দশটি কবিতা
ঋতো আহমেদ
চোখের ভেতর শূন্য আঁকো
চোখের ভেতর শূন্য আঁকো, তারপর তাকাও, দ্যাখো
যতগুলো শূন্যের পর চিনতে পারবে বলে ভেবেছিলে,
তার থেকেও দূরে, আমাদের নিজস্ব ছায়াপথের শেষ
সীমানায়, সমস্ত গ্রহ ও নক্ষত্র পেরিয়ে, সমস্ত আলো ও
অন্ধকার পেরিয়ে, যেই অবয়বকে দেখতে পাচ্ছ বলে
ভাবছো তুমি, যাকে রক্ত ও মাংসে আপন বলে চিহ্নিত
করছো তুমি, যার ভালোবাসায় সিক্ত হোচ্ছ প্রত্যেকটি
রাত, যার প্রেম পরিপূর্ণতায় ভরে দিচ্ছে তোমার তৃষ্ণা,
যার হাত এমন আবেশে জড়িয়ে আছে যেন শতাব্দীর
পর শতাব্দী আর জন্মের পর জন্মান্তর একে অপরের
সাথে মিশে আছ এমনই আলিঙ্গনে যেন চোখ মেলে
তাকালেই যে কারো চোখের থেকে উঠে আসবে ঈর্ষা
ঔৎসুক্য, এমন-কি যে কেউ প্রশ্ন করে জানতে চাইবে
কে
কে সে
কার জন্যে উৎসর্গ করছো নিজেকে, আপাদমস্তক কে
তোমাকে ঢেকে দিচ্ছে গাঢ় আবরণে, তবে কি শূন্য মানে
বুঝতে হবে অন্ধত্ব আর চোখ মানে জ্ঞান, নাকি নদী ভেবে
সহজ প্রণয় থেকে স্রোতস্বিনী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে
আশঙ্কা বলবো, যে আশঙ্কার বীজ-বপন আর চাষাবাদ
মনুষ্য জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই জেনে আসছি
আমরা, তবে কি পৃথিবীর পথ ঘুরে আসা সমস্ত বিষাদ
আয়ু নিয়ে ফিরে গেলে তখনও দেখতে হবে প্রেম গেঁথে
আছে চোখের ভেতরে শূন্যে, আমাদের আপন আলোয়
অনন্ত গতির বিন্দু
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সানাউল হক
এক অক্ষে বিশ্ব অনন্ত গতির বিন্দু;
যে বিন্দু আকার ও নিরাকারে
মিশে আছে আমাদের জীয়নস্রোতে— অতলে— মহিমায়— মনে,
যেখানে ছেয়ে আছে বোধ— মায়া— মহামায়া— সভ্যতা, আর ওই গতির থেকে উঠে আসা প্রাণ—
আদিম প্রাচুর্য— প্রেম— সমস্তই কেবল তোমাকে ভেবে;—
হে অনন্তের মহতী সম্রাজ্ঞী আমার— প্রিয়তমা,
ধন্যবাদ ও অভিনন্দন তোমায়;—
আঁধার থেকে এনে দিচ্ছ আজ যে সম্ভাবনার উদ্ভাস,
যে আশার সৌর্য্যময়তার বনে— যে আগুন— যে প্রজ্বলনে জ্বলে উঠছ আজ
জেনো তার গূঢ় কথন
এঁকে যাচ্ছি আমরা প্রতিটি দিন ও রাত্রির পিঠে
যে কোনো কবিতার মতো— যে কোনো গল্পের মতো— সমুজ্জ্বল;
যেন সূর্যের সাথে ‘ভোর’ জেগে উঠছে নিদ্রাভঙ্গের মতো
অনন্ত পাখিদের গান আর
মেট্রোপলিটন-কংক্রিটের শীতল শরীর বুড়িগঙ্গার আলিঙ্গন ভেঙে
সৃষ্টিময়তার জল ছিটিয়ে দিচ্ছে আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর;
যে ময়দান— যে সড়ক— যে ইট-কাঠ-দালান— ফ্ল্যাট বাড়ি—
যে শহর ম্রিয়মাণ ছিল এদ্দিন
তার ব্যাস্ততার ক্যানভাস ভেঙে— হে প্রিয়তমা,,
একই অক্ষে পৃথিবী/ব্রহ্মাণ্ড এবং তুমি
আমাদের—
আমাদের অনন্ত গতির..
