You are currently viewing ইসরাত জাহান || অসমাপ্ত গল্পটা

ইসরাত জাহান || অসমাপ্ত গল্পটা

ইসরাত জাহান
অসমাপ্ত গল্পটা

মাঝরাতের কাদাকাদা ঘুমটা ভেঙে যায়, মারকুটে ভেপসা গরমের তোড়জোড়ে। গরমটা অনেকটা সন্ত্রাসীদের মতো, তেড়েমেরে চলে আসে। ঘর্মাক্ত আমি, দুইবার এপাশ ওপাশ করে উঠে বসি। ভেজা জুবুথুবু গেঞ্জিটা একটানে শরীর থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে, পানির বোতলটাকে খুঁজি, বিছানার এপাশে হাতাই, ওপাশে হাতাই, আধো- অন্ধকারে পানির বোতলটা খুঁজে পাই না। বিরক্ত হই অল্পতেই আজকাল, নিজেকে গোটা-চারেক গালি দেয়ার মুহূর্তে ওর কথা মনে পড়ে, অশ্লীল এই গালিটা যে ওর মুখেই শোনা, আমার সময়ের সঙ্গী, কানে বাজে ওর গমগমে কণ্ঠের সেই হাসির উচ্ছ্বাসটুকু। যা একটা সময় বাতাসে দাপিয়ে বেড়াত।

তখন রাগ হয়। এইভাবে হুটহাট মনে পড়ার কি দরকার। বলা নেই কওয়া নেই, যখন তখন চলে আসে, আবার চলে যায়। শান্তি দিল না। বরাবরই বেয়ারা ছিল, আজও তাই আছে। লীন হাওয়া পুঞ্জ হয়ে কুঞ্জ বেঁধেছে মনে। এখনও মাঝেমধ্যে যেভাবে হুটহাট হাজিরা দিচ্ছে, মনে হয় আবারও কোন অনিয়মের লেজুড় তৈরী হচ্ছে আশপাশে । আমি জানি ওর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, কারো কাছে অভিযোগ জানাতে চায় না। ঠিক একারণেই একটা সময় কত যে গালাগাল দিতাম, তারপরও হেসে হেসে উসখুস চুলে সামনে এসে দাঁড়াত। বকবক করে আমাকে শোনানোর ছলে অন্যদের বলত…

বুঝলা, এই জিনিস তো আমার শরীরের লগে মিশশা গেছে, আরে মিশবো না ক্যান, সেভেন থাইকা টেন পর্যন্ত বাপের লগে শেয়ারে নেভী ফুঁকতাম, বাপে মাটিতে ফালাইলে বহুত কষ্টে তুইলা রাখতাম, তারপর কলেজে উইঠা দোস্তগো লগে গোল্ডলিফ টানতাম। হ্যার পরে বেনসন, এখনও বেনসন রেগুলার চলে, অরজিনাল মালবোরো তো মার্কেটে নাই। গোল্ডলিফ আর খাইতে পারিনা। বেনসনই এখন শেষ ভরসা, আর তোমাগো বন্ধু। আমি যে তার কাছে দুই চাইডা গালি হুনতে আহি, হে কি বুঝে…

