ওরা ফেরেনি কেউ
বিচিত্রা সেন
কিস্তি-৭
১৩.
ঘোষবাড়ির অন্দরমহলে বড়মার কক্ষে এখন প্রতি সন্ধ্যায় শ্যামাসঙ্গীতের আসর বসে। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীতও হয়। আদিত্য তার সুমিষ্ঠ কন্ঠ দিযে সবার মন জয় করে নিয়েছে এ কয়দিনেই। বড়মার পুত্রবধুরাও তাকে খুব আদর করে। তাঁদেরকে সে বড় ঠাকুরমা, মেঝ ঠাকুরমা, ছোট ঠাকুরমা বলে ডাকে। বড় ঠাকুরমার পুত্রবধুকে সে বড় কাকী বলে ডাকে। এই বড়কাকী আদিত্যকে খুব স্নেহ করেন। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। তারা সবাই কলকাতায় থেকে লেখাপড়া করে। তাদের কারো সাথে এখনো পর্যন্ত আদিত্যের দেখা হয়নি। মেঝ ঠাকুরমার পুত্রবধু মেঝ কাকীর তিন ছেলে এখানেই থাকে। তাদের সাথে মাঝে মাঝে তার দেখা হয়, কথাও হয় এক আধটু। ছোটো ঠাকুরমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। গত একমাসে একতটুকুই জেনেছে আদিত্য। এর মধ্যে বড় ঠাকুরমার পোর্ট্টেট করে সে ঘোষবাড়িতে ভীষণ সাড়া ফেলে দিয়েছে। সবাই এখন তার পিছু লেগেছে যার যার পোর্ট্টেট করিয়ে নিতে। সময়টা বেশ ভালোই কাটছে আদিত্যের। তবে মাসে দুবার বাড়ি গিয়ে সে মা-ঠাকুরমাকে দেখে আসে। দেখতে দেখতে আদিত্য বি.এ. পাশও করে ফেলে। সে ঠিক করে ফেলে শহরেই সে চাকরি করবে। মা-ঠাকুরমাও সম্মতি দেন।
এর মধ্যে ঘোষবাড়িতে অতিথিশালার পাশে গড়ে তোলা হয় মেস। এক লাইনে আটটি রুম বানিয়ে প্রতিটি রুমে চারটি করে চৌকি পাতা হয়। তাদের জন আলাদা রান্নাঘরও তৈরি হয়। হুহু করে প্রতিটি চৌকি ভাড়া হয়ে যায়। আদিত্যও ওখান থেকে একটা চৌকি মাসভিত্তিক ভাড়া নেয়। লেখাপড়ার পাঠ চুকে গেলেও এ বাড়িটা তার ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আবার অতিথিশালায় থাকতেও তার সংকোচ হচ্ছিল। তাই সে মেসে গিয়ে ওঠে। অতিথিশালার আরও কয়েকজন মেসে ওঠে। মায়ের থেকে টাকা নিয়ে আদিত্য একটা হারমোনিয়াম কিনে ফেলে। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি চিত্রকলাটাকে ও সে গুরুত্বের সাথে নেয়।
এর মধ্যে একদিন বন্ধু অনিল এসে খবর দেয় রেলওয়েতে লোক নিচ্ছে। দু’বন্ধু ওখানে আবেদন করে। কয়েকমাস ধরে চলে নানা প্রক্রিয়া। অবশেষে রেলওয়েতে আদিত্য এবং অনিলের চাকরিটা হয়েই যায়। নিয়োগপত্র পেয়ে আদিত্য ছুটে যায় তার গ্রামের বাড়িতে।
সন্ধ্যাবাতিটা দিয়ে মনিবালা শাশুড়ির হাতে-পায়ে-বুকে সরিষার তেল গরম করে মালিশ করছিল। এমন সময় আদিত্য ‘মা’ ‘মা’ চিৎকার করতে করতে ঘরে ঢোকে। নাতির কন্ঠ শুনে আদিত্যের ঠাকুরমার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তখনো গ্রামের বাড়িতে সদর দরজা বন্ধ করে রাখার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। তাই আদিত্য বিনা বাধায় ঘরে ঢুকে পড়তে পেরেছিল। মনিবালা এই ভরসন্ধ্যায় ছেলেকে দেখে খুব অবাক হয়। বলে,
-ও মা, তুই? এন সন্ধ্যার সময় তুই কোত্থুন? আদিত্য হেসে বলে,
-ভালা খবর দিতাম আইশশি অ মা।
তারপর মায়ের হাতে সে নিয়োগপত্রটা তুলে দেয়। মনিবালার চোখ উজ্জ্বল হয়। ঠাকুরমাও শোয়া থেকে উঠে বসেন। মনিবালা নিয়োগপত্রটা হাতে নিয়ে স্বামীর ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,
-অনে দেখ্তন্ না? অনর ফোয়ার সরকারি চরি হইয়ে। অনে আশীর্বাদ হরিবাক অনর ফোয়ার লাই।
মায়ের দেখাদেখি আদিত্যও বাবার ছবির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। মায়ের কথা শেষ হলে সে বাবার ছবিতে নমস্কার দেয়। তারপর আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলে,
-অ বাবা, অনে আঁরে আশীর্বাদ হরিবাক্।
