You are currently viewing জাতীয় নির্বাচন ও একটি খসড়া প্রস্তাবনা ||  আলী সিদ্দিকী 

জাতীয় নির্বাচন ও একটি খসড়া প্রস্তাবনা ||  আলী সিদ্দিকী 

জাতীয় নির্বাচন ও একটি খসড়া প্রস্তাবনা 
আলী সিদ্দিকী 
 
 
একাত্তর টিভিতে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সঞ্চালিত ৮ই জুলাইয়ের এডিটর্স গিল্ডের গোলবৈঠকটি নানাবিধ কারনেই  খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। অধ্যাপক হোসাইন কবির বিষয়টি নজরে আনার পর পুরো অনুষ্ঠানটি মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। বিষয় হলো-এদেশের নির্বাচন, বিদেশের তৎপরতা। বিষয়টি পুরনো হলেও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আটজন প্যানেল আলোচকদের সিংহভাগই বর্তমান ও অতীত ক্ষমতাকেন্দ্রের সুবিধাভোগী হিসেবেই পরিচিত। দুয়েকজন আছেন যাঁরা ক্ষমতাকেন্দ্রে থাকতে আগ্রহী বলে খ্যাতি আছে। উপস্থিত আছেন সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ কর্তৃক অপদস্ত হওয়া অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন, সুজনের দিলীপ কুমার সরকার, অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, সাবেক সচিব মোফাজ্জল করীম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও দৈনিক আমাদের অর্থনীতি’র এডিটর ইনচার্জ হিসেবে মাসুদা ভাট্টি।
পদ-পদবী, অভিজ্ঞান, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তিশীল আলোচকদের যুক্তি-প্রতিযুক্তি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারন তাঁরা ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে কিংবা তার কাছাকাছি অবস্থান করছেন এবং তাঁরা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল ও পথের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁরা তাত্ত্বিকভাবে নিজস্ব এজেন্ডা তুলে ধরতেই অংশ নিচ্ছেন গোলটেবিলে। তাই তাঁদের আলোচনা মনোযোগ দাবী করে। বিস্তৃতভাবে না হলেও তাঁদের আলোচিত-সমালোচিত বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
 
 
গণতন্ত্রের মূল্যমান অপমানজনক
 
স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পরেও আমরা বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে অক্ষম বলেই বিদেশীরা হস্তক্ষেপ করছে। আমরাই বারে বারে তাদের ডেকে আনছি। আমেরিকার ভিসা নীতি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি  সুবিধা বাতিলের শর্তারোপ করা হয়েছে। পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগীদের এমনতরো শর্তারোপ অপমানজনক। পুরো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে গণতন্ত্রের জন্য আমেরিকার দেয়া ভিসা নীতি এবং ইইউর জিএসপি বাতিলের শর্ত। দুয়েকজন ছাড়া অন্যরা প্রধানমন্ত্রী যে সুরে আটলান্টিক পাড়ি না দিয়ে অন্যান্য মহাদেশে বন্ধু খোঁজার ও ব্যবসার কথা বলছেন তার সাথে সুর মেলানোর চেষ্টা করেছেন। গলাও ছড়িয়েছেন কেউ কেউ। মাসুদা ভাট্টি তো বার বার বলছিলেন যে, গণতন্ত্রের জন্য মূল্যমান নির্ধারণ করে দেয়া অপমানজনক। এটা আসলে বিশ্বদরবারে এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশের উচ্চকন্ঠ থামিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনাকে লাইমলাইট থেকে সরিয়ে দেয়ার নীলনকশা। এই পয়েন্টে সবাইকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ট্রেন্ড অনুসরণ করতে দেখা গেলো।
 
 
সিলেকটিভ ডেমোক্রেসি ও সাদা বর্ণবাদ
 
ইমতিয়াজ আহমেদ তাঁর হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে ব্যাখ্যা করতে চাইলেন যে, কলোনিয়াল ইমাজিনেশন থেকে আমরা বেরোতে পারি নি বলেই পশ্চিমাদের তোয়াজ করি। পশ্চিমারা নিজ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ এবং গণতন্ত্রের প্রেসক্রিপশন শুধু সিলেকটিভ দেশে চাপিয়ে দেয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের কিংবা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রে তারা নিশ্চুপ। এক্ষেত্রেও সবাই সমস্বরে ধুয়া দিলো। অনেকেই একমত হলেন যে, সাদা চামড়া দেখলে আমরা জামাই আদরে মেতে উঠি। আসলে ওরা সেই কলোনিয়াল দৃষ্টিতেই আমাদের দেখে। আলোচনা প্যানেল আলোচকদের  দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে যথারীতি এগোতে লাগলো।
 
