You are currently viewing একটি রাবিন্দ্রীক ভ্রমণকাহিনী/ জাকির তালুকদার

একটি রাবিন্দ্রীক ভ্রমণকাহিনী/ জাকির তালুকদার

একটি রাবিন্দ্রীক ভ্রমণকাহিনী

জাকির তালুকদার

শান্তিনিকেতনে এসেও তারা পুরীর সমুদ্রে ঝাঁপানোর গল্পই বারবার করে চলে। বাংলাদেশ থেকে আসা আটজন আর তাদের কলকাতার সঙ্গী তিনজন ঘুরে-ফিরে পুরীর সমুদ্র, সাধনা আশ্রমের চমৎকার এবং সস্তা ঘরোয়া খাবার, সৈকতে উটের হাওদা আর ঘোড়ার পিঠে সওয়ারি হওয়ার স্মৃতি মুচমুচ করে আওড়ায়। তারসাথে পুরীর মুচমুচে গজা, খাঁটি ছানার সরপোড়া। বাংলাদেশের মানুষ কক্সবাজারের গর্ব ছাড়তে নারাজ। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত বলে কথা। কিন্তু নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে যে কক্সবাজারে বেড়াতে আসা মানুষের গলা কাটে সবাই। হকার থেকে শুরু করে হোটেল মালিক। পুরীতেও দাম হয়তো অন্য এলাকার চাইতে একটু বেশিই, কিন্তু তাকে গলাকাটা আখ্যা দেওয়ার যুক্তি পায় না কক্সবাজার ঘুরে আসা মানুষ। কিন্তু সেসব কথা তো আর কলকাতার মানুষকে জানানো যায় না। হোক না তারাও বাঙালি, হোক না ঘনিষ্টতম বন্ধু বা আত্মীয়ের মতো কাছের মানুষ- তবুও তো অন্যদেশী। নিজের দেশের দুর্নাম নিজেরা করতে পারি যতখুশি। কিন্তু অন্যদেশের মানুষকে শুনিয়ে শুনিয়ে অবশ্যই নয়। তাই বলে অবশ্য অন্যদেশের ভালো জিনিসের প্রশংসা করতে কার্পণ্য থাকাটাও উচিত নয়। মাজেদ তাই রবীন্দ্রনাথের কোলের মধ্যে এই শান্তিনিকেতনে বসে থেকেও বারবার পুরীর কথাই তোলে- আহা! কী সুন্দর! কত সস্তা! কত নিরাপদ।

রাতের খাবারের পরে পূর্ব পল্লী রেস্টহাউজের ফটকের সামনে রকের মতো লম্বা সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে আছে ওরা। সঙ্গে শান্তিনিকেতনে বড় ডিগ্রি নিতে আসা কুষ্টিয়া ভার্সিটির জামান। মাজেদ মহা উৎসাহে পুরীর গল্প করে চলেছে। কিন্তু হঠাৎ একসময় খেয়াল করে অন্যেরা তার কথা তেমন মনোযোগ দিয়ে শুনছে না। কণ্ঠের সতেজতা মিইয়ে যেতে যেতে একসময় নিভেই যায়। আবছা অন্ধকারেও বুঝতে পারে শামীম, মিঠু, মাহবুব, নীতা- এমনকি তার বউ রিমা পর্যন্ত মাজেদের কথায় কান প্রায় দিচ্ছেই না। মাজেদ থেমে যাওয়ার পরে কিছুক্ষণ নীরব বসে থাকে সবাই। যেন এখন কোন কথা দিয়ে নতুনভাবে শুরু করা যায় তা ভাবছে সবাই। সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়ে নীতা গেয়ে ওঠে- সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে…

মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ সেঁধিয়ে গেছেন ওদের মনের মধ্যে। এটা অনিবার্যই ছিল। একে তো রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। তার ওপর ‘আর্ট-কুলচুর’ করা বাঙালি হলে ঘুরে-ফিরে রবীন্দ্রনাথের কথা না বলা মহাপাতক। তাতে নিজেদেরে সাংস্কৃতিক মানের পারদ নিচে নেমে যায় সরাৎ করে।