সেদিন রাতে নন্দলালের ঘরে যেন অনেকদিন পর উৎসব লাগে। আদিত্যের সরকারি চাকরি হয়েছে শুনে জ্ঞাতিরা এসে ভিড় করে। আদিত্যের ঠাকুরমা সবাইকে তারপর দিন দুপুরে ভাতের নিমন্ত্রণ দেয়।
আদিত্যের মা ঠাকুরমা দুজনেই যদিও নিরামিষ খায়, তবুও জ্ঞাতিদের জন্য রাঁধুনি ডেকে এনে মাছের ব্যবস্থা করা হয়। সবাই খেয়ে প্রাণভরে আদিত্যের জন্য আশীর্বাদ করে। বাড়িতে দুদিন থেকে আদিত্য আবার শহরে ফিরে আসে।
ঘোষবাড়িতে এসেই সে সোজা চলে যায় বড়মার কক্ষে। আদিত্যকে দেখে খুব খুশি হন তিনি। আদিত্য তাঁকে প্রণাম করলে তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন। আদিত্য তাঁর পাশে বসে। তারপর চোখমুখ উজ্জ্বল করে তাঁকে খুশির খবরটা দেয়। বলে,
-বড় মা, আঁর সরকারি চরি হইয়ে।
শুনে বড়মার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বলেন,
-কী হস্ তুই? তোর সরকারি চরি হইয়ে? আঁত্তে বড়্ খুশি লাগের।
বড়মার দেখাশোনা করে যে মেয়েটি, সে এসে আদিত্যকে দুটো মিষ্টি ও এক গ্লাস জল দিয়ে যায়। আদিত্য নিঃসংকোচে খায়। তারপর কিছুক্ষণ গল্প করে মেসে ফিরে আসে। এক সপ্তাহ পরে সে চাকুরিতে যোগ দেয়।
চাকরিটা আদিত্যের ভালোই লাগছে। তবে এখনো সে সন্ধ্যায় বড়মাকে শ্যামাসঙ্গীত শোনায়। বড়মার ¯েœহটা সে বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারে। গান শোনানোর পর বড়মা তাকে কখনো খালি মুখে আসতে দেয় না। প্রতিদিন তাকে কিছু না কিছু খেতে দেবেই। সেদিনও সে বড়মাকে গান শুনিয়ে মুড়ির মোয়া খেয়ে চলে আসছিলো, ঠিক তখন বড়মা বললেন,
-অ বাজি, ইক্খিনি বোই্।
বলে তিনি, ‘মালবিকা’, ‘মালবিকা’ বলে ডাকতে লাগলেন। এ বাড়িতে এ নামটি আজ প্রথম শুনলো আদিত্য। কে এই মালবিকতা? আগে তো কখনে এ নামে কাউকে বড়মা ডাকেনি। একটু পরই এক তরুনী এসে ঢুকলো বড়মার রুমে। বয়স সতেরো/আঠারো হবে। অপূর্ব সুন্দরী সে। গায়ের রঙ একেবারে হলুদ। কোমার পর্যন্ত ঘন কালো চুল। কালো চোখ এবং ভ্রুতে সে অনিন্দ্যা। আদিত্য মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। মেয়েটি আদিত্যের দিকে একপলক তাকিয়ে বড়মার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমায় ডেকেছো বড়মা?
কন্ঠস্বর তো নয়, যেন পিয়ানো সুর তুললো। এত সুন্দর করে কেউ কথা বলতে পারে? বড়মা হেসে বললেন,
-অ, তোরে ডাইক্কি যে আদিত্যের অঙ্গে পরিচয় হরাইতাম।
মালবিকা আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমার নাম মালবিকা ঘোষ। কলকাতায় থাকি। উচ্চ মাধ্যমিক দিলাম এবার।
আদিত্য বিহ্বলতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু মেয়েটির সপ্রতিভতা তাকে লজ্জায় ফেলে দিলো। কোনোরকমে লজ্জার ভাব কাটিয়ে সে হাত জোড় করে বললো,
-আমি আদিত্য নারায়ন চৌধুরী। রেলওয়েতে ছোটখাটো একটা চাকরি করি। আপনাদের কথা শুনেছিলাম, তবে আজ প্রথম দেখলাম।
মালবিকা মিষ্টি করে হাসলো। আদিত্য ভাবলো মানুষ এত সুন্দর করে হাসতে পারে? মালবিকা বললো,
-আপনার কথাও আমি কলকাতায় থাকতে শুনেছিলাম। আপনি নাকি প্রতি সন্ধ্যায় বড়মাকে গান শোনান। আজ আমিও শুনলাম। বেশ ভালো আপনার গলা।
আদিত্য লজ্জা পেয়ে বললো,
-আরে না, না, তেমন কিছু না। আমি শিল্পী নই। বড়মা পছন্দ করেন বলে এখানে এসে গাই।
মালবিকা হেসে বললো,
-শুনলাম তো আজ। বেশ ভালোই তো গান দেখলাম।
আদিত্য এবার উঠে দাঁড়ালো। বললো,
-আমাকে এবার যেতে হবে। আসি।
মালবিকা হাত জোড় করে নমস্কার জানালো। বললো,
-কাল তো আবার আসবেন।
আদিত্য মাথা নেড়ে বললো,
-আসবো।
আদিত্য বেরিয়ে গেলে বড়মা মালবিকার দিকে তাকিয়ে বললো,
-কী রে, আদিত্যরে ক্যান লাইগ্গি তোর?
