You are currently viewing ঢেউ / সিরাজুল ইসলাম

ঢেউ / সিরাজুল ইসলাম

ঢেউ

সিরাজুল ইসলাম

জেগে স্বপ্ন দেখছে না তো? হাতখানেক দূরত্বের ভেতর লীনা। এরকম বাস্তবে হয়? তার তেইশ বছরের জীবনে এতোটা কোন দিন চমকায়নি রাহুল।

দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো সে, বললো, এই লীনা, লীনা তুমি…’

অস্ফুট গলায় বললো লীনা, কি বিশ্বাস হচ্ছে না তো! ছুঁয়ে দেখো। ‌

স্বর্ণ রংয়ের নাচের মুদ্রার মতোএকটা হাত এগিয়ে আসছে ঢেউ তুলে। সম্মোহিতের মত দেখছিলো রাহুল। লীনার হাতের কব্জির ওপরে সোনালী রেনুর মত লোমগুলোর জন্য লীনাকে মনে হচ্ছে সত্যিকারের রক্তমাংসের।

লীনা অভিমানের স্বরে বললো, কি আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে? দাঁড়িয়ে থেকে আমার দুই পায়ে যে ব্যথা ধরে গেলো।

খুবই বোকার মত কাজ হয়ে যাচ্ছে। কেউ এসেছে এবং দরজার ঘন্টা বহুক্ষণ ধরে বেজে যাচ্ছে তা রাহুল বুঝতে পারছিলো, কিন্তু বিছানা ছেড়ে তার সাধের ঘুম নষ্ট করে কে ? কে না কে এলো তা দেখার মতো উদ্যমী লোক সে কখনো নয়।

বিজলী আপা কিংবা রতন দুলাভাই সে কাজ করবে। এমন কী বিনতু তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে হাত উঁচু করে দরজার ছিটকিনি খুলতে পারে। সুতরাং বাড়িতে কেউ এলে দরজা খুলে দেবার দায় রাহুলের নয়।

কিন্তু বাইরের মানুষটি যে লীনা স্বয়ং তা রাহুলের বুঝতে পারা উচিত ছিলো। তার ভালবাসার চুম্বকে কি ক্ষয় ধরেছে? লীনাকে যে সে কষ্ট দিলো সেজন্য রাহুলের একটা শাস্তি পাওয়া উচিত।

রাহুলকে দেখতে দেখতে চোখ নত করে লীনা বললো, তোমার খালি গা।

এটা রাহুলের দ্বিতীয় বোকামি, বিনতু প্রায়ই তাকে বলে, খালি গায়ে তোমাকে মামা পশুর মতো লাগে।

জিন্সের যে প্যান্ট পরনে রাহুলের তাতেও বিশ্রী দুর্গন্ধ। এ এক বদ অভ্যাস তার, পারতপক্ষে গা থেকে ময়লা কাপড় ছাড়ে না। অবশ্য কোনো বদ বু রাহুলের নাকে লাগে না। সে অহংকার করে বলে, আমার সিজনড নাক। গায়ের চামড়াও।

তা বলে লীনার নাক তার মতো হতে যাবে কেন?

তুমি একটু বসো প্লিজ, পেপার পড়ো।

লীনাকে বসিয়ে রেখে তার চোখের সামনে থেকে দ্রুত পালিয়ে বাঁচে রাহুল। দাঁত মাজা, মুখ ধোয়া, কাপড় পাল্টানো, তার সব তড়িঘড়ি কাজ।

একইরকম ভঙ্গিতে বসে ছিল লীনা। তার সামনে কাঁচের নিচু টেবিলটার উপর পত্রিকা ও অনেকগুলো ম্যাগাজিনের একটা স্তুপ। তা সে উল্টেও দেখে নি। ছোটখাট শরীর লীনার, সে আরো গুটিসুটি হয়ে বসেছিলো।

রাহুল বললো, তারপর। তুমি হঠাৎ কোত্থেকে…?

লীনা গম্ভীর চোখ মেলে তাকালো রাহুলের দিকে। চোখ দু’টি বড় বড়। কিন্তু সুন্দর। সে সঙ্গে বড় রহস্যময়। সরাসরি ওই চোখের দৃষ্টি রাহুল সহ্য করতে পারে না। মনে হয় লীনার দৃষ্টির সামনে রাহুলের কোন কিছুই আর গোপন থাকে না।এ এক মহা সমস্যা, তার ওপর বুকের ভেতরটা গুরগুরও করে। সে কিছু লুকাতে চায় লীনার চোখের সামনে থেকে?

দ্রুত তার চোখ সরিয়ে নিলো রাহুল লীনার চোখের ওপর থেকে।

রাহুল বললো, কলেজ ফাঁকি দিয়েছো? কলেজের ইউনিফর্ম, কলেজের ব্যাগ..।

এ কথায় রাগ হলো লীনার। সামান্য ঝাঁজের সঙ্গে বললো, হ্যাঁ।

কথার রাগটা ধরতে পারলো রাহুল, বললো, কেন গো?