টিএসসির সামনে দাঁড়িয়ে ফয়সাল সেদিন কথাগুলো বলছিল আমাকে শান্ত করার খাতিরে, আমাকে মানিয়ে নেয়ার জন্য ওর কাকুতি মিনতিগুলো আমাকে অহংকারী করে তুলছিল, দিনদিন। চাহনীতে জমা ছিল অবজ্ঞা। খেয়াল করতাম, ওর পায়ের আঙুলগুলোকে ,অবিরাম ধূলো সয়ে নোংরার চুড়ান্ত। নিজের প্রতি উদাসীন মানুষটা আমার প্রতি ভয়ংকর যত্নশীল ছিল। আর যত্নশীল ছিল নেশায়। রাজনীতি ওর নেশা ছিল। অকপটে বলতো সে কথাগুলো। এদিকে এতটাদিন না আসার কারণ, সাথে বিভিন্ন রকম আন্দোলনের খবরা-খবর। সিগারেট নিয়ে আমার আপত্তির কারণে প্রায় সময় এমনই কথা শুনতে হতো আমাকে, যখনই ওকে শর্ত জুড়ে দিতাম, আমার আর ধূমায়িত শলাকার ভেতরে একটিকে বেছে নেয়ার মাল্টিপল চয়েসের প্রশ্নে। কিছু সময় তর্ক করত, কিছুসময় বড় বড় স্বপ্নের গল্প, একটা সময় বোঝাতে অপারগ হয়ে রাগ করে আমাকে ফেলে উঠে যেত আড্ডার আসর ছেড়ে। ছুটে চলা রিকশায় উঠে পড়ত। হাতের মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক তখন ওতটা রমরমা হয়নি। ১০ টাকায় পার্লস গুনে গুনে আতঙ্কে কথা বলতে হতো। ওভাবে সপ্তাহখানিক কেটে যেত, তারপরে শুরু হতো পেছন পেছন ঘুরঘুর করা। বিড়াল যেমন আদর পেতে পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে, ঠিক তেমনটা। হয়তো আমি উদ্যানে শর্মী, তন্দ্রা সাথে বসে গল্প করছি। হঠাৎ উঁচু কালো মাড়িতে সারিবদ্ধ দাঁতগুলো বিকশিত করে হাজিরা হত। কিছুসময় দাড়িয়ে থাকত, আমার বন্ধুদের সাথে তর্ক করত বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক ইস্যু নিয়ে, তারপরে আমার পাশে এসে বসত, হাতটা নিজের মুষ্ঠিতে নিয়ে, কিছু না বলে এক ঝাটকায় টেনে তুলে নিয়ে আসত ওদের কাছ থেকে, আড়ালে। তখন কোথা থেকে যেন একটা অধিকারবোধ চলে আসে ওর ভেতরে ,সেই বোধ আমাকে তুলতুলে আদুরে বালিকা বানিয়ে দিত। আর ওকে কাঁচামাংসের খাদক। আমরা ছুটতাম দুর্ভেদ নেশায়। তারপরে কিছুসময় একান্তে কাটিয়ে রাগ, অভিমানের বরফকে জলে গড়িয়ে হলে ফিরে আসতাম। ওর চোখের টলমল জলে রোদের ঝলক আমায় প্রবোধ দিত, মানুষটা আমার ।

হুম, আমি এই মানুষটাকে আমি বুঝতাম, ও যেদিন আসত, আমি বাতাসে ওর গায়ের চাপা গন্ধটা টের পেতাম, এখন মনে পড়লে কিংবা মনে করার চেষ্টা করলে সামনে এসে দাঁড়ায় পারিচিত কিছু দৃশ্যপট। কিছু রোদ্দুরের মতো সতেজ হয়ে, কিছু আবার কুয়াশার মতো ধোঁয়াসা। মলিন মুখটায় জমে থাকত আমাকে নিয়ে কত অভিযোগ…

এই মানুষটার সাথে ঝগড়া বোঝাপড়াটা ছিল প্রায় দুই বছর। সেটা আরো দ্বিগুণ হয়ে, একচিলতে বারান্দার টবের ফুলে স্থির হতে পারত। কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি?