জেগে ওঠো ভিসুভিয়াস
‘পতনের পথ সবচে সহজ’—
‘পতন মানে পচন’ বলে ছুড়ে দিচ্ছ আজ ঘৃণা, অবজ্ঞা এবং শ্লেষ;
যেন তার দীর্ঘশ্বাস
হঠাৎ-ই আগুন হয়ে ঝলসায়,
যেন অগ্নোৎপাতে হাজার বছর পেরিয়ে জেগে ওঠে ভিসুভিয়াস,
যেন এই শহরে
আমাদের চোখের ভেতর— আমাদের বুকের ভেতর
ঘন হয়ে বসে শব্দের লাভা;
অক্ষরে অক্ষর যদি উগরে দেয় নীহারিকা
তখনও বলবে তুমি নেই— আলো নেই— পথ নেই— কেবল বিলীন কৃষ্ণগহ্বর,—
মিথ্যে সব— বাজে— মিথ্যে—
স্বপ্ন তখনও দেখবে তুমি সহজ স্খলনে
দূরে— বহু দূরে—
দূরের বছরের নক্ষত্রের মতো হঠাৎ নিভে যাওয়া অন্ধকারে,
নীচে,—
অনেক পাতালে
পড়ে আছে প্রেম প্রাচুর্য ও প্রথা;
অথচ
অথৈ জলের মতোই ছিল আমাদের অপেক্ষার রঙ;
গভীরতা ছিল— প্রাঞ্জল ছিল প্রতিটি পঙ্ক্তির যাপন;
যাকে ফেলে এসছো সহস্র দিন ও রাত্রির ’পারে,—
যার প্রাণময় উপস্থিতিই একমাত্র কাম্য ছিল,— যখন
অধীর আগ্রহে তার পথের দিকেই তাকিয়ে থাকতে
যেন তার কথা গান হলে সেই দৃষ্টির ঝর্ণাধারায় আছড়ে পড়তো
সমূহ অভিযোগ—
মিশে যেত দূরান্তের সহযাত্রীর সখ্যে;
তবে কেন পতনের তুচ্ছ তীর—? কেন আজ গলিত লাভা—?
কেন এই শ্লেষ—?
আমি কি এতোই অতীত!— ভীত!— ভারাক্রান্ত! —?
সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য তুমি
দিনের পর দিন সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য হয়ে উঠছ তুমি।
বিস্ময়কর তোমাকে রোধ করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে এখন।
কি করব, কোথায় যাব, কার শরণাপন্ন হব—
কিচ্ছু কিনারা করতে পারছি না আমি।
কেবলই মনে হচ্ছে আমাকে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত দেখে তোমার যে পৈশাচিক আনন্দ
তার উৎস যেন আমারই কোনও ভুলে।
যদি একবার সেই পরিচ্ছন্ন মুখের এমন বদলে যাওয়া রূপ
আঁচ করতে পারতাম,—
যুগান্তরের পর যখন অধীর আগ্রহে
আঁকছিলাম আমাদের একই পরিণতির ছক,
যদি একবার তখনই পরখ করে নিতাম,—
আজ আর এমন করে আপাদমস্তক
নিজেকে নির্বোধ ভাবতে হতো না;
ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলতে শুধু বুঝতে হতো না
আগুন/কামনার দিন ও রাত্রির শুরু;
প্রণয় ভেঙে বর্ষিত হতো না বিদ্বেষ।
শরীরে শরীর ঠুকে যেখানে জাগবার কথা উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ
সেখানে আজ মরুপ্রান্তর,
ধূ ধূ বালি আর বালিয়াড়ি— হাতছানি— মরিচিকা—,
যেন বাসনার বিরহ জ্বালায় ঝলসানো প্রেম আমাদের
জীবন জ্বালানো ভুল ছিল;
যেন শুভংকর ও নন্দিনী ভুল, কালিদাস ভুল
ইয়েটস এলিয়ট রিলকে—
সবই ভুল।
কেবল টেড আর প্লাথ প্লাবনের মত সর্বগ্রাসী হয়ে আসে,
সমস্ত পরোয়া/দোহাই উপেক্ষা করে
এই শতাব্দীর প্রথম জীবন্মৃত প্রেম হিসেবে
ফিরে আসে আমাদের দেহে,
নিজস্ব ছায়াপথের বিষন্ন নরকে উগরে দেয় বিষ,
বিষাদে ঢেকে দেয় প্রাণ— শহর— বিচরিত মায়া।
দিনের পর দিন সত্যি সম্পূর্ণ আলাদা করে ভাবতে হচ্ছে তোমাকে।
শেষ কবে দেখেছিলে মনে নেই,
কেননা এখন শুধু তাকাও কেবল;
দ্যাখো না যে ভীষণ মেঘ করলে আকাশে জলের ঘনঘটা
হৃদয়ে নৈঃশব্দ্যই বয়ে আনে তোমার।
যাকে তুমি পরিবর্তনের পাথেয় বলে চিহ্নিত করেছিলে একদিন—
পৃথিবীতে অকুণ্ঠ আলিঙ্গনে উর্বর করেছিলে যার প্রান্তর—
তার প্রাচুর্য আর আলোকিত করে না তোমায় আজ।
কিন্তু কেন?
