You are currently viewing আভাঁ-গার্দ সাহিত্য সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেসকে লেখা মিলান কুন্দেরার চিঠি  

আভাঁ-গার্দ সাহিত্য সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেসকে লেখা মিলান কুন্দেরার চিঠি  

আভাঁ-গার্দ সাহিত্য সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেসকে লেখা মিলান কুন্দেরার চিঠি  

অনুবাদ: মলয় রায়চৌধুরী

প্রিয় কার্লোস,

আজ আপনার জন্মদিন এবং এ বছর আমারও বার্ষিকী, ৭০-এ পা রাখার; আপনিও ৭০-এ পা রেখেছেন; আমরা, আজ থেকে ৩০ বছর আগে, প্রাগে, প্রথমবারের মতো দেখা করেছি। প্রাগে আপনি এসেছিলেন রুশ আগ্রাসনের মাত্র কয়েক মাস পর, এসেছিলেন হুলিও কোর্তাসার আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে; এসেছিলেন আমাদের পক্ষে কথা বলতে, চেক লেখকদের জন্য আপনাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে।

তার কয়েক বছর পর, প্রাগ ছেড়ে আমি ফ্রান্সে চলে আসি, তখন আপনি ফ্রান্সে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত। এখানেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হয়, বারবার দেখা হয়, কথা হয়; আমরা বন্ধুর মতো সম্পর্কিত হয়ে পড়ি। আমি ছিলাম মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ এক বিক্ষুব্ধ নির্বাসিত লেখক। তখন আপনি আমার মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন, বিচক্ষণতার সঙ্গে আমাকে সমর্থন করেছেন এবং অন্যান্য চেক বন্ধুকেও সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। বহু বহু দিন আমার স্ত্রী ভেরা আর আমি মেক্সিকো দূতাবাসে আপনার অতিথি হয়েছি, একসঙ্গে আমরা রাত্রি যাপনও করেছি (তখন আমরা প্যারিসে থাকতাম না)। সকালের নাশতার টেবিলের আড্ডার কথা খুব মনে পড়ে কার্লোস, সেখানে আমরা রাজনীতি নিয়ে খুব কমই কথা বলেছি আর অবিরাম কথা বলেছি কেবল উপন্যাস নিয়ে, আর আমাদের সেসব কথা কোনো দিনও শেষ হয়নি!

ঠিক তখনই কিন্তু আমি মধ্য ইউরোপ-সংক্রান্ত (সেন্ট্রাল ইউরোপ) ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন হতে শুরু করি, একটা ঘোর তৈরি হয়; বিষয়টি আমার নিজের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত (রাশিয়ার দখলদারিত্ব কিংবা অপহরণ) কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণটি বোধ হয় এটিই যে, মধ্য ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য কিংবা নির্দিষ্টতা, যা সেই মধ্যযুগ থেকে আজও অস্তিত্বমান। মধ্য ইউরোপ কোনো রাষ্ট্র নয়, একটা সংস্কৃতি কিংবা নিয়তি। একজন হাঙ্গেরিয়ান কিংবা একজন চেকের কাছে ইউরোপের কী অর্থ? হাজার বছর ধরে তাদের জাতিরা ইউরোপের রোমান ক্রিস্টিয়ানিটি-সমৃদ্ধ অংশে বাস করেছে। ইতিহাসের প্রতিটি পরতে তাদের অবদান আছে। তাদের কাছে ইউরোপের কোনো ভৌগোলিক অর্থ নেই, বরং ইউরোপ তাদের কাছে একটি আধ্যাত্মিক ধারণা। আর আমরা দিনের পর দিন এই নিয়ে কথা বলেছি, কীভাবে অসাধারণ এক মিল মধ্য ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার ভেতর, উভয়ই বারোকরীতির দ্বারা গভীরভাবে চিহ্নিত, একজন লেখকের জন্য যা ম্যাজিক্যাল এবং কল্পনাবিস্তারি স্বপ্নের জাল। অবশ্য ফরাসিদের কাছে তা বিজাতীয়। আমি প্রায়ই ভাবতাম যে ফ্রান্সে স্যুররিয়ালিজমের জন্ম কীভাবে সম্ভব হয়েছিল। আসলে স্যুররিয়ালিজম শিল্প হিসেবে নয়, আদর্শ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল ফ্রান্সে। আমরা, আপনি আর আমি—বিশ্বের এ দুটি অঞ্চলের মধ্যে আরেকটি বিস্ময়কর মিল খুঁজে পেয়েছি: মধ্য ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকা বিশ শতকের উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটি বিস্তৃত নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে—প্রুস্ত-পরবর্তী উপন্যাসে এবং সেই উপন্যাসের নতুন নন্দনতাত্ত্বিক আলো-হাওয়ায়। প্রথমত, দশের, বিশের এবং তিরিশের দশকে মধ্য ইউরোপে একটি অতি বিশিষ্ট প্রবাহ এসেছিল—কাফকা, মুসিল, ব্রখ এবং গোমব্রোভিজ; তারপর, ষাটের লাতিন আমেরিকায় আরেকটি অতি বিশিষ্ট প্রবাহ দেখা গিয়েছিল।