তোমাকে দেখতে।

লীনার ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য পাশের সোফা ছেড়ে লীনার কাছে এসে বসলো রাহুল।

বললো, তাই নাকি?

তুমি টেলিফোন করো না। কলেজের সামনে রাস্তায় তোমাকে দেখি না। একদিন আমাকে না দেখলে তুমি অস্থির হয়ে পড়তে। এখন বিশ্বাস হয় না তুমি সেই তুমি। তুমি ঢাকায় ছিলে না?

ছিলাম তো। ফোনেও চেষ্টা করেছি বহুবার, দেখি টেলিফোন সবসময় তোমার মা ধরে ‌। ভীষণ ভয় পাই আমি ম্যাডামকে।

এ আবার কি ধরনের কথা?

কেন, ম্যাডামতো বাজারে এখন খুব চালু শব্দ।

লীনা ওর মুক্তোর মতো দাঁত বের করে একটু হাসলো। বললো, আমার মন বলছিলো, তোমার একটা কিছু হয়েছে। এতোদিন তোমার কোন রকমের খোঁজখবর নেই ।তাই নিজেই চলে এলাম। তোমার বাসা খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হয়েছে, জানো, আর কী বৃষ্টি! এই বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি খোঁজাখুঁজি।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে নাকি?

একেবারে আকাশ থেকে পড়লে?তুমি কোন জগতে থাকো?

তোমার জগতে।

খালি কথা। কথার ফুলঝুরি।

কথা না সত্যি।

হাত বাড়িয়ে রাহুল ছুঁতে গেলো লীনাকে।

হায় আল্লাহ, তোমার গোটা জামা যে ভেজা।

রাহুলের হাতটা আলতো ঠেলে সরিয়ে দিলো লীনা, বললো এতোক্ষণে আমার প্রেমিকের নজরে পড়লো। আবার বড় বড় সব কথা, তোমার জগৎ…।

রাহুল বললো, এই ভেজা জামা কাপড়ে তোমার নির্ঘাত ঠাণ্ডা লাগবে। তোমার যে ঠাণ্ডার ধাত। একটুকুতেই তুমি জ্বরে পড়ে যাও।

আমার কিছু হবে না।

উঠে যেতে যেতে রাহুল বললো, দেখি বাইরে আপার কী কাপড়-চোপড় আছে।

লাগবে না বলছি।

গৃহকত্রী হিসেবে বিজলী অত্যন্ত গোছানো। তার নিজস্ব পরিধেয় কাপড় চোপড় রাখার পৃথক কাঠের আলমারি। আলমারির দরজার হাতল টেনে রাহুল দেখলো, ভাগ্য ভালো, তালা আটকানো নেই। সামনে পেলো লাল বুটি বুটি পাঞ্জাবি ধরনের একটা জামা। সেটা নিলো। সঙ্গে নীল রঙের সালোয়ার।

লীনা বললো, না, না, আপার কাপড় পরবো , আপা আবার কী মনে করবে।

বিজলী আপা জানতেও পারবে না। আর জানলেই বা কি!তুমি এ ঘরেই ভেজা জামাগুলো বদলে ফেলো তো। তোমার জন্য আমি চা বানিয়ে আনি। আমিও এখন পর্যন্ত চা খাইনি।

তুমি চা বানাতে পারো? আমার বিশ্বাস হয় না।

আগে খেয়ে দেখো তো।

ট্রের ওপর দু’ কাপ চা, একটা পিরিচে কয়টা নোনতা বিস্কুট নিয়ে এসে রাহুল দেখলো, লীনাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে বিজলী আপার পোশাকে। লীনা খুবই শুকনো, হালকা-পাতলা। বিজলী একেবারে উল্টো। আগে থেকে তার মোটা হওয়ার ধাত । বিনতু হওয়ার পর থেকে সেই যে মোটা হতে শুরু করলো আর কমে না। আলগা মেদ ঝরানোর জন্য বিজলী এক্সারসাইজ করে। কিন্তু তা কেবল মাত্র দু’তিন দিনের জন্য। ওর ধৈর্য নেই। কষ্ট সইতে পারে না, সহ্য শক্তি কম।

লীনা বললো, আমাকে দেখে তুমি হাসবে না কিন্তু, তুমি তো আমাকে এটা পরতে দিলে।

রাহুল বললো, বিশ্বাস করো তোমাকে ভারী মিষ্টি লাগছে।

চোখ পাকালো লীনা, আবার! কথা, খালি কথা।

ভেজা জামাগুলো শুকাতে দেবার জন্য লীনা গিয়ে দাঁড়ালো বাইরের বারান্দায়। সেখানে হ্যাঙ্গার স্ট্যান্ড।

বাইরে তাকিয়ে এ মুহূর্তে বুঝবার উপায় নেই, কিছুক্ষণ আগেও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিলো। এখন একেবারে ঝকমকে দিন।