ভাবা যায়! এখনকার শান্তিনিকেতনের এই বিপুল বিস্তার, এই সুবিন্যাস দেখে কে আন্দাজ করতে পারবে যে রবীন্দ্রনাথ এখানে মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে খড়ের চালার নিচে শুরু করেছিলেন ইস্কুল।

জামানের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শামীম ধরে ফেলে গল্পটাÑ একবার প্রবল বর্ষার রাতে ছনের চালার ঘরগুলো সব ভেসে যাচ্ছিল বৃষ্টির তোড়ে। শিক্ষক-ছাত্র কারো শুয়ে ঘুমানোর উপায় ছিল না। তারা সেই রাতেই ঝড়জল মাথায় নিয়ে চললেন গুরুদেবের কাছে। অনুযোগ করতে আর প্রতিকার চাইতে। কিন্তু গুরুদেবের কাছে গিয়ে তারা এ প্রসঙ্গে কোনো কথাই তুলতে পারলেন না।

কেন? কেন?

উদগ্রীব প্রশ্ন ওঠে নারীকণ্ঠে। মাজেদ অবাক হয়ে দেখতে পায় প্রশ্নটা করেছে তারই বউ রিমা। রিমার মধ্যেও রবীন্দ্রভক্তি! রবীন্দ্রনাথের গান বাজলে যে কি না বলে-বন্ধ করো তো প্যানপ্যানানির গান।

শামীম উত্তর দেয়- অনুযোগ করতে আসা শিক্ষক-ছাত্রের দল দেখতে পেলেন পেলেন যে কবিগুরুও ঘুমাননি। তার ঘরের চালাতেও অসংখ্য ছিদ্র। তিনি মেঝেতে পেতে রেখেছেন বালতি, গামলা, থালা। বিছানা গোটানো একদিকে। খাটের ওপর জল পড়ছে ঝরঝরিয়ে। আর তিনি এককোণে বসে আছেন জুবুথুবু হয়ে। কবিগুরুর নিজের ঘরেই যখন এই অবস্থা অন্যরা তখন নিজেদের অসুবিধার কথা বলে কীভাবে!

মিঠু বলে- গ্রেট ম্যান!

