You are currently viewing আলিয়োশা >  লিপি নাসরিন 

আলিয়োশা > লিপি নাসরিন 

আলিয়োশা 

লিপি নাসরিন 

বসার ঘরটা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাকিটা সময় তালাবদ্ধ থাকে। হঠাৎ কেউ এলে, যদিও  আসার মতো অনেকে আছে কিন্তু সময় নিয়ে গল্প গুজব করার মানুষের খুব অভাব, দরজা জানলায় হাত পড়ে। ভিতরে বসবার আসবাবগুলোতে এক বিষণ্ণ গুমোট ভাব থমথম করে। অনেকদিন পর ঘরে প্রবেশ করলে গুমোট পরিবেশের বিষণ্ণ গন্ধে নাক ,চোখ ঝাই ঝাই করে। দেয়ালে ঝুলানো ছবিগুলো যেন চমকে উঠে কাঁপতে থাকে। সেটি কল্পনা নাকি সত্যি  আলিয়োশা ঠিক বুঝতে পারে না। ঘরে প্রবেশ করেই সে প্রথমে ছবির ফ্রেমগুলো সোজা করে বসাতে চায়,তারপর সোফার কাপড়গুলো ঠিকঠাক করে দক্ষিণের দরজাটা খুলে দেয়। ঘরের মধ্যে হুহু করে বাতাস ঢুকে গুমোট বিষণ্ণ বাতাসকে তাড়িয়ে নেয়। পর্দাগুলো দুলে উঠে তিরতির করে। রাত হলে পর্দার সাথে সেও কেঁপে উঠতো। কিন্তু এই সাত সকালে পর্দার এভাবে কেঁপে ওঠা আলিয়োশার সারা শরীরে একটা ভয়ার্ত শিহরন জাগিয়ে তোলে। হঠাৎ তার মনে হলো পর্দার আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। এ ঘরের দরজা জানালার পর্দাগুলো বেশ ভারি। আলিয়োশা এক ঝটকায় দরজার কাছের জানালার পর্দাটি সরিয়ে দেয়। না, কেউ নেই। অহেতুক এই মানসিক অবস্থার জন্য নিজেরই লজ্জা লাগে। প্রচণ্ড এক মানসিক দৃঢ়তা ওর। মায়ের কথাটা কানে বাজে, অন্তরে প্রচণ্ড ভয় পেলেও তাকে কখনো বাইরে আসতে দেবে না। মুখ শক্ত করে রাখবে ,তাহলে তোমার শত্রুরাও বেশি আগাতে সাহস পাবে না। 

মায়ের এই কথা ও মনে প্রাণে ধরে রেখেছে সর্বাবস্থায়। বইয়ের শেলফ মুছতে মুছতে আলিয়োশার মনে হয় জীবনটা এতো ছোট কেন? এক জীবনে পৃথিবীর সব ভালো বইগুলো পড়ে শেষ করা যায় না। বইগুলো ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে একজনের মুখ অবিরাম জেগে ওঠে। সে তাকে অনেক ভালো ভালো বই পড়িয়েছে, কতো বিচিত্র আলোচনা করেছে দুজন। বই, জগৎ,জীবন, কেউ কোথাও নেই তবু শব্দ করে আলিয়োশা  হেসে ওঠে কিন্তু এখন তার বিষণ্ণ হওয়ার কথা ছিলো সেই মানুষটাকে ভেবে। সেই যেদিন প্রথম মানুষটাকে দেখলো তুলতুলে পা ফেলে হেঁটে চলছে তার ঘরের মধ্যে, আলিয়োশার বিস্ময়ের কোন অন্ত ছিলো না। এ কী পুরুষ মানুষ, নাকি পুরুষ শিশু! কেমন এক প্রবল দ্বন্দ্বে কেঁপে উঠেছিল সে। আরো সময় চাই ,আরো বেশি সময় চাই নিজেকে নিজের কাছে সম্পূর্ণ বুঝে নিতে। কী চাইছে আলিয়োশা? প্রেম, সঙ্গ নাকি কেবলি বন্ধুত্ব? আজ আর এসব বুঝতে গেলে নিজেকে কী ভীষণ  স্বার্থপর মনে হয় আলিয়োশার!  হঠাৎ দড়াম করে এক শব্দ শুনে ওর হাসি থেমে যায় , হাতে ধরে রাখা বইটা পড়ে গেল মেঝেতে। দৌড়ে ডাইনিংয়ের দিকে গিয়ে দেখে দরজাটা হা করে খোলা। 