রিকশার ঘেরাটোপের মধ্যে বসেছিলো লীনা, আর ঝমঝম করে বৃষ্টি, এর ভেতরেই রাস্তায় বিপুল বৃষ্টির পানি জমে গেছে।ঝড়ো বাতাস আর সে-সঙ্গে এক হাঁটু পানি ঠেলে রিকশা চালাতে বেচারা রিকশাওয়ালার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। লীনা খুব মায়া বোধ করছিল রিকশাওয়ালার জন্য। এ-মায়ার কেন্দ্রবিন্দু হঠাৎ করে ঘুরে গেল রাহুলের প্রতি। রাহুলকে সে কয়েক দিন দেখে না। এই মুহূর্তেই রাহুলকে চোখের দেখাটা না দেখলে সে বাঁচবে না।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে লীনা বললো, চা-টা ভালোই বানিয়েছো কিন্তু। ওয়ার্ড।

হেসে রাহুল বললো, তাহলে তোমার সংসার সামলাতে পারবো বলো।

লজ্জারুণ গলায় বললো লীনা, তুমি খুব বাজে বকো।

রাহুল বললো, আমার আপা- দুলাভাইয়ের সংসার কেমন লাগলো তোমার? আমি কিন্তু এখানে পরগাছা।

দেখলামই না কিছু। তোমার ঘরটা দেখবো। তুমি কী ভাবে থাকো, আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়। তোমাকে এতোদিন ধরে চিনি, গলা একটু নামিয়ে বললো, ভালোবাসিও, তা-ও তোমার কিছু আমি জানি না।

রাহুল বললো, বললাম যে পরগাছা, আমার আবার ঘর। আপা একটা স্টোররুম করেছে, সব অকেজো মাল সেখানেই ডাঁই করা, আমিও একটা ডিসপোজেবল আইটেম, ঘুণে ধরলে বা গন্ধ ছড়াতে শুরু করলে বাইরে ফেলে দেবে।

জ্বী না। আমি জানি।

রাহুলের ঘরটা যথেষ্ট সুন্দর। সে বাড়িয়ে বলেছে। তবে ছড়ানো বইপত্র, গানের ক্যাসেট, এলোমেলো কাপড়-চোপড়। ভালোবাসার মানুষের ঘর এরকমেরই হয়। লীনার ভাবনার সঙ্গে মিলে গেছে।

নিচু ডিভানটার উপর বসলো লীনা। বললো, মাথার উপর এই ফ্যান যে সারাদিন চলে বোঝা যায় । দিনের বেলায় ঘরের বাতিটা নেভাও তো, আমার মনে হয় না।

তাড়াতাড়ি বাতির সুইচ অফ করে লীনার পাশে এসে বসলো রাহুল। বললো, আজ সারাদিন এখানে থেকে যাও।

রাহুল ভাবতেও পারেনি এক কথায় রাজি হয়ে যাবে লীনা।

থাকবো। তোমার সংসার করবো।

আপার অফিস। দুলাভাইয়ের অফিস। সন্ধ্যার আগে একজনও ফিরবে না। দুপুরের পর শুধু বিনতুকে স্কুল থেকে নিয়ে আসবো।

লীনা বললো, তোমাদের অন্য ঘরগুলো দেখবো।

চলো।

প্রথমে বিনতুর ঘর। ঘরের দেয়ালে ম্যাকগাইভারের পোস্টার। পুরো ছোট আলমারির ঢালা সারি সারি ছোট বড় স্টিকারে ঠাসা।

বেবি কট। সেখানেও স্টিকার।

লীনা বললো, এত স্টিকার ও পায় কোথায়?

এই স্টিকার জোগাড় করে দেওয়াও আমার সার্ভিসের অঙ্গ।

এ-ই বিনতু তোমার ভাগ্নি হয় না!

হয়, একজন আমার ভাগ্নি, একজন আমার বোন, একজন দুলাভাই। কিন্তু সবাই আমার মাস্টার,প্রভু। একটা কিছু করে তো আমাকে খেতে হবে। প্রভুর সেবা করা ছাড়া আর কিছু আমি পারি না। আর পারলেও এই বেকার মানুষকে কাজ দিচ্ছে কে?

রাহুলের কথায় বড়ো মন খারাপ হলো লীনার, বললো তুমি চাকরি পাচ্ছো না, তোমার খুব খারাপ লাগে- না?

রাহুল কোন জবাব দিলো না।

ওয়ারড্রবের উপর ফ্রেমে বাঁধানো বিজলী এবং রতনের ছবি। বিয়ের সময়কার।

অনেকক্ষণ ধরে লীনা ওই ছবির দিকে তাকিয়ে আছে, তা দেখে রাহুল বললো, কী দেখছো গো?