এই স্বল্প আলোতেও রিমার চোখের মুগ্ধতা দেখতে পায় মাজেদ। রবীন্দ্রনাথ বড় মানুষ ছিলেন সেকথা লেখাপড়া জানা সব বাঙালিই জানে। কিন্তু তাঁর জীবনের সবকিছু নিয়ে এত আদিখ্যেতা করার কোনো মানে খুঁজে পায় না মাজেদ। ছোটবেলা থেকেই নিজের গ্রামে কিংবা পাশের গ্রামে যাত্রাপালা অনেক দেখেছে মাজেদ। কলেজে পড়ার সময় নাটক-গানের অনুষ্ঠানে গেছে দুই-চারবার। তারপরেই তো তার প্রবাসজীবন। প্রথমে জাপানে দশটা বছর। তারপর দেশে ফিরে ব্যবসার চেষ্টা। ব্যবসা জমাতে না পেরেে আবার চাকুরি নিয়ে আবু ধাবি। ঘাম-কষ্ট মরুভূমিতে বিন্দু বিন্দু নিংড়ে দিয়ে পয়সা উপার্জন করা। জানে যে সেই পয়সাতে বউ-মেয়েরা ঢালাও কেনাকাটা করে আর নিজেদের ঝলকানি দেখিয়ে বেড়ায় পাড়া-প্রতিবেশীদের। তাতে অবশ্য আপত্তি নেই মাজেদের। পয়সার জেল্লা যদি মানুষকে দেখানোই না গেল তাহলে সেই পয়সা থাকলেই কী আর না থাকলেই কী! দুই বছর পর পর তিনমাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসে সে। এবার এসে দেখতে পায় মিঠু আর মাহবুবের ফ্যামিলির সাথে জোট বেঁধে তার বউ-মেয়েরা ইন্ডিয়া ভ্রমণের ব্যবস্থা ফাইনাল করে রেখেছে। তখন আর নিজে সায় না দিয়ে উপায়টা কী। কলকাতা থেকে যোগ হয়েছে মাহবুবের লেখকবন্ধু শামীমের পরিবার। আসলে যাবতীয় খাটাখাটনি করছে শামীমই। মাজেদ বুঝতে পারছে, শামীমের নেতৃত্ব না পেলে নিজেদের বেড়ানো এত নির্বিঘ্ন-নিশ্চিন্ত হতো না। সেই কারণে সে দলের সঙ্গে থাকতে পেরে খুশিই। যদিও শান্তিনিকেতন আসার ইচ্ছা তার ছিল না। প্রশ্ন করেছিল, এখানে দেখার আছে টা কী? একটু থমকে গিয়ে মাহবুব বলেছিল যে এখানে আসলে সেই অর্থে দেখার কিছু নেই। মাজেদ ও তার পরিবার ইচ্ছা করলে না-ও যেতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসেছে মাজেদরাও। মাহবুব-শামীমদের গল্পগাছার মধ্যে সে তেমন একটা ঢুকতেই পারে না। বিদেশে থাকা মানুষদের নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীর আগ্রহ ব্যাপক। এমনকি অচেনা মানুষও যখন শোনে যে সে প্রবাসী, সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে বিদেশের গল্প শুনতে চায়। বিদেশ মানেই আমাদের চাইতে ভালো দেশ। বিদেশে থাকে শুনলেই লোকের পুরো মনোযোগ তার ওপর আছড়ে পড়ে। কিন্তু এদের কাছ থেকে সেরকম কোনো ইঙ্গিতই আসে না। আরে বাবা আরবের কথা নাহয় বাদই দাও, জাপানের গল্প তো শুনতে চাওয়া অন্তত উচিত। কিন্তু এরা কেউ আগ্রহই দেখাল না একফোটাও। মনে মনে এদের গালি দিয়েছে মাজেদ ‘কুয়ার ব্যাঙ’ বলে। নিজেকে এই বলে সান্ত¦না দিয়েছে যে তার পরিবারের কাছে তো অন্তত সে খুব বড় মানুষ। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে আগ্রহের মানুষ। কিন্তু তবুও খচখচানি যায় না। মাহবুব-শামীমদের কাছে নিজেকে একটু অপাংক্তেয়ই মনে হয়।

মাহবুব, শামীম, জামান আবার লেখকও বটে। তারা লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। সে আবার কী জিনিস? মাজেদ আঁচ করতে পারে না এই রকম কোনো ম্যাগাজিনের নাম সে জাপান কিংবা আবু ধাবি কিংবা ঢাকাতেও শুনেছে কি না। সেই লিটল ম্যাগাজিনের কথা উঠতেই জামান সেখানেও রবীন্দ্রস্তুতি শুরু কর- পৃথিবীর প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বেরুল ১৯১২ সালে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগের বছরে। হ্যারিয়েট মুনরোর সম্পাদনায়। নাম পোয়েট্রি। তার দ্বিতীয় সংখ্যাতেই প্রকাশিত হলো রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ কবিতা। সেইসঙ্গে তাঁর কবিতা বিষয়ে এজরা পাউন্ডের প্রশংসাভর্তি প্রবন্ধ। পরের বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন রবীন্দ্রনাথ।

তারপরে রবীন্দ্রনাথ নিজেও চাইছিলেন, বাংলায় একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হোক। প্রমথ চৌধুরী সেই কাজটি করলেন। বের করলেন ‘সবুজ পত্র’। রবীন্দ্রনাথ নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘কনিষ্ঠ’। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী ‘সবুজ পত্র’ ছেড়ে নড়লেন না। এই কাগজে লেখার জন্য কী আকুতিই না ছিল রবীন্দ্রনাথের। যে রবীন্দ্রনাথ থুথু ফেলার জন্য মুখ খুললে তিনি কী কথা বলবেন ভেবে লোকে তার কথা টুকে রাখার জন্য কাগজ-কলম নিয়ে রেডি হয়ে যেত, যে রবীন্দ্রনাথের লেখা পেলে বর্তে যায় দুনিয়ার সব পত্রিকা, সেই রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজ পত্র’তে কবিতা পাঠিয়ে সঙ্গে চিঠি লিখতেন এই বলে যে, যদি তোমাদের এই কবিতাটি ছাপার জন্য পছন্দ না হয়, তাহলে ‘প্রবাসী’ পত্রিকাতে পাঠিয়ে দিয়ো।

ভাবা যায়!