-মালবিকা স্বাভাবিকভাবেই বললো,
-ভালো তো।
এরপর দুজনে নানা আলাপে মেতে উঠলো। ওদের আলাপটা বেশ মজার। একজন চট্টগ্রামের আ লিক ভাষায় কথা বলে, আরেকজন কলকাতায় থাকার কারণে প্রমিত বাংলায় কথা বলে। তবে দুজনেই দুজনের ভাষা বোঝে। তাই কথা বলতে কোনো অসুবিধা হয় না। দুজনের আলাপে আজ নানা বিষয় স্থান পেলেও ঘুরে ফিরে বার বার আদিত্যের কথাই আসে বেশি।
বড়মার ঘর থেকে মেসে ফিরে আদিত্য তার নির্ধারিত চৌকিতে শুয়ে পড়ে। আজ কেমন যেন অস্থির লাগছে তার। মালবিকা মেয়েটা যেমন সুন্দর, তেমন মিষ্টভাষী। কী সুন্দর করে কথা বলে বইয়ের ভাষায়। আদিত্য যদিও তার সাথে সেই ভাষাতেই কথা বলেছে, তারপরও তার কন্ঠটা কেমন বেসুরো লাগছিল নিজের কানে। নিজেকে শাসন করতে চায় আদিত্য। মনকে বলে, খবরদার আদিত্য, মালবিকাকে নিয়ে ভাবতে যাবি না। এতে বিপদ হতে পারে। কিন্তু মন অবাধ্য স্বরে জবাব দেয়, কেন, ভাববো না কেন? মালবিকাদের চেয়ে আদিত্যরা কি কোনো অংশে কম। পার্থক্য শুধু একটাই। মালবিকাদের প্রতিপত্তি শহরে, আর আদিত্যদের প্রতিপত্তি গ্রামে। মালবিকার কথা ভাবতে ভাবতে আদিত্য সে রাতে ঘুমিয়েই পড়ে। রাতের খাওয়া আর হয় না।
ঘোষবাড়ির বড়মার মাথায় ইদানিং একটা বুদ্ধি এসেছে। মালবিকাকে তিনি আর কলকাতায় যেতে দিতে চান না। মেয়ের আঠারো বছর চলছে। এবার ওর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে কলকাতায় পড়–য়া মেয়ে। যাকে তাকে তো আর বিয়ে দেওয়া যাবে না। এমন ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে যে মালবিকার মূল্য বুঝবে। আদিত্যকে তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো তাঁর নাতিরা এবং নাতবউরা হয়তো গ্রামে বিয়ে দিতে চাইবে না। তাছাড়া কলকাতায় পড়–য়া মেয়ে গ্রামে গিয়ে হয়তো নিজেকে মানাতেও পারবে না। কিন্তু আদিত্যকে তিনি যেমনটা চিনেছেন, এ ছেলে মালবিকাকে মাথায় তুলে রাখবে। ছেলেটা উঁচু বংশের ছেলে, লেখাপড়াও জানে। সরকারি চাকুরিও করে। গ্রামেও খোঁজ নিয়েছেন তিনি। বেশ সহায়সম্পত্তি আছে। শুধু একটাই সমস্যা মালবিকাকে গ্রামে যেতে হবে। কারণ আদিত্যের সাথে কথা বলে তিনি যা বুঝেছেন, বউকে সে মা-ঠাকুরমার কাছেই রাখবে। পরে হয়তো কোনো এক সময় শহরে আনবে। আগে মালবিকার মতটা নিতে হবে। মালবিকা যদি রাজি থাকে, তবে তিনি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও এ বিয়ে দেবেনই। যেই ভাবা, সেই কাজ। তিনি ‘মালবিকা’ ‘মালবিকা’ বলে চিৎকার শুরু করলেন। চিৎকার শুনে মালবিকা ছুটে আসলো। উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-কী হয়েছে বড়মা? এভাবে ডাকছো কেন?