ওর সাথে পরিচয়ের আগে তমালের সাথে সখ্যতা ছিল, তমাল ছিল আমার কিশোরীবেলার প্রথম আলিঙ্গন। মফস্বল আবহে বেড়ে উঠেছিলাম তমাল ও আমি। আমাদের সখ্যতার স্বাক্ষর বিচরন করত বিভিন্ন গাছে ও দেয়ালে দুটো শব্দের মাঝে যোগচিহ্ন দৃশ্যমান হত। আমরা ছিলাম আমিষ গন্ধী বিনোদন আমাদের পাড়ায়। মুরব্বিরা দু-চার কথা বলত, চায়ে চুমুক দিতে দিতে। অবশ্য সেই আলাপ বেশী দূর এগোয়নি। তমাল দূরদেশে পড়তে গিয়ে আমাকে ভুলে গেল। প্রতারনায় ভেঙে পড়া আমি নিজের নামটাকে বিখ্যাত করার নেশায় পাড়ি দিলাম শহরের কোলাহলে। নেশাখোর হলাম পড়াশোনায়। আমার সারাদিন তখন কেটে যেত হয় ক্লাসে না হয় লাইব্রেরিতে নোট গোছানোর তাড়ায়। সেই তাড়াই আমার কাল হলো, ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতে যাবার তাড়া ছিল, টুকটাক নোট গোছানোর তাগিদে। কিন্তু রিকশায় উঠে পড়লাম কুগ্রহে, রিকশা সামনে এগিয়ে যেতে পারে না, সামনে বিশাল মিছিল। একটা সময় বিরক্ত হয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ি। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসি মিছিলের সামনের সারিতে। সেখানে দেখি একটা রোদে পোড়া সাদা শার্ট গায়ে জাড়ানো শ্যাম গড়নের হালকা পাতলা লম্বা একটা ছেলে হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। কেন যেন সেদিন এতো মানুষের মাঝে ভেতরে শুধু ওই ছেলেটার উপরে আমার রাগের সকল নিঃশ্বাস একত্রিত হয়। নিরুপায় আমি রাগের সব রেশটুকু নিজের ভেতরে গজগজিয়ে জাদুঘরের সামনে এসে দাঁড়াই। এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষন। পেটের ভেতরে ক্ষুধার ইঁদুর দৌড় টের পাচ্ছিলাম বেশ।
তারপরও কিছুসময় যাদুঘরের মুল ফটকে দাঁড়িয়ে থাকি ক্ষুধার্ত পেটে। নাড়িভুড়ির মোচড়ানো অনুভব করি। আমাকে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয় না। এরই মাঝে পুলিশ এসে লাঠিপেটা শুরু করে, এক মিছিলে সমাজ বদলে ফেলা মানুষগুলোর ছোটাছুটি শুরু হয়। বিপদের হাওয়া সবার আগে নিরীহ মানুষের উপরে এসে পৌঁছায় সেটা মা আমাকে ছোটবেলা থেকে শিখিয়ে ছিল, তাই তো নিজেকে বিপদ থেকে গা বাঁচাতে আমিও দৌড়তে থাকি। একটা সময় বুঝি আমার হাতটা একটা শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি। তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা। রাগে এক ঝটকায় হাতটা ছড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। সেই ছেলেটাও দাঁড়িয়ে পড়ে, আমার দিকে অবাক-খুশি মিশেল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । হঠাৎ অচেনা একজনের উপস্থিত, আগের পুষে থাকা রাগের উত্তেজনায় আমি কিছুসময়ের জন্য বোবা বনে যাই। সেই সুযোগ ছেলেটা সরে পড়ে আমার সামনে থেকে। তারপরের দিনগুলো রোজকার কাজের মাঝে কেটে যায়। হঠাৎ একদিন হলে একটা ছোটো চিরকুট আসে জুনিয়র কয়েকটা মেয়ের হাতে হাতে।

প্রথম দিনের চিরকুট,

একশত টাকা হবে?
পরোটা ডিম খাবো, বাকি টাকা দিয়ে বেনসন কিনব, তারপরে অসংখ্য প্রেমিকার মাঝে যার মুখটা মনে পড়বে, তার নামে দুটো টান দিয়ে ধোঁয়াটা বাতাসে ছেড়ে দেবো। হবে কি একশত টাকা?