পরিকল্পিত পরিণতির এমন বদলে যাওয়াই কি চেয়েছিলে তুমি?
আমি কি এতোই সহজ!— তুচ্ছ!
নাকি বিস্ময় অন্য কোথাও, অন্য কোনও আলোকবর্ষের ভাঁজ খুলে
আবারও বেরিয়ে আসতে বলছো আমায়
নতুন পৃথিবীর পথে?
আমি তার দশ দিগন্ত
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: নুদরাত নিসা (উড়ো চিঠি)
চোখের ভেতর অন্ধকার আকাশ আমার, আমি তার দশ দিগন্ত
হাতরে বেড়াই, যদি সে আসে, প্রকট হয়, ঈশান মেঘের ঘনঘটায়
যদি তার হৃদয় জমে থাকা বিগত কয়েক জন্মের অভিযোগ আর
অভিমান নিয়ে ভেঙে পড়ে, যদি বাড়ে প্রেম, গাঢ় অমানিশায় এই
প্রণয়ের কোন কিনারা করবো আমি
যদি ভুল হয়
আড়ালে আগলে রাখা স্মৃতি যদি ছুঁয়ে ফেলি, যদি তার (কষ্টের)
গোপন চিঠি উড়ো চিঠি হয়, আমি তার উত্তরে কী লিখবো তখন,
কেমন হবে আমার শব্দের/বাক্যের/কথার বুনন, যদি ভেঙে-পড়া
অশ্রু এসে নামে, যদি তার সব ভার শেষ হয়ে নির্বাসনে যায়, সেই
প্রলয়ের কী বোঝাপড়া করবো আমি
যদি না বুঝি
যদি তারে খোঁজার চেষ্টায় কালে মহাকালে সমস্ত বিরহী বিকেলে
মেঘে ও পঙ্ক্তিতে কাছে দূরে সরে সরে ফিরে দেখি চোখে, দৃষ্টিতে,
তবে কি শুধুই আমি, কেবলই আমার প্রত্যাবর্তন ঘনিয়ে আসতে
হবে, আমার শব্দের লাভায় লাগাম টেনে ধরতে হবে, যেন অন্ধত্ব
এবং প্রণয়ের দূরত্ব অতিক্রম করে
আসতে পারি
তবে কি উত্তাল কালবৈশাখী আমার ভীরুতা কলুষ আর আমার
দূর্বলতার জঞ্জাল সাফাই করার জন্য, আমার কন্ঠস্বরে হৃদয়ের
রৌদ্র ঝলসানো প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে আজ, আমি কি বন্ধুত্বের
ইস্তিহার লিখতে গিয়ে নিজেকে পেরিয়ে যাচ্ছি প্রেমে, পূণ্যে ও
দূর্বার বিরহে, আমি কি চিঠির সেই ছেলেটির প্রেরণার প্রতিকৃতি
দেখতে পাচ্ছি
আমাকে স্পন্দিত করো
যে করেই হোক আমাকে স্পন্দিত করো।
তোমার হৃদয়ের উষ্ণতায় আজ আলোড়ন তোলো।
আমাকে জাগাও।
এই ধরিত্রীর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তোমার দৃষ্টিকে ফেরাও।
দ্যাখো—
সহস্র বছরের পর আরও একবার আমাদের সেই প্রাচীন প্রণয়ের উত্থান
বিম্বিত সময়ের ফাঁদে— ফিরে আসা ফাল্গুনে— বিস্ময়ে—
ইতিহাস চিরে আসে;
হৃদয়ে নৈঃশব্দ্যে জলে এখনও অনেকটাই উত্তাল যেন।
যেন সামান্য ছুঁলেই আজ
ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে তার কবেকার সেইসব দেহ,
বিগলিত মন, অপার প্রেম, পুরাতন পরিচিত কথা, রূপ, বিচ্যুত আলো।
এমনকি সামান্য কণ্ঠের জোরেই আজ অঝোরে বর্ষিত হবে ভাষা;
অসংখ্য শব্দের বাণ।
যেন সব স্মৃতিময় কাল, যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য প্রলাপ,
ঘুরে আসা গান, ঘুরে ফিরে আসা কষ্টের আর্ত সুর,
কবেকার মান—
এখানে এইসবে, আজও সভ্যতার উত্তাপে আমাদের অন্তর্গত প্রলয় ও দাগ।
আমাকে সিক্ত করো।
যে করেই হোক এই শরীরের ভাঁজে মৃত্তিকার ঘ্রাণের যে প্রলেপ লেগে আছে,
তাকে নিস্তেজ করো।
হৃদয়ের রৌদ্রতাপে ও ঘামে প্রসন্ন করো।
হে আমার প্রাণময়ী,, আবারও স্পর্শ করো এমনই স্পৃহা।
কেননা একমাত্র আমাদের জন্যই প্রতিদিন
দৃশ্যমান হয়ে ওঠে নমিত সূর্যের পৃথিবী, উদ্যত পাহাড়, উড়ন্ত মেঘমালা; আর
সমবেত বৃক্ষরাজির সেই ব্যকুল সঙ্গীত।
তবে আজ কেন এই দূরে থাকা শুধু?
দূরের গ্রহের মাটির পাতাল কেন আর?
কেন আর শব হয়ে পড়ে থাকা এই?—
হে প্রেমময়ী আমার,,
ছুঁয়ে দাও আমায়;
স্পন্দিত করো প্রেমের প্রাবল্যে তোমার।
অন্তরীক্ষে তুমি আজ
আগুন আমাকে ঝলসাতে পারবে না।
কেন জানো?
কারণ, আমি নিজেই আগুন।
অনন্তের গহিন থেকে প্রসারিত করেছি আমার উদগ্রীব শিখা,
প্রকাশিত করেছি অগুনিত স্ফুলিঙ্গ,
পাতাল গর্ভ থেকে উৎক্ষিপ্ত করেছি লাভা, প্রণয়-অগ্নি।—
অন্তরীক্ষে তুমি আজ আর কোন বিদ্যুৎ ঝলকাবে?
মেঘে মেঘে আর কত গর্জাবে তোমার কণ্ঠস্বর?
কত আর ছুড়বে বজ্র?
আমি কি এতোই ঘৃণার— বিদ্বেষের যে আমাকে ভস্ম করতে উদ্যত হয়েছ!
অথচ এই আমিই ছিলাম তোমার সব থেকে প্রিয় পাহাড়,
সব থেকে ঘন বৃক্ষরাজির বন।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটবে বলে, আমার প্রত্যেকটি চরাই
উৎরাই পেরুবে বলে,
প্রত্যেকটি ঝোপ ও জঙ্গলে রাত্রি নামাবে বলে
কথা দিয়েছিলে সেদিন।
আমার বুকের কাছে সুগভীর নিঃশ্বাসে
ভালোবাসার দূর্দান্ত পঙ্ক্তিমালা উচ্চারিত করছিলে।
এমন-কি দূরের অগ্রগামী নাক্ষত্রিক আলোয়
আমাদের গত/অনাগত সময়ের সমূহ ছবি এঁকে দিচ্ছিলে, যেন
আমরাই একমাত্র পৃথিবীতে প্রথম প্রাচীন নৌকোর মনুষ্য জোড় ছিলাম।
আমাকে শত্রু করে কী লাভ তোমার?