বড়মা মুখটা গম্ভীর করে বললেন,
-তোর অঙ্গেঁ আঁর হতা আছে। বোই।
মালবিকা বড়মার এমন গম্ভীর মুখ দেখে ঘাবড়ে গেলো। কাঁপা স্বরে বললো,
-কী কথা বড়মা?
বড়মা গম্ভীর স্বরে বললেন,
-সত্যি করে হ আদিত্যরে তোর তে ক্যান লাইগ্গি?
আচমকা এ প্রশ্ন শুনে মালবিকা সত্যি খুব অবাক হলো। বললো,
-ভালো তো। ভদ্র ছেলে।
বড়মা কোনো ভনিতা না করে এবার সরাসরি বললেন,
-আঁই যদি তোর অঙ্গে আদিত্যর বিয়া ঠিক করি, তুই রাজি হইবি না?
এমন সরাসরি প্রশ্নের মালবিকা সত্যি সত্যি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। আদিত্যকে সে দেখেছে মাত্র কয়েকদিন। ছেলে হিসেবে খুব ভালো বোঝা যায়। ভালো গায়, ভালো আঁকে। সরকারি চাকরি করে। পরিবারে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু তাই বলে তাকে বিয়ে করা যায় কিনা এমনটা তেতো সে ভাবেনি। তাছাড়া আদিত্যের পরিবার থাকে গ্রামে। সে দুয়েকবার বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে গ্রামে গিয়েছে ঠিকই। তবে দুতিনদিনের বেশি থাকেনি। কিন্তু আদিত্যকে বিয়ে করলে তাকে তো গ্রামে থাকতে হবে। এটা তো সে পারবে না। তাই সে বড়মার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলো। বড়মার চুল তো আর এমনি পাকেনি। তিনি বুঝতে পারলেন মালবিকা কী ভাবছে। মালবিকার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তিনি বললেন,
-আঁই বুইজ্ছি তুই কী চিন্তা হর্র? গ্রামত্ থাকিত্ ফারিবি না ভার্ব। ফয়লা হয়েক বছর থাকিবি যে এরি, ইতার পর আঁই আদিত্যরে হোইয়া রে তোরে শহরত লোই আইশ্শুম্।
মালবিকা তবু কিছু বলে না, তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে গ্রামের চিন্তাটা। আদিত্য যত ভালো ছেলেই হোক তার পক্ষে গ্রামে থাকা সম্ভব না। তাছাড়া কলকাতায় থাকতে থাকতে সে এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, চট্টগ্রাম শহরের এই বাড়িও তার ভালো লাগে না। কলকাতায় তার ভাইয়েরা বোর্ডিং স্কুলে পড়লেও সে থাকে মামার বাসায়। মামা সরকারি বড় অফিসার। কী সুন্দর বাংলো তার। মামাদের বাসায় নানা উপলক্ষে পার্টি লেগেই থাকে। তার মামী অতি আধুনিকা। তাই নিজের মেয়ে দুটোকে যেমন খুব সৌখিনভাবে চালায়, মালবিকাকেও একইভাবে চলতে হয়। ওই বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। ঘরে সব সৌখিন জিনিসপত্র। ওরকম একটি পরিবেশে থাকতে থাকতে মালবিকা এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এখন এ বাড়িতে আসলে তার সবকিছু বিরক্ত লাগে। সে জায়গায় সে গ্রামে গিয়ে থাকবে কী করে?
মালবিকাকে চুপ থাকতে দেখে বড়মা একটু অসন্তুষ্ট হন। মুখ কালো করে বলেন,
-তুই যদি গ্রামত থাকনরে এত ডরাস, তাইলে ঠকিবি। শহরত থাকোন্না ফোয়া হয়তো ফাইবি, কিন্তু আদিত্যর মতো ভালো ফোয়া ন ফাইবি।
বড়মার কথা শুনে মালবিকা দ্বিধায় ভোগে। মনে হয়, বড়মা যা বলছে তা তো সত্যও হতে পারে। ছেলেটাই যদি যোগ্য না হয়, তবে শহরে থেকে সে কি সুখী হতে পারবে? সে বড়মার দিকে তাকিয়ে বলে,
-ঠিক আছে, আমাকে দুদিন সময় দাও বড়মা। আমি একটু ভেবে বলি।
বড়মা বুদ্ধিমতী। মালবিকার সময় চাওয়াতে তিনি বুঝতে পারেন আদিত্য একেবারে বাতিলের খাতায় যায়নি। তাই হেসে বলেন,
-ঠিক আছে, তুই সময় লোইয়ারে হ।
সেদিনের মতো আলাপ আর জমে না। একটু পর মালবিকা উঠে চলে যায়।
সেদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে ফিরে আদিত্য চরম অস্থিরতায় ভোগে। একটু পরে সে রড়মাকে গান শোনাতে যাবে। আগে বড়মা শুধু শ্যামাসঙ্গীত শুনতো। এখন সব ধরনের গাইন শুনতে চান। তাই সে একটা ছোট ট্রানজিস্টার কিনে নিয়েছে। সময় পেলে ওটা চালিয়ে নতুন নতুন গান শিখে নেয় সে। গান শুনে বড়মা খুব খুশি হন। কিন্তু আজকের সমস্যাটা সে কারণে নয়। এ কয়দিনে মালবিকার সাথে তার প্রতিদিন দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে। মেয়েটি তাকে মোহগ্রস্থ করে রেখেছে। সারাক্ষণ তারই ভাবনাতে আচ্ছন্ন থাকে সে। সে ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে পোর্ট্টেটে। গত দুদিনে সে একটা মালবিকার পোর্ট্টেট করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো এই পোর্ট্টেটটা মালবিকাকে দেওয়া ঠিক হবে কিনা সে তা বুঝে উঠতে পারছে না। তার এই অস্থিরতা খেয়াল করলো রুমমেট রাখালবাবু। তিনি কৌতুহল মিশ্রিত স্বরে হেসে বললেন,
-কী ব্যাপার, আদিত্য বাবু? এত অস্থির হইয়া আছেন ক্যান?
