আমাদের কবিতা-গানে জীববৈচিত্র্যের ছবি
আমিনুল ইসলাম
রূপ-রস-গন্ধে ভরা এই পৃথিবীটা মানুষের একার জন্য নয়। জলে-স্থলে হাজারো রকমের প্রাণী, কীট-পতঙ্গ, অসংখ্য প্রকারের উদ্ভিদ, বৃক্ষরাজি। নানা রঙের ফুল, নানা রকমের পাখি। প্রাণী ও উদ্ভিদ মিলিয়ে পৃথিবীর জলে ও স্থলে প্রাণের যে মেলা-সরলার্থে তা-ই জীববৈচিত্র। জীববৈচিত্র্যের মধো আন্তঃপ্রজাতি বা প্রজাতির বৈচিত্র এবং পরিবেশের বৈচিত্র্য রয়েছে। জীববৈচিত্র্য একারণেই যে, সকল প্রাণী ও উদ্ভিদের সুষম সহাবস্থানই পৃথিবীকে প্রাণী ও উদ্ভিদের বাসযোগ্য করে রাখে এবং রেখেছে। এই জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব রক্ষায় অপরিহার্যরূপে অস্তিত্ববান পরিবেশ ও প্রতিবেশ: পাহাড়, নদী, ঝরনা, সাগর, পর্বত, আকাশ, বাতাস, চন্দ্র সূর্য তারা। সুন্দর বাসস্থানের জন্য বিচিত্র প্রাণী ও উদ্ভিদের উপস্থিতির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। বনে হরিণ না থাকলে চিতাবাঘের গায়ে অপরিমেয় শক্তির জোগান থাকবে না; আবার বাঘ না থাকলে হরিণ হারিয়ে ফেলবে তার চঞ্চল চরণের ক্ষিপ্রগতি, বনভেদী চাহনি। সকল প্রাণীর উচ্চারণমালা, সকল পাখির মধুর কাকলি, উদ্ভিদের সবুজ অভিব্যক্তি, পাহাড়ের ঝরনা, নদীর কুলকুল ধ্বনি এসবকিছু নিয়েই ‘লক্ষযুগের সঙ্গীতমাখা সুন্দর ধরাতল’।(‘পুরস্কার’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) বনবিভাগ সংগত কারণেই আজকাল এই ধারণাটি নিয়ে জোরেসোরে কথাবার্তা বলছে। পৃথিবীতে যে সব লতাগুল্ম, বৃক্ষরাজি, মাছ, কীট-পতঙ্গ এবং অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী আছে, তারা প্রকৃতিতে পরস্পর প্রয়োজনে লড়াই করে এবং তার চেয়ে বেশি পার¯পরিক নির্ভরশীলতার মাধ্যমে বেঁচে থাকে। প্রকৃতিতে বিরাজমান পারস্পারিক স্বাভাবিক দ্বন্দ্ব ও নির্ভরশীলতা তাদের সকলের ভারসাম্যপূর্ণ সংখ্যা ও পরিমাণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অটুট রাখে। সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির প্রকৃতিক নিয়মে দ্বন্দ্ব-নির্ভরশীলতার-মাধ্যমে টিকে থাকার পক্ষে যে ধারণা সম্প্রতি বেশি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তার নাম জীববৈচিত্র্য। কৃত্রিমভাবে কোনো বিশেষ প্রাণী বা উদ্ভিদ প্রজাতি নিধন করা হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে এবং ক্ষতি হবে সকলের। যেমন- ব্যাঙ উজাড় হয়ে গেলে ক্ষতিকর পোকামাকডের বৃদ্ধি ঘটবে, সাপের সংখ্যা কমে যেতে পারে এবং ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যাবে। তাছাড়া ইঁদুর নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে নতুন আবিস্কারে সহায়তাও করে থাকে। সকল প্রাণী যেহেতু মূলত উদ্ভিদ বা অরণ্যের ওপর নির্ভরশীল জীবন যাপন করে এবং যেহেতু সকল জীবের বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ ও ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে থাকে বৃক্ষরাজি বা অরণ্য, তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছে বৃক্ষনিধন এবং বন উজাড় হওয়া কার্যকরভাবে প্রতিহত করা। বিজ্ঞানমতে একটি প্রমাণ সাইজের আমগাছ পাঁচসদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের সারা বছরের অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে। ১ হেক্টর পরিমাণ বনভূমি ৬০০-৬৫০ কেজি অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং একই সাথে ৯০০ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাস হতে অপসারণ করে থাকে। একটি গাছ পরিবেশ বিশুদ্ধ রাখার জন্য যে অবদান রাখে তা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে করা হলে কমবেশি ১৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে। ৫০০ মিটার বনভূমি ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমাতে পারে। (‘অরণ্যের জন্য ভালাবাসা’, আ,ল,ম, আবদুর রহমান) বৃক্ষ ও প্রাণীর ইতিহাস পারস্পারিক নির্ভরশীলতা ও সহ-অস্তিত্বের ইতিহাস।
প্রায় ৩০০ কোটি বছরের বিবর্তনে জীববৈচিত্র্য বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে। হিসাব মতে বর্তমানে পৃথিবীতে উদ্ভিদ ও প্রাণ প্রজাতির সংখ্যা একত্রে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ। (‘অরণ্যের জন্য ভালাবাসা’, আ,ল,ম, আবদুর রহমান) সমগ্র জীবনের মূলে রয়েছে সূর্য। মাটি ফুড়ে উঠে তা প্রথম অনুভব করেছিল উদ্ভিদ এবং তাই সে-ই প্রথম সূর্যকে প্রণতি জানিয়েছিল। উদ্ভিদকে জন্ম দিয়ে বসুন্ধরা অনুভব করেছিল প্রথম সৃজন বেদনা- এবং বাৎসল্য মায়া। প্রকৃতি প্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথের গভীর অনুভূতিময় কাব্যিক উচচারণ ছুঁয়েছে সেই রহস্যের রোমাঞ্চকর শরীর:
অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ-
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-পরে, আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।
(‘বৃক্ষবন্দনা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থে মানুষের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তারা যেন অযুত সৃষ্টির বৈচিত্র্যময় সমাহারকে দুচোখ ভরে দেখে এবং তাকে অস্বীকার না করে। বলা অযৌক্তিক নয় যে সৃষ্টিকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এবং মনের ভালোবাসা মিশিয়ে দেখার চোখ মূলত কবি সম্প্রদায়ের। কবিরা জীববৈচিত্র্য শব্দটি ব্যবহার না করলেও তাদের কবিতায় জীববৈচিত্র্য ও তার পটভূমি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ছবি এঁকেছেন নিপুণহাতে। কবির পক্ষেই তাঁর জন্মভূমিকে ‘নমো নমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি’ (‘দুই বিঘা জমি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) বলে সম্বোধন করে তার জীববৈচিত্র্যভরা প্রকৃতির বন্দনা করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় গঙ্গা নদী-স্নিগ্ধ সমীরণ, অবারিত মাঠ, উদার আকাশ, ছায়াসুনিবিড় গ্রাম, পল্লবঘন আম্রকানন, মাঠের রাখাল, দিঘির কালো জল একটি জনপদকে ভরে তুলেছে জীব ও উদ্ভিদের সুষম সহ-অবস্থানের পটভূমিতে। আর নদী থাকলেই মাছ, কুমির, শশক, নৌকাসহ মাঝি; মাঠ থাকলেই শস্যের সারি, পশুপাখি, কৃষকের গান, আকাশ থাকলেই মেঘ, বলাকার উড্ডীন ডানা; পল্লবঘন আম্রকানন থাকলেই ভোমরা, মৌমাছি, ফুল ও ফলের সমাহার, পাখির কুজন; রাখাল থাকলেই গবাদির পাল, মেঠোসুরে বাঁশি। এখানেই তো জীববৈচিত্র্যের শত এককের ছড়াছড়ি।
