জাকিয়া শিমু
বেলা শেষে
মোহন মিয়াঁর বাড়ির দক্ষিণকোণায় ন্যাড়া একটি আমগাছ আছে। গাছটি বহুকালের সাক্ষী হয়ে শতায়ু বৃদ্ধের নড়বড়ে দাঁতের মতো ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! বেশ ক’বছ আগে ব্জ্রপাতে গাছের বৃহদাংশ ক্ষয়ে গেছে। আগে, যাও কিছু আম ধরতো এখন তাও হয় না। গাছটি অযথা বাড়ির দরকারি জায়গা দখল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে’- বাড়ির সকলের এমন যুক্তিযুক্ত ধারণা হলেও মূখ্যত মোহন মিয়াঁর কারণে গাছটি উপড়ে ফেলা যায় না! এই গাছটিকে তাঁর বড়ো আপন মনে হয়। তিনি ফলহীন এই গাছের গোঁড়ায় দিনভর ঝিম মেরে বসে থাকেন! তাঁর মন বিচ্ছিন্ন-বিবাগি, সারাক্ষণ অসোয়াস্তিতে ভরে থাকে! চোখজোড়ায় রাজ্যের বিবর্ণ ঘোলাটে-ভাব আশ্রয় নিয়েছে! শান্তি বাস করে স্বপ্নের ভেতর কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছেন! গাঁয়ের লোকজন পাগল ভেবে তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করে ! শুধু কী পড়শি! নিজঘরের মানুষগুলোর অবহেলা মাপার কী বাটখারা হয়! তারপরও পুরনো ঘুণে-ধরা আসবাবের মতো জীবনটা বয়ে নিতে হয় তাঁকে!
গত প্রায় চল্লিশটি বছর দুর্দান্ত ব্যতিব্যস্ত সময় ছিল মোহন মিয়াঁর। অন্যের স্বপ্নের পেছনে আজীবন ছুটে চলা মানুষটি, বুঝতেই পারে নাই নিজজীবনের সুখের ঘুড়িটা আলগোছে সুতো ছিঁড়ে কখন পালিয়ে গেছে! মগজে অগণিত প্রশ্ন অবিরত জ্বালিয়ে মারে তাঁকে, তিনি খোঁজে পান না, জীবনে ভুলটা কী করলেন! জীবনের নানান অধ্যায় বিচরণ শেষে,শেষবয়সে যা পেলেন, তা কী আসলে তাঁর পাওনা ছিল! এমন হাজারো ভাবনা আজকাল অনেকটা জোর করে জেতেচেপে বাস করে তাঁর মনেরঘরে। তিনি জীবনের খেরোখাতা খুলে বসে থাকেন কিন্তু হিসাব মিলাতে পারেন না! অবুঝ শিশুর মতো আকাশমুখি মুমূর্ষু দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন! মাথার উপর আকাশটি ক্ষণে ক্ষণে সুরত বদলায় কিন্তু তাঁর মনের আকাশে ঘন মেঘ জমে অনড়ে বসে থাকে! মনের-মেঘ বড্ড তাতায়, বেদনার অতলে ডুবিয়ে রাখে!
উঠোনের পশ্চিমপাশে বাপ-দাদার আমলের একখানা আধঃপাকা রান্নাঘর। রান্নাঘরের ছাল-ওঠা মেঝেতে বাতে-ধরা পা দু’খানা ছড়িয়ে মোহন মিয়াঁর স্ত্রী, চুলার মুখে পাটকাঠি গুঁজে আর নিজমনে বিরবির করে খিস্তি আওরায়! নিজেকে অভিশাপ দেয়, অদৃষ্টরে শাপশাপান্ত করে ! হাঁড়িতে ঝিঙ্গেশাইল চালের ভাত টগবগিয়ে ফুটে। তাতিয়ে-ওঠা চুলার পাশে চৌকোনা কাঠের পিঁড়িতে জবুথবু হয়ে বসে থাকা বউটার জন্য বড্ড মায়া জমে আছে মোহন মিয়াঁর মনে। সেই পনের ষোলো বছর বয়সে লাল জমিনের ওপর সোনালি পাড়ের বেনারসি জড়িয়ে, এ-বাড়ির বউ করে নিয়ে এলেন। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা! চোখের তারায় সেসব ঝলমলে দিনগুলো আজও জায়গা নিয়ে জোর দখলে বসে আছে।
এরপর কতোটা বছর চলে গেল, দুজনে পাশাপাশি বসে একবেলা মনেরকথা বলার সময় হয়ে ওঠে নাই! নিজের জীবনযৌবন, সাধ-আহ্লাদ অমাবস্যার রহস্যে-ভরা অন্ধকারেই রয়ে গেছে। বউটির ওপর খুব অবিচার করা হয়েছে যা এখনো তা সমানতালে চলছে! মোহন মিয়াঁর বিবেকের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এখনো ক্ষয়ে যায়নি, ভাবনার বলয় বহুদূর অবধি চলে যায়। নিজের ওপর ইদানীং খুব রাগ হয়। নিজমনে অদৃষ্টের চৌদ্দগুষ্ঠীকে মনের খায়েশ মিটিয়ে অভিশাপ দেন। তারপরও মনটায় একদণ্ড স্থিতি ফিরে আসে না!
মোহন মিয়াঁ পৈতিকসূত্রে বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন; ভাঙ্গাচোরা দু’টি তাঁতকল আর পনের ষোলো শতাংশের একখণ্ড ভিটেমাটির উপর পক্ষঘাতগ্রস্ত দেহের ন্যায় ঢলে-পড়া একখানা দু’চালা টিনকাঠের ঘর। এর থেকে একরত্তি বেশি কিছু নয় ! ওটুকু ঘরে ঠাঁসাঠাসি করে- চার ভাইবোন, দাদিসহ বাবা মায়ের হা-ভাতের সংসার। ভাঙ্গা তাঁতকলে সপ্তাহে বড়জোর চার পাঁচ জোড়া লুঙ্গি, পরিবারের সবার একত্রে হাড়ভাঙ্গা খাটুনী শেষে নামানো যেত। তা বিক্রিবাট্টায় যা জুটত তার দৌলতে সংসারে্র নুনপান্তার যোগারযত্ন কোনোমতে চলত। বহু কষ্টে প্রাইমারিটা শেষ করে সে। হাইস্কুলে পড়ার যোগ্যতা থাকলেও সামর্থ্যের সংকুলান ছিল না। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে সংসারের জোয়ালটা আলগোছে তাঁর কাঁধে নেমে পড়ে।
সেসময়ে দেশজুড়ে বাঁধে আরেক ফ্যাসাদ! প্রাচীন হাতে-বোনা তাঁতকলের জায়গা দখল করে নিতে আসে যন্ত্রচালিত তাঁতকল! প্রথমে যদিও যন্ত্রকলের সাথে বিগ্রহ ঘটে আদি তাঁতকলের কিন্তু একটা সময় পর যন্ত্রচালিত কলের তাণ্ডবে কুলাতে না পেরে দেশ থেকে হাতেবোনা তাঁতকল প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়! এমন দুর্যোগে গ্রামগুলোর হাজার বছর ধরে চলে আসা জীবনযাত্রায় বিস্তর প্রভাব পড়ে। তাদের সাথে সুতোর সম্পর্ক ছিল মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কের মতো গভীর। মাকু টানা,চরকি ঘূর্ণন,কাপড়ে শান দেওয়া কিংবা কাপড়ে মিহি ভাঁজ এসব কাজের সাথে তাদের জীবন ছিল আপনজনের সম্পর্কের মতো ঘোর মায়াময়। ধীরে ধীরে চিরাচরিত সেসব শব্দ জীবন থেকে প্রায় নিভে যেতে থাকে! এবং বংশ পরম্পরায় অভ্যস্ত জাত ব্যবসা হারিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে! মোহন মিয়াঁর গাঁয়ের প্রায় আশিভাগ লোকের মূখ্যত বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল এই তাঁতকর্ম। এসব তাঁতীদের পূর্বপুরুষরা তাঁতকর্ম করেই এযাবতকাল টিকে ছিলেন। তাদের জমিজমা যেমন নেই অন্য পেশায় দক্ষতাও নেই। এমন অবস্থায় তারা বেকার হয়ে, নিরুপায়ে নিন্মশ্রনির কাজের খোঁজে শহরে ভিড় জমায়। যাদের সে সামর্থ্যটুকু নেই তাঁরা আশপাশের গাঁয়ে খুব অল্প মূল্যে পৈরত দিতে শুরু করে।
মোহন মিয়াঁর বাবা ছিলেন শ্বাসেের রোগি। খুব কষ্ট করে শুয়ে-বসে-জিরিয়ে তাঁতের কাজ করতেন। তার পক্ষে বাড়ি ছেড়ে যত্রতত্র কাজ করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে সে-বয়সে মোহন মিয়াঁ গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে শহরে গেলেন। দূর সম্পর্কের এক খালার বাসায় কোনমতে থাকার জায়গাও পেলেন। খালুর পুরান ঢাকায় রাস্তারপাড়ে ঝুপরিঘরের তেহারির দোকান। খালুর তেহারির নামডাক শহরজুরে। মানুষজন তাঁর দোকানে খাবার খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেসুত্রে অনেকের সাথে তার জানাশোনা। তেমন এক খদ্দেরের মাধ্যমে মোহন মিয়াঁ থান কাপড়ের দোকানে কাজ পেয়ে যায়। কাপড়ের দোকানে কাজের আয়ে কোনমতে টেনেটুনে মোহন মিয়াঁর সংসার চলছিল। কিন্তু একদিন হুট করে খালু হার্ট এটাক করলেন এবং সবাইকে তাজ্জব বনে ফেলে পরপারে চলে গেলেন! ডা দেখানোর সময় মিলল না। খালু আবেগি মানুষ ছিলেন। অপরের দুঃখে নিজের চোখে পানি জমত। নিজ আয়ের বেশিরভাগ অংশ গরীবদুঃখীকে দিয়ে দিতেন। বউ সন্তানের জন্যে এক পয়সা রেখে যেতে পারেন নাই। খালুর বড় ছেলে মোহন মিয়াঁর সমবয়সী। সবেমাত্র সে কলেজ যাওয়া শুরু করেছে। উপায়ন্ত না পেয়ে সংসার চালাতে তাকে যেতে হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। বাড়ির বড় ছেলে বিদেশে গেলে সংসারের দেখভালোর দায়িত্ব এসে পড়ে মোহন মিয়াঁর কাঁধে।
খালুর একমাত্র মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে স্থানীয় হাইস্কুলে পড়ে। মোহন মিয়া সে মেয়েকে স্কুল থেকে আনা-নেয়া করে। তাকে সে ঠিক নিজবোনের মতো দেখে। বড় ভাইয়ের মতো সবসময় খোঁজখবর করে। সত্যি বলতে কী, তাঁর মনে খালুর মেয়ের বিষয়ে বাড়তি কোন ভাবনা কাজ করত না। বয়স বড় জোর পনের হবে কিন্তু বছর না ঘুরতে মেয়েটি তালগাছের মতো হাতেপায়ে অতিরিক্ত বারবাড়ন্ত হয়ে উঠল। এ বয়সে মেয়েদের শরীরে প্রকৃতিপ্রদত্ত একটি সৌন্দর্য ধরা দেয়,তার মধ্যে বোধহয় একটু বেশিই সেরূপ সুষমা লক্ষ করা গেল। একসময় অবশ্য মোহন মিয়াঁ বুঝতে পারে খালুর মেয়ে তাঁর প্রেমে ডুবে আছে। এবং খালা কিংবা বাড়ির সকলে এ সম্পর্কে বেশ আগ্রহি। শেষতক অবশ্য পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। দিনটির কথা স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। শ্রাবণ মাস। টানাসপ্তাহ ধরে ঘোর বর্ষণ চলছে। আকাশ ভরা কালো ভারি মেঘ,গর্ভবতী গাভির মতো হেলেদুলে ছুটে চলছে। সূর্যের দেখা নেই। এমন ঘোর বাদলদিনে কেড়াই নৌকায় জনাদশেক লোক নিয়ে বরযাত্রী রওনা হয়। নৌকা ধলেশ্বরী নদীতে পৌঁছতে ঘোলাজলের আকাশ সমান ঢেউ আছড়ে পড়ে নৌকার ওপর ! নৌকা ডুবে ডুবে অবস্থা, সে কী উৎকণ্ঠা সবার। শেষে অবশ্য কাগজের নৌকার মতো ভেসেছুটে অবশেষে ভরসন্ধ্যায় নৌকা ভিড়ে বুড়িগঙ্গা নদী তীরে। খালুর বাড়ি পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা পাড়ে। রাতে অনেকটা ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে হয় এবং পরদিন ভোরবেলা বউ নিয়ে তারা গাঁয়ে ফেরত আসে।
বিয়ের পাঁচমাসেরমাথায় পৌষের এক সকালবেলা। কুয়াশা তেমন ছিল না বলেই বোধহয় শীত পড়েছিল জোতমতো। শীতের লেপকাঁথায় মুড়ি দিয়ে সেদিন গ্রামটি ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু পিয়নের চোখে ঘুম নেই। তিনি মোহন মিয়াঁর দুয়ারে সাইকেল ভিড়িয়ে উচ্চস্বরে হাঁক দেন। মোহন মিয়াঁ জবুথুবু দেহটাকে কাঁথায় মুড়িয়ে দুয়ারে নেমে আসেন। সেই অধঃপাতের শুরু! সেদিনের স্মৃতিরা চোখে ভাসতে বুকটা কেমন মুচড়ে উঠল তাঁর! স্বার্থপর দুনিয়ার চেহারাটা সৃষ্টিকর্তা তাঁর সামনে উন্মূক্ত করেছিল সেদিন, কিন্তু সে ধরতে পারে নাই। চিঠিটি মধ্যপ্রাচ্যে যাবার আহ্ববানে স্ত্রীর বড়ভাইয়ের কাছ থেকে আসে। সেসংবাদে বাড়িসুদ্ধ লোক খুশির বানে ভেসে বেড়ায়। মনে আছে, শুধু বউয়ের চোখে কষ্টেরজল আষাঢ়েবৃষ্টির মতো টপটপ করে ঝরছিল। আচমকা এমন সংবাদে কষ্টটা তাঁর বুককে বিক্ষত করলেও পরিবারের মানুষগুলোর আক্ষেপ তাঁকে ভিন্ন কিছু ভাবতে সাহস দেয়নি। তাছাড়া ঘরে নতুন বউ, বিরাট সংসারের ভার তাঁর মাথার উপর। তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। নতুন বউকে নিয়ে শঙ্কা ছিল সবচেয়ে বেশি,অথচ অতোটুকু মেয়ে একহাতে সমস্তটা বড়ো নিপুণভাবে সামলে নিয়েছিল।
অনেক বছর এভাবেই কেটে যায়। মরুদেশে দিনরাত স্বপ্ন দেখতেন,একদিন ভরা সংসারে ফেরত যাবেন। স্বপ্নতো দেখাই যায় যতদূর মন চায় কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন হয়। সঠিক সময়ে তাঁর আর ফেরা হয় না। মা চলে গেলেন পরপারে। শেষসময়ে দেখার সুযোগটুকু হয়নি। বোন দু’টোকে ধুমধাম করে বিয়ে দিতে হয়েছে। ভাতেরহাড়ি উপচে পড়া বলকের মতো ভাইদের সংসারে আজ সুখ বইছে অথচ তার যোগান দিতে মরুর দাবদাহে পুড়েক্ষয়ে তাঁকে গাধার মতো পৈরাত দিতে হয়েছে। সংসার নিয়ে তারা এখন মহা ব্যস্ত সময় পার করছে ! এমন ব্যস্ত অবশ্য একসময় তিনি নিজেও ছিলেন তবে তাতে তফাৎ ছিল বিস্তর। তাঁর ব্যাপৃত সময়ের ফসল ভোগ করেছে সকলে মিলে আর এদের ব্যস্ততা শুধু নিজের বউ-বাচ্চাদের ঘিরে!
হেমন্তের বেলা চটজলদি পড়ে যায়। বউটা এবয়সে একা হাতে রান্নাবান্না সামলে উঠতে হিমসিম খায়। সকালের জলখাবারের ঝামেলা না চুকতে, দুপুরের আয়োজনে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ার তাগিদ আসে। দু’ছেলের বউ নিজেদের ঘরবন্ধী করে রেখেছে, অযথা রেষারেষিতে। সংসারের কাজে এরা খুব একটা বিপদে না পড়লে ঘেঁষে না। একজন কাজেরলোক অবশ্য আছে। সেও বউদের ফুট ফরমায়েশ খেটে দম ফেলার ফুসরৎ পায় না। বউদের এমন আচরণ মোহন মিয়াঁ কিংবা তাঁর বউ’র না বোঝার কথা নয়। এরা খয়রাতি মনমানসিকতার মেয়েছেলে। তাদের এসংসারের উপর কোন মায়া নেই। মায়া, বড্ডো জটিল বিষয় এবং পুরোটাই মনের ভেতর জন্ম নেয়, তা জোর-জবরদস্তি করে মনে বসানোর চেষ্টা বিফল। একান্নবর্তী সংসারে তাদের বড়ো অনীহা,ছেলেরাও ইনিয়ে বিনিয়ে আলাদা সংসারের গুণকীর্তন শোনায়।
মোহন মিয়াঁ এসব ভাবনায় আছন্ন হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন নিজের বউ’য়ের দিকে। বউটি নির্দ্বন্দ্ব মনে একাধারে রান্নাঘরে কাজ করে যাচ্ছে। ভাতের মাড় কাটতে হাড়ি ঠেকা দিলে গরম ফেনের ক্ষুধা-সৃষ্টি সুবাস পুরোবাড়ি বইতে শুরু করে। মসুর ডালে চলছে পাঁচমিশালির ফোঁড়ন, মৌরীর কড়াগন্ধটা নাকে এসে লাগছে। জোড়াচুলার একপাশে বসেছে ডালের বড়িতে ভাঁজা কই মাছের ঝোল অন্যপাশে সরষে বাটায় ইলিশপাতুরি। এসবই মোহন মিয়াঁর পছন্দের খাবার। সে বেছে বেছে স্বামীর পছন্দের খাবার রান্না করে। কিন্তু এসব খাবার বহুকাল অবহেলিত এবং পচিয়ে ফেলা পাকস্থলি আর নিতে পারে না। ইলিশমাছের পেটির টুকরোয় তেলমসলা মেখে বউ লাউপাতা তুলতে এসে মোহন মিয়াঁকে গোসলের তাড়া দিয়ে যায়। কিন্তু সে নড়ে না,পাথরের খাম্বার মতো ঠায় বসে থাকে, ইলিশ মাছের পাতুরির গন্ধ তাঁকে নিয়ে ছুটে যায় সেই কবেকার মায়ের রান্নাঘরে-
সেসময়ে তাদের দিনের দু’বেলা ডালভাত চলত! তবে মাঝেমধ্যে কপাল ভালো থাকলে গাঁয়ের মরাখালে ধরা গোরাগারা ছোট মাছের চচড়ি। তবে শনিবার আসলেই বাড়িতে একটি উৎসবের সুবাতাস বইত। শনিবার হাটবার! সারা সপ্তাহ ধরে রাতদিন খাটুনীর ফসল তাঁতে-বোনা লুঙ্গি বেচাবিক্রির দিন সেদিন। বাবা সাতসকালে লুঙ্গির গাঁটরি মাথায় তুলে হাঁটের পথে দ্রুত পা চালাতেন যাতে বেলা থাকতে বাড়ি ফিরে আসতে পারেন। যদিও বাবার ফেরা হতো ভরসন্ধ্যায়, নয়তো তারও পরে; পুবহাটির মসজিদের এশার আযান পরে গেলে। আমাদের হয়তো সেই সাতসকালে পেটে পান্তা আর গতকালের বেঁচে যাওয়া ডাল-ঝোলের মিশ্রন পড়েছিল তাও মেপে মেপে। পেট ক্ষুধার ধকল সইতে না পেরে ঘট ঘট আওয়াজ তুলত। তারপরও বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা ছিল আমাদের জন্যে মহা আনন্দের বিষয়, অনেকটা কঠিন জখমের পর প্রাণে বেঁচে থাকার মতো কঠিন আনন্দের।
সন্ধ্যা নামতে মা বাইরবাড়ির রোদখাওয়া খড়নাড়া উঠোনের ডালিম গাছের গোঁড়ায় মাটির চুলাপাড়ে জড়ো করতেন। মায়ের এই আয়োজন দেখে আমাদের মন শান্তনা পেত, আমরা বুঝতাম বাবার ফেরার সময় হয়েছে। বাবা ফিরতেন শেষ-বাজারের চোখ-বসে যাওয়া জোড়াইলিশ নিয়ে! আনন্দে তার চোখে মুখে হাসির বিজলিবাতি জ্বলজ্বল করত। লুঙ্গি বেচা হয়ে গেছে সকাল সকাল কিন্তু ইলিশ যে সস্তায় মিলবে ভাঙ্গাবাজারে। বাজার তখন সবে মেলতে শুরু করেছে,বাবা মাছের দোকানঘেঁষা চায়েরদোকানে ঘাপটি মেরে বসে থাকেন। সমানতালে মাছ বেচাকেনা চলছে-তাজা ইলিশের গন্ধে বাজার ম ম করছে! বাবার অপেক্ষার সময় শেষ হত না। সময় কাটাতে বগলের নীচে ভাঁজে রাখা প্লাস্টিকের আঁশটে গন্ধের মাছের ব্যাগটা বারকয়েক ভাঁজ ভেঙ্গে খুলেন আবার যত্ন করে ভাঁজ করেন এবং বগলে আঁকড়ে ধরে কান পেতে মাছের বাজারের দরদাম শুনেন।
ভাঙ্গাবেলায় মাছের বাজারে মানুষের ভিড় কমতে শুরু করত। তখন অল্পদামে মাছ ছেড়ে দেওয়া ছাড়া জেলেদের অন্যকূল থাকত না। বাবা ঠিক তখন ঝোপ বুঝে মাছের বাজারে ঢুকে পড়তেন। ততক্ষণে অবশ্য সেরা এবং তরতাজা মাছগুলো চলে গেছে অন্যেদের ঝুলিতে। তারপরও তিনি দক্ষ হাতে মাছের পেট টিপেটিপে একজোড়া ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। বাবার ডিমওয়ালা মাছ খুব পছন্দ ছিল। মা, মাছের পেটে ডিম দেখলে গলা চড়িয়ে হাঁ হুতাশের কাব্য খুলে বসতেন। আমরা মনোযোগ দিয়ে মায়ের সেসব গল্প শুনতাম। “ মাছের পেটের ডিম মাছের আসল স্বাদ নষ্ট করে দেয়। মাছের মা, শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিয়ে ডিমে ভরে রাখে। যাতে বাচ্চাগুলো পরিপুষ্ট হতে পারে, সেজন্য মাছের গায়ে স্বাদ থাকে না”। কিন্তু বাবা সে-কথা কানে তুলতেন না। দু’চুলার একপাশে মোটা চালের ভাতের বলক ভুতভুত করে ফুলে ফেঁপে উঠত আরেকপাশে লম্বা ফালি করে কাটা কচু আর মিষ্টি কুমড়োয় ইলিশ মাছের ঝোল। মা ভাতের বলকের ওপর বসিয়ে দিতেন বাবার জন্য দু’টুকরো সরষে ইলিশপাতুরি। বাবা ইলিশ মাছের পাতুরি খুব পছন্দ করেন। সবগুলো ভাইবোন চুলার চারপাশে ঘুমজড়ানো চোখে বসে থাকতাম রান্না শেষের অপেক্ষায়।
মোহন মিয়াঁর বউ’র রান্না শেষ হলে,গোছগাছের কাজটা কাজের মেয়েটি করে দেয়। এ সময়ে মেজাজমর্জি ভাল থাকলে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয়ার ফুঁসরতে তাঁর পাশে এসে বসে। তিনি প্রতিদিন এই সময়ের অপেক্ষায় থাকেন। দু’জনে পাশাপাশি বসার এই একটু সুযোগ মিলে। তবে নিজেদের একান্ত নয়, সংসারের দু’চারখানা টুকটাক জরুরি আলাপ পাড়ে তাঁর সাথে। যেমন- বড় ছেলেটা আর বিদেশ করতে চায় না। ছোট ছেলে নিজের নামে জমি রাখতে চায় কিংবা মেয়ের জামাইদের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবনিকেশ। এসব বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কোনো মতামত দিতে যান না তিনি। তাঁর জীবন কেটেছে মধ্যপ্রাচ্যের গাধাদের সাথে। সারাদিন তপ্ত রোদের আঁচে পুড়ে ভেড়া-গাধাদের মাঠে চড়িয়েছেন। গাধাদের চড়াতে মগজের জোর লাগে না, গতর খাটাতে হয়। সে হিসেবে সংসার, সম্পত্তি, বিষয়আশয় এসব কূট বিষয়ে তাঁর বুদ্ধি বিবেচনা এমন অবেলায় কাজ দেবার কথা নয়।
তিনি জীবনভর কঠোর পরিশ্রম করে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করেন। প্রথমে মা-ভাইদের তারও পরে বউ’য়ের কাছে পাঠান। তারা তাদের ইচ্ছে মতো খরচ করেছে। কখনো কেউ মোহন মিয়াঁর মতামত জানতে চায় নাই। অবশ্য এখন যে বউ এসব প্রসঙ্গ টানছে,সেটা তাঁর মতামত চাইতে নয়। সে নিজেও জানে সেটা দেবার ক্ষমতা তাঁর স্বামীর নেই। শুধু মানুষটার কাছে বলার জন্যে বলা! নিজের মনে মানুষ যেমন কথা বলে, অনেকটা সেরকম করে বলা। তিনি অবশ্য বউকে কোনো দোষ দেন না। মহিলার সাথে কেউ কখনো ছিল না। মোহন মিয়াঁ নিজেও তার পাশে থাকতে পারেননি। নিজের মতো স্ত্রীও পোড়া কপাল নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে। তিনি নিজেও একসময় কতো কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ধু ধু মরুদেশে গাধার বহর ছাড়া একটি চিল কাকও ছিল না। অবশ্য বউ’র আশেপাশে মানুষের অভাব ছিল না কিন্তু নিজের কথাগুলো বলার মতো একটি মানুষ কী ছিল ! আজও যে আছে তাও হলফ করে বলার সুযোগ নাই। মোহন মিয়াঁ এতবছর পর তাঁর সংসারে ফিরে এসেছেন কিন্তু কূটকৌশলপূর্ণ এ সংসারে সম্পূর্ণ বেমানান তিনি!
মোহন মিয়াঁর বউ জীবনের সমস্ত চাওয়া-বিসর্জন দিয়ে এ-সংসারি গড়েছে। স্বামী বছরের পর বছর বিদেশ করেছে। মানুষটির জন্যে তাঁর মনে মায়া-ভালোবাসার কমতি ছিল না। মনটা সারাক্ষণ বিক্ষিপ্ত থাকত। নিজের জন্যেও কী আক্ষেপ কম হত! কষ্ট ভুলে থাকতে সে ব্যস্ত থাকত সংসার নিয়ে। এসংসার তাঁর কাছে হেলাফেলার বিষয় নয়, সাক্ষাত উপাচার। সংসারে শুরুতে বলতে গেলে সংসারে কিছুই ছিল না, আব্রুহীন ছিল!, এখন নেই, এমন একটি কিছু খুঁজে বের করা মুশকিল। সংসার গড়তে টাকাকড়ির চাইতেও যে বিষয়টি আবশ্যক, তা হলো- মায়া। সে খুব কষ্টে বিন্দু বিন্দু মায়া জমিয়ে মালা গেঁথে আজকের এই সংসার গড়েছে। যাদের অন্তরে সংসারের জন্যে দয়ামায়া নেই তাদের কাছে সোনার সংসারও হয়ে ওঠে তামস্রি। তাই এসংসারের গায়ে ছুরিকাচি চালিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করতে তিনি নারাজ। মোহন মিয়াঁ নিজেও বউকে সমীহ করে চলেন। তার জ্ঞান বিবেচনা সাধারণ মেয়েছেলের মতো নয়। ছেলের বউরা দায়দায়িত্বের পাশ কাটিয়ে সোনার সংসারটা ভাগ বাটোয়ারা করে নিবে, তাতে তাঁর নিজেরও আপত্তি আছে।
তিনি ছুটিতে দেশে ফিরতেন, তাও পাঁচসাত বছর পর পর। একবার হল কী, নিজের বড়ো মেয়েকে চিনতে ভুল করলেন। হাতাকাটা ফ্রক পরা মেয়ে রেখে গেলেন, ফিরে এসে দেখেন, গায়েগতরে বেড়েঝেরে মেয়ে লম্বায় মায়ের উপরে চলে গেছে। তারপর সে-মেয়ের বিয়ে হয়, ছোট মেয়েটির বিয়ে হয়। পরিবারের কোনো দরকারি আয়োজনে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেন নাই। মেয়ের জামাইদের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাত হয়,মরুর দেশে। তিনি দু’জামাইকে নিজের কাছে নিয়ে বিয়ের যৌতুক পূরণ করেন। ছেলেদের পড়াশুনার জন্য যদ্দুর করা যায়, করেছেন। ওরা ভালো করতে পারে নাই। ভালো ফলাফল করতে গেলে, অভাব থাকতে হয় তিনি সেই অভাবটা তাদের দিতে পারেন নাই।
এখন ভাবনাগুলো মাথায় এসে ছটফট করে! দোষটা আসলে তাঁর নিজের। ছেলেরা পড়ার মধ্যিখানে ঘোষণা দেয়, দেশ ছেড়ে বিদেশ যাবে। বড় বিদেশ ! বাবার মতো ছোট দেশে যেয়ে গাধা চড়ানো তাদের পোষাবে না। তারা পৃথিবীর নামকরা দেশে যাবে। অবশ্য তারা বড় দেশে যেতে পারেনি। ওসব দেশে যেতে শুধু বাবার-টাকা নয়, নিজের যোগ্যতাও লাগে ! যোগ্যতা বাবার- টাকা ক্ষয়ে কেনা যায় না।
ছেলেরা বিয়ের বয়সের আগেই নিজেদের পছন্দে ধুমধাম করে বিয়ে করেছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করেছে। মোহন মিয়াঁকে ধারদেনা করে টাকার যোগান দিতে হয়েছে। জীবনে বহুবার তাঁকে এই অবস্থার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। ভাইদের ব্যবসার টাকা যোগাতে, বোনদের বিয়ের সময়। ছোট বাড়িতে ভাইদের আলাদা সংসারের সংকুলান হয় না বলে নতুন বাড়ির জায়গা কিনতে-এরকম বহুবার ধারদেনায় ডুবেছেন!