কে? কে? ওখানে কে?

আমি বুবু, কলার কাঁধি  কাটতে কাটতে কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দেয় ফরিদা।

আলিয়োশা পিছনের বারান্দায় গিয়ে জানালার পাল্লা খুলে দেয়। এক ঝলক উত্তরের বাতাস ঢুকে ওর সমস্ত শরীরে কী এক শিহরন  জাগিয়ে যায়। মুখ বাড়িয়ে বলে, কলা কাটছো যে , এখনো তো পোক্ত হয়নি।

আর পোক্ত হবে না বুবু , গাছ কেটে দিতেছি, আবার গোড়া থেকে বের হয়িছে। এবার বড় বড় হবে কলা। 

ফরিদা কয়েক ছড়া কলা গেটের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাগানের রাস্তা পেরিয়ে সদর রাস্তায় গিয়ে ওঠে। আলিয়োশা বারান্দা থেকে আবার বসার ঘরে প্রবেশ করে। এই ঘরে দুই আলমারি বই, নিচের ঘরে আরো পাঁচটি বুক শেলফ ভরা বই। এগুলো সেই মানুষটির। আলিয়োশা বলেছিল, তেমন কিছু চাইবার নেই আমার শুধু আপনার বইগুলো আমাকে দেবেন, ভাববেন না, ওগুলো আমার বংশ পরম্পরায় যত্নে থাকবে। আলিয়োশা আবার স্মৃতি মোহাবিষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো চোখের সামনে এখনো যেন জীবন্ত। বিভাগের বারান্দা, ইনস্টিটিউটে সেই আনন্দঘন বিকেলগুলো তার জীবনে উজ্জ্বলতম আবিষ্কার। সেই আনন্দরূপের  সাথে তার পরিচয় না হলে হয়তো তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়গুলো প্রচণ্ড বিরক্তিকর আর একঘেয়ে লাগতো। কিন্তু তবুও আলিয়োশার মনে এক দ্বিধান্বিত সংশয় কাজ করে। সেটি কি অন্যায় কিংবা পাপ!! এই দ্বন্দ্ব সে বয়ে বেড়াচ্ছে আজতক। তারপর ?? আরো কিছু মুখ জলের অতল থেকে বুদ্বুদের মতো ভেসে উঠে ছড়িয়ে পড়ে পৃষ্ঠদেশে। কেমন অস্বস্তি হয় আলিয়োশার।

ভাবতে চাই না, না কিছুই হয়নি, কিছুই মনে করতে চাই না।  ঘেমে উঠলো আলিয়োশা। 

কে যেন খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো।

যা বেরিয়ে যা, বদমাশ কোথাকার!! কী ভেবেছিলি, হ্যাঁ কী ভেবেছিল? আমি কিছু বুঝতাম না? তোর বিচার আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে দিয়ে রেখেছি। শুধু তোর না তোদের, যা আর কখনো আমাকে বিরক্ত করবি না।