পরিবেশ বিজ্ঞানে একটি কথা আছে: প্রতিবেশ। কোনো একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে থাকা সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাহারকে ঐ অবস্থানের প্রতিবেশ বলা হয়। এর দুটি অঙ্গ। মাটি, পানি, বায়ু আলো হচ্ছে জড়জগৎ। উদ্ভিদ ও প্রাণী মিলিয়ে প্রাণের জগৎ। দুটো মিলে প্রতিবেশ। আমার যখন ছোট, পাঠশালার যাত্রী; মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়েছি, মুখস্থ করে শুনিয়েছি বন্দে আলী মিয়ার সেই বিখ্যাত কিশোর কবিতা ‘আমাদের গ্রাম’, যা একটি সুন্দর প্রতিবেশের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখিত হতে পারে । সেখানে মায়ের সমান ছোট গ্রামকে প্রকৃতি আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, সে গ্রামের মাঠ ভরা ধান, জলভরা দিঘিতে চাঁদের আলো পড়ে ঝিকমিক করে ওঠে পরিবেশ। আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড়, পর¯পর আত্মীয়ের মতো মিলেমিশে রয় এবং সকালে সোনালি সূর্য পূর্বদিকে ওঠার সাথে সাথে পাখির কুজন ও মৃদমন্দ বাতাসের ফিসফিসানিতে সাড়া দিয়ে ফুটে ওঠে শত রকমের শত বর্ণের ফুল। কবি দেখেছেন: ‘মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।’ (‘আমাদের গ্রাম’, বন্দে আলী মিয়া) জীববৈচিত্র্যের মূলকথাও হচ্ছে অনুকূলে ভৌগোলিক প্রতিবেশে সকল প্রাণী ও উদ্ভিদের এই ‘মিলে মিশে’ থাকা।
সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশ। ফুলপাখি, গাছপালা, জলজ প্রাণ, পাহাড় নদী এসবকিছুর সমাহার আমাদের দেশকে ভরে তুলেছে মুখরিত জীববৈচিত্র্যে। পল্লীকবি জসীমউদদীন দেখেছিলেন প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা গ্রামবাংলার এই রূপ। তিনি শহরের জীববৈচিত্র্যহীন যন্ত্রনির্ভর পরিবেশ ছেড়ে আধুনিক মানুষকে ‘গাছের ছায়ার লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়’-ভরা গ্রামে বেড়াতে যাবার ‘নিমন্ত্রণ’ জানিয়েছেন আজ থেকে অনেক বছর আগেই। সেখানে রাখাল ছেলে গরু চরায় মাঠে, তার বাঁশির সুরে কান পাতে গাঁয়ের যুবতি, সেখানে গাছে গাছে ডাকে দোয়েল-শ্যামা-ঘুঘু; সেখানে রাস্তার ধারে খালে কিলবিল করে ডানকিনে মাছ, সেখানে নদীর জল কাকের চোখের মতো কালো। কবি আল মাহমুদ তাঁর মায়ের হারানো ‘নোলক’ খুঁজতে গিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বাংলাদেশ। খুঁজে পাননি; তবে এ দেশের মাটিজলে তিনি পেয়েছেন জীববৈচিত্র্যে ভরা এক নান্দনিক মিলনমেলার সন্ধান। সে মিলন মেলায় বোয়াল মাছ, তিতাস নদী, সাদা বকের ঝাঁক, সবুজ বন, বনের হরিণ, টিয়ে, সবুজ চুলে ফুলপরা বনের সাধারণ পাখি, সুগন্ধীযুক্ত ফুল, আহারভরা বুক নিয়ে পাহাড় এবং পাতার ফাঁকে-চেয়ে-থাকা হাজারো হরিণ পারস্পারিক সৌহার্দ্য ও নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে আমাদের এবং তাদের সকলের মাতৃভূমিকে ভরে রেখেছে বিচিত্র আনন্দ ও সৌন্দর্যের সমারোহে। কবিতাটির কয়টি লাইন উদ্ধৃত করা যেতে পারে:
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনে দিক
সবুজ বনের হরিণ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমার তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি না তো।
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো-
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক।
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
(‘নোলক’, আল মাহমুদ)
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি উপাধি শুনে মনে হয় শুধু ভাঙচুর, শুধু বিপ্লব, শুধু তোলপাড়। ভয়ে শিউরে ওঠে গা। অথচ এই মানুষটির হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশের পাহাড়-ঝর্ণা-নদী, বনের প্রাণী, ফুলের বাগান, পাখপাখালির মেলা। নজরুলের একটি গান এমন-
আকাশ হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ
ঐ পাহাড়ের ঝর্না আমি উধাও হয়ে বই গো