চেনে নেই, জানা নেই, হঠাৎ এমন একটা চিরকুট পেয়ে আমি কিছুটা বিরক্ত ও বিমোহিত হয়ে পড়ি। পরক্ষনে মনে হয়, মেয়েটা হয়তো ভুল করেছে, অন্যের চিরকুট ভুল করে আমাকে দিয়েছে, কিন্তু কষকষে জেরায় সবকিছু তেলাপিয়া মাছের ডিম ছাড়ার মতো হড়বড়িয়ে বলে ফেলে।

মেয়েটা বলে, ছেলেটার নাম ফয়সাল। আমি আর আগ্রহ দেখাই না। মেয়েটা চলে যায় একেবারে শূন্য হাতে। এরই মাঝে কেটে যায় অনেকটা সময়। আবারও একটি চিরকুট নিয়ে আসে আমার রুমমেট।

ভালোই তো দৌড়াতে পারো, আসো না, আবার দৌড়াই।

সস্তা কথার চিরকুটটা দেখে আমার মেজাজ আরো গরম হয়, ফালতু ছেলে, পড়াশোনা করে না, সাথে আরো অনেক সম্ভাষণ যুক্ত করে গালাগাল দেই। তখন আমার বন্ধু জানায় ফয়সাল নামের ছেলেটি আমার নাম, ডিপার্টমেন্ট, দেশের বাড়ি, এমনকি কয়টা টিউশনি করি সেটাও জানে। বুঝতে পারি আমাকে পাঠ পুরোপুরি ওর শেষ। একটু ভয় লাগে, এমন ছেলেপেলেরা একটু অভদ্র হয়।

এরপরে অন্য একদিন আমার রুমমেট এসে জানায়, গেটের বাহিরে অপেক্ষা করছে, দেখা করতে চায়, রাগের পরদ উথলে ওঠে যেন। ঠিক করি যাবো না, কি দরকার এমন ছেলের সাথে দেখা করার। আবার মনে হয়, এতোকিছু যে মানুষটা জেনে ফেলেছে, সে যেকোন উপায় ঠিক দেখা করবে। তাই ভদ্রভাষায় জেনে নেয়া দরকার, কি প্রয়োজনে এতোটা আয়োজনের।

গেট থেকে মাথা নুইয়ে বেরতেই দেখি অস্থিরভাবে পায়চারী করছে গোয়ায় ছেলেটা। আমাদের দৃষ্টির মাঝে মুখোমুখি ছিল আমার লাল ওড়ানাটা, ওর রোদ-চশমা। আমার দৃষ্টি ছিল ওর চোখে যা চশমায় ঢাকা ছিল,আর ওর আমার মুখাবয়বে যা লাল ওড়নায় প্যাঁচানো ছিল। অনেকবার ভেবেছি কি হতো যদি আমরা এই আড়াল সরিয়ে সরাসরি তাকালে, অপাঙক্তেয় লাগত নিজেকে!

তারপরে আমাদের হঠাৎ হঠাৎ দেখা হওয়া শুরু হয়। কি মোহে, অজানা এক রহস্যে ছুটে যেতাম সবাইকে লবডঙ্কা দেখিয়ে, ঝামেলাটা অক্সিটোসিনের কারণেই হত। এখন বুঝি। আমাদের দিনগুলো আনন্দময় ছিল, তাই হয়তো, ফয়সালের পরে কারো সাথেই মলাট বন্দি হতে ইচ্ছে করে নাই, নতুবা হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে ভুলে যাওয়ার উপযুক্ত অনুষঙ্গ আজও খুঁজে পাইনি।

প্রায় ২৩ বছর হয়ে গেলো।

সেই নববর্ষের সকালটা আমাদের দু’জন একসাথে ঘোরাঘুরি করার ইচ্ছে ছিল। প্রস্তুতি সেভাবেই ছিল। শহরটাও সেজেছিল বৈশাখি আবহে। ফয়সালকে একটা সাদা পাঞ্জাবী কিনে দিয়েছিলাম। আর ওর কেনার কথা ছিল আমার জন্য লাল চুড়ি। হলে সেদিন সবারই গোসলে তাড়া ছিল, সতীর্থদের অনেকের সেদিন বাহির অপেক্ষামান সঙ্গী ছিল। আমি যখন বের হই তখন শুনি চারপাশে শোরগোল। রাস্তায় লোকজনের ছোটাছুটি দেখে আতংকিত হয়ে যাই। ভয়ে আমি আবারও হলে ফিরে আসি। কিছুসময় পরে খবর আসে বোমা হামলার। বুকের ভেতরে হুহু পাখিটা ডেকে ওঠে। অস্থির আমি, অমঙ্গল আশংকায় পাথর হয়ে যাই, দাঁড়িয়ে থাকি। ঘন্টাখানিক পরে ওর বন্ধু আশরাফ এসে আমাকে দুঃসংবাদটি দেয়। আমার কারো সাথে কোন কথা বলতে ইচ্ছে করে না, আমি শুধু দাঁড়িয়ে থাকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে।