 
নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও গণতন্ত্র 
 
এম সাখাওয়াত হোসেন জানালেন, সরকার একতরফাভাবে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করে নির্বাচনের দায়িত্ব একদিনের জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব খর্ব করা হলো। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশন  জাস্ট নিধিরাম সর্দার। ভোট ডাকাতি রাতে হোক বা দিনে কমিশনের তা রোখার এখতিয়ার থাকলো না। এই অবস্থায় কমিশনের দায়িত্ব দিলেও আমি নেবো না।  মাসুদা ভাট্টি অসন্তুষ্ট গলায় বলেন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু দলের গঠনতন্ত্র বদলে দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়টি আলোচনা হয় না।
দিলীপ কুমার সরকার বলেন, রাষ্ট্রের মেশিনারিজ গুলো স্বাধীন না হলে এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হলে নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হবে না। এক্ষেত্রে অবশ্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা কালাকানুন বাতিল করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। আবুল হাসান চৌধুরী নির্বাচনে পরাজয় অস্বীকার করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের হোয়াইট হাউসে হামলার উদাহরণ দিয়ে আমেরিকার গণতন্ত্রকে ধুয়ে দিলেন এবং তাদের গণতন্ত্র আমাদের নিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই বলে বাগাড়ম্বর করলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা উল্লেখ করলেন না। আলোচনায় যথাযথ  নেতিবাচক প্রভাব বজায় থাকে।
 
 
উন্নয়নই প্রধান, গণতন্ত্র নয়
 
ইমতিয়াজ আহমেদ সিঙ্গাপুর স্টাইলের কর্তৃত্ববাদী সরকারই বাংলাদেশের মতো এসডিজিমুখী দেশের জন্য প্রযোজ্য বলে মত প্রকাশ করেন। কাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশ গত পনের বছরে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর স্ট্রং নেতৃত্ব ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। মাহফুজা খানম জানান, উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় দ্বিমত উপেক্ষা করে এগোতে হয়। আজ মানুষের মধ্যে ক্ষুধার কষ্ট নেই তাই তাদের রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। অসন্তুষ্টি না থাকলে আন্দোলনও থাকে না। মোফাজ্জল করীম ক্ষীণ কন্ঠে হলেও বলার চেষ্টা করেন, মানুষকে স্বাধীনভাবে নাগরিক অধিকার চর্চা করতে না দিলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় না। আবুল হাসান চৌধুরী মত দেন, নানা মুনির নানা মতে দেশের উন্নয়ন করা যায় না। মানুষ রাজনীতির চেয়ে অন্নবস্ত্রের কথা বেশি ভাবে। দিলীপ কুমার সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, খিচুড়ি পাকানো রাষ্ট্রধর্ম, বাহাত্তরের সংবিধান, চারস্তম্ভ ও মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা তুলে ধরলেও কাউকে আমলে নিতে দেখা গেলো না। এম সাখাওয়াত হোসেন তাঁর  ভদ্রজনোচিত ভাষায় বলার চেষ্টা করেন, মানুষ গত দুইটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারে নি। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আসার পর মানুষের মধ্যে নাগরিক অধিকারবোধ জেগে ওঠে। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট নির্দেশনা দিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাজ সীমিত করে দিয়ে অগণতান্ত্রিক নির্বাচনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেবে। কিন্তু দিলীপ সরকার, এম সাখাওয়াত হোসেন  ও মোফাজ্জল করীম ছাড়া আলোচকগণ নিজেদের কমফোর্ট জোনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
 
 
ভূরাজনৈতিক রসগোল্লা ও গোঁফে তেল
 
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে বর্তমান স্ট্যাটাসকো ধরে রাখার উপর গুরুত্বারোপ করে অনেকেই ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এখন চাপের মুখে পড়ছে বলে মন্তব্য করেন। অনেকে মতপ্রকাশ করেন যে, বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণের কারণে বাংলাদেশে প্রভাব বজায় রাখার জন্য দুই মেরুর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ভিসা ও বাণিজ্য সুবিধাকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহারকারীদের প্রভাব থেকে বাংলাদেশের এখনি বেরিয়ে আসার সুবর্ণসুযোগ বলে কেউ কেউ মত দিলেন। বর্তমান সরকার সেন্টমার্টিন দিচ্ছে না বলে আমেরিকা বৈরিতা দেখাচ্ছে বলে জানান কেউ কেউ। এম সাখাওয়াত হোসেন পরিষ্কার করে বলেন, বঙ্গোপসাগরে ছয়টি দেশের শেয়ার আছে এবং বাংলাদেশ চাইলেই একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আমেরিকা সেন্টমার্টিন অফিসিয়ালি চেয়েছে তেমন প্রমাণ সরকার দেখাতে পারেনি। কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশের এখন চীন-রাশিয়া জোটে যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ পশ্চিমা দেশগুলোতেই বেশি। সুতরাং এখনই গোঁফে তেল দেয়ার মানে হয় না বলে টিপ্পনী করে কেউ কেউ।
 
 
তত্ত্বাবধায়ক সরকার না সরকারের অধীনে নির্বাচন 
 
শেষমেশ আলোচনা মূল পয়েন্টে এসে পৌঁছে যা পুরো রাজনীতিচর্চার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু- তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন? প্যানেলের অধিকাংশ আলোচকই সংবিধানের আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কিন্তু গত দুইটি নির্বাচনের বাস্তবতা, রাতের ভোট ও অনির্বাচিত ১৫৪ জনকে মনোনীত করা দেশবাসীকে বিক্ষুব্ধ যেমন করেছে তেমনি নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাহীন করে তুলেছে। জানানো হলো, সুপ্রিম কোর্ট তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছে। মুনতাসীর মামুন একপ্রকার কড়া গলায় বলেন, নির্বাচন হবে এবং বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে। বিএনপিকে নির্বাচনে আসতেই হবে। যদি না আসে রাজপথেই মীমাংসা হবে। আমরা রাজপথের আন্দোলন দিয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনেছি। বিএনপি পারলে সেটা করে দেখাক। কিন্তু বিএনপির পক্ষে রাজপথে জোয়ার আনাও যেমন অসম্ভব তেমনি বাড়াবাড়ি না করে নির্বাচনে অংশ নেওয়াও জরুরী। মুনতাসীর মামুনের কথায় পরিষ্কারভাবে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রত্যয় ফুটে ওঠে। তিনি পরিষ্কার বলেন যে, স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনীতি একসাথে চলতে পারেনা। কিন্তু বিজ্ঞ মুনতাসীর মামুন এটা বললেন না যে, ৯৬তে যদি তত্ত্বাবধায়ক জনগণের দাবী হয়ে থাকে এখন কেন নয়? তখন আওয়ামী লীগ বিএনপি সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায় নি অনাস্থার কারনে, এখন বিএনপিও তা চাইছে। বিচারপতি খাইরুল হককে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করলেই আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও গ্রহনযোগ্য হবে? তেমন প্রমাণ কি আওয়ামী লীগ ১৪ ও ১৮ সালে দিয়েছে? এই প্রশ্নে মাসুদা ভাট্টি, মুনতাসীর মামুন, আবুল হাসান চৌধুরী, মাহফুজা খানম কিংবা ইমতিয়াজ আহমেদ কোনো কথা বলেন নি।
 