লিটল ম্যাগাজিনের লেখক হিসাবে মাহবুবরা বেশ শ্লাঘা বোধ করে এই মুহূর্তে।

মাজেদ বিরক্তই বোধ করে একটু। একজন লোককে নিয়ে এত কথা চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয়? দুনিয়াতে আর কিছু যেন নাই, আর কোনো মানুষ যেন নাই। খালি রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ। তখন মনে পড়ে, কলেজে ওদের মধ্যে একটা জোক খুব চালু ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। সে শুনেছিল রমজানের কাছে। অন্যদের শোনাতে গিয়ে দেখেছে, প্রায় সবাই সেটা জানে। রমজান খাস রাজশাহীর ছেলে। গল্পটা এত রসালো করে বলত!

বুঝলি বোটা রবীন্দ্রনাথ গান লেখত কেমন করা জানিস? একবার রবীন্দ্রনাথ জাহাজে চাপ্যা বিদ্যাশ যাছে। পাশের কেবিনে এক খুব সুন্দরী জুয়ান মিয়্যা। মুনে কর একেবারে সেই রকম জিনিস। রবীন্দ্রনাথ তাক পটানোর লাগ্যা তখুনই গান বানায় গাইতে শুরু করল- ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।’ মিয়্যাটার খুব ভালোই লাগল। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারল যে মাছ বড়শির কাছে ভিড়্যাছে। সে তখুন ডাইরেক্ট ইশারা করে গাওয়া শুরু করল- ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে।’ মিয়্যাটা রেগে গেল বুঝলি। এমন বড় একজন কবি ডাইরেক্ট এমন অসভ্য প্রস্তাব দেয় কীভাবে। সে মুখ ঝামটা দিয়্যা চল্যা গেল নিজের ঘরে। রবীন্দ্রনাথ তখন কী আর করে। মাথাত মুনে কর মাল চড়্যা গ্যাছে। তখন হস্তই ভরসা। এদিক খনিক পর মিয়্যাটার মুনে হলো, এতবড় একজন কবি আমার কাছে একখান আব্দার করল, আমার সেটা পুরণ করা উচিত। সে তখন পায়ে পায়ে আস্যা ঢুকল রবীন্দ্রনাথের কেবিনে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো ততক্ষণে ফিনিস। মনের দুঃখে গান ধরল- ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।’

রমজানের বলাও শেষ, আর সঙ্গে সঙ্গে হোস্টেলের ছাদফাটানো হাসি।

 

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার নিয়ে কথা তখনও শেষ হয়নি। নীতা মনে করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে- ‘গীতাঞ্জলি’র খাতাটা হারিয়ে গেলে কী দশা হতো ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়।

কী হইছিল দিদি? তুমুল কৌতূহল নিয়ে রিমা প্রশ্ন করে।

নীতা একবার অনুকম্পার দৃষ্টিতে তাকায় রিমার দিকে। এই সবার জানা বিষয়টাও জানে না মেয়েটা? বাংলাদেশের মেয়েরা এতটাই ফাঁপা। তবে বলতে তার খুবই ভালো লাগে অনেকবার শোনা এবং বলা গল্পটা।

১৯১২ সালের মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তখন তাঁর মনের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু প্রত্যাশিত স্বীকৃতি তিনি পাননি। তাঁর পঞ্চাশ বৎসর পূর্তিতে কলকাতায় একটা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু তা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। নানা প্রিয়জনের মৃত্যু তাঁকে অত্যন্ত বিমর্ষ করে রেখেছিল। ভেবেছিলেন যে বিলেতে গেলে জীবনের একঘেয়েমি কিছুটা হলেও কাটবে। তাঁর সাথে যাবেন বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। কিন্তু কলকাতায় জাহাজে ওঠার সময় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। বাতিল করা হলো যাত্রা।

সর্বনাশ!