ফিরিয়ে দাও বরং প্রেমের আগুন থেকে কামনার প্রচণ্ড রঙে
পৃথিবীকে যেমন করে রাঙিয়ে গিয়েছিলে সেদিন;
ফিরিয়ে দাও সে প্রমত্ত রূপ তোমার।
বর্ষিত হও প্রবল ঝর্ণাধারায়।
আছড়ে পড়ো এই নগরীর প্রতিটি সুউচ্চ দালানের দেহে।
প্রত্যেকটি রাজপথে অলিতে গলিতে তোমার সোহাগের দাগ লেগে যাক
যেন সব ঋতুমতী নারীদের গোপন যৌবন উছলে ওঠে,
অমিত সম্ভাবনায় জেগে ওঠে ভোর।
আমার আগুনের হাতটি ধরো, হে প্রিয়তম শত্রু আমার
আমাকে নিয়ে যাও—
শতাব্দীর সব থেকে দূর্বার প্রেমময়তায় নিয়ে যাও তোমার অন্তরীক্ষের
অপার সৌন্দর্যের সখ্যে।
অন্তরাত্মায় এঁকেছো আর্তনাদ
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সোনিয়া আকন্দ (পেন্সিল স্কেচ: ‘আর্তনাদ’)
অন্তর্গত প্রলয় ও সৌন্দর্যে পুড়ছে হৃদয়;
তাই
প্রণয় ক্যানভাসে লিখেছি অগ্নির নাম
আর তুমি
অন্তরাত্মায় এসে এঁকে দিলে আর্তনাদ তোমার।
কী ছিল সেখানে?
কী সেই কষ্টের কথা?
তোমার দ্যাখার চোখের মনে ও মননে
হৃদয়ের শব্দাবলীর কী সেই রূপ যে তুমি
রক্ত ও মাংসের
এই ঝর্ণা-বওয়া মনুষ্য জীবনে নিজেকে ভেবে নিচ্ছ আজ
অন্য কেউ?
অন্য কোনও পৃথিবীর পথে পথ ঘুরে এসে
ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে তোমার
দূরতা।
সত্তায় ও প্রেমের সংঘাতে আশ্চর্য তোমার শরীর ও শিকল!
তোমাকে ভীষণ ভালোবাসবো বলে ভেবেছিলাম একদিন।—
প্রাচীন নিঃস্ব নারীর কান্নার রঙে তোমার চোখের প্রান্তর,
তোমার কাজল
যে বিপুল বৈচিত্রের নদী বইয়ে দিয়েছিল—
বিস্তীর্ণ প্রেম-পথে যে আশার
ঔজ্জ্বল্যের আগুন জ্বালিয়েছিল—
তাকে আজ আর কোন হিমে নিস্তেজ রেখেছো?
প্রত্যেকটি ঊষার আগমনে তোমার নামের উচ্চারণের ধ্বনিকে
আমি যে প্রতিধ্বনিত করছি;
হৃদয়ে আত্ম-ক্ষরণের পঙ্ক্তিমালায় প্রবাহিত করছি
কালের যাত্রার মহাকাল।
তবে আজ কেন এই হিম, কেন এই বিপন্ন ভয়, আর্ত নিনাদ?
আমাকে বলো,—
তুমি কি সেই ট্রয়ের হেলেন ছিলে না কোনোদিন?
জুলিয়েট কিংবা সীতা?
শিরি অথবা শকুন্তলার মোহনীয় রূপ মাধুর্য্যের বিভোর কালিদাস কি
আমিই ছিলাম না?
আমি কি তোমার জন্য দেবদাস হইনি এই বাংলায়?
নাকি তুমি ঈশ্বরী গায়ত্রী স্পিভাক?
আমার বিনয়ী ভালবাসার দূর্দান্ত আহবান তোমার অন্তরের কর্ণকুহরে
পৌঁছে না কোনো কালেই।
ও আমার অগ্নি-সুন্দরী,
দাঁড়াও।
আমাকে বলো,
এই পথ এই গতি তোমাকে কোথায় পৌঁছাবে শেষ পর্যন্ত?