শিল্পের আধুনিকতা আর উপন্যাস—আমি এ দুটি বিষয় নিয়েই বেশির ভাগ সময় ভেবেছি, নিজেকে গড়ে নিয়েছি। অনুগত থেকেছি। আভঁ-গার্দ চিন্তাভাবনা উপন্যাসের শিল্পকে সব সময়ই আধুনিকতার বাইরে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছে, উপন্যাসকে এমন কিছু বিবেচনা করেছে, যার সময় অতিবাহিত হয়েছে; পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আভঁ-গার্দ যখন তাদের নিজস্ব ঔপন্যাসিক আধুনিকতা তৈরি এবং ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিল, তখন তারা বিশুদ্ধ নেতিবাচকতার পথ অনুসরণ করেই এটি করেছিল: উপন্যাস, চরিত্র, প্লট, গল্প এবং (সম্ভব হলে) বিরাম চিহ্ন ছাড়া। ফলে উপন্যাসগুলো গর্ব করে নিজেদের অ্যান্টি-উপন্যাস হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। আধুনিক কবিতা কিন্তু কখনোই নিজেকে কবিতাবিরোধী বলে দাবি করেনি। শার্ল বোদলেয়ারের হাত ধরে কাব্যিক আধুনিকতা (পোয়েটিক মডার্নিজম) আমূলভাবে কবিতার এসেন্সের কাছে যেতে চেয়েছে। কবিতা কেবল কবিতাই হবে।

আমি এই নিয়ে কিছুটা ভেবেওছি। আধুনিক উপন্যাসকে আমি অ্যান্টি-উপন্যাস হিসেবে নয় বরং অতি উপন্যাস বা অত্যধিক উপন্যাস (আলট্রা নভেল) হিসেবে কল্পনা করেছি। অতি উপন্যাস সেই বিষয়ে মনোনিবেশ করে, যা শুধু উপন্যাস করতে পারে। অতি উপন্যাস জীবনের সমস্ত অবহেলিত এবং বিস্মৃত সম্ভাবনাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে, উপন্যাসের শিল্প তার চার শতাব্দীর ইতহাসে যা করে এসেছে। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়েছে।

২৫ বছর আগে আপনার ‘তেরা নস্ত্রা’ পড়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি একটি অতি উপন্যাসই পড়েছিলাম। আপনার বইটি প্রমাণ করেছে যে এই এই জিনিসগুলোর অস্তিত্ব আছে, এই এই জিনিসগুলো থাকতে পারে।

আর তার ১৫ বছর পর আপনার ‘ক্রিস্টোফার এখনো জন্মায়নি’ উপন্যাসেও সেই একই জাদু খুঁজে পেয়েছি: সমস্ত আকর্ষণীয় সম্মোহন এবং নতুনত্বসহ উপন্যাসের দুর্দান্ত আধুনিকতা।

উষ্ণ আলিঙ্গন, কার্লোস!

মিলান কুন্দেরা

******************************