উধাও হয়ে বই।।
চিতা বাঘ মিতা আমার গোখরো খেলার সাথী
সাপের ঝাঁপি বুকে করে সুখে কাটাই রাতি…..।
ঘূর্ণী হাওয়ার উড়নি ধরে নাচি তা থৈ থৈ
ও আমি নাচি তা থৈ থৈ
পাহাড় ঘুমায় ঐ।।
(নজরুলসংগীত)
কাজী নজরুল ইসলামের এই গানে মানুষ, সাপ, চিতাবাঘ প্রভৃতি প্রাণী এবং আকাশ, পাহাড়, ঝরনা, ঘূর্ণি হাওয়া বন সবাই মিলে যে আনন্দযজ্ঞের আয়োজন করেছে, তাতে তারা নিজেরাও নিমন্ত্রিত, নিমান্ত্রিত জগতের অন্যান্য প্রাণী এবং উদ্ভিদও। তা না হলে নজরুল এই আনন্দ-আয়োজনের জীবন্ত কথাচিত্র আঁকলেন কীভাবে? আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড়, পাহাড়ের কন্যা ঝরনা, ঝরনার মিতা চিতাবাঘ, তার খেলার সাথী গোখরো ও ঘূর্ণি হাওয়া এবং সে ঘূর্ণি হাওয়ার উড়নি ধরে তাথৈ থৈ নেচে বেড়ায়। এদের যে কোনো একটির অনুপস্থিতি আনন্দ-সমগ্রের অঙ্গহানি ঘটাবে এবং তা থৈ থৈ পাগলপারা আনন্দ-নৃত্যের ছন্দপতন ঘটবে। যদি পাহাড় না থাকে তবে ঝরনা জন্মরহিত হবে; ঝরনা না থাকলে নদী শুকিয়ে যাবে এবং পাহাড় না থাকলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিও হবে না। ফলে মরে যাবে উদ্ভিদ। শুকিয়ে যাবে বন। বন না থাকেল চিতাবাঘ, হরিণ, সাপ, পাখি কোনোটাই থাকবে না। সবুজের রাজধানী মরুতে রূপান্তরিত হবে। হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য; অসম্ভব হয়ে পড়বে মানবসম্প্রদায়ের দীর্ঘ ও উপভোগ্য অস্তিত্ব। এমন মধুর গান রচনা ও সুর সৃষ্টির ভাবনাও বাসা বাঁধবে না কবির মেধা ও মননে। বিরাজমান সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ একটি ভৌগোলিক প্রতিবেশে বৃহত্তর জীবন-সমাজের পরস্পরের সম্পূরক ও পরিপূরক হয়ে, জগতের আনন্দ-যজ্ঞের আয়াজক ও অংশীদার হয়ে নিজ নিজ প্রজাতির স্বাভাবিক অস্তিত্বের আয়ুস্কাল পূরণ করবে- এটাই জীব-বৈচিত্র্যের মর্মবাণী। সেই মর্মবাণীর কাব্যিক ও সুরেলা কথাচিত্র কাজী নজরুল ইসলামের এই গান।
নজরুলের কবিতা-গানে অসংখ্য পাখপাখালির মেলা; হরেক রকম ফুলের সমাহার। তাঁর কবিতা পড়ে, গান শুনে মনে হয় জীববৈচিত্র্যের বন্দনা এ সব। নজরুলের পাখিগুলোর নামের তালিকা পাখি বিশারদদেরও বিস্মিত করবে। তিনি কি কখনো ড. সালীম আলীর মতো বিলে-ঝিলে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন? তাঁর পাখপাখালির নাম:- নীলকণ্ঠ, চড়ূই, হাঁড়িচাঁচা, মানিকজোড়, ঘুঘ, হলদেপাখি চুমকড়ি, ছাতারে, ময়না, কুক, টুনটুনি, শালিক, মুরগি, বাবুই, খঞ্জনা, পানকৌড়ি, রাজপাখি হুতুমপেঁচা, বক, ভুতমপেচাঁ, জলপায়রা, টিয়া, পেঁচা, সারস, মৌটুসী, গাঙচিল, চিল, কাক, ফিঙ্গে, ডাহুক, বলাকা, চোখগেল, চখাচখী, শকুন- শ্যামা, কপোত, হাঁস, বউ কথা কও, দোয়েল, চকোর-চকোরী, চাতক, ময়ূর, কৌকিল, পাপিয়া, বুলবুল, কোয়েলিয়া, বুনোহাঁস, শুকসারী, বনকপোত, জলপায়রা, মাছরাঙ্গা মরাল প্রভৃতি। এসব পাখির জন্য রয়েছে বিল-নদী, গাছপালা, ফুল ও ফল। নজরুলের কবিতা-গানে এত বিচিত্র ধররের ফুলের নাম ব্যবহ্নত হয়েছে যে, তাঁর কবিতা-গানকে বাংলার ফুলবাগান বলা চলে। নজরুলের ফুলের নামগুলো হচ্ছে: মহুয়া, পলাশ, বকুল, শিমুল, অশোক, চম্পা, মধুমালতি, বেলা, পথ-মজ্ঞুরী, কদম, সন্ধ্যামালতী, কমল, শাপলা, মল্লিকা, শালুক, পদ্ম, চামেলী, সূর্যমুখী, সন্ধাামণি, রজনীগন্ধা, কুমুদিনী, তারাফুল, চাঁপা, গোলকচাঁপা, নার্গিস, টগর, যুথী, বেল, গোলাপ, পারুল, বৈঁচি, কলমি