হাত থেকে বইটা পড়ে যায়। চমকে ওঠে ও। পর্দা গুলো আবার দুলে ওঠে। আলিয়োশা উঠে পিছনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এদিকটা বেশ নির্জন। পিছনের দিকের বিরাট বাগানটা পেরিয়ে উত্তরপাশে বাঁকাল খাল। খালটিতে একসময় জোঁয়ার-ভাটা খেলতো। আলিয়োশা শুনেছিল তার দাদীমার কাছে ওদের পূর্বপুরুষ ঐ খাল দিয়ে কোলকাতা যেতো সওদা নিয়ে। তাদের ব্যবসা ছিলো কোলকাতায়। তখন অবিভক্ত বাংলা। স্বদেশি আন্দোলন  দানা বাঁধছে। ইংরেজ খেদাও রব চারিদিকে। আলিয়োশার প্রপিতামহ ছিলো এতদঞ্চলের জমিদারের নায়েব। আলিয়োশার দাদীমা বলতো গাতিদার। তাদের সে বিশাল বাড়িটা এখনো মূল ভবন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে;যেটি তার প্রপিতামহের তৈরি। তার বাবা-চাচা এবং চাচাতো চাচারা মূলভবনকে ঘিরে নতুন স্থাপনা তৈরি করলেও মূল বিল্ডিংটা দাঁড়িয়ে আছে একশ বছরেরও অধিককাল। এই বাড়িটা বৃটিশ ম্যাপে আঁকানো ছিলো ,এবং তখন এ অঞ্চলে জমি মাপের সময় তাদের এই বাড়িটাকে চিহ্নিত করেই মাপজোক হতো। সে কথা এখনো  বলাবলি করে যাদের কাছে পুরানো দলিল আছে। 

কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলে। আলিয়োশা স্মৃতি থেকে ফিরে শোনার চেষ্টা করে। যেন দ্বৈত কথোপকথনে আলিয়োশার কণ্ঠস্বর।

তোমরা কারা?

আমরা প্রকৃতির প্রাণী 

আমি তোমাদের দেখতে পাচ্ছি না কেন?

আমরা চারিদিকে বিস্তৃত হয়ে আছি। দেখতে পাও?

তোমরা কী আলাপ করছো? আমি শুনতে পাচ্ছি না কেন?

আর কোন শব্দ নেই। হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেছে। শুধু বাতাসের হু হু শব্দে ভেসে আসে হেনরি ডেভিড থরোর সেই বিখ্যাত কথা-

“Rather than love, than money, than fame, give me truth.”

“A life in solitude doesn’t need to be lonely”.

আলিয়োশা সিঁড়ি ভেঙে নিচে  নামতে থাকে। ঐখানে  আনন্দ , ঐখানে  সত্য  ,ঐ সত্যের কাছে আমাকে যেতে  হবে।

কবে থেকে যেন বুঝতে শিখেছিলাম ওটা গাছ, ওটা নদী- তারও কতোরূপ , কেমন সুদূরে টানে, ওটা আকাশ সেখানে কতো রকমের খেলা চলে, প্রচণ্ড খেয়ালিপনা তার। কবে থেকে যেন বুঝতে শিখেছিলাম সেই ভোরবেলা যখন কোঁচড়ে করে ভেজা শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনতাম, তার সুবাস  এখনো বোধকে আচ্ছন্ন করে, অন্ধকার বাঁশতলা, শীর্ণ মাটির পথে পিছন ফিরে তাকাতে তাকাতে বাড়ির দিকে হাঁটতাম, তা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে  কখন যেন ঝড় হয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে বেভুলা সময় ,কবে থেকে যেন বটের ঝুরিতে দোল খাওয়া সেই কৃশকায় মেয়েটি সম্পূর্ণ অচেনা হয়ে কালো দেয়াল ফেটে বাইরে এলো, আর উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্টতর হলো তার অবয়ব, কবে থেকে ভাটফুল তার নগ্ন সৌন্দর্য নিয়ে চোখে জেল্লা ধরিয়েছে, কবে থেকে যেন সিন্দুরটোকা আম গাছটার নিচে ঘন হতে থাকা অন্ধকারে ঝি ঝি পোকার ডাককে মনে হয়েছে এক বিস্ময়কর রাগিণী, কবে থেকে যেন এক হারানো পৃথিবী নিস্তব্ধতা ভেঙে উঠে এলো আমার হৃদয়ের মাঝে – সেই তখন থেকে আমার কাছে প্রেম এসেছিল এক অলৌকিক সংবাদ নিয়ে। যে জীবনে প্রেম নেই সে জীবন আনন্দের স্বরূপ বোঝে না। প্রকৃতির নির্জনতার মধ্যে যে নির্ঝরের আনন্দধ্বনি প্রবাহিত তাই প্রেম, সেই অলৌকিক প্রেম। 

আলিয়োশা নিচে নেমে উপরের সিঁড়ির দিকে ঘুরে তাকায়। কেউ কি তাকে বলছিল, আস্তে নামো আলিয়োশা, পড়ে যাও যদি। না, কেউ নেই। আজকাল বড্ড ভ্রম হয়।

মানুষটা সময় অসময়ে যেন সামনে এসে দাঁড়ায়। কতো কিছু সাবধান করে! আলিয়োশার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সত্যি কি মানুষটা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো ,নাকি …সংশয়ে মন উদ্বেলিত হয়। খুব বেশিদিন তো তাদের ঘর-বসতি হয়নি। মোটে  পাঁচটি বছর! কতো কিছু যে এ জীবনে বাকি থেকে যায়! 

আলিয়োশা পিছনের প্রাচীরের গেট খুলে বাগানে ঢোকে। ঘনঝোপে ঢেকে আছে প্রায় চারিদিক, তার ফাঁক দিয়ে পেয়ারা আর বুনো আমড়ার গাছ। পূর্বদিকে সারি করে শবরি কলার ঝাড়, পশ্চিমমুখে বাঁশগাছের জড়াজড়ি, কাড়াকাড়ি। আলিয়োশা আরেকটু এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় যেখানে বড় আম গাছটার একটা মোটা শেকড় যেন হা করে রয়েছে সেখানে গিয়ে থামলো। দুদিন আগে বৃষ্টি হয়েছে ,মাটি নরম। হঠাৎ আলিয়োশা খেয়াল করলো সে খালি পায়ে এসেছে। শরীরে সাময়িক ঝাঁকুনি খেলেও পরক্ষণে সামলে নিলো। ওর জামা, সালোয়ারে এখানে ওখানে জমে থাকা জলের ছাপ। আম গাছের শিকড়ের উপর গিয়ে পা দুটো সামনে মেলে দিয়ে আলিয়োশা বসে পড়ে। 

আব্বার মনে করেছিলেন তিনি প্রথম পুত্র সন্তানের বাবা হবেন। তো অনাগত পুত্রের নাম রাখবেন আলিয়োশা। The Brothers Karazov  আব্বার খুব প্রিয় উপন্যাস। সেই তিন ভাইয়ে ছোটটা যিনি,তার নাম ছিলো আলিয়োশা, অ্যালেক্স ফিয়োদর পুরা নাম; কিন্তু পুত্র সন্তান না হয়ে আমি হলাম মেয়ে তাই বলে আব্বা তার সেই প্রিয় নাম আর পরিবর্তন করলেন না। আম্মার তো এই নাম মোটেই পছন্দ ছিলো না।

ও আচ্ছা তাই বলো। কেউ হয়তো আলিয়োশার কথার পিঠে কথা চালছে।

হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে যেদিন প্রথম কথা হলো, তুমি তো আমার নাম শুনেই প্রেমে পড়েছিলে। বুঝলাম তুমি সব ভুলে গেছো। তারপর হঠাৎ ওর কণ্ঠ জড়িয়ে গেলো- তুমি  তো আমাকেই ভুলে গেছো। 