সুখী দম্পতি।

পাখি স্বরে ডোর বেল বেজে উঠলো। রাহুল গেলো দরজা খুলতে। তার পেছনে লীনা।

দরজা খুলে রাহুল লীনাকে বললো, কাজের খালা।

রাহুলকে কাছে ডাকলো লীনা। বললো, এই শোনো, ওকে আজ ছুটি দিয়ে দাও। আমি রান্না করবো।

মানে?

আমি পারবো দেখো না!

তাই হলো।

কাজের খালাকে বিদায় দিয়ে রাহুল দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে, তখন লীনা বললো, আপার সংসার দেখে আমার নিজেরই খুব ঘর সংসার করতে ইচ্ছে করছে। একদিনের জন্য অবশ্য।

রাহুল বললো,হ্যাঁ একদিনের জন্য ঘর-সংসার ভালো অবশ্যই। তবে সংসার আসলে একটা নরক।

এ্যাই, তুমি একথা বললে কেন?

না, এমনি কথার কথা।

বিনতু এসে খাবে, আগে রান্নাটা সেরে ফেলি। আমাকে দেখাও তো কোথায় কী?

অবাক হয়ে লীনাকে দেখছিলো রাহুল।

রাহুলকে ওরকম ভাবে তাকাতে দেখে লীনা বললো, ভয় পাচ্ছ কেন? আমি অনেক কাজ পারি। তোমার মতো বসে বসে খাই না।

ফ্রিজ থেকে মুরগি বের করে দিলো রাহুল। শাকসবজি নিলো লীনা।

বটি নিয়ে বসেছে লীনা। পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো রাহুল।

একটা খুশি চিকমিক করছে লীনার সারা চোখে মুখে। রাহুল ভাবলো, মেয়েরা বড় সংসার ভালবাসে। লীনাও।

মাংস কাটতে কাটতে লীনা বললো, তোমাকে আমার এত ভালো লাগে কেন জানো?

রাঁধুনি লীনাকে দেখছিলো সে। সে কী বলবে?

তুমি খুব ভালো। এই ফাঁকা বাসা। শুধু তুমি আর আমি। একবারও আমার সঙ্গে তুমি কোন অসভ্যতা করবার চেষ্টা করোনি।

রহস্য ভরা বড়ো বড়ো চোখ দুটো তুলে লীনা তাকালো।

ওই দৃষ্টিতে বড়ো বিভ্রান্ত বোধ করলো রাহুল। লীনার অনেক কথা এবং আচরনে বহু সময় সে এরকম বিভ্রান্ত হয়ে যায়। লীনার কথার যে মানে সে ধরে নেয়, পরে মিলিয়ে দেখেছে, লীনা সে-কথার আসলে বিপরীত মানে করেছে। ‌

রাহুল মনে করে দেখলো, সে কোনদিনও অন্য কিছু ভেবে লীনার গায়ে হাত দেয়নি। এতোদিনে একটা চুমু পর্যন্ত খায়নি। এইমাত্র লীনা যা বললো, সে কথার অর্থ কী?

রাহুল যা ভেবেছে ,তা-ই? তার লীনার কথায় খুশি হওয়া উচিত ?

রাহুলের মাথা ঝিমঝিম করছে।

চুলা জ্বালিয়ে দিয়েছিলো লীনা, চুলার ওপর কিছু নেই। আগুনের শিখাটা অনেক দূর পর্যন্ত উঠেছে। লাল আলো এসে লীনার চোখে-মুখে পড়েছে । লীনাকে খুব অন্যরকম মনে হচ্ছে তাই।

কথা ঘোরাবার জন্য রাহুল বললো, তুমি লীনা বলছিলে না আমি বসে বসে খাই। সে-কথাটা সত্যি না। টাকা রোজগার ছাড়া এ সংসারের সমস্ত কাজকর্ম আমাকে করতে হয়। বাজার করা, বিনতুকে স্কুল থেকে আনা, ওকে পড়ানো, কারো অসুখ বিসুখ হলে ডাক্তারের কাছে ছোটা। এসব তো আছেই। কিছু একটা করছি, আমার ভালো লাগে। অন্যরকম কাজের একটা নমুনা বলি। তুমি যে আমার লীনা, তোমাকেও সব কথা বলা যায় না। আজ বলি, তাহলে মনটা আমার হালকা লাগবে।

একটু থামলো রাহুল। উৎসুক চোখে চেয়ে আছে লীনা।

আমাদের বাড়ি রাজশাহী তুমি তো জানো। কী কারনে বিনতুর ইস্কুলে লম্বা ছুটি ছিলো। রাজশাহীতে এমনিতে আমাদের আসা-যাওয়া কমে গেছে। অনেকদিন পর সে-বার গেলো আপা। এই বাসায় তখন রতন দুলাভাই আর আমি। প্রথম দুই তিন ভালোই কাটলো। তারপর একদিন দুলাভাই অফিসে গেলো, তার কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলো বাড়িতে। সঙ্গে আবার অচেনা একটা মেয়ে। বেশি বয়স না, তোমার চেয়ে কিছু বড় হতে পারে। মেয়েটার চোখে মুখে, সারা শরীরে একটা চঞ্চলতা। একবার মাত্র ওই মেয়েটাকে দেখলাম, আমার তাকে ভাল লাগেনি।