লতা, ভাঁটফুল, রক্তশালুক, হলুদচাঁপা, কেয়া, নীলশালুক, জুঁই, নীলকলম, ডালিম, বনফুল, শিরীষ, বাবলাফুল, কেতকী, নাগকেশর, মৌরিফুল, শিউলি, কুন্দ, করবী, কনকগাঁদা, কৃষ্ণচুড়া, কৃষ্ণকলি, অপরাজিতা, মাধবী, বনতুলসী, দোলনচাঁপা, মল্লিকা, হিজল, ঝিঙেফুল, রঙন, হাসনাহেনা, সর্ষেফুল, কামিনী, নেবুফুল, সজিনা ফুল, সোঁদালফুল, কাঁঠাল-চাঁপা, কচুরী, জবা প্রভৃতি। জীববৈচিত্র্যের ধারণার বৃত্তের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গৃহপালিত প্রাণী, বন্যপ্রাণী, নানাজাতের গাছপালা, লতাগুল্ম, কীটপতঙ্গ এবং তার অনিবার্য অনুষঙ্গ প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ। যেমন: পাহাড়-পর্বত, নদী, খাল,ঝরনা, মাটি, পানি, বায়ু ইত্যাদি। নজরুলের একটি গানকে জীববৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক প্রতিবেশের নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ত্রিতালে রচিত গানটির নাম ‘বসন্তমুখারী’ যা নিম্নরূপ:
বসন্ত মুখর আজি
দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে
বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি’।।
অকারণ ভাষা তার ঝরঝর ঝরে
মুহু মুহু ‘কুহুকুহু’ ‘পিয়াপিয়া’ স্বরে,
পলাশ বকুলে অশোক শিমুলে
সাজনো তাহার কল-কথার সাজি।।
দোয়েল, মধুপ, বন-কপোত-কুজনে
ঘুম ভেঙে দেয় ভোরে বাসরশয়নে।
মৌনী আকাশ সেই বাণী বিলাসে
অস্ত-চাঁদের মুখে মৃদুমৃদু হাসে।
বিরহ শীর্ণা গিরি ঝরণার তীরে
পাহাড়ী বেণু হাতে ফেরে সুর ভাঁজি।।
নজরুলের এই একটি গানে পাহাড়, ঝরনা, নদী, জঙ্গল, গাছপালা, ফুলপাখি, কীটপতঙ্গ, আকাশ, চাঁদ, বাঁশি, বাসরশয়ন, বিরহ-মিলন সমীরণ, বনমর্মর, প্রকৃতির ভাষা এ সবকিছুই জীববৈচিত্র্যের বাহ্যিক রূপের বাহার ও আত্মিক ঐকতানের মাধুর্য নিয়ে সুষম সহাবস্থানের ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে।
প্রকৃতির আর এক নিবিড় সন্তান কবি জীবনানন্দ দাশ। সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা পাখিডাকা ছায়াঢাকা বাংলার রূপ তাঁর চোখে ধরা দিয়ে দিয়েছে জীববৈচিত্র্যের সমাহার নিয়ে। বাংলাদেশের নদনদী, পাখপাখালি, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষরাজি, লতাগুল্ম-শস্য-ফল, মাটির গন্ধ, আকাশের রঙ, নদীর কুলকুল ধ্বনি, পাখির কুজন, গুবরে পোকার অস্ফুট ভাষা, বনের মর্মর সবকিছুই জীবনানন্দের কবিতায় উপস্থিত হযেছে নতুন মাত্রা ও নবতর ব্যঞ্জনা নিয়ে। তাঁকে প্রকৃতির নিবিড় চিত্রকর বলা যায়। তাঁর ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থকে উদ্ভিদ-উদ্যান ও ইকোপার্ক এর শাব্দিক প্রতিচ্ছবি বলা চলে। নমুনাস্বরূপ উক্ত কাব্যগ্রন্থের নিচের কবিতাটি:
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ:
সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল:
সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে- সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অ¯ফুট, তরুণ;
সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকার ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকারে সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের পর –
শঙ্খমালা নাম তার; এ-বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়ে ছিলো বর,
তাই সে জম্মেছে নীল বাংলার ঘাসে আর ধানের ভিতর।
(‘এই পৃথিবীতে এক’, জীবনানন্দ দাশ)।