আজ যেমন দাঁড়িয়ে থাকি আদালতের প্রাঙ্গনে।

অভিযুক্তদের থুতু ছিটিয়ে আসতে যাই। যদি একটি বার দেখা হতো সেই লোকগুলো সাথে, সামনে পিছনে পুলিশের ব্যারিকেট, কঠোর আবডালের কারণে সচক্ষে দেখার সুযোগ হয়নি আজও। টিভিতে যেকুটু দেখা যায়, আমি তারপরও যাই, যদি কোনদিন সুযোগটা সিঁড়ি বেয়ে পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে। বলা তো যায় না। ঘটনার এতোটা বছর পরেও আমার দিঘল হুহুটা থামে না।

এখন বাবা মায়ের একটাই কথা, কেন আমি এখনও একা। তাদের কিভাবে বোঝাই, ফয়সালের পরে কারো সাথেই সুখদুঃখ ভাগাভাগি করতে ইচ্ছে করে নাই, আর হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে ভুলে অন্য কারো মাঝে ডুবে যাওয়ার উপযুক্ত অনুষঙ্গ আজও খুঁজে পাইনি। সময় ও আমি সমান্তরাল তালে এগিয়ে যাচ্ছি এখন।

সেদিন ফয়সালের এক বন্ধুর সাথে কথা হলো। অনেকটা বছর পরে, আমার কর্মস্থলে এসেছিল। মাঝেমধ্যে অনেকেই নিজেরা সেধে যোগাযোগ করতে আসে, দেখা করার জন্য। যেহেতু এখন আমি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি, নানা কাজে কাছে দূরের অনেকেই আসে, খোঁজ নেয়। আশরাফ দেশের বাহিরে থাকে। দেশে এলেই দেখা করতে আসে। এখন চুপচাপ বসে আছে আমার টেবিলের সামনে।

ওকে দেখে আমার কেমন যেন অস্থির লাগা শুরু হয় । ফয়সালের কথা মনে পড়ে। আশরাফের কানের পাশে কাঁচা-পাকা চুল, গলার নীচে হালকা মেদ, চোখে চশমা দেখে মনে হয়, ফয়সাল বেঁচে থাকলে ওরও কি এমনতর পরিবর্তন আসত। আমি আঁড়চোখে তাকাই, আর ফয়সালের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য আশরাফকে ভার্সনা দেই । মৃত্যু বন্ধুকে দেয়া ওয়াদা রাখতে আসে। ফয়সাল ওর এই বন্ধুকে মৃত্যুর আগে বলেছিল তার প্রিয় মানুষটাকে দেখে রাখার জন্য। সেজন্যই হয়তো এই আসা। কিছু সময় বসে বসে গল্প করে, চা খায়, অনুমতি নিয়ে সিগারেট খায়, তারপরে চলে যাওয়ার আগে একবার উঠে দাঁড়ায় । তারপরে আবারও বসে থাকে।

