ওঙ্কার
মেহনাজ মুস্তারিন
চকচকে রোদে এক হাতে আজকের দৈনিক আরেক হাতে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় একটা টুলে আয়েস করে বসেছে রতন। চায়ে প্রথম চুমুক দিতেই তার খেয়াল হলো, অস্বাভাবিকভাবে জায়গাটা বেশ নীরব। এখানে বসে দূরে বেশ খানিকটা দেখা যায়। বাড়ির একপাশে পদ্মার ধূ ধূ বালুচর, অন্যপাশে সবুজ খোলা মাঠ। ইশকুলের এই খোলা মাঠ যখন তখন তাকে মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলার কথা। নিজেকে তখন সে দেখতে পায় ইউনিফর্ম পরে মাঠে ছুটাছুটি করতে। বালক বয়সের খেয়ালগুলো একটা বয়সে সকলকে টানে। অদ্ভুত এক অনুভব। আজ মাঠটা চমৎকার করে সাজানো, বেশ উঁচু একটা স্টেজও বানানো হয়েছে, সামনে সারি সারি চেয়ার পাতা। নানা রকম ফুল আর পাতাবাহার দিয়ে সাজানো হয়েছে মাঠ।
“প্রধানমন্ত্রী রাজশাহী আসছেন, তিনস্তরের নিরাপত্তার মাঝেই শহরজুড়ে ব্যাপক আয়োজন”—দৈনিকের হেডলাইন পড়ার পর বাকি খবরগুলোর দিকে না তাকিয়ে পেপারটা এক পাশে রেখে দিলো রতন। এই খবরের সাক্ষী সে নিজেই। শহরে আজ মানুষের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেশি। কিছুক্ষণ পরপর পুলিশের গাড়ির পোঁ পোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। মাঠজুড়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ তো আছেই, এসএসএফের চৌকষ একটা দলকেও দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে চার-পাঁচটা কুকুরকে নিয়ে একটা দল ঘুরে গেল। রতন ভাবছে, কয়টা বাজলো? একটু পরে অফিসে যেতে হবে। রিকশা চলাচল বন্ধ, হেঁটে যেতে হবে, তাড়াতাড়িই বের হতে হবে। রত্না এখনো বিছানা ছাড়েনি। বাচ্চারা দেরি করে উঠবে, ইশকুল ছুটি। আজ শহরজুড়ে অন্য রকম দিন।
বাড়ির ঠিক পূব দিকটায় একটা ডোবা মতো আছে। আশেপাশের বাড়ির ময়লা আবর্জনা ফেলা হয় সেখানে। যে যেমন করে পারে, খোসা প্যাকেট এটা সেটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেয়। বেশ কয়েকবার লোক ডেকে পরিস্কার করানো হয়েছে, মানুষজনকে হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করা হয়েছে; কিন্তু, যেকার সেই। মানুষ নিজ থেকে সচেতন না হলে জোর করে পরিস্কার হতে বাধ্য করা যায় না। সেই গর্তে রতন দেখতে পেল জয়নালকে, একটা লাঠি দিয়ে কী যেন খুঁড়ছে। ‘এটাকে নিয়ে আর পারা গেল না! দিন নাই রাত নাই কখন যে কী করে! তা, এখন তোকে এই গর্তে নামতে হবে কেন? মানুষজন তো আর খালি খালি তোকে পাগল বলে না!’
দুজন পুলিশকে দেখা গেল সেখানে আসতে, এসেই তারা জয়নালের সাথে কথা জুড়ে দিয়েছে। কী বলছে কে জানে? রতনের মনে হলো, জয়নাল তার হাতের লাঠিটা তার দিকে তাক করে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। দূর থেকে বোঝার উপায় নাই, আর পুলিশের লোকেরাই-বা কী জানতে চাইছে!
জয়নালের বাবা রেলওয়েতে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সে ছোট। অভাবের মধ্যেও বাচ্চাদের পড়ালেখার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ ছিল তার বাবার। ক্লাস টেনে পড়ার সময় প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেক দিন ভুগেছিল সে। বাসায় জলপট্টি এটা সেটা দিয়ে কোনো উন্নতি না হলে মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। সেখানেও ঠিকমত চিকিৎসা হয়নি। সেই থেকে ধীরে ধীরে তার বুদ্ধি লোপ পায়, বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। এ ডাক্তার সে ডাক্তার, সাধ্যের মধ্যে কম চেষ্টা করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত পরিচয় বদলে হয়ে গেল পাগলা জয়নাল। সারা দিন ঘুরে বেড়ায়, সময় মত ঘরে ফেরে, কারও কোনো অনিষ্ট করার কথা শোনা যায় নি। কিছু দিন ঘরে আটকে রাখার চেষ্টা করেও দেখা গেছে; কিন্তু, তাতে করে ক্ষতিই হয়েছে তার। যে দুয়েকটা শব্দ বলতে পারতো, সেগুলোও ভুলে গেল। তারপর থেকে শুধু একটা শব্দই শোনা যায় তার মুখে—ওঁম। ঘরে থাকাটা জয়নালের পছন্দ না– এটা তার বাবার অভিমত। বাবা মা দু’জনেই অসম্ভব ভদ্র মানুষ। অন্য ভাইবোন সকলে বেশ ভালো। সত্যি বলতে, আশেপাশের মানুষ জয়নালকে ভালোইবাসে। কথা বলতে না পারুক, কাজ কর্ম দেখলে যে কেউ তাকে বুদ্ধিমান বলেই ভাববে।
শুধু বুদ্ধিতে না, জয়নালের শরীরে বলও অন্যদের চেয়ে বেশি। বিধাতা মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তার গতরে শক্তি বাড়িয়ে দিয়ে থাকবে। পাড়ার মানুষ সেটা জানে। সেজন্য এর ওর বাসায় ভারী কোনো জিনিস টানতে সবার আগে জয়নালের খোঁজ পড়ে। এসব ফাই ফরমাস খাটতে কোনো দিন এতটুকু বিরক্ত হয়েছে এমন দাবি কেউ করতে পারবে না। রতনের মনে আছে, তার পাশের বাসায় আসা ভাড়াটেদের কথা। বড় একটা স্টিলের আলমিরা কিছুতেই ভেতরে নিতে পারছিল না। খোদার কী খেয়াল, ঠিক সে সময় জয়নালও হাজির। লোকজনের পেরেসানি দেখে রতনের দিকে তাকিয়ে ওঁ ওঁ শব্দে জানতে চাইল, এটা সে ভেতরে নিয়ে যাবে কিনা। ভাড়াটিয়া তো কিছুতেই রাজি না, তাদের ভয় জয়নাল এটা ভেঙে ফেলবে। রতন যখন আশ্বস্থ করল, ভয় পাওয়ার কিছু নাই, তখন চোখে দুধের সরের মতো পাতলা সন্দেহ নিয়ে ভদ্রলোক রাজি হলে জয়নাল একাই পুরো আলমিরাটা বাসার দোতালায় নিয়ে রাখলো।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। কে এল এত সকালে? রান্নাঘরে গিয়ে কাপটা বেসিনে রেখে দরোজার দিকে গেল রতন। ঘন ঘন বেল বেজেই চলেছে। ব্যস্ত হয়ে দরোজাটা খুলতেই বড় গোল আলুর মতো গোল হয়ে গেল তার চোখ! ‘ভুল দেখছি না তো!’—জয়নালকে ধরে আছে একজন পুলিশ, সাথে বেশ কয়েকজন সিভিল ড্রেসে। নিচের ঠোঁটটা বেশ ফোলা, মুছে ফেলা রক্তের দাগ ছাপিয়ে থির থির করে কাঁপছে ঠোঁট দুটো। চোখের তারায় খেলা করছে আশা ও সংশয়। ভাষাহীন সেই প্রকাশের দিকে তাকিয়ে রতনের বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে— এরা কি জয়নালকে মেরেছে?
পুলিশদের মধ্য থেকে একজন “আপনাকে একটু থানায় যেতে হবে।” বললে রতন বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, যেন ভুলে গেছে সবকিছু। তখন সেই ভদ্রলোক জয়নালকে দেখিয়ে “একে চেনেন তো?” প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে জবাবে রতন সম্মতিসূচক মাথা উপরনিচ করে। পুলিশটি জিজ্ঞেস করল, “ওকে পাগল সাজিয়ে কোন কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন?”
“দায়িত্ব? কিসের দায়িত্ব স্যার?” রতনের চোখে রাজ্যের জিজ্ঞাসা।
“ওখানে গর্ত খুঁড়ে কী করছিল ছেলেটা? আপনিই তো তাকে বলেছেন গর্ত খুঁড়তে! চলুন এ মুহূর্তে এত কথা শোনার সময় নাই। থানায় শোনা যাবে।” বলে রতনকে পিকআপ দেখিয়ে তাতে উঠতে বলল পুলিশের কর্তা ব্যক্তি। সাথে জয়নালকেও তুলে নিতে ভুল করলো না।
রতন সাহস করে বলল, “স্যার আমার স্ত্রী ঘুমিয়ে আছে, তাকে বলা দরকার।”
দলের অন্য একজন শান্তভাবে বললেন, “যান, তবে বেশি সময় নেবেন না!”
এলাকার দোকান পাটগুলো সবে খোলা হচ্ছে। চায়ের স্টলে পানি বলক দিচ্ছে। রতন-জয়নালকে পুলিশের গাড়িতে দেখে অনেকের চোখেই কৌতুহল, তারা বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছে। এমনিতেই শান্তশিষ্ট শহর। জয়নাল বিড় বিড় করে কী যেন বলছে। লুঙ্গিটা মাঝে মাঝেই ঠিক করার কাজে ব্যস্ত। হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরা। ঠোঁটে লেগে থাকা তির তির কাঁপুনিটা আর নাই। একটু পর পর পিট পিট করে তাকাচ্ছে রতনের দিকে। চেহারায় কোন ভাবান্তর নাই। কিন্তু রতনের? একরাশ চিন্তা তার মাথায়। কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে? জয়নালের মতো একটা পাগল, যে কিনা কথা বলতে পারে না, আকার ইঙ্গিতে কী বলল না বলল, পুলিশের কাছে সেটা কেন এত বিশ্বাসযোগ্য হলো—এমন ভাবনা তার মাথায় খেলা করছে। থানার কাছাকাছি আসতেই রতন দেখে, প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে বের হওয়া লম্বা এক মিছিল তাদের গাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেল।
থানায় পৌঁছানোর পর দেখা গেল দারোগা বাবুর চেয়ারটা ফাঁকা। দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার দেখিয়ে রতন ও জয়নালকে বলা হলো সেখানে বসতে। জয়নালকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, ধপ করে মেঝেতেই বসে পড়লো সে, তাও আবার রতনের চেয়ার ঘেঁসে। চোখজোড়া একটু উদাস। বিড় বিড় করে বকে যাওয়া কথা এখন বন্ধ। সেকেন্ড অফিসার রতনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সত্য করে বলেন তো কেন ওখানে গর্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন?”
রতন খুব সাবলিল ভাবে উত্তর দিলো, “স্যার! আমি কিছুই জানি না।”
কথাটা শুনে সেকেন্ড অফিসার বিরক্তবোধ করেন, রতনের কানের কাছে মুখ নিচু করে এনে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, “আপনি জানেন না! বলেন কি?” তারপর জয়নালের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম এই ছেলেটার?”
“জয়নাল, স্যার!”
“হ্যাঁ, জয়নাল! নামটা তো বেশ!” বললেন সেকেন্ড অফিসার, তারপর মুখে গম্ভীরতা ধরে রেখে আগের কথার সাথে যুক্ত করলেন, “এই ছেলেটাই আমাদের বলেছে আপনার নির্দেশে সে গর্ত খুঁড়ছিল। এখন মিস্টার রতন! সংক্ষেপে বলুন বিষয়টা।”
সেকেন্ড অফিসারের কথায় রতন অবাক। জয়নাল তো কথা বলতে পারে না। সাধ্যের মধ্যে যতটুকু কুলায়, সবটুকু বোঝানোর চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করলো না রতন। “সে বুদ্ধিতে খাটো স্যার। কথা বলতে পারে না, খালি ওঁ ওঁ করে!”
কথাটা সেকেন্ড অফিসার বিশ্বাস করলো বলে মনে হলো না। রতন বেশ ঘাবড়ে গেল। শেষে কোন ধারায় চালান দেয়! এমন সময় একজন কনস্টেবলকে ঘরে ঢুকতে দেখে “আসসালামুআলাইকুম সোহেল ভাই” বলে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল রতন।
“আরে রতন ভাই! কোন সমস্যা?”
রতন গড়গড় করে বলে গেল তার কথা। এত কথা শোনার সময় কোথায়, মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সোহেল ভাই বলল, “টেনশন করবেন না। প্রধানমন্ত্রী আসবেন, এই সময় এধরনের ধরপাকড় হয়েই থাকে। নাশকতার আশংকা থাকে তো! তার মধ্যে দু’একটা মিস্টেক যে হয় না, তা বলা যাবে না। কোল্যাটারাল ড্যামেজ। প্রেসিডেন্ট ওবামার বিখ্যাত উক্তি!”
“কোল্যাটারাল ড্যামেজ! ওবামা! আমি তো কিছুই বুঝছি না সোহেল ভাই।” রতন মুখ শুকনো করে হাসলো।
“আচ্ছা, আমি দেখছি।” বলে সোহেল ভাই ভেতরে চলে গেলেন।
কোল্যাটারাল ড্যামেজ কথাটা রতনের মাথায় জায়গা পেল না। তার তখন একটাই চিন্তা, যে উটকো ঝামেলায় আটকে গেছে সেটা অফিসে কীভাবে জানানো যায়। রত্নাকে যদিও বলে এসেছে অফিসে খবরটা পৌঁছে দিতে, সেটা সে করতে পেরেছে কিনা, কে জানে? পুলিশ দেখে মাথা নষ্ট হলে ওর কী দোষ? অফিস খবর না পেলে সেটা হবে বাড়তি বিপদ। নতুন এক ম্যানেজার এসেছে, অফিসের সকলকে সারাক্ষণ বেতন কেটে নেওয়ার হুমকির মধ্যে রাখে! আরে বাবা! কেউ কি ইচ্ছে করে কাজে দেরি করে? রতনের মনে হলো, এতক্ষণ এলাকায় অনেকে নিশ্চয় জেনে গেছে।
এই পাড়ায় আসা হয়েছে বেশ কয়েকবছর হলো। এলাকাবাসীর সাথে এরই মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। মসজিদে নিয়ম করে যাওয়া হয় না ঠিকই; কিন্তু, গুরুজনদের সাথে দেখা হলে মতবিনিময় হয়। এমন আকস্মিক ঘটনা ঘটবে ভাবতে পারছে না রতন। মনটা ভার হয়ে আছে। কতজন কত কিছু মনে করবে, এই সেই বলবে। এলোমেলো ভাবনার মাঝে তার নজর গেল দেয়াল ঘড়ির দিকে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই জনসভা শুরু হয়ে গেছে। এই একটা দিনকে ঘিরে কত প্রস্তুতি কত সাজগোজ। গ্রাম গঞ্জ থেকে দলে দলে লোক মাঠে সমবেত হচ্ছে। রাস্তাঘাট টিপটপ। হেলমেট ছাড়া মোটর স্যাইকেল চালালেই পুলিশ তাদের থামিয়ে ধমক দিচ্ছে। শুধু তাই না, হেয়ার কাট মোবাইল সবই চেক করা হচ্ছে। রাস্তাঘাট যেটুকু ভাঙাচুরা ছিল, সেগুলো দ্রুত সারিয়ে তোলা হয়েছে। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে। সৌন্দর্য বাড়াতে সদ্যকেনা ফুল গাছে এক রাতেই ফুটে উঠেছে ফুল। দেয়ালে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবিগুলো নতুন করে জীবন্ত। নতুন নতুন লাইট পোস্টের আলোর শোভায় শহর যেন নতুন রুপে নিজেকে আবিষ্কার করছে।
রতন ভাবছে মানুষ ভাবে এক, আর ঘটে আরেক। ভেবেছিল আধাবেলা অফিস করে নিজ বারান্দায় বসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনবে। গত কয়েক দিন ধরে অফিসের কলিগরা মজা করে তাকে বলেছে “রতন ভাই আপনার তো টিকিট কাটা লাগবো না, ঘরে বসেই সব দেখতে পাবেন।”
রতনের বাসা মাঠের ঠিক পশ্চিম ঘেঁসে বানানো।
কলিগদের কথা শুনে রতনের মনে হয়েছিল, নেতা-নেত্রীদের এক নজর দেখতে পাওয়া কত বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার! কত জনের কত রকম উচ্ছ্বাস। সেখানে, তার কেন এমন কিছু মনে হয় না, সেটা অবাক করার মতো। রতনের মাথায় নতুন একটা প্রশ্নের উদয় হলো—কোনো কারণ ছাড়াই কত মানুষ প্রতিদিন ক্ষমতার বেড়াজালে আঁটকে পড়ছে! জয়নালের কথাটাই মনে হলো সবার আগে। অসহায় ছেলেটার এই যে অস্বাভাবিক জীবন, ভুল চিকিৎসার কারণে তার নামের পাশে যে পাগল শব্দ যুক্ত হয়েছে, তার দ্বায়ভার কে নেবে? আর কেউ না জানুক, রতন খুব ভালো করে জানে, জয়নালের পাগলামীর অন্তরালে লুকিয়ে আছে একটা সেবক মন। প্রায় ওকে দেখা যায় দোকানের সামনে, রাস্তায় এখানে ওখানে পড়ে থাকা কাগজ কুড়াতে। প্রথম দিকে অনেকের মতো রতনও তাকে পাগলই মনে করত। এক দিন অফিস থেকে ফেরার পথে পাড়ার চা-ঘরে বসে চা খেতে খেতে তার নজর গিয়েছিল জয়নালের দিকে, রাস্তায় সে কাগজ কুড়াচ্ছে। প্রথমে অতটা গুরুত্ব দেয় নি, ভেবেছিল এমন কত পাগলই তো কাগজ কুড়ায়। পরক্ষণে তার নজরে পড়েছিল এমন কিছু যা সে কল্পনাও করতে পারেনি। কাগজগুলো কুড়িয়ে একটু দূরে একটা ডাস্টবিনে ফেলছে জয়নাল। সেদিন থেকে জয়নাল সম্পর্কে রতনের ধারণা পালটে গেল। সময় সুযোগ পেলে ওর সাথে আলাপ জুড়ে দিত। সকলে তাকে পাগল বলে অথচ কী সুন্দর তার কণ্ঠের ওঁম উচ্চারণ। ওই এক শব্দ দিয়ে সে যে ঠিক কী বলে, তার মর্মোদ্ধার দুঃসাধ্য; সেজন্য যে যার মতো করে মানে দাঁড় করায়। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে যে সকল বোধের অভাব হরহামেশাই চোখে পড়ে, জয়নালের মধ্যে তা দেখা যায় না। বরং, তাকে দেখা যায় স্বাভাবিক কাজগুলো নীরবে করতে। যেমন, খাওয়ার পরে ময়লা প্লেট টেবিলে রেখে চলে যাওয়া—অনেকের কাছে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু, অন্য কেউ পরিষ্কার করবে সে আশায় প্লেট ফেলে রাখে না জয়নাল।
হঠাৎ করেই রতনের ভাবনা জগতে ছেদ পড়লো। তার চোখ আটকে গেছে মেঝেতে বসে থাকা জয়নালের উপর। পান খেয়ে কাগজের কয়েকটা মুড়ি থানার এই ঘরে ফেলে দিয়েছিল কেউ। মেঝে থেকে সেগুলো কুড়িয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওঁম ওঁম করছে জয়নাল। তার চোখে জিজ্ঞাসা, ময়লা কাগজ কোথায় ফেলবে? হাত বাড়িয়ে নিতে যাবে, রতনের দৃষ্টি গেল দরজার দিকে, সোহেল ভাই এগিয়ে আসছে। রতনের হাতে ধরে থাকা আবর্জনার দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বলছেন, “আরে আরে কী করছেন! ময়লায় হাত দিচ্ছেন কেন? জীবানু গিজগিজ করছে তো! রাখেন রাখেন, সকালে ঝাড়ুদার আসবে, সেই পরিষ্কার করবে।”
সোহেলের কথাকে একদম পাত্তা দিলো না জয়নাল, রতনের দিক থেকে এবার সে তার মুখ সোহেলের দিকে ফিরিয়ে গলার স্বর যতটা সম্ভব উঁচু করে একনাগা
ড়ে বলতে থাকলো, “ওঁম! ওঁম!”
৭.৭.২৩
**************************