রাখালবাবু কুমিল্লার লোক। তিনি জেটিতে কাজ করেন। আদিত্যরা একরুমে যে চারজন থাকে, তিনি তাদেরই একজন। রাখাল বাবুর কথা শুনে আদিত্য দ্বিধায় পড়লো। কথাটা কি রাখালবাবুকে বলা যায়? বললে উনি আবার পাঁচ কান করবেন না তো? একটু ভেবে সে না বলারই সিদ্ধান্ত নেয়। একটু চালাকি করে সে। বলে,
-অফিসের একটা ঝামেলা নিয়ে ভাবছিলাম।
রাখালবাবু বলেন,
-আমারে কি কওন যায় কী ঝামেলা?
আদিত্য মাথা নেড়ে বলে,
-দুদিন দেখি, তারপর বলবো।
তারপর মনের সমস্ত দ্বিধাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কাগজে মোড়ানো পোর্ট্টেটটা নিয়ে সে বড়মার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
১৪.
ঘোষবাড়িতে আজকের সন্ধ্যায় বড়মার ঘরে একটা হুলস্থূল পড়ে গিয়েছে। আদিত্য মালবিকার একটা পোর্ট্টেট এঁকেছে। সেটা দেখতেই এত ভিড়। এতদিন ধরে কতজনই আদিত্যের কাছে আবদার করেছিল তাদের একটা পোর্ট্টেটের জন্য। আঁকবো আঁকবো করে সে কারো পোর্ট্টেট করে দেয়নি। অথচ কয়েকদিন হলো মালবিকা এসেছে। আর এরই মধ্যে তার পোর্ট্টেট হয়ে গেলো। এ নিয়ে একটু কানাঘুষাও চলছিল।
কিন্তু মালবিকার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পোট্টেটটার দিকে। মানুষ সত্যি এক ভালো আঁকতে পারে! বড়মা কিন্তু খুব খুশি। আজ বড়মার রুমে পুত্রবধূ এবং নাত বউরাও ভিড় করেছে। এবার বড়মা সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
-এবার তোঁয়ারা যার যার ঘরত য। আঁর ঘর খালি হোরি দেও।
বড়মার আদেশ অমান্য করার সাহস ঘোষবাড়িতে কারো নেই। সবাই একে একে বেরিয়ে যায়। মালবিকাও বেরিয়ে যায়। ঘরে এখন আদিত্য আর বড়মা।
আদিত্য সংকোচের সাথে বলে,
-বড়মা, অর্নতে পছন্দ হইয়ে না ছবি ইবা?
বড়মা রহস্য করে বলেন,
-ছবি তো আঁরতে পছন্দ হোইয়ে। কিন্তু এত মানুষ থাকতে তুঁই আঁর মালবিকার ছবি ক্যায়া আঁইক্কু? হিতিরে তোঁয়ার বেশি পছন্দ হোইয়ে নাকি
আদিত্য লজ্জা পেয়ে কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে থাকে। আদিত্যের এই লজ্জাবনত মুখ দেখে বড়মা যা বোঝার বুঝে নেন।
তারপর হেসে বলেন,
-আইচ্ছা, চাই, তোঁয়ার লাই আঁই কী হোরিত্ ফারি?