আলিয়োশা প্লিজ। এই যে আমি তোমার পাশে তোমাকে ছুঁয়ে আছি।

একটা কাঠবেড়ালি গাছ থেকে ছুটে এসে ওর পাশ কেটে বেরিয়ে গেলো। চারিদিকে আবছা কুয়াশার মতো, সূর্য উঁকি দিয়ে লুকিয়ে পড়ছে। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া আসলো কোথা থেকে। আলিয়োশার ওড়না এক প্রান্ত উড়ে গেলো বেশ কিছু দৃর।গাছের শুকনো পাতা ঝরঝর করে নেমে ভেজা মাটিতে ছড়িয়ে পড়লো যেন ঝরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো ওরা। আলিয়োশা তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। উঠে পড়লো চকিত, ঝরা পাতার উপর উপর পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গেলো আরো কিছুটা। সামনে লজ্জাবতীর ঝোপ । বেগুনি ফুলগুলোর যেন তারার সাথে মাস্তি। কোথা থেকে উড়ে এলো একটা সাদা প্রজাপতি। নাচতে নাচতে গিয়ে বসলো ফুলের উপর। আলিয়োশা আস্তে করে এগিয়ে গিয়ে একটু ঝুঁকে তাকিয়ে রইলো।

“I go and come with strange liberty in nature  a part of herself”

ওর মাথার উপর দিয়ে একটা ফড়িং চক্কর দিয়ে উড়ে গেলো। লজ্জাবতীর পাতায় আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে  চললো আরো সামনে।

কী গান গাইছো আলিয়োশা?

আমার তো প্রিয় গান অনেক, সেগুলোর সমন্বয় করে একটা গান, হেসে ওঠে আলিয়োশা।

জোরে গাও, আমরা সবাই শুনি।

আলিয়োশা সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে আনমনে বলে, তুমি সঙ্গীত শুনতে পাচ্ছো না।চুপ চুপ! কথা বলো না। ঐ যে শোন পাতার গান বাতাসের সুরে, ঘুঘুর ঘুঙুরের ধ্বনি,কলাপাতার বাঁশি!

তুমি না এখনো সেই রকমটি রয়ে গেছো, পাগল একটা।

প্রতিটি মানুষের মধ্যে লুকিয়ে আছে আরেকটি মানুষ যাকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না। মানুষ অপ্রকাশ্য হলেই সে প্রকাশ্যে আসে একাকী।

তুমি জানো না ফুকো কী বলেছিল পাগলদের সম্পর্কে? চেতন আর অবচেতন কয়েকবার অস্ফুট উচ্চারণ করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আলিয়োশা। 

Love begin in shadow and end in light.

অনতিদূরে একটি কবর ,বহু পুরোনো, ঝোপজঙ্গলে ভরে গেছে, মাটির ছাদ ভেঙে পড়েছে। চারিদিকে ইটের প্রাচীর খসে চিহ্নস্বরূপ দুএকটি দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা বলেছিল এই জমিটা যাদের কাছ থেকে কেনা তাদেরই কোন পূর্বপুরুষের কবর ওটা। মানুষের মানুষ হয়ে জন্মানোর কী সার্থকতা! সেই তো আর সবকিছুর মতো তাকেও মরে যেতে হয়। ধ্বংস হয়ে যেতে হয়। কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। কেউ আর মনে রাখে না। মানুষ একা, মানুষের কর্ম একা, মানুষের যাপন একা, মানুষের ধ্বংস হওয়া, সেও তো একা! এ নির্সগের সঙ্গী আছে ,মানুষের নেই। জল বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, মেঘের মধ্যে বাস করে আবার বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। মানুষও কি ফিরে আসে? আলিয়োশা আকাশের দিকে তাকায়। গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে খণ্ড খণ্ড ধুসর আকাশ দেখা যায়। কেমন যেন অচেনা মনে হয় সবকিছু।

আলিয়োশা? হু বলে আকাশের দিকে চোখ রেখেই উত্তর দেয় সে।

তুমি কি সেই কথাগুলো ভুলে গেছো?