মেয়েটিকে ড্রইংরুমে বসিয়ে রেখে দুলাভাই আমাকে ডাকলো। বললো, কী সারাক্ষণ ঘরে মুখ বেজার করে বসে থাকো। যাও সারাদিন আজ ফুর্তি করে এসো। আড্ডা মারো, সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখো, স্টেডিয়ামে আজ ভালো ফুটবল খেলা আছে।

রতন দুলাভাইকে এত প্রগলভ আমি কোনদিন দেখিনি। একশ’ টাকার দুটো নতুন নোট বের করে আমাকে দিলো। আমি নিলামও।রাজশাহী যাওয়ার সময় আপা বলে গিয়েছিলো, ফাঁকা বাসা রেখে গেলাম, তুই একটু খেয়াল রাখিস।

আমি তো এমনিতেই কোন কাজের না, কী খেয়াল রাখবো আমি, তুমি বলো লীনা! সারাদিন পাগলের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। একবার মনে হল বিষয়টাকে আমি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছি।কিন্তু নিজেই আমি নিজেকে কনভিন্স করাতে পারছিলাম না। বেশি দেরী করে বাড়ী ফিরলাম। আমার জন্য নাকি দুলাভাই বসেছিল। আমাকে নিয়ে খেতে বসলো। খেতে খেতে রতন দুলাভাই হালকা গলায় বললো, তোমার বোনকে আবার তুমি কিছু বলতে যেও না।

আমি বুঝলাম, দুলাভাই কী বলতে চাইছে, আমার ভেতর থেকে ক্রোধের একটা উদগার উঠলো। আমি বলতে চাইলাম, দুলাভাই আপনি অন্যায় কাজ করেছেন। ওর চোখের দিকে তাকালাম, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম, দৃষ্টিতে আগুন।

রাহুলের মুষড়ে পড়া চেহারা দেখে বড় মায়াবোধ হলো লীনার। বুকটা তোলপাড় করে উঠলো তার। ইচ্ছে হলো রাহুলের এলোমেলো চুলের মাথাটা কাছে টেনে নেয়। ভালোবাসা জানায়। কিন্তু তার ভালোবাসা প্রকাশের রীতিনীতি যে জানা নেই।

সে বললো, কই আমরা তো এই ফাঁকা বাসায়ই। তুমি আর আমি। আমরা তো অন্যায় কিছু করছি না।

রাহুল একটা শ্বাস ছেড়ে বললো, তুমি বুঝবে না, বাদ দাও।

রাহুল গোসল করতে ঢুকলো বাথরুমে। ওই সময়ের ভেতর লীনার রান্নার পাট শেষ। লীনা ডাইনিং টেবিল সাজাতে শুরু করেছে।

স্কুল ছুটির সময় হয়ে গেলো বিনতুর।

রাহুল বললো লীনাকে ,তুমি তো আর একা বাসায় থাকতে পারবে না। কী ভুত টুত ভয় পাও? তুমিও চলো বিনতুকে নিয়ে আসি। তুমি তো আবার আমার সঙ্গে রিক্সায় উঠতেও ভয় পাও। চেনা কেউ দেখে ফেলে যদি?

আজ আমার কোন ভয় নেই।

কী ব্যাপার আজ হঠাৎ তোমার সাহস বেড়ে গেলো যে।

লীনা বললো, এমনি।

রিকশায় যেতে যেতে রাহুল বললো, এ বাড়ি বোধহয় আমাকে তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে।

ভালই তো। দেখলে তো আমি সংসার করতে পারি। তোমার সঙ্গে আমার খুব থাকতে ইচ্ছে হয়।

তুমি যা ভাবছো, তা না।

তাহলে?

বিজলী আপার বিয়ের ছবি দেখতে দেখতে তুমি বলেছিলে না সুখী দম্পতি। ওদের বিয়েটা মনে হয় ভেঙ্গে যাবে।

যা, তা হবে কেন? ওদের বিনতু আছে না? একটা মাত্র মেয়ে। কী মিষ্টি।

রাহুল বললো, খুব বাড়াবাড়ি যাচ্ছে আজকাল। কাল রাতের কথা বলি। দু’জনের লেগে গেলো। অশ্লীল কথাবার্তা, তোমাকে বলতে পারবো না। গায়ে হাত তোলার পর্যায় পর্যন্ত চলে গেলো। আমার ঘুম খুব পাতলা। বিজলী আপার নাকি সুরে কান্না বিছানায় শুয়ে আমি শুনতে পাচ্ছি। ঘুম ভেঙে গিয়ে সেসঙ্গে বিনতুও কাঁদতে শুরু করলো। ভাবা যায় না, এর মধ্যেই আপা মেয়েটাকে চড় চাপড় মারতে শুরু করলো। বিনতুকে আটকে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি কী রকম একটা পুরুষ মানুষ দেখো, আমার কিছু করবার উপায় নেই। উঠে গিয়ে বিনতুকে যে কাছে নিয়ে আসবো সে সাহসটাও নেই। আমার কিছু ভালো লাগে না লীনা।

লীনা তাকে থামাতে গেলো। বললো, তোমার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। খোলা মাঠে, এক গাদা লোকের মধ্যে তোমার পাঁচালী শুরু করলে।

রাহুল কিছুটা জেদের সঙ্গে বললো, কিচ্ছু হবে না, আর কেউ শোনে তো শুনুক। এতো লুকোনোর কী!

