এতক্ষণ ঘরে ঘাপটি মেরে করলেন কী? দু’দুজন নারী আমরা আপনার বাসায় এসেছি। পুরুষদের কথা বাদ দেন। আপনি আমাদের রেখে ভেতরে নিজেকে আটকে রাখলেন কী করে?
টগর বলল, আগামীকালই একটি সেমিনারে আলোচনা করতে হবে বয়স্কদের যৌন জীবন। আপনারা যে বিষয় নিয় আড্ডা দিচ্ছিলেন, আমার গবেষণার বিষয়ও সেটাই। আপনারা হেসে হেসে যা বলছিলেন, শরীর ও মনের ওই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা রিসার্চ করি। এগুলো একটার সাথে আরেকটা সম্পৃক্ত। তাই এ দুটোর সমন্বয় করতে পারল মানুষ শেষ বয়স পর্যন্ত সুখী দাম্পত ̈ জীবন কীভাবে যাপন করতে পারে। সে ̧লো নিয়েই লেখাপড়া আর কী!
জাহাঙ্গীর স্ত্রীকে বলল, তবু তুমি কিছুসময় আমাদের গল্পের ভেতর থাকতে পারতে!
কাজল বলল, তোর বউ সব শুনেছে বলল না?
জাহাঙ্গীর বলল, আরে সব শোনে কী করে? ও সব বিষয়ে ওই এক-আধটুকানে যাওয়াকেই সবটুকুশুনেছে মনে করে আমার সাথে যা নয়, তাই ঝগড়া করে! ওই যে প্রবাদ আছে না, অর্ধেক কথা শোনা ভয়ঙ্কর।
রাতের খাবার সেরে প্রায় দশটার দিকে জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে বেরিয়ে লিফটে ঢুকেই কজন মিলে রুবীকে ভর্ৎসনা করতে লাগল, ‘ঘরে ঢুকেই তোর মনে এই দাদা-দাদি মার্কা গল্প এল কী করে? পুরো সময়টা ফ্যাচরফ্যাচর করে কাটল।’
রুবী বলল, এটা ছোটবেলার ঘটনা তো, তাই মাথা থেকে নামে না। তাই যেখানে যাই সুযোগমতো নামিয়ে দিই!
আরমান বলল, স্কুলের বিষয়ে তোমার ভূমিকা তো সবচেয়ে সিরিয়াস। এই যে আমরা একেকজন একেক পেশা ও মানসিকতার, কিন্তু তুমিই গড্ডালিকা প্রবাহের প্রধান ভেড়াটির ভূমিকা পালন করে চলেছ। সেই তোমার ভেতরে এত ফালতু গল্প! নিজেও কম কিছু ঘটাওনি! একেবারে উপন্যাস হয়ে যায়!
লিফট দশতলা থেকে নিচে নেমে আসে। নিজে অনুপস্থিত থাকার ঘাটতি পোষাতে ওদের বিদায় অভ্যর্থনা জানাতে ওদের সাথে নেমে এসেছিল ডা. টগর। সে রুবীর পিঠ চাপড়ে বলল, ভেড়া হলেও তুমি দলনেতা তো! তোমরা সবাই আমাদের জন্য দোয়া করো। আর পাঁচদিন পরই আমরা জার্মানের উদ্দেষ্যে রওনা হব। ফিরে এসে এমনি আরও অনেক গল্প হবে!
ওরা সবাই যারযার গাড়িতে উঠে পড়ে। আর টগর তার ফ্ল্যাটে ফিরতে অপেক্ষমান আরও ক’জনের সাথে সর্বোচ্চ দশজন বহনকারী লিফটে ঢুকে পড়ে।
****************************************

Leave a Reply