বিয়ের পরপর ছুটিতে দেশে না ফিরে বাড়তি কাজ করে গেছেন, ধারকর্জ শোধ করতে।
ইদানীং মোহন মিয়াঁর বড়ো আফসোস হয়! নিজের জন্যে যতটুকু, বউটির জন্যে আরও বেশি।
প্রতি সপ্তাহে বউয়ের গুটিগুটি হাতের লেখায় লম্বা চওড়া একটা চিঠি পেতেন। যেদিন চিঠি হাতে পেতেন মনে হতো যেন মরুর বুকে সুখের অঝর ধারার বর্ষণ বয়ে গেল। চিঠিতে দুজনের স্বপ্নগুলো ঠাঁসা করে বোনা থাকত। স্বপ্ন বুনে রাখত বউটা তার শাড়ির ভাঁজে, আঁচলের ছোঁয়ায়। সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নরা ঝরে গেছে। মোহন মিয়াঁ তপ্ত বালুর নীচে যত্ন করে লুকিয়ে রাখা সেসব স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেন সময়ের ফেরে। বহুদিন পর সব হারিয়ে বসে বসে ভাবনাগুলোর জাবর কাটেন। মাঝে মাঝে মনে হয়- এবয়সে দেশে ফিরে বোধহয় মস্ত বড়ো ভুল করলেন। জীবনের বাকিকটা দিন মরুদেশে কাটিয়ে দিলে অন্তত দেশের মানুষগুলোর অবজ্ঞা থেকে বাঁচা যেত। সবাই যেমন তাঁর সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না, তিনি নিজেও তাদের সাথে মন খুলে মিশতে পারেন না। নিজে- বউ’য়ের সাথেও মন ভাগ করা কঠিন হয়ে উঠে। সবাই কেমন বদলে গেছে কিন্তু নিজের ভাবনাগুলো, সেই প্রথম বিদেশ যাত্রার সময়ে স্থির হয়ে আছে। মোহন মিয়াঁ ঘাঁটি গেঁড়ে বসে থাকেন। দুপুর গড়িয়ে সময় বিকেলে ঠেকে। বউটা দু’দুবার উঠার তাগাদা দিয়ে যায়। কিন্তু সে আম গাছটার মতো স্থির হয়ে বসে থাকে।
তাঁর শরীর কাহিল হয়েছে কেউ টের পায় না। অবশ্য তাঁকে নিয়ে কেউ ভাবনায় নেই বলে তিনি সবার নজরহীন রয়ে যান। তিনি নিজেও অবশ্য নিজের যত্ন করেন নাই। প্রায় চল্লিশ বছর মরুভূমিতে একটানা কাজ করে গেছেন। শরীরে নানা রোগ ব্যামো বাসা বেঁধেছে। শরীরের উপর জুলুম করে খেটে গেছেন। শেষের দিকে শরীর আর কুলাতে পারে নাই। একদিন কাজে জ্ঞান হারান এবং পরদিন তাঁকে উদ্ধার করে হসপিটালে নেয়া হলে কর্কট রোগ ধরা পড়ে! মালিকপক্ষ তাঁকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। নিরুপায় মোহন মিয়াঁ দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হন!
***********************************************