আজকে আর আদিত্যের গান শোনানো হয় না। কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে গল্প করে সে ঘোষবাড়ির অন্ত:পুর থেকে বেরিয়ে আসে। মেসে ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেলে দেখা যায় ঘুম তার চোখ থেকে পালিয়েছে। সারারাত দুচোখের পাতায় মালবিকা এসে ভর করে।
আদিত্য ছবিটা দিয়ে যাওয়ার পর সে রাতে যার যার স্ত্রীর সুবাদে পুরুষরা খবরটি পেয়ে যায় এনিয়ে একটা অসন্তোষও দানা বাঁধে। বিষয়টি টের পেতে বড়মার দেরি হয় না। তাই পরদিন চাকর মারফত আদিত্যকে আসতে বারণ করে সেই সন্ধ্যায় তিনি বাড়ির পুরুষদেরকে নিজের রুমে ডাকেন। বড়মার আদেশ অমান্য করার সাধ্য কারো নেই। তাই সবাই যার যার কাজ সেরে, কিংবা বাকি রেখে সন্ধ্যায় বড়মার রুমে এসে হাজির হয়। বড়মা কোনো ভনিতা ছাড়াই শুরু করেন। বলেন,
-তোরা বলে বেগ্গুনে আদিত্যর র্উ খেপি আছশ্? হিতি মালবিকার ছবি আঁকি এন্ কী অপরাধ হর্ইগে যে? আঁর ছবিও তো হিতি আঁইক্কি।
মালবিকার কল্যানীর বাবা বড়মার বড় নাতি বলেন,
-তোঁয়ার ছবি আর মালবিকার ছবি এক হইলো না? তুঁই বুড়া মানুষ, তোঁয়ার ছবি আঁকিত্ পারে। কিন্তু মালবিকার ছবি কিল্লাই আঁকিবু?
মালবিকার দুইকাকুও এই কথায় সায় দেয়। বড়মা মুখ গম্ভীর করে ফেলেন। তারপর কঠিন স্বরে ঘোষণা দেন-
-আঁই তো অন্যরকম ভার্বি। আদিত্যরে আঁর খুব পছন্দ। আঁই ঠিক হোইরগি মালবিকারে আঁই আদিত্যর হাতত্ তুলি দিইয়ুম। তোরা আপত্তি হোইরলেও আঁই হুনতাম ন।
মালবিকার বাবা আঁতকে ওঠেন। বলেন,
-তুঁই ইয়িন্ কী র্হ যে? আঁর মাইয়ারে আঁই গ্রামত বিয়া দিয়ুম না? গ্রামত থাকিবার লাইনা আঁর মাইয়ারে আঁই কোলকাতাত্ রাখি ফরাই?
বড়মা স্বরকে আরও কঠিন করে ফেলেন। বলেন,
-মাইয়ারে কোলকাতাত্ রাইক্খু, শিক্ষিত হোইরগু ভালা হতা, কিন্তু মাইয়ারে বিয়া দেওন ফরিবু যে ভালা ফোয়া চাই। আদিত্য বড়্ ভালা ফোয়া। হিতি সরকারি চরি হরে। ঠিকই একসমত্ শহরত্ লোই আইবু বউ।
বড়মা এ সংসারের কর্ত্রী। বড় বাবা বেঁচে থাকতেই তাঁকে এ সম্মান দিয়ে গেছেন। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই চূড়ান্ত। মালবিকার বাবা-কাকারা বুঝলেন বড়মা যখন বলেছেন তখন এ বিয়ে হবেই। এর অন্যথা হলে হয়তো বড়মা কাশীতে চলে যাওয়ার জিদ ধরবেন। তাই আর তর্কে জড়ালেন না তাঁরা। শুধু মালবিকার ছোটকাকু বললেন,
-মালবিকা রাজি আছে না এ বিয়াত্?
বড়মা দৃপ্তস্বরে বললেন,
-হিতিরে রাজি হরানোর ভার আঁর উদ্দি ছাড়ি দে।
রুমের মধ্যে বাড়ির পুরুষদের নিয়ে বড়মা কথা বললেও রুমের বাইরে তাঁদের স্ত্রীরা কান পেতে ছিলেন। বড়মার শেষ সিদ্ধান্ত শুনে সবাই বুঝে ফেললেন মালবিকার এ বিয়ে হবেই। এবার তাঁরা যার যার রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
মালবিকার মা সোজা চলে গেলেন মালবিকার রুমে। মালবিকা তখন কুশি কাঁটায় একটা রুমাল বানাচ্ছিল।
মাকে ঢুকতে দেখে সে মায়ের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। মায়ের মুখ ঘোর অন্ধকার। মালবিকা বললো,
-কী হয়েছে মা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
মায়ের চোখে জল টলমল করছে। কলকাতায় রেখে তিনি যে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, সেই মেয়েকে ঠাকুরমার নির্দেশে গ্রামে পাঠাতে হবে? এই মেয়ে কি কখনো গ্রামে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? মাকে চুপ দেখে মালবিকা আবার বললো,
-মা, বলো না কী হয়েছে?