কোন কথা? একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ওরা কণ্ঠনালীতে ধাক্কা দেয়।

সেই যে ভলতেয়রের সেই কথা

‘It is quite natural that all the metamorphosis seen on earth led in the East. Where everything has been imagined, to the notion that , our souls pass one body to another, a nearly imperceptible speck becomes a worm, a worm becomes a butterfly. An acorn is transformed into an oak, an egg into a bird, water becomes a cloud and thunder. Wood changes into fire and ashes. In short everything in nature appears to be metamorphosed”

মনে আছে , মানুষেরও রূপান্তর ঘটে। আচ্ছা মানুষের কি সত্যিই আর কিছুই থাকে না। একেবারেই কি শেষ? মনে হয় সে যেন কোথাও, কখনো ছিলো না, কিংবা হয়তো ছিলো, হয়তো না।

সব মানুষ হয়তো থাকে না তবে কেউ কেউ তো থাকে। এই যে আমরা ভলতেয়ারের নাম উচ্চারণ করে তার কথা বলছি, তিনি তো আছেন। থাকবেন আরো কতো কতো মহাকালে। অস্ফুট শব্দে হু বললো আলিয়োশা। আকাশ ধূসর থেকে সোনালী রোদে হেসে ওঠে। টুকরো টুকরো সোনা যেন গাছ-লতা ভেদ করে আলিয়োশার মাথায় ঝরে পড়ছে।

আর কতো দূর যাবে? আমার যে পায়ে ব্যথা হয়ে গেলো। সশব্দে হেসে উঠে আলিয়োশা বললো, তুমি কখনো হেঁটে আমার সঙ্গে পেরে ওঠোনি। আমি তোমার কতো আগে থাকতাম মনে আছে তোমার?

হ্যাঁ আছে। তোমাকে একটা  কথা অনেকদিন বলবো ভেবেছি কিন্তু পাছে তুমি কষ্ট পাও তাই বলা হয়নি।

কী কথা বলে জিজ্ঞেস করার উপক্রম করতেই একটা হলদে পাখি সামনের বনপেটরার ঝোপে উড়ে এসে বসলো। কালো মাথাটা এদিক -ওদিক ঘুরিয়ে  দুবার দেখে নিয়েই এক ঝটকায় আলিয়োশার পাশ কেটে বেরিয়ে গেলো।

তবে কি আমার রূপান্তর ঘটছে, মাটি ,অজৈব থেকে জৈব তারপর স্পন্দন আবার চক্র করে স্পন্দন ফুরিয়ে জৈব থেকে অজৈব তারপর মাটি!!

“মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, মাটিতেই আমি তোমাদের ফিরিয়ে নেব এবং এ মাটি থেকেই তোমাদেরকে পুনরায় আবার বের করে আনব।”

আচ্ছা, বলে পাশে তাকাতেই  দেখলো কেউ কোথাও নেই কেবলি নিসর্গের সঙ্গীত বেজে চলেছে আপন খেয়ালে। ও এগিয়ে গিয়ে প্রায় বাগানের সীমানার কাছাকাছি চলে এলো।

আমি জানি তুমি কী জানতে চাও।

বড় জারুলের আড়াল থেকে কেউ একজন বললো, তুমি জানো?

বা রে না জানার কী আছে? তুমি জানতে চাও …

আচ্ছা তার আগে বলতো, আমাকে কি তোমার খুব উচ্চাভিলাষী মনে হয়?