তুমি কি শুনতে পাবে—
তুমি কি বুঝতে পারবে কোনও দিন এই আর্তনাদ
তোমার প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণার প্রচণ্ড প্রত্যাবর্তন ছিল?
হৃদয়ে রক্তের রূপ
চোখের গভীরে তোমার কেঁপে ওঠে দূর বিস্তৃত অভীষ্ট গন্তব্য আমার;
যেখানে জলের কোনও ছায়া নেই (ছায়া হতে নেই কোনও কায়ারও)।
কেবল
হৃদয়ে রক্তের রূপ উছলে ওঠা বানে
ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে সেই
শব্দের শতাব্দীর পথে; যেন ওই পথ আর আমি
আর আমাদের আগুনের কাল
বিস্তীর্ণ ছায়াপথে, কালে/মহাকালে আর প্রোথিত জীবনের রঙে,
এঁকে দিচ্ছে আজ
প্রেম ও রাত্রির পার্থিব ভীষণ প্রণয়।
দৃষ্টির দূরত্বের মাপ ও প্রণয়-দিগন্ত-রেখায়
লিখে দিচ্ছে নাম—
আমাদের।
যেন আমরাই প্রথম অন্ধকার,
আমরাই একমাত্র পৃথিবীতে দূর দূরান্তের গন্তব্যের যাত্রী।
রূপের রক্তের নৌকোয় আমরা গতি,
আমরা চাকা,
আমরা হাওয়ায় শূন্য এবং মহাশূন্য বেগে আমাদের অন্তহীন গহিন অরণ্যের মন;
হৃদয়ের অতল তোলপাড়ে আর
অবিরাম কণ্ঠস্বরে উন্মাতাল কোরে দিক—
যেন ঝলসানো ধ্বনি তোমার চোখের থেকে উঠে এসে
ক্রমশ বেড়ে
চলে যাচ্ছে এই নগরীর সবচেয়ে উঁচু ফ্ল্যাটবাড়িটির দেহের গোপনতম ভাঁজে;
আমাদের নিজস্ব ব্যথার আনন্দ আর প্রকৌশলে;
হৃদয়ে, রক্তে ও রূপে।
সমূহ শব্দের দ্যুতি
অন্তর্জালে বাধা পড়ে আছে সমূহ শব্দের দ্যুতি;
এখন গ্রহণের কাল।
এক
মহারাত্রির পথ আমার দুয়ারে;
আমি তার আহবান জানি।
শব্দে নৈঃশব্দ্যে
আমি তার অন্যতম অন্ধকারে অন্তর্গত মহাকাশ জানি।
এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে
মর্ম বেদনার মতো গূঢ় সেই কবেকার কথাদের ইতিহাস জানি।
ঝলসানো হৃদয়ের ধ্বনির যে প্রতিধ্বনি হঠাৎ গুমড়ে উঠে ফিরে আসে—
আমি তাকে চিনি।
আমাকে আড়াল করার কিছু নেই।
এখন শুধু গ্রহণের কাল।
একই অক্ষে পৃথিবী, তুমি আর আমি—
সকলেই সমবেত আছি,
অহরাত্রির ব্যাপক শরীর জুড়ে আমাদের বিমূর্ত সময়।
ও আমার প্রাণময়ী,,
আমাকে ছেড়ে আসতে দাও,
ফেলে আসতে দাও আজ জালের শিকল ভেঙে বিগত জন্মের
সবটুকু মায়া;
প্রলম্বিত প্রস্তর-পথ পেরিয়ে আমার প্রত্যাবর্তন যেন
তোমার কাছেই হয়;
তোমাকে আন্দোলিত ক’রে এক আশ্চর্য আঘাত যেমন দৃশ্যত সুন্দরে
বেদনার্ত হয় নিজেই;
এমন-কি বাঁধের পাহাড় আর উড়ন্ত প্রণয়ের মন
যেমন
অপেক্ষার শেষে নেমে আসে এই মেট্রোপলিটনে, প্রত্যেকটি রাজপথে—
আমাকে বিপন্ন করো তেমনই প্রেমে;
আমার শব্দের দ্যুতি এখন শুধু অন্ধকারে, অনেক পাতালে, আকাশে,
অন্তর্গত জালে।
=========================