মালবিকার মা মেয়ের সাথে প্রমিত বাংলাতেই কথা বলেন,
তাঁর বাবার পরিবার কলকাতায় চলে যাওয়াতে তাঁর সবসময় ওখানে যাওয়া আসা আছে। মেয়ের আকুলতা দেখে তিনি বললেন,
-ঠাকুরমা মানে তোর বড়মার কথা বলছি। হুট করে একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। আমাদেরকে একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করলেন না।
মালবিকার ভ্রু কুঁচকে গেলো। মাকে এত আবেগী কখনো দেখেনি সে। মা যেন কান্না চেপে অনেক কষ্টে কথা বলছেন। মায়ের এমন রূপ দেখে তার বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠলো। মায়ের হাত ধরে খাটের ওপর বসালো সে। তারপর মায়ের হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললো,
-তুমি ঠান্ডা মাথায় আমাকে বলো তো বড়মা কী বলেছেন?
মালবিকার এ কথায় মা ঢুকড়ে কেঁদে উঠলেন। বললেন,
-তোর বড়মা ঠিক করেছে আদিত্যের সাথে তোর বিয়ে দেবে। আদিত্য ছেলে হিসেবে ভালো সেটা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু ওর পরিবার তো গ্রামে থাকে। তুই কখনো গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবি?
মালবিকা থমকে যায় মায়ের প্রশ্নে। বড়মা বলার পর থেকে সে এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল। বিশেষ করে ওইদিন তার পোর্ট্টেটটা পাওয়ার পর থেকে আদিত্যের প্রতি তার কেমন একটা টান অনুভব করছিল। তবে বিয়ের ব্যাপারটি যে আজ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে সে এতটা ভাবতে পারেনি। এখন মায়ের সরাসরি প্রশ্নে সে মাথা নিচু করে ফেল্লো। কথায বলে মায়ের চোখ সবজান্তা। মেয়ের মাথা নিচু করে থাকার ধরণে মা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। বললেন,
-কী রে, তুই মনে হয় এই বিয়েতে রাজি?
মালবিকা কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তাই সে চুপ করেই রইলো। মা বললেন,
-তুই গ্রামে গিয়ে থাকতে পরবি?
মালবিকা এবার চোখ তুললো। মায়ের চোখে চোখ রেখে বললো,
-আমি এ বিয়েতে রাজি না হলে বড়মা খুব কষ্ট পাবেন। রাগ করে তিনি হয়তো কাশীতেই চলে যাবেন। সংসারে অনেক অশান্তি হবে মা।
মা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুঝলেন, মেয়ে আদিত্যতে ডুবেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন,
-তুই রাজি থাকলে তো আর কোনো চিন্তা নেই। আমি তাহলে এত ভাবছি কেন? তাহলে বিয়ের আয়োজন শুরু হোক।
বলেই মা রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মালবিকা মায়ের চলে যাওয়া দেখে ভাবতে লাগলো কাজটা কি সে ঠিক করলো? সে কি আসলেই পারবে গ্রামে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে?
এদিকে বিয়ে নিয়ে যে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে তার কিছুই জানে না আদিত্য। বড়মা চাকর পাঠিয়ে তাকে নিষেধ করেছিল তাঁর রুমে যেতে। এরপর দুদিনে সে ইচ্ছে করেই যায়নি। ৪র্থ দিন সেই চাকরটাই আবার এসে খবর দিল বড়মা তাকে ডেকেছে। কথাটা শোনার পর থেকেই বুকটা কেমন দুরুদুরু করে কাঁপছে আদিত্যের। শুধু মনে হচ্ছে বড়মা তাকে এ তিনদিন ডাকেননি কেন? একবার মনে হচ্ছে বড়মা হয়তো অসুস্থ ছিল, আবার মনে হচ্ছে, না, অসুস্থতা না, অন্যকিছু ঘটেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই সে বড়মার রুমের দিকে রওয়ানা দিলো।
রুমে ঢুকতেই বড়মা হেসে তাকে সম্ভাষণ জানালেন, বললেন,
-কী রে, বাজি, ক্যান আছো তুঁই?
আদিত্য হেসে বললো,
-ভালা আছি বড়মা, অনে ক্যান্ আছোন্?
বড়মা বললেন,
-আঁইও ভালা আছি। তোঁয়ারে ডাক্কি যে আজুবা গানর লাই ন। একখান জরুরী হতা হোইর্বা লাই।
আদিত্যের বুকটা আবারও ধুপ্ধুপ্ করে উঠলো। তবে উপরে সেটা প্রকাশ করলো না। গলাকে খুব স্বাভাবিক করেই বললো,
-কী হতা বড়মা?
বড়মা কোনো ভণিতায় গেলেন না। একেবারে সরাসরিই বললেন,
-আঁই তোয়ার হাতত্ মালবিকারে তুলি দিতাম চাইর। তুঁই রাজি আছ না?
আচমকা এমন প্রস্তাব পেয়ে আদিত্য প্রথমে কোনো কথাই বলতে পারলো না। তারপর কাঁপা গলায় বললো,
-মালবিকা এ বিয়াত্ রাজি আছে না? আসলে বড়মা আঁর বর্উতে তো গ্রামত থাকন ফড়িবু। মালবিকা ফারিবু না?
বড়মা গম্ভীর স্বরে বললেন,
-কষ্ট হইলেও থাকন্ তো ফরিবু। পরে একসময তুঁই হিতিরি শহরত্ লই আইবা যে এরি।
আদিত্য একটু চুপ থেকে বললো,
-আঁই আঁর মা-ঠাকুরমারে আগে জানাই।
বড়মা বললেন,
-ঠিক আছে, তুঁই তোইলে আগে হিতারার মত ল।
এরপর কথা আর বেশি এগুলো না। গানও আর গাওয়া হলো না। একটু পরই আদিত্য নিজের মেসে ফিরে আসলো।
পরদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। বাড়িতে যখন পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ছেলেকে দেখে তো মনিবালা খুব অবাক। কিন্তু ঘরে ঢুকে ঠাকুরমার অবস্থা দেখে আদিত্যের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ঠাকুরমা খুব অসুস্থ। খুব কাশি, জ্বর তো আছেই। সেই সাথে পেটে তীব্র ব্যথা। আদিত্যদের গ্রামের একটা ছেলে ডাক্তার হয়ে এখন গ্রামেই বসে। তার নাম বেশ ছড়িযে পড়েছে। খুব ভালো চিকিৎসা করে নাকি সে। আদিত্য গিয়ে তাকে ডেকে আনলো। রোগীর অবস্থা দেখে যোগেশ ডাক্তারের মুখ কালো হয়ে গেলো। ঔষধ সে দিলো ঠিকই, কিন্তু আশা দিতে পারলো না। সে রাতে কেউ ঘুমাতে পারলো না ঠাকুরমার ছটফটানিতে। পরদিন বিকেলে সমস্ত জ্বালা যন্ত্রনার অবস্থান ঘটিয়ে নন্দলালের মা পৃথিবীর মায়া ছাড়লেন। আদিত্যই মুখাগ্নি করলো। যে কথা বলার জন্য সে বাড়ি এসেছিল সে কথা আর বলা হলো না।
অফিসে দরখাস্ত পোস্ট করে একেবারে ঠাকুরমার শ্রাদ্ধ শেষ করে সতেরোদিন পরে সে শহরে ফিরলো। অফিসে দরখাস্ত পোস্ট করার সময় ঘোষবাড়ির ঠিকানাতে বড়মার কাছেও সে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। বড়মা পড়তে না পারলেও কেউ না কেউ তাঁকে নিশ্চয় এ চিঠি শুনিয়েছে। মেসে ফিরে সন্ধ্যায় সে বড়মার সাথে দেখা করতে গেলো। বড়মা সংবাদটা শুনেছে। মালবিকা তাঁকে চিঠি পড়ে শুনিয়েছে। বড়মা বললেন,
-মন খারাপ ন হোইরগু। বেগ্গুনত্তে একদিন যন ফড়িবু।
আদিত্য মাথা নিচে করে বসে রইলো। একটা জিনিস খেয়াল করেছে সে, মালবিকা এখন আর এ ঘরে আসে না। তবে কি মালবিকা, আদিত্যকে পছন্দ করে না, নাহলে এমন একটা দুঃসংবাদেও মালবিকা একটিবারও এ ঘরে এলো না কেন? আদিত্যের মন খারাপ দেখে বড়মা হঠাৎ বলে উঠলেন,
-বোত্দিন তোঁয়ার গান না হুনি। আজুবা উগ্গা গান গ চাই।
আদিত্য কেমন যেন এক খেয়ালে ছিল। বড়মা বলার সাথে সাথে শুরু করলো একটা নজরুল গীতি। রেডিও থেকে যে গান সে শিখেছিল। খুব দরদ দিয়ে সে শুরুল করলো “তোমার আকাশে এসেছিনু হায আমি কলঙ্কি চাঁদ, দূর হতে শুধু ভালোবেসেছিনু সে তো নহে অপরাধ”। চোখ বন্ধ করেই গাইছিলো সে। যখন গান শেষ হলো তখন অনেকগুলো হাতের তালিতে তার চোখ খুলে গেলো। অবাক হয়ে সে দেখলো ঘোষবাড়ির নারীরা সব ভিড় করেছে এ ঘরে। তাদের মধ্যে মালবিকাও আছে মালবিকার মা, ঠাকুরমাও আছে। সবার করতালিতে আদিত্য সত্যি লজ্জা পেলো। সবাই খুব প্রশংসা করতে লাগলো। আদিত্য বড়মার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আঁই তইলে এবার যাই বড়মা।
বড়মা বললেন,
-কালুবা আবার আইশ্শু।
বড়মার রুম থেকে মেসে ফিরে আদিত্য ভাবলো মাকে চিঠি লিখেই মালবিকার কথা জানাবে। সত্যি সত্যি সব কথা জানিয়ে সে একটা চিঠিও লিখে ফেললো। পরদিন অফিসে যাবার সময় সে সেটা পোস্ট করে দিলো।
******************************