জিজ্ঞেস করি, কি দরকার? কোন কথা বলে না। দিনব্যাপী নিরবতার পণ করেছে মনে হয়। আমি কাজের তাড়া দেখিয়ে বিদায় করতে চাই। তারপরও বসে থাকে। বুঝতে পারি কিছু বলতে চায়। অনেকটা সময় পরে নিরবতা ভাঙে আশরাফের। হুরহর করে কেঁদে ওঠে। পুরুষদের কান্না দেখতে আমরা তেমন একটা অভস্ত্য নই। তাই তো আমি একটু বিচলিত হয়ে পড়ি। উঠে আসি স্বান্তনা দেয়ার জন্য, ওমনি আশরাফ আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা শক্ত করে। আচমকা ওর ওমন আচরণ আমিও কিছুটা বিহ্বলিত হয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কাঁদতে থাকে ফয়সালের বন্ধুটি। আমি ওকে বাঁধা দিতে পারি না। কাঁদুক আজ। হালকা হউক। এইভাবে কিছুটা সময় জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার ওপাশে কিছু চোখ এসে যে ফিরে গেছে, টের পাই। তাই তো আশরাফ স্বাভাবিক হলে, চলে যেতে বলি, কাজের তাড়া দেখিয়ে। খারাপ লাগে তারপরও বলি। কারণ আমি যে ফয়সালকে ভুলতে চাই। কিন্তু পারি না, নানা কাজে, যেকোনো দরকারে আমার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাড়িয়ে আছে বিপ্রতীপ কোন হয়ে এখনও।

এক কামরার অফিস কক্ষে সরকারি একজন নারী কর্মকতা একজন চেনাজানা পুরুষকে জড়িয়ে ধরে আছে, বিষয়টা দুই একজনের চোখে পড়েছে,আমি নিজেই সেটা জানি। তারপরে চারজনের কানে যায়, দুই একজন ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার মতো করে বলেই ফেলেন, তাদের নজরে আগেও এসেছিল, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না, তাই এতোদিন বলেন নাই। তারপরে আমাকে আর কিছু করতে হয় না। বাকি সবকিছু অফিসের সহকর্মী, সহকারীরা নিজ নিজ উদ্যোগ করে নেয়। আমার নামে বদনাম, রটনা, ঘটনা, রিপোর্ট সবকিছু হয়। মিটিং হয় আমার অগোচর। আমার এতোদিন সততা, সন্মান, নীতিদর্শন, সবকিছু মুহূর্তেই লোপাট হয়ে যায়। চরিত্রে কালশিটে দাগ লেগে যায়। চারপাশে ফিসফাসের অত্যাচারে চাকরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই।

আজ আমি একেবারে মুক্ত। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বের হতেই দেখি আকশটা কালো হয়ে আছে। হঠাৎ ঝড়,বৃষ্টি। আবহাওয়ার সংবাদে হয়তো ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। নানা ঝামেলায় জানার সুযোগ হয় নাই। আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার তাড়ায় রাস্তায় নেমে পড়ি। আগে বৃষ্টি হলে অফিস থেকে দেয়া গাড়িটা এড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরতে ভালো লাগেত। আজ গাড়ি নাই।

বৃষ্টির দিনে রিকশায় বসে সেদিনগুলোর কথা মনে পড়ে, আমি আর ফয়সাল গল্প করতাম। ও শোনায় ওর ছোটোবেলার গল্প, রাজনীতি ও বিষন্নতার কথা, হলের জীবন। সুযোগ পেলে লুকিয়ে চুমু খেত। আজকের বৃষ্টিটা বেশ জোড়ালো। সারা শরীর সিক্ত আমার। অনুভব করি ফয়সালের স্পর্শ। আমার মনে পড়ে তুমুল বর্ষায় শৈশবের নদীর উচ্ছ্বল আনন্দ, আধ-ডুবা‌ ধানক্ষেত,হেঁটে বাড়ি ফেরার কাদামাখা পথ। আমার আনুষঙ্গিক জীবন থেকে বৃষ্টি, ফয়সাল হারায় না। আমার হাতে টিকটিক করে ওর রেখে যাওয়া কালো বেল্টের চারকোনা ঘড়িটা। প্রতিদিন মুছে রাখায় রুপালি বাকেলটা এখন স্কেলিং করা দাঁতে মতো চকচক করে।

তারপর!

তারপরের গল্পটা অসমাপ্ত থেকে যায়। হঠাৎ ঝড়ের ছোবলে দেশের বহু এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়েছে, গাছ চাপায় নিহত হয়েছে দুজন। এরমধ্যে একজন সরকারি নারী কর্মকতাও আছেন।
***************************************

Leave a Reply