জীবনানন্দের কবিতার রাজ্যে জলসিঁড়ি, ধানসিঁড়ি, ধলেশ্বরী, কর্ণফুলী, জলাঙ্গী, গাঙুড়, পদ্মা নদীর জল পান করে বেড়ে উঠেছে অসংখ্য উদ্ভিদ-ঔষধি, বনজ ও ফলজ গাছ। কাঁঠাল, হিজল, ডুমুর, জাম, বট, অশ্বত্থ, ফণীমনসা, শটিবন, কলমিদাম, ভাঁটফুল, অপরাজিতা, আকন্দ, বাসকলতা, কামরাঙ্গা, বেত, নাটা, ধুন্দল, ভেরেন্ডা, তাল, তেঁতুল, কদম, শিয়ালকাঁটা, আনারস, শিমুল, কাঁঠাল, লালশাক, বুনোচালতা, হেলেঞ্চা, বাঁশ, পলাশ, কাঁঠালীচাঁপা, কাঞ্চনমালা, সুন্দর, মাদার, পরথুপী, মধুকুপীঘাস, লিচু, রুপশালীধান, বালামী-ধান, শাল, সেগুন, পশমিনা ধান, কমল, গোলপাতা, করবী, আশশ্যাওড়ার বন, সজিনা, জামরুল, গাব, শসলতা, করমচা, বেলকুড়ি, সুপারির বন, ক্ষীরুইগাছ, ঢেঁকিশাক, সর্ষেক্ষেত্র, বাসমতী, চিনিচাঁপা, পামগাছ, লেবুগাছ, এলাচিফুল, দারুচিনি, আলোকলতা, দ্রোণফুল, তলতাবাঁশ, মৌরীফুল, নোনাফুলের গাছ, আতাগাছ, ঝাউবন, জামরুল, আমগাছ, খাগড়ার বন, নলখাগড়া, শ্যাওয়া, কাশবন, গোলাপ, কাঁটাবন, বেলগাছ, শিউলি, বাবলা, মাকাল, শিরীষবন, বাতাবিলেবু, মেহগিনি, তরমুজ, পেয়ারা, মোরগফুল, অর্জুন, মটকাফলের গাছ, দেবদারু, চোরকাঁটা, হরিতকি, পিয়াশাল, পিয়াল, আমলকি, নিম, জামিরের বন, পিপুল, কলার বাগান, হোগলা, চন্দ্রমল্লিকার বন, জলপাই, জাফরান, উলুবন, টমাটো, তমাল, বঁইচির ঝোপ, শাঁই বাবলা, ক্যানাফুল, নাগার্জুন, নাশপাতি, নাগেশ্বর, নাহর গাছ, পুষ্পসেবী, পানবন, রজনীগন্ধা, কাঞ্চন, পুঁই, ডুমুর, শেফালী, কৃষচুড়া, কুল প্রভৃতি। আর এই সবুজ প্রাণের সমারোহকে কলকালতি ও মধুর গুজ্ঞনে ভরে রেখেছে জীবনানন্দ দাশের পাখি ও কীটপতঙ্গের দল। দাঁড়কাক, শালিখ, লক্ষীপেঁচা, গাঙশালিখ, হাঁস, রাজহাঁস, দোয়েল, বক, মাছরাঙ্গা, শ্যামা, ঘুঘু, কবুতর, ফিঙে, খজ্ঞনা, শকুন শঙ্খচিল, গাঙচিল, বউ কথা কও, চড়ূই, কোকিল, পানকৌড়ি, ডাহুক, মুনিয়া, শুক, নিমপাখি, সুদর্শন, নিমপেঁচা, চকোর-চকোরী, বাদুড়, হীরামন, মরাল, পাপিয়া জীবনানন্দ দাশের জামিরের বনে, হিজলের ডালে, বঁইচির ঝোপে গান গেয়ে চলেছে দিনরাত। তার সাথে মেঠো ইঁদুর, গোবরে পোকা, ঝিঁঝিপোকা, গঙ্গাফড়িঙ, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা, নীলভোমরা, ভীমরুল, রুপলিমাছ, স্বরপুটিমাছ, রুপালিচিতল, সাপমাসী, বেজী, জোনাকি-পাকা, মাছ প্রভৃতির অর্ধ¯ফুট ভাষা ও ধ্বনি তাঁর কবিতাঙ্গনকে ভরে তুলেছে নিবিড়প্রাণের গুঞ্জরনে। তাই তো এই প্রাণের মেলা ছেড়ে যেতে চাননি জীবনানন্দ দাশ। ‘আবার আসিবো ফিরে-ধনাসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়’বলে তিনি ঘোষণা দিয়ে গেছেন। (‘আবার আসিব ফিরে’, জীবনানন্দ দাশ)
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতায় ব্যক্তির আর্তি ও সঙ্কট এবং সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষার ছবি ফুটে উঠেছে, তবে তাঁর অধিকাংশ কবিতার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যময় চিত্রপট। তাঁর কবিতা পাঠকের নিকট উপভোগ্য হওয়ার এটা অন্যতম প্রধান কারণ। অকাল প্রয়াত কবি আবুল হাসানের গভীর অনুভবের মন ও সুক্ষ্ণ প্রত্যক্ষণের চোখে ধরা পড়েছে প্রতিবেশের খুঁটিনাটি ছবি। তিনি তাঁর ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কাব্যগ্রন্থে ‘গাছগুলো’ এর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছেন: সকালে কাঠের খোপ থেকে বের হয়ে মুরগিগুলো যখন শস্যকনা খোঁজে, তখন কাক ও চড়ূই খুঁটে খুঁটে তুলে আনে টাটকা সুগন্ধী ভোর। আর তখন গাছগুলো তাদের জন্য মিহি অক্সিজেন ঢেলে দেয়। তাছাড়া, তারা সারারাত শয়নিতা পাখিনীর শয়ন গড়িয়ে রাখার পর সকালের জন্য সাজিয়ে রাখে প্রাতঃরাশ এবং বেলা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ‘সচ্ছল সিন্দুক থেকে বের করে দেয় রোজ ভেষজ ওষুধ ফল’। (‘গাছগুলো’, আবুল হাসান) জীবের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও ঔষধ বৃক্ষই সরবরাহ করে থাকে- এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি আবুল হাসানের এই কবিতায় কাব্যিক ব্যঞ্জনাসহ ফুটে উঠেছে।