 
বিচার মানি কিন্তু গাছ আমার
 
অবশেষে আলোচনা পশ্চিমা আধিপত্য, পিটার হাস, চায়না-রাশিয়া সংযুক্তি,  নতুন অর্থনৈতিক জোট বাংলাদেশকে নতুন স্বর ও সুযোগ এনে দিয়েছে পশ্চিমা গণতন্ত্রের প্রেসক্রিপশন তোয়াক্কা না স্বাধীন সার্বভৌমিক ভুমিকা পালন করার। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত না রাখা হলে জাতির সকল অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমরা উন্নয়ন সহযোগীদের কথা শুনবো কিন্তু তাদের প্রেসক্রিপশনে দেশ চালাতে আমরা বাধ্য নয়। আমাদের স্বাধীনতা কারো দয়ার দান নয়, রক্তার্জিত। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের ওজন বেশি হয়, এখানেও সেটা পরিষ্কার। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বারবার বিনাবিচারে হত্যা, গুম, দুর্নীতি , অর্থপাচার, পুলিশী নির্যাতন, জামাতের সাথে আঁতাত, স্বাধীনতার মূল চার নীতি থেকে সরে গিয়ে আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থার দিকে বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়ার বিষয়গুলো মাঝে-মধ্যে তুলে আনেন কিন্তু তাঁর কথার সলিড উত্তর কেউ দেননি। মোফাজ্জল করীম, এম সাখাওয়াত হোসেন ও দিলীপ কুমার সরকারের কন্ঠস্বর একপ্রকার চাপাই পড়ে গেছে গোলটেবিলে।
 
 
ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাংলাদেশকে যেন একটিমাত্র দলের কাছে ইজারা দেয়া হয়েছে। এটি যেনো ষোলো কোটি মানুষের দেশ নয়। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-হেফাজতের সাথে আঁতাত করে স্বাধীনতার মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিলেও আওয়ামী লীগকে বেঈমান বলা যাবে না। স্বাধীনতার পক্ষের লেভেলধারী (সকলে নয়) জ্ঞানপাপীরা পাছার কাপড় খুলে আওয়ামী লীগকে ধোয়া তুলসীপাতা বলবে, সেটা সবাইকে মেনে নিতে হবে? কেনো?  আমজনতা কি উচ্ছিষ্টের জন্য পা চাটছে?
 
মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলাটা রাজনৈতিক স্ট্যান্ট। তিনি বঙ্গবন্ধুর বার্তাটিই পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। সেজন্যে জিয়াকে স্বাধীনতাবিরোধী বলে কোনঠাসা করতে হবে কেনো? মুনতাসীর মামুন বললেন, স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে রাজনীতি করা যায় না। জামাতের সাথে করা যায়? যে জামাতকে নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ দিয়েছিলো সেটা রক্ষা না করে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে জামাতের লায়াবিলিটি নিজামী কামারুজ্জামান মুজাহিদদের সরিয়ে দিয়ে এখন জামাতকে নামিয়েছে খেলার ময়দানে। তাহলে স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে রাজনীতি কারা করছে?
 
আমরা দেখেছি, বিএনপি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বাংলা ভাইয়ের উত্থান, হরকাতুল জিহাদসহ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের মদদ করেছে, তাদের অপকর্ম নীরবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব ন্যাক্কারজনক কাজের জন্য হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধারা দলে থাকা সত্ত্বেও বিএনপি ঘৃণিত হয়েছে এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির মদদদাতা হিসেবে হয়েছে কলংকিত। বুঝলাম বিএনপি নিজের শক্তির ভারসাম্যের জন্য এসব করেছে কিন্তু আওয়ামী লীগ কি করেছে? তারা কি ক্ষমতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে? শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিএনপির মতো ছাড় দিয়েছে? দেয় নি। বরং কোণঠাসা করেছে নয়তো কিছু উচ্ছিষ্ট ছুঁড়ে দিয়ে দায় সেরেছে। আর মুনতাসীর মামুন এখন এসেছেন বলতে যে, স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে রাজনীতি করা যায় না!  আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি- এই ভুল ধারণা থেকে বাঙালীদের বেরিয়ে আসার সময় হয়ে গেছে।
 
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় পেয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত সাফল্য সমূহকে তৃণমূল পর্যন্ত সুচারুভাবে বাস্তবায়নের। সবচেয়ে বড় যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেটা হলো, রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্রধর্ম। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে গিয়ে ধর্মীয় রাজনীতিকে পুঁজি করার মানসেই দুরভিসন্ধিমূলকভাবে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখেছে। তাই তারা আজ মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ পশ্চাদপসরণ। ইতিহাসের চাকা পেছনে ঘোরানো। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানের সাথে, মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত গৌরবের সাথে প্রতারণা। ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচন নিয়ে যে দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে তা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে আস্থায় রাখার জন্য সাহায্য করে না।
 