কখনো তা আমার মনে হয়নি। তুমি বরং…

আমাকে খুব মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখতো জানো, এটা ওটা নিয়ে বাজে বাজে কথা বলতো। তার level of intellectuality একেবারে জিরো। তারপরও তো আমি বহু বছর মানিয়ে চলেছি, চলিনি বলো? আমি তো অনেক আগেই ফিরে যেতে পারতাম। কেনো যাবো বলো? যাওয়ার জন্য তো আসিনি। কিন্তু আর পারছিলাম না।

থাক মন খারাপ করো না আলিয়োশা। তোমার জীবনে কিছু ভুল মানুষ এসেছিল, তবে জগতে যা কিছু ঘটে তার অগ্র-পশ্চাৎে  কারণ থাকে।

তবে কী জানো ঐ সব ভুল মানুষ আমাকে অনেক শিখিয়েছে। কিছু পেতে গেলে কিছু তো হারাতে হয় তাই না? প্রতিটি মানুষই তো একা একদম নিজের সাথে।

এটা কি সবাই বুঝতে পারে?

কেউ পারে, কেউ পারে না, লোকটি উত্তর দিলো।

হঠাৎ  ঝরঝর করে বৃষ্টি নামলো। আলিয়োশা দৌড়ে জারুল গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল।

আচ্ছা ঐ যে সেই মানুষটা , যিনি তোমার সাথে দেখা করার জন্য পৌঢ়ত্বকে পায়ে ঢলে তোমার কাছে এসেছিলেন।

খুব অবাক ব্যাপার জানো ,একজন মানুষ শুধু আমাকে দেখার জন্য এভাবে আসতে পারে আমার ভাবনায় ছিলো না। তারপর আরো একবার দেখা হয়েছিল। সেবার আমি গিয়েছিলাম একটা অফিসিয়াল কাজে। ফোন করতেই বললেন, আমি আসছি তোমাকে নিয়ে বাইরে ডিনার করবো, আর কোনদিন দেখা হবে কিনা? মানুষটা খুব অদ্ভুত!!

পরে শুনেছিলাম তিনি অসুস্থ। দু একবার কথা হয়েছিল ফোনে। এখন আর তাকে ফোনেও পাই না। কে জানে কেমন আছে।

আলিয়োশা ঘরে ফিরে যাও ,আরো জোরে বৃষ্টি নামবে হয়তো , লোকটি বললো।

কোন ঘরের কথা বলছো? ঘর আমার কই? এক ঘর থেকে আরেক ঘর, তারপর…

শরীর খারাপ করবে, পাগলামি করো না, ঘরে যাও।

বৃষ্টিতে ভিজলে আমার কখনো কিছু হয়নি। আমি কতো বৃষ্টিতে ভিজে বৃষ্টির জল ধরেছি, স্নান করেছি।

ওই বয়সে ওটা মানিয়ে গিয়েছিল,  এখন বয়স হচ্ছে।

বয়স বাড়ার একটা সুবিধা আছে জানো তো?

কী সুবিধা?

তুমি যা খুশি তাই করতে পারবে সবাইকে থোড়াই কেয়ার করে। কেউ তোমার সামনে কিছুটি বলবে না।

বৃষ্টির তোড় বাড়লো। এখনো আর একটু পথ গেলেই খালের পাড়।

পাতার উপর বৃষ্টির পতনে পাতা কেঁপে উঠছে, পাখিরা এ পাশ থেকে ও পাশে ছুটোছুটি করছে,

প্রাচীরের শেওলা ধরা গা থেকে গুলঞ্চের শুকনো পাতা ঝরে যাচ্ছে মাটিতে

আলিয়োশা সেই জারুল তলে দাঁড়িয়ে দুহাত প্রসারিত করে দিলো সামনে। দুহাতের দুগাছি সোনার চুড়িতে বৃষ্টি যেন রুনঝুন শব্দ তুলে মাটিতে গিয়ে পড়ছে।

“In heaven a spirit doth dwell

‘ Whose heart-strings are a lute’

None sing so wildly well

As the angel Israfel …”

আলিয়োশার হৃদয়তন্ত্রী সুরের মূর্ছনায় ভেসে যায় , আলিয়োশা কাঁদছে।