বিনতু কখনো হাঁটে না। তার বরাবর ঘোড়দৌঁড়ের অভ্যাস। সে যখন আরও ছোট ছিল সর্বক্ষণ এটার সঙ্গে ওটার সঙ্গে লেগে হোঁচট খেতো। এই দরজার চৌকাঠে লাগলো তো, এই খাটের কোনায়। নিজের পায়ে পা জড়িয়েও কখনো দুম করে পড়ে মাটিতে। বিজলীর বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর এ বদ স্বভাব বদলানো যায়নি। মায়ের বকুনির ভয়ে পরে যা হয়েছে, বিনতু প্রচন্ড ব্যথা পেলেও আর কাঁদতো না। বিনতুর হাঁটু, হাতের ফর্সা কনুই জুড়ে কালো কালো দাগ। বিনতুর ঘোড়দৌঁড়ের চিহ্ন।

রাহুল বিনতুকে বলে, তুই একটা ঘোড়া‌ তোর কোনদিন বিয়ে হবে না। কোন ঘোড়াকে মানুষ বিয়ে করে না।

দূর থেকে স্কুলের গেটে দাঁড়ানো রাহুলকে দেখে ঘোড়াটা দৌঁড়ে এলো। লীনা বিজলীর পোশাক পরে রয়েছে, তাই কিছুটা দূরত্ব থেকে তাকে বিনতুর মনে হলো – তার মা।

অবাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে অত্যন্ত খুশিও হলো।

কিন্তু কাছে আসতে বিনতু যখন বুঝতে পারলো, রাহুলের পাশে মা নয়, অন্য একটি মেয়ে, বেদনায় তার সুন্দর মায়াভরা মুখটা নীল হয়ে এলো। বিনতুর পা জড়িয়ে যাচ্ছে।

অতো মানুষের ভিড়ের মধ্যে, স্কুল মনে হয় ছুটি হয়েছে মাত্র কিছুক্ষণ, নীল জামা পরা কিচিরমিচির বালিকারা বেরিয়ে আসছে, তার মধ্যে রাহুলের কোমর জাপটে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো বিনতু।

রাহুলের চেয়ে বেশি আশ্চর্য হলো লীনা।

হাঁটু মুড়ে বিনতুর পাশে বসতে বসতে রাহুল বললো, কি হলো রে তোর বিনতু?

চোখের পানি এবং কান্নার ফোঁপানি মিশিয়ে বিনতু বললো, মামা, মা আর ফিরবে না। কোথায় চলে গেছে।স্কুলে আমাকে রেখে যাওয়ার সময় মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কতো কাঁদলো ‌। আদর করলো। বললো তোর পচা মা’টাকে তুই ভুলে যাসরে বিনতু। তুই তোর মামার সঙ্গে থাকিস। তোর রাহুল মামা তোকে কখনো ফেলবে না। আমি মাকে এতো ধরে রাখবার চেষ্টা করলাম কিন্তু মা থাকলো না। মা কোথায় গেলো মামা?

রাহুলের খুব ইচ্ছে হলো বিনতুকে সে কোলে তুলে নেয়। ওর গালে চুমু খায়। কিন্তু নিষ্ঠুরের মত বিনতু বড় হয়ে গেছে।

বিনতুর একটা হাত চেপে ধরলো লীনা। সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে সে বললো, ও কিছু না। তোমার মা অফিসে গেছে। ঠিক সময় মতো দেখবে ঘরে ফিরে আসবে তোমার মা। মায়েরা ঠাট্টা করে না? ওটা ছিল একটা ঠাট্টা। তুমি একটা বোকা মেয়ে বিনতু।

লীনার কথাতে তার মন না ভরুক লীনাকে পছন্দ হয়েছে বিনতুর। চোখের দৃষ্টিতে রাহুলকে জিজ্ঞেস করলো বিনতু, ও কে?

রাহুল বললো, এটা তোমার একটা আন্টি‌।

বিনতু বললো, আন্টি একটা খুব বাজে শব্দ । তাতে কিছু বোঝা যায় না, আসলে কে?

বুদ্ধিমতী এই মেয়েটিকে বড়ো ভালো লাগলো লীনার । বললো, আমি তোমার মামার বন্ধু।আমি বুড়ি বলে আমাকে তোমার বন্ধু ধরতে যদি আপত্তি না করো তাহলে আমি তোমারও বন্ধু।

কী ভেবে বিনতু বললো, এতো সহজে কী হয়? তুমি এখনো আন্টিই আছো।

বিনতুর কথা শুনে রাহুলের বুকে দামামা বাজছিলো। এই একটা কারনে বিজলীকে সে দারুন ভয় পায়। মতিচ্ছন্ন মহিলা। সে জন্ম থেকে এই মেয়েটির সঙ্গে জুড়ে গেছে, তার চেয়ে বেশি বিজলীকে আর কে চেনে!

বাসায় ফিরে প্রথম কাজটি করলো রাহুল, বিজলীর অফিসে টেলিফোন, সত্যি সত্যি বিজলী আজ অফিসে যায়নি, কোনো সংবাদও দেয়নি।

মাথা ঘুরছিল রাহুলের, চোখে ঘুরিয়ে সে দেখলো, লীনা বিনতুকে খাওয়ানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে।

বিনতু সহজ ও স্বাভাবিক।

রতনের অফিসের টেলিফোন প্রায় সময় ব্যস্ত। যাহোক তিন বারের চেষ্টায় রতনকে পেলো রাহুল।

রাহুল সাদামাটা গলায় বললো, আপা আজ অফিসে যায়নি।

রতন শুধু বললো, ও।

বিনতুকে বিজলী যা বলে গেছে, রাহুলের ইচ্ছে হলো না টেলিফোনে রতনকে তা সে শোনায়। হা হা করে রতন হেসে উঠতে পারে। তার বরাবরকার প্রিয় কথাটাই বলবে , বিজলী একটা ইমম্যাচিউর মহিলা, তার কথাবার্তা সমস্তই ইমম্যাচিউরড। ওসবে কান দিলে চলে না।

রাহুল বললো, আপার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

রতন বললো, বিজলী একটা ইমম্যাচিউর মহিলা, তার কথাবার্তা সবই ইমম্যাচিউরড, ওসব কান দিলে চলে না। অত খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। সময় হলেই ও চলে আসবে।

রাহুল শুনলো, কিন্তু কোন জবাব দিলো না।

রতন বললো, এই শোনো আমি নিজেই টেলিফোন করতাম। আমার অফিসের একটা লোককে পাঠাচ্ছি বাসায়। আলমারির মাথার উপর আমার ব্রিফকেসটা গোছানো রয়েছে। তার হাতে দিয়ে দিও। আমি আজ সন্ধ্যায় চিটাগাং যাচ্ছি। অফিসের কাজে। কবে ফিরবো এখন বলতে পারছি না।

রাহুলের বলার কিছু ছিলো না।

রতন বললো, তুমি আর কিছু বলবে রাহুল?

রাহুল বললো, না।

তুমি বিনতুকে একটু খেয়াল করো।

খুব ভোরে উঠতে হয় বিনতুর। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হয়। তাই তার রাতের ঘুমটা পুরো হয় না। ফলে স্কুল থেকে ফিরে, খেয়েদেয়ে, সারা বিকেল পড়ে পড়ে ঘুমায় মেয়েটা।

আজ লীনার সঙ্গে খুব গল্প করার লোভ হচ্ছিলো বিনতুর। কিন্তু ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। যত্ন করে তাঁকে শুইয়ে দিলো লীনা।

প্লেটে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছে রাহুল। তার খেতে ইচ্ছে করছে না। এত পরিশ্রম করে লীনা রান্নাবান্না করলো।

লীনার অবস্থাও তাই।

রাহুল বললো, ছন্দপতন হয়ে গেলো। তোমার একদিনের সংসারটাও ভালো যাচ্ছে না।

লীনা বললো, তুমি বেশি বেশি ভাবছো।

রাহুল বললো, হতে পারে।

লীনা জিজ্ঞেস করলো, ওদের সমস্যাটা কী?

রাহুল বললো, সমস্যা আবার কী! আমি অত শত বুঝি? তবে মিসম্যাচড কাপল বলে আমার মনে হয়। তোমার বলা সুখী দম্পতি নয়। স্বামী স্ত্রী হলেও দুজনের সবকিছুতে এত পার্থক্য…।

লীনা বললো, তুমি আমি কি এক? দু’জন আলাদা আলাদা মানুষ, তফাৎ থাকবে না?

রাহুল বললো, আপার বিয়ের এক বছর থেকে তাদের সংসারে আছি আমি। ওদের আশ্রয়ে আছি বলতে পারো। আমাদের বাড়ির অবস্থা তেমন একটা সুবিধার না। মফস্বল শহর। আমার ভালো লাগত না। একটু ভালো থাকার লোভেই এদের সঙ্গে আছি। দেখি তো সব। দুই শত্রু কখনো এক ছাদের তলায় থাকতে পারে না। একটা সামান্য ছুতো ধরে লাগালাগি এ বাড়ির নৈমিত্তিক ঘটনা। তুমি চিন্তা করতে পারবে না!