এখনো সব শেষ হয়ে যায় নি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির অশুভ আঁতাত পরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়েই আদর্শিক লড়াই আওয়ামী লীগকে করতে হবে। আঁতাত নয় প্রতিরোধ। এজন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের সদুপদেশ আমরা অবশ্যই নেবো। তবে আমাদের সমস্যা আমাদেরকেই সমাধান করতে হবে। সেজন্য নিচের প্রস্তাবনাসমূহ আমরা বিবেচনা করতে পারি:
 
 
এক.
প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা। সর্বাধিক দশটি বৈঠকের মাধ্যমে ছয়মাসের মধ্যে কমিশন সর্বসম্মত ভাবে একটি জাতীয় সমঝোতা নীতি প্রণয়ন করবেন। কমিশনের দশটি বৈঠকে দশজন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ সভাপতিত্ব করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তে এই সমঝোতা নীতি প্রণীত হবে।  কমিশন প্রণীত জাতীয় সমঝোতা নীতির আলোকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার ও পরবর্তী ছয়মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা হবে। যে সব দল পরবর্তীতে নীতির বিরুদ্ধে যাবে সেই সব দল নির্বাচনে অযোগ্য বিবেচিত হবে।
 
 
দুই.
মুক্তিযুদ্ধের আলোকে জাতীয় কমিশন গঠিত হবে এবং যে সব দল মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি দেবে না তারা এই কনভেনশনে যোগদানের অযোগ্য বিবেচিত হবে। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কোনো বিতর্ককেই কমিশন গ্রহন করবে না।
 
 
তিন.
কমিশনভুক্ত দলসমূহের জেলা ও উপজেলা, পৌরসভায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং জাতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি থাকতে হবে। দলসমূহের গঠনতন্ত্র গণতান্ত্রিক হতে হবে এবং সর্বপর্যায়ে গোপন ব্যালটে নেতৃত্ব নির্বাচিত হতে হবে।
 
 
চার.
রাষ্ট্রের কোন পর্যায়ের কোন কর্মকর্তা- কর্মচারী এই কমিশনের সদস্য হতে পারবে না। রাষ্ট্রের সকল প্রশাসনিক দফতর ছয়মাসের জন্য কমিশনের অধীনে থাকবে।
 
 
পাঁচ.
নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগকে স্বাধীনসত্তা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। কোন সাদাকালো নির্দেশনা দিয়ে এসব সাংবিধানিক বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
 
 
ছয়.
নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাহী বিভাগ সুস্পষ্টভাবে নির্বাচন কাজে বিরত থাকবে। সামরিক, আধা-সামরিক   ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশাধীন থাকবে।
 
 
সাত.
জাতীয় কমিশন আয়োজন, গঠন ও সমন্বয় করবে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন জাতীয় কমিশন প্রণীত সুস্পষ্ট নীতিমালার আলোকে নির্বাচন আয়োজন করবে।
 
উপরের সাতটি খসড়া প্রস্তাবনা একটি গ্রহনযোগ্য এবং ক্রিয়াশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এই আলোকে আলোচনা সমালোচনা, সংযোজন বিয়োজন হবে অথবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ধর্তব্যের মধ্যেই নেবেন না। কিন্তু অনেক কষ্টার্জিত দেশটিকে আগামী প্রজন্মের বাসোপযোগী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে হবে। সম্মিলিতভাবে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো  গড়ে তোলার জন্য নিরন্তর হানাহানি নয়, যুক্তিসংগত সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বিদেশের হস্তক্ষেপমুক্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে আমাদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের ছাড় দিয়ে হলেও সমঝোতায় আসতে হবে। আজকের বিরোধাত্মক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সময়ের দাবী হলো সমঝোতা আর এই সমঝোতার জন্য প্রয়োজন জাতীয় কমিশন। দেশপ্রেমিক ও ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগই পারে এই আলোকে জাতিকে নতুন আলোর পথে এগিয়ে নিতে। এটি আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক দায়িত্ব।