না। সর্বনাশ নয়। বরং সেই সময় না যেতে পারাটাই হলো শাপে বর।

বিশ্রামের জন্য তিনি চলে গেলেন শিলাইদহে। সেখানে তিনি ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ছিলেন।

এই সময়টাতেই তিনি ‘গীতাঞ্জলি’র গানগুলি তর্জমা করেন। বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে সময় কাটানোর জন্য। এই তর্জমা সম্পর্কে কবিগুরু লিখেছিলন- ‘আমি কোনো একটা অবকাশের মুহূর্ত্তকালে নিজের কতগুলো কবিতা ও গান ইংরেজি গদ্যে তর্জমা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। ইংরেজি লিখিতে পারি এ অভিমান কোনোকালেই নাই; অতএব ইংরেজি রচনায় বাহবা লইবার প্রতি আমার লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু নিজের আবেগকে বিদেশী ভাষার মুখ হইতে একটুখানি নূতন করিয়া গ্রহণ করিবার যে সুখ তাহা আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল। আমি আর এক বেশে নিজের হৃদয়ের পরিচয় লইতেছিলাম।’

এই রকম এত বড় একটা পুরো কোটেশন নীতার হুবহু মুখস্ত! রিমার মুগ্ধতা আরও বেড়ে যায়। পুরো গল্পটা আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।

কয়েকমাস পরে রবীন্দ্রনাথ বিলেত গেলেন। তিনি ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন ১৯১২ সালের ২৬ জুন। জাহাজ থেকে নেমে  পাতাল রেলে চেপে তারা হোটেলে গেলেন। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল যে অ্যাটাচি কেসের মধ্যে ‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদের খাতাটি ছিল, সেই বাক্সটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মাগো!

মুখে হাতচাপা দিয়ে অস্ফুটে চিৎকার করে ওঠে রিমা।

একটু হেসে নীতা বলে- সেই অ্যাটাচি কেসটা কয়েকদিন পরে ফেরত পাওয়া গেল লস্ট প্রপার্টি অফিসের মাধ্যমে। না পেলেই ঘটে যেত চূড়ান্ত সর্বনাশ।

বিলেতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেশি লোকের পরিচয় ছিল না। চেনা-জানা ছিল উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের সাথে। পরিচয় হয়েছিল কলকাতায়। রোদেনস্টাইন ছিলেন চিত্রশীল্পি। তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি দেখতে আর আলোচনা করতে। সেখানেই রবীন্দ্রনাথের সাথে রোদেনস্টাইনের পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর তর্জমা করা কবিতা পড়তে দিলেন রোদেনস্টাইনকে। রোদেনস্টাইনের খুব ভালো লেগেছিল সেগুলো। তিনি কিছু কবিতা টাইপ করে পড়তে দিলেন কয়েকজন কবি-সাহিত্যিককে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ডব্লিউ বি ইয়েটস।

রোদেনস্টাইন তাঁর নিজের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের একক কবিতাপাঠের আয়োজন করেছিলেন ৩০ জুন। শ্রোতাদের মধ্যে ইয়েটস ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এজরা পাউন্ড।

ইয়েটস এবং এজরা পাউন্ড দুজনেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা খুবই পছন্দ করেছিলেন।

তারপরের ঘটনা তো স্বপ্নের মতো দ্রুত ঘটে গেল।

ইয়েটস কবিতাগুলো পড়তে দিয়েছিলেন আরেক বিখ্যাত কবি টমাস স্টার্জ মুরকে। এই স্টার্জ মুরই রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেছিলেন নোবেল পুরস্কারের জন্য। তাঁর প্রস্তাবটি লুফে নিয়েছিলেন নোবেল কমিটির সদস্য সুইডেনের কবি ভারনার ভন হেইডেনস্টাম।

রবীন্দ্রনাথ পেয়ে গেলেন নোবেল পুরস্কার। এশিয়া মহাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসাবে।