শুরুত যে কথা বলা হয়েছে যে জীবনের অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে বৃক্ষ। জীববৈচিত্র্যের মূল কথাটি এই যে এই পৃথিবীর সকল প্রাণী এবং উদ্ভিদ পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। আবার এদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য নদী-সমুদ্র-বৃষ্টি-পাহাড়-পর্বত প্রভৃতি ভৌগোলিক উপকরণাদির সুষম উপস্থিতি। তবে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বৃক্ষের আনুপাতিব উপস্থিতি। হয়তো একারণেই কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বলেছেন: ‘প্রাণের আদ্যকথা গাছ ….. / প্রাণের মধ্যকথা গাছ/ প্রাণের অন্তঃকথা গাছ।’ (‘গাছসূত্র’, আবু হাসান শাহরিয়ার ) গাছের উপর শুধু মানবজীবনই নয়, সমস্ত প্রাণের অস্তিত্ব নির্ভরশীল, সে কথা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘স্পার্টাকাস’ নামক কবিতায়। কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করে দিলাম:
কেন এই মৃত্যুদন্ড বধ্যভূমি রচনার সাধ?
এগারো হাজার গাছ ছায়াস্বরে করে প্রতিবাদ।
পাখিরা স্বারকলিপি দিয়ে আসে অরণ্যের কাছে
বাতাসও বিবৃতি দেয়; সে খবর রটে গাছে গাছে।
কীটেরা মিছিল করে ভাঙে একশ চুয়াল্লিশ ধারা
কেবল মানুষই নয়, পোকারাও হয় বাস্তুহারা।
কাঠুরে সভ্যতা ঘোরে হাতে নিয়ে দুধারী কুঠার
কেবল মানুষই নয়, পতঙ্গও বোঝে অধিকার।
কেবল মানুষই নয়, কৃত্যে বাঁচে উই-পিঁপীলিকা
তাদেরও সমাজ আছে; নিরন্তর রয়েছে জীবিকা।
কেবল মানুষই নয়, দ্যাখো দূর নিসর্গপাড়ায়
কত কী প্রাণের নদী ঢেউয়ে ঢেউয়ে নিরন্তরে যায়।
বরং মানুষই নয়, যদিও পৃথিবী তার দাস
দাসেরে বাঁচাতে গাছ আজও অবিচল স্পার্টাকাস।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে আবার ফিরে যেতে হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। প্রকৃতিপ্রেমিক কবিদের শিরোমণি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি এই দেশের, এই পৃথিবীর ‘এইসব তরু-লতা গিরিনদী বন/এই চিরদিবসের সুনীল গগন/এ জীবনপরিপূর্ণ উদার সমীর/জাগরণপূর্ণ আলো, সমস্ত প্রাণীর/অন্তরে-অন্তরে গাঁথা জীবন সমাজ’ ছেড়ে যেতে চাননি।(‘বসুন্ধরা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) জীবনানন্দ দেখেছিলেন জীববৈচিত্র্যে ভরা ‘বাংলার রূপ’। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন ‘সমস্ত প্রাণীর অন্তরে-অন্তরে-গাঁথা জীবনসমাজ’। প্রাণ তো বাইরের ‘রূপ’ নয়; এ হচ্ছে ভেতরের ‘কল্লোলগীত’। বিশ্বকবি জীববৈচিত্র্যের ভেতরের সেই ‘কল্লোলগীত’ আপন হৃদয়-দ্বারে কান পেতে শুনেছেন, জীববৈচিত্র্যে ভরা পৃথিবীর গান গেয়েছেন আপন মনের মাধুরী ও কণ্ঠের সুধা মিশায়ে:
………….আমারে ফিরায়ে লহো
সেই সর্ব-মাঝে যেথা হতে অহরহ
অঙ্কুরিছে মুকুলিছে মুঞ্জরিছে প্রাণ
শতেক সহস্ররূপে, গুঞ্জুরিছে গান
শতলক্ষ সুরে, উচ্ছ্বসি উঠিছে নৃত্য
অসংখ্য ভঙ্গিতে, প্রবাহি যেতেছে চিত্ত
ভাবস্রোতে, ছিদ্রে ছিদ্রে বাজিতেছে বেণু;
দাঁড়ায়ে রয়েছো তুমি শ্যাম কল্পধেনু,
