You are currently viewing অর্থহীন শব্দ সমাচার || মেহনাজ মুস্তারিন

অর্থহীন শব্দ সমাচার || মেহনাজ মুস্তারিন

অর্থহীন শব্দ সমাচার

মেহনাজ মুস্তারিন

মানুষ যে কতকিছুতে এবং কতভাবে সুখ খোঁজে—টাকা-পয়সা ধন-দৌলত, ক্ষমতা, আধিপত্য, প্রেম-ভালোবাসা, বলে শেষ করা যাবে না। জীবনে সবচেয়ে সুখকর বিষয় আসলে কী? কার কাছে কী জানি না, আমার কাছে আদরের ডাকের চেয়ে সুখকর আর কিছু নাই। আদর করে ডাকার বিষয়টি সবধরণের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শুধু মানুষ তো না, অন্যান্য অনেক প্রাণীর মধ্যেও এই ডাক আমি দেখতে পাই। পাখির মায়ের কথাই যদি বলি, তার মুখে এত ডাক কোত্থেকে আসে, কেনই বা আসে? মা বাবা সন্তান বন্ধু স্বামী স্ত্রী যার কথাই বলি না কেন, এই ডাকের জন্য সবাই উম্মুখ হয়ে থাকে। এর কত ধরণ, আর কতই তার বৈচিত্র্য। তারা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ডাকের এই বৈচিত্র্য নিয়ে কখনো কেও ভেবেছে কিনা জানি না, আমার ভাবনাজগতে তারা হঠাৎ করেই ঢুকে পড়ে। বিচিত্র সেই ধরণ বিচিত্র তার ডাক। আমি এমন কোন মা দেখিনি যে তার সন্তানকে অদ্ভুত সব শব্দ করে ডাকে না। কী যে মধুর সেই শব্দমালা, আর কী অদ্ভুত সেই ছোঁয়া! সেই অনুভবের বিস্ময় বোধহয় কোনদিন পুরোপুরি উন্মোচিত হবে না। কোন শব্দের যে কী মানে, কেও বলতে পারবে না; অথচ, সেই সব শব্দের গাঁথুনিতে লুকিয়ে আছে কত রসিকতা কত দরদ কত মায়া কত অনুভব আরও কতকিছু।

আমার কথাই যদি বলি, আমি আমার সন্তানদের আদর আহ্লাদ করে বিচিত্র সব শব্দ করে বিচিত্র সব রঙঢঙে ডাকতাম। বলতাম, ওরে আমার সাঞ্জু, ওরে গুল্টি, ওরে আমার গিলতু, গুচু সহ নানা শব্দে। সেসব শব্দের মানে জানা নাই, জানার চেষ্টাও করিনি কোনদিন। এখন এই ডাকগুলো মনে পড়লে আপনা থেকেই হাসি, বিচিত্র সেই শব্দমালার গভীরে ডুব দেই। আমার এক আত্মীয়কে দেখতাম ছোট্ট বাচ্চাদের আদর করে “হুনতুনু  হুনতুনু” ডাকতে। যেমন তেমন ডাক না, তিনি তা করতেন গলার স্বর পাল্টে ফেলে, মুখের নানা অঙ্গ ভঙ্গি করে। এই শব্দের কী মানে আজও জানি না। 