এবার আরেকটা গান হোক।

মিঠুর প্রস্তাবে সানন্দে সায় দেয় রিমাও- নীতাদি সত্যি গান শুনব আরেকটা।

নীতার আপত্তি নেই। গান শুরু করে- ‘যদি বারণ করো তবে গাহিব না…’

আর সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব পল্লী গেস্ট হাউজের ফটকের পাশে শুয়ে থাকা চার-পাঁচটা কুকুর একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। থেমে যায় নীতার গান। জামান হেসে ওঠে- বারণ করছে গো।

এইসময় মনে পড়ার ঢঙে মাজেদ বলে ওঠে- আবু ধাবিতে আপনি একটাও কুকুর দেখতে পাবেন না।

এমন বেসুরো লাগে কথাটা যে রিমা পর্যন্ত আধো অন্ধকারে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। অন্যদের মুখে হয়তো শ্লেষের হাসি ফুটেছে। তবু রক্ষা যে ভদ্রতা করে তারা কোনো শ্লেষের কথা বলেনি, কিংবা শব্দ করে হেসে ওঠেনি। কিন্তু মাজেদকে কিছুই স্পর্শ করে না। সে তার মতো করেই বলতে থাকে- কুকুর একটাও দেখবেন না আপনে রাস্তায়। তবে হ্যাঁ, বিড়াল দেখতে পাবেন শয়ে শয়ে। রাস্তাঘাটে বিড়ালের সংখ্যা এত বেশি যে আপনে এক কিলোমিটার গাড়ি চালালে অন্তত তিন-চারখান বিড়াল চাকার তলায় পড়বে।

তাই? মাহবুব ভদ্রতার জন্যই প্রশ্নের মতো শব্দটি উচ্চারণ করে।

উৎসাহিত হয়ে মাজেদ বলতে থাক- আর বলবেন না। খালি বিড়াল আর বিড়াল।

এত বিড়াল কেন ওখানে?

তা তো বলতে পারব না। তবে শুনেছি নবীজী খুব বিড়াল পছন্দ করতেন।

ও। আবু ধাবির লোকেরা খুব হাদিস মানে তাই না? খুব ধর্মপরায়ণ?

এর উত্তরে একটু হোঁচট খায় মাজেদ। সত্যি কথাটা বলা উচিত হবে কি না ভাবে। তারপর দ্বিধা ছেড়ে ফেলে- ঠিক তা না। বরং উল্টাই বলতে পারেন। নামাজ-রোজা করে-টরে হয়তো। কিন্তু আবু ধাবিতে গেলে মনেই হবে না আপনে আরবে আছেন।

মানে?

মানে, মনে হবে আপনে ইউরোপে আছেন। রাস্তায় বের হলে দেখবেন ছোট পোশাক পরা মেয়েরা দলে দলে চলেছে। পর্দা-বোরখার বালাই নাই।

তাই? তারা সেই দেশের মেয়ে?

শুধু সেই দেশের না তো। সারা দুনিয়ার মেয়েরা আছে।

চাকুরি করতে গেছে?

খুক খুক করে হাসে মাজেদ। সবার মনোযোগ তার দিকে এসে গেছে ভেবে মনে মনে পুলকিত। বলে- চাকরি না, ব্যবসার জন্যে আসে।

কীসের ব্যবসা?

মাজেদ যেন মিঠুর প্রশ্নে একটু বিরক্তই হয়। কিছুই বোঝে না ছেলেটা। স্পষ্ট করে আবার বলাও যাচ্ছে না। তবু বলে- যুবতী মেয়েদের আবার কীসের ব্যবসা বুঝেন না!