লীনা বললো, তুমি খাচ্ছো না, খাও। রান্না খুবই বাজে হয়েছে আমি জানি। তবে আমি শিখে নেবো, অতোটা শঙ্কিত তোমাকে হতে হবে না।

হাসলো রাহুল। বললো, সংসার করবার লোভটা তুমি এখনো সামলাতে পারলে না, লীনা।

লীনা বললো, মেয়েমানুষ, আমি সংসার করবো না? আর তোমাকে যখন ধরেছি, ছাড়ছি না কিন্তু বলে রাখছি, যতো যাই হোক, খিদে পেলে আমি ভাতের প্লেট নিয়ে বসে থাকতে পারি না, তোমাকে আগেভাগে বলে রাখছি। পরে আবার এনিয়ে আমার পেছনে লাগতে যেও না।

রাহুল বললো, পরিস্থিতিটা তুমি বুঝতে পারছো না। তোমাকে এবাড়ির ব্যাপারটায় আমি জড়াতে চাই না। বিজলী একবার এক গাদা ঘুমের বড়ি খেয়েছিলো। একবার ইলেকট্রিকের তার হাত-পায়ে জড়িয়ে আত্মহত্যা করতে যায়। কপালের জোরে বলতে হয় , দু’বারই বেঁচে যায় ভদ্রমহিলা।

লীনা আতঙ্কের গলায় বললো, খুবই আশঙ্কার কথা। আমাদের এরকম হাত-পা ছেড়ে বসে থাকা উচিত?

রাহুল বললো, অন্যরকমও আছে। একবার এক ঝগড়াঝাটি, মারামারির সূত্র ধরে আপা এক দিন কোথায় চলে গেলো। ফিরলো চারদিন পর। কোথায় গেলো, কোথায় ছিলো, কেউ জানে না। তাই খোঁজাখুঁজিতে গেলে বিনতু বেচারি শুধু ভয় পাবে, লাভের লাভ কিছু হবে না।

তাহলে এরকম চুপচাপ থাকবে? কিছু একটা করতে হবে না?

করছি তো, এই যে অপেক্ষা করছি।

সন্ধ্যার দিকে লীনাকে বললো রাহুল, ওঠো, এবার বাড়ি যাও।

লীনা বললো, যাচ্ছি না আমি।

বিস্ময়ের সঙ্গে বলে রাহুল, কিছু বলছো তুমি?

যা বলেছি, তুমি শুনতে পেয়েছো।

তোমার বাড়িতে ভাববে না?

ভাববে।

তাহলে?

আমার দায়িত্ব নিতে তুমি ভয় পাচ্ছো!

না, তা হবে কেন?

তোমাকে বেশি ভয় পেতে হবে না। তোমার ম্যাডাম ইলোপের অভিযোগে পুলিশ সঙ্গে নিয়ে এখানে আসবে না।

তোমার বাড়িতে তো জানে না কিছু।

আমাকে নিয়ে ওরাও একটু ভাবুক না! বিনতুকে নিয়ে আমার কেমন লাগছে, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। এতো পাগল পাগল লাগছে। সব লন্ডভন্ড করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

লীনার চোখমুখ দেখে তাকে কিছু বলার আর সাহস হলো না রাহুলের।

সন্ধ্যেবেলা গ্লাসে দুধ খেতে খেতে বিনতু বললো, আন্টি এই জামায় তোমাকে একদম ভালো লাগছে না। মা খুব মুটকি। তুমি মায়ের একটা শাড়ি পরো।

বিনতু নিজেই লীনার জন্য শাড়ি পছন্দ করে নিয়ে এলো।

এ বাড়িতে আজ একবারের জন্যও টেলিভিশনের সুইচ অন হলো না।

একটু গা ছমছম করছিলো রাহুলের।

এক গাদা বিনতুর হোমওয়ার্ক। লীনা পড়াতে বসিয়েছে বিনতুকে। বিনতুর মাথার এত ভালো, কিন্তু বড্ড মুডি।

পাখি স্বরে গভীর রাতে ডোর বেল বেজে উঠলো। সে শব্দে একই সঙ্গে চমকে উঠলো দু’জন। গান শুনিয়ে বিনতুকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে লীনা।

রাহুল আর লীনার মুখ চাওয়াচাওয়ির মধ্যে দ্বিতীয় বার বাজলো বেল।

ভয়ের বদলে রাহুল দেখলো লীনার চোখে মুখে যুদ্ধে জিতে যাওয়ার মতো আনন্দ।

দরজা খুলে দেখবার জন্য রাহুল উঠে দাঁড়ালো।

লীনা বললো, তুমি যাও আমি বিনতুর কাছে থাকি।

রাহুলের পা সরে না। সে কোনোই আন্দাজ করতে পারে না, কোথায় সে যাচ্ছে!