তোমারে সহস্র দিকে করিছে দোহন
তরুলতা, পশুপক্ষী কত অগণন
তৃষিত পরানী যত; আনন্দের রস
কতরূপে হতেছে বর্ষণ, দিক দশ
ধ্বনিছে কল্লোলগীতে। নিখিলের সেই
বিচিত্র আনন্দ যত এক মুহূর্তেই
একত্রে করিব অস্বাদন এক হয়ে
সকলের সনে।
(‘বসুন্ধরা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
জীববৈচিত্র্যের এই ‘কল্লোলগীত’ শোনার অধিকার সকলের, এই ‘বিচিত্র আনন্দ’ আস্বাদনের সুযোগও অবারিত জগৎ জুড়ে। কিন্তু যদি পারমাণবিক বিস্ফোরণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, বৃক্ষনিধন, পশুপাখিশিকার ও হত্যা পৃথিবীতে সকল প্রাণীর সুষম সহাবস্থানকে অসম্ভব করে তোলে, সবুজের সমারোহে ডেকে আনে ধ্বংসলীলা, তবে তো অদূর ভবিষ্যতে নিখিলের ‘বিচিত্র আনন্দ’ সকলের সনে এক হয়ে একত্রে আস্বাদনের আর সুযোগ থাকবে না। অথচ ক্ষমতা-উম্মত্ত-মানুষ আজ তার লোভ-লালসা ও স্বার্থবুদ্ধি চরিতার্থ করার জন্য পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। ফলে জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। এই এক শ্রেণির মানুষের কুটিল স্বার্থপরতা গভীর পীড়া দিচ্ছে কবিদেরও। কবি আবিদ আজাদ জীববৈচিত্র্যের ধারক প্রকৃতিকে সম্বোধন করে সংক্ষুব্ধ স্বরে বলে উঠেছেন:‘হে প্রকৃতি, মানুষের গোপন অস্ত্রের সাথে তোমাকে জেনো/ভারসাম্য রক্ষা করে যেতে হবে। মনে রেখো, তোমার আবহমান নিসর্গের রাজধানী আজ/মানুষের পারমাণবিক সমর সজ্জার আঘাত সীমায়।’ (‘হে প্রকৃতি’, আবিদ আজাদ) আসলে এ হলো মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলে যাওয়া সম্পর্কে প্রকৃতির সম্ভাব্য পতিশোধ গ্রহণের আশঙ্কাজনিত হুঁশিয়ারি। কারণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করছে এক শ্রেণির মানুষ এবং তা প্রতিহত করে জীববৈচিত্র্যের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা এবং তাকে সংরক্ষণ করার দায়িত্বটাও মানব সম্প্রদায়ের। এ অবস্থায়, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পক্ষে সবুজ প্রাণের প্রতিনিধি গানের পাখি শ্যামা বাংলা কবিতা গান-ছড়ার – বাগানের এক কোণে বসে ছড়ায় ছড়ায় বলে যাচ্ছে সুরে সুরে:
সুন্দরবন বান্দরবান
বন ভালোবাসি
গাছগাছড়া থাকলে বেশি
গাঁও গেরামে আসি।
শিস্ শুনে সবুজ বনে
কান পেতে রয় বাঘও যে
শেয়াল ভাবে মিষ্টি গানে
মামাও ভোলেন সহজে।
বন কাটিয়া করছো উজাড়
গাছপালা যায় আগুনে
গান কি হবে ফাগুনে?
তাই তো বলি বন কেটো না
বৃক্ষ লাগাও না গুনে।
(‘গানের পাখি’, আমিনুল ইসলাম)
কবিরা বারবারমনে করিয়ে দিয়েছেন এবং দিতেছেন যে, পৃথিবীটা অথবা মহাবিশ্ব কেবল মানুষের বসবাসের জন্যেই নয়, এই পৃথিবীতে এই মহাবিশ্বে সমান অধিকার সকল প্রাণীর , সকল উদ্ভিদের, সকল জড়বস্তুর। আবার অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও জড়বস্তুর উপস্থিতরি ওপর নির্ভর করে মানুষের অস্তিত্ব। তাই এই পৃথিবীকে মানবসৃষ্ট দূষণ থেকে মুক্ত রাখা সকল মানুষের আবশ্যিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। মানুষ যুদ্ধবিগ্রহ, বৃক্ষনিধন, বনভূমি উজাড়করণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, পারমাণবিক মারণাস্ত্র নির্মাণ, প্রাণীনিধন প্রভৃতি থেকে থেকে সরে এসে যত তাড়াতাড়ি পৃথিবীকে সবুজ ও সতেজ রাখার কাজে তার জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা , বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবে, ততই মঙ্গল।
—–০০০—–