ও।

ততক্ষণে কুকুরগুলোর চিৎকার থেমে এসেছে। জামান উঠে পড়ে- আমি চললাম।

তাকে যেতে হবে বেশ খানিকটা পথ। একেবারে সাঁওতাল পল্লী পার হয়ে আরও খানিকটা। অবশ্য সাইকেল আছে সঙ্গে। ধীরে-সুস্থে গেলেও আঠারো-কুড়ি মিনিটের বেশি লাগবে না।

শামীম বাধা দেয়- আরে তোমার এত সকাল সকাল যেতে হবে কেন? রাত তো বেশি হয়নি।

মাহবুব যোগ করে- আর এখানে তো আর ঢাকার মতো ছিনতাইকারী নাই। অতএব দুশ্চিন্তা কীসের? আরও কিছুক্ষণ আড্ডা মারা যাক।

উঠতে গিয়েও বসে পড়ে জামান। মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে- কাল সকালে পাঠভবনের ছাত্র-ছাত্রীরা অনুষ্ঠান করবে। দেখতে যাবে? খুব সুন্দর অনুষ্ঠান করে ওরা।

মিঠু জানতে চায়- পাঠভবন মানে?

পাঠভবন মানে বলা যেতে পারে ইস্কুল।

ও। এখানে স্কুলও আছে!

আছে। স্কুল দিয়েই তো শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর এখানে স্কুল শিক্ষকদের মর্যাদাও অনেক।

যেমন?

এখানে পাঠভবনের শিক্ষকদের বেতন, মর্যাদা সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমান পর্যায়ের।

বাপরে। ইস্কুলের মাস্টার আর ইউনিভার্সিটির প্রফেসার একই সমান! এ যে মুড়ি-মুড়কির একদর!

কণ্ঠে একটু কাঠিণ্য চলে আসে মাহবুবের- গুরুদেবের কাছে শিশুর শিক্ষার মূল্য বড়দের তুলনায় বেশি ছিল। এবং সেটাই হওয়া উচিত।

সুরটাই কেটে গেছে। আড্ডাটা আর জমলই না।

 

০২.

নিজেদের রুমে ঢুকেই স্বামীকে সরাসরি অভিযুক্ত করে বসে রিমা- তুমি না! তুমি একটা! কী সব আবোল-তাবোল কথা কও! কী দরকার আছিল ঐ সময় আবু ধাবির কুকুরের কথা তুলার? সবকিছুর একটা পরিবেশ আছে না?

রিমাও তাকে অন্যদের তুলনায় ন্যূনই ভাবছে। লজ্জায় যেন মাথা কাটা যাচ্ছে তার।

পাল্টা ক্ষেপে উঠতে পারত মাজেদ। রিমাকে বলতে পারতÑ বউয়ের কাছ থেকে পরিবেশের পাঠ নিতে হবে তাকে স্বামী হয়ে?

বলতে পারত- দেশ-বিদেশ দেখা মানুষ সে, বই না পড়লেও তো তার জ্ঞানগম্যি কম নাই।

বলতে পারত- ঐ শালারা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে করেটা কী? নাকি সুরে গান গায় আর হিজড়াদের মতো ড্যান্স দেয়।

বলতে পারত- ঐসব পন্ডিতি দিয়ে দেশের কোন লাভটা হয়েছে?

বলতে পারত- ওরা তো ফাঁকিবাজ। কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে দিনে একখান-দুইখান ক্লাস নিতে হয়। তা-ও ঠিকমতো নেয় না। ক্যাম্পাসেই যায় না। আবার বসে বসে পন্ডিতি মারায়।

বলতে পারত- দেশে যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ছুঁয়েছে, সেটা কাদের পাঠানো টাকায়?

বলতে পার- রবীন্দ্রনাথকে দেবতার আসনে বসিয়ে একশ্রেণীর মানুষ ব্যবসা ফেঁদেছে। সেই ব্যবসাদারদের দুচোখে দেখতে পারে না তাদের মতো খাটনেঅলা মানুষরা।

আরও অনেক কিছু বলতে পারত মাজেদ।

কিন্তু সেসব কিছুই না বলে বউয়ের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে একটা হাসি দেয় সে। খুব ক্লান্ত কণ্ঠে বলে- ঐদেশে কুত্তা নাই ক্যান জানো?

রিমা জানতে চায় কী চায় না, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সেই আগের ক্লান্তস্বরেই বলতে থাক- ওদের দুই-পা-অলা কুত্তার দরকার নাই। কুত্তার মতো ব্যবহার করার জন্যে আমরা সব মিসকিন দেশের হাজার হাজার দুইপায়া কুত্তারা আছি না?