মাঝে মধ্যে অদ্ভুত কিছু  ব্যাপার  কাজ করে আমার মাথায়। আচ্ছা এ নিয়ে ভাববার কী আছে? আদর আহ্লাদের আবার অর্থ কী! তা খুঁজতে যাবার প্রয়োজন কী বাপু!  আসলে সেইসব শব্দের উদ্ভব কোথা থেকে হয়, সেটা জানতে কেন জানি মন চাইলো। সেই অনুভব কিন্তু কখনো হারায় না।  হৃদয়ের পরতে পরতে লেপ্টে থাকে ভালোবাসার ছোঁয়া স্পর্শ। তাহলে কী দাঁড়ালো? শুধু মা একা না, একইভাবে বাবাও কিন্তু নানা অঙ্গভঙ্গি করে আদরের ধরণ পরিবর্তন করেন। আসলে আমার  অনুসন্ধিৎসু মন খোঁজার চেষ্টা করছে কোন দম্পতি, মানে স্বামী স্ত্রী কি এমন আদরের শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের ভালোবাসার প্রকাশ খুঁজতে, যা তাদের নিত্যদিনের চাওয়া পাওয়া এমনকি অনুভবের পথ মসৃণ করে? হৃদয়ের লাবণ্য বেড়ে যায় বহুগুন? এটা সত্যি, বিয়ের পর কিছুদিন ভালোবাসার মানুষের কাছে কিছুটা আহ্লাদ করতে দেখা যায়, আর তা কাছের মানুষদের চোখে ধরাও পড়ে। তারপর এক সময় সবই অভ্যাসে পরিণত হয়। বিয়ের আগে প্রেমিক বা প্রেমিকার কথায় থাকে আদরের বন্যা। সেই বন্যার জলে ওরা ভেসে যায়, ভাসতে ভাসতে আশ্রয় নেয় নতুন কোন ভুবনে। যেখানে আলোয় আলোকিত হয় হৃদয়, সুমিষ্ট বাতাস বইতে থাকে, আকাশের নীল মনে হয় আরও নীল। সাদা বক তাকিয়ে থাকে মায়ার চোখে। ওরা দুজন তখন প্রজাপতি; ইচ্ছে মতো ঘুরতে থাকে ফুলে ফুলে। কী উচ্ছ্বাস! কী উল্লাস! যেন সেই আনন্দ ধারায় গড়িয়ে পড়ে একে অপরের দেহপল্লবে। দু’জনের হাত তখন মুষ্টিবদ্ধ, কোন কষ্ট যন্ত্রণা সেই ধরে থাকা হাত স্পর্শ করতে পারে না। চোখে তখন স্বপ্ন! সেই স্বপ্ন ঘিরে রাখে কত রঙ রূপ! প্রেমবাগানে যখন সেই স্পুটিত ফুল উঁকি দেয় প্রকৃতির কোলে তখন পাখিদের কলকাকলিতে কুঞ্জন ভরে উঠে। ফুলগুলো মেলে দেয় পাপড়ি। কত বৈচিত্র‍্যের সেই শোভা, আবার দেখা যায় ডালপালা একে অপরের ঘাড়ে হেলে পড়ছে। দু’জনের চোখ জোড়া খুঁজে কখনো বৃষ্টি কখনো বসন্ত বাতাস। ঝড় হাওয়াও তাদের পছন্দ!  সেই হাওয়ায় মাতাল প্রেমিক প্রেমিকা নিজেকে প্রকাশ করে অন্য রূপে। চারাপাশে কোলাহল নেই নির্জন এক মায়াবী আবেদন। প্রেমিকা শক্ত করে ধরে থাকে হাত স্পর্শ করে বলে—জান্টু আমার। প্রেমিকের চোখে বিস্ময়! চেয়ে থাকে অপলক। অবাক তার চাহনি। যেন অমন আদুরে শব্দ কখনো শোনেনি। কেও কখনো তাকে ওমন করে ডাকেনি। এতটা আদর করেনি কেউ। প্রেমিকার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে প্রেমিক বলে—টুনি আমার। যুগল এই পথ চলার যেন এখান থেকেই শুরু। হাঁটতে থাকে ওরা স্বপ্নের পথ ধরে। এগিয়ে যায় জীবনের বাঁকে বাঁকে। যেখানে ভালোবাসার চিহ্নগুলো একেকটা শব্দের বৈচিত্র্যে মুগ্ধতা আনে। ছড়িয়ে পড়ে আনন্দধারা আকাশে বাতাসে।

এমনই এক যূগলের খোঁজ পেয়েছিলাম। দেখা পেয়েছিলাম ওদের। ভাগ্যক্রমে ওদের জানার সুযোগ হয়েছিল। অদ্ভুত সেই জুটি। দু’জনেই পঞ্চাষোর্ধ, তবু, ওদের দেখতাম অদ্ভুত সব শব্দের দোলায় ওদের ভালোবাসাকে কী চমৎকার ভাবে প্রকাশ করছে! এখন ষাট পেরিয়ে গেছে। আজ অর্থহীন শব্দ সমাচার লিখতে গিয়ে বহুদিন পরে তাদের কথা মনে পড়ে গেল। আমার দেখা সেই জুটি একