জিললুর রহমান-এর গুচ্ছকবিতা
দৌড়
দৌড় একটা সংক্রামক ক্রিয়া। যখন তটস্থ কেউ ভীত দৌড়ায়, চারপাশের সকলের মধ্যে সঞ্চারিত হয় ভয়। তারপর দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য সকলে দৌড়ায়, জানে না, জানতে চায় না কেন——কি কারণে এই দৌড়। তারপর একসময় সকলেই ভুলে যায় দৌড়েকে প্রথম হয়েছে কিংবা প্রথম কে দৌড় শুরু করেছে। সব দৌড় প্রতিযোগিতার নয়, কিছু কিছু ভীতযোগিতারও।
২.
আমরা শৈশবে বেহুদা দৌড়েছি, বাবার মারের ভয়ে, পাড়ার জাঁদরেল মুরব্বির ভয়ে,মিউনিসিপালিটির টিকাদিদির ভয়ে….
দৌড়াতে দৌড়াতে বেয়ে উঠেছি সুউচ্চ সুপারী গাছ, দেয়াল টপকে পালিয়েছি মনিরদের বাসার পেছনে।
শৈশব মানেই দৌড়, কখনওবা পুকুরে লাফাবো বলে। এখন বার্ধক্যে দেখি দৌড় চলছে অনন্তকাল——জীবনের দৌড়, জীবিকারদৌড়, অর্জনের দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে এলেও ফরেস্ট গাম্পের মতো কদর করে না কেউ। কেমন চোরের মতো মনে হয়, দৌড়ে যাচ্ছি জীবনের কাছে ধরা পড়ে যাবো বলে…
৩.
ইশকুলে বার্ষিক প্রতিযোগিতা জিনিষটা দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া দরকার। এখানেই প্রথম জেনেছি সহপাঠীরা বন্ধু নয়, শত্রু—প্রতিযোগী—প্রতিদ্বন্দ্বী। তারপর ক্লাস টেস্ট কিংবা বার্ষিক পরীক্ষায় মৃত্যুঞ্জয় আমাকে ডিঙিয়ে প্রথম হলেই বাবা রেগে কাঁই। আমিওদিলাম ভোঁ দৌড়——পালাই পালাই।
আর সেই মৃত্যুঞ্জয় যখন পরীক্ষার খাতা শূন্য রেখে মৃত্যুর কাছে পরাজয় মেনে নেয়, তখনও কি আমি তার সাথে পেরেছিপ্রতিযোগিতায়? সে আমার ঢের আগে পৌঁছে গেল জীবনের শেষ সীমানায়…
৪.
দৌড়ে যাচ্ছি রাস্তা পেরোতে, দৌড়ে যাচ্ছি গাড়িটা ধরতে, দৌড়ে যাচ্ছি ব্রিজের ওপরে স্রোতের সাথে পাল্লা দিতে। দৌড়ে চলেছিধরতে সময়, মনের ভেতর টম মরিসন। সময় ছুটছে পাগলপারা——আমরা কেবল দৌড়ে সারা।
৫.
চন্দ্র ছুটেছে মাস কাবারি, পৃথিবী ছুটেছে বছর গড়াতে, সূর্য কেবল মিল্কি পথে দুলকি চলেছে নিজের খেয়ালে। দৌড়ে সবাই যে যারগতিতে, মাপছি কেবল আলোক-কণার। কৃষ্ণবিবর হা করে আছে আসবে কখন আলোর কুমার——কখন সে কোন আলোকতারকা হারায় গহীন অন্ধকারে। আমরা তবু অনন্তকাল ছুটছি হুদাই কার খেয়ালে…
৬.
দৌড়ে ভীষণ নাম করেছে কোভিড এবং উসাইন বোল্ট। মানুষের গতি বাতাসের সাথে যুদ্ধ করেই এগিয়ে যাবার। ভাইরাস ছোটেবাতাসের বেগে হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে উড়ে। ভাইরাস খুব নাম করেছে আজ মানুষের ঘরেদোরে। মানুষ জানে না, জান বাঁচাতেইছুটছে কোভিড——মানুষের বুকে ঠাঁই গড়ে নিলে জমে ওঠে তার কুরবানির ঈদ।
৭.
একদিন আমার পায়ের সামনে চকচকে ফুটবল এসে থামবে। সামনে গোলপোস্টে গোলী উধাও। চাইলেই দৌড়ে গিয়ে একলাথিতেই গোল করা যায়। কিন্তু আমার সমস্ত আগ্রহ ফেলে দিয়ে এসেছি বঙ্গোপসাগরে। আমি আর দৌড়াব না ফুটবলেরপেছনে। তোমরা একে পরাজয় বলবে, আমি অনুভব করবো পরম বিজয়——দৌড়ের বিরুদ্ধে।
৮.
ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছে দৌড়ে যাচ্ছি সুতোটি ধরার জন্যে আজীবন। সময় উড়ে গেলবাতাসের মতো, আর জীবন লটকে থাকলোআকাশের কার্নিশে। কেবল আমিই হোঁচট খেয়ে পড়েছি নর্দমায়।
(১৪ জুলাই ২০২১ রাত ১২:২৭ ঢাকা)
একটি বিস্তীর্ণ মরা লাশের খপ্পরে
ক্ষেতের চারার থেকে আজ
সবুজ পাটের পাতা ভেঙেছে জমির কারুকাজ
শালার ঘুমটা ভাঙে না
ভাতঘুম ভাতঘুম কিছুতে ভাঙে না
স্বপ্ন আর স্বপ্নদোষে ঘরে বসে কাটে দিন
যেমন সূর্যের সোনা ঝরে প্রতিদিন
বিষণ্ন সূর্যের তেজ
এখনও হয়নি নিস্তেজ
তবু, আমাদের তেলতেলে স্বভাবের আলো
প্রদীপের তলা জুড়ে এতো এতো কালো
চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে কতো বীর্য
মধ্যাহ্ন গগনে হায় সৌম্যকান্তি সূর্য
জনপদে তারপরও আজ কেউ বীর্যবান নই
পাটের আঁশের বেশে আমরাও নেতিয়ে পড়ে রই
আমাদের আবাদী জমির যতো সোনালী পাটের আঁশ
ঘরকে ঘিরছে যেন চারিপাশ
মাঠ থেকে আজ থোকা থোকা পাটপাতা
গ্রাম হাঁট গঞ্জঘাট ছেড়ে শহরের দিকে ওত পাতা
ধীরে ধীরে গন্জের ঘাটের যত নৌকার গলুই
গুম হয়ে পড়ে থাকে নদীর দু’পাড়ে ওই
রাস্তাগুলো বেদখল সাড়ম্বরে
একটি বিস্তীর্ণ মরা লাশের খপ্পরে
বাংলার জংলার প্রান্তরের কুয়াশা কাতর হেমন্তকে ঘিরে
আজ আর কোনো উৎসব নেই ওরে
এখানে কেবলি লাশ
খেয়ে যাচ্ছে নিরাসক্ত স্বর্ণালী পাটের আঁশ
এখনও ঘুমের ঘোরে যারা দেখে স্বপ্ন দু’চারিটি
এই লাশ এই আঁশ এইসব ঘোলা ঘোলা স্বপ্নের চ্যারিটি
গিলে খাবে মহাকাল গিলে গিলে আয়ু
তেমাদের যত পরমায়ু
আজ সব ফাঁপা ফাঁপা জ্বলন্ত ফানুস
পাটের চারার ঘাম আমাদের হুঁশ
শ্রমিকের ঘরে নুন দিয়ে যাবে
তুমি সেই নুন শুষে শুষে কী করে বানাবে
রক্ত কিংবা একতাল মাংসের স্তুপ
গোধুলি আলোয় সেইসব স্বপ্ন কী স্বপ্নদোষেরা চুপ
সমস্তু ভূগোলে আজ সোনালী আঁশের
বোঁটকা গন্ধের মৌতাত; বিষণ্ন লাশের
চোখ থেকে কেবল পাটের দড়ি
আমাদের ঘরের ভেতরই
ঢুকে পড়ে হুকুম করেছে কোনো
দিগভ্রান্ত জেনারেল যেন
বলে যাচ্ছে মাখো তেল যতো পারো ধনবাদী গুহ্যদ্বারে
আমরা আসব ফের বারে বারে
আসবোই পাটকল থেকে লাশ হয়ে হয়ে
লাশ করে দিয়ে যাব এই রুগ্ন প্রেতের আলয়ে
(আমরণ অনশনরত পাটকল শ্রমিক আবদুস সাত্তারের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় সকল পাটকল শ্রমিকদের জন্যে নিবেদিত)
(বিকাল ৪:৪০, ১৩-১২-২০১৯, চট্টগ্রাম)
লেইস ফিতা, লেইস…
ভরা রোদ্দুরের তীব্র দুপুরে অলস
শুয়ে শুয়ে কান পেতে থাকি
দূর বাতাসের বুকে সে কোন্ সুরের আশা
আসে ফেরিঅলা
হ্যামিলনের বাঁশির সুরে ডেকে ডেকে
টেনে আনে নারী ও শিশুকে
লেইস ফিতা, লেইস….
কোনো শাড়িটির পাড় লাগানোর
অথবা কামিজ কতো ধরনের জামা
লেইস লাগানো বড় প্রয়োজন
এমনকি বিনোদনে বেহুদা ঔৎসুক্যে
রিনিঝিনি কাঁকনের মধুর ঝঙ্কারে
ছুটে আসে ফেরিঅলা, হাঁকে
লেইস ফিতা, লেইস…
চুলের বিনুনী বাঁধা
নীল ফিতা বহুদিন হয়ে গেছে
এবার ক’দিন তবে
লাল ফিতা বাঁধা যাক চুলে
আর চাই উকুনের কাঁকুই একখানি
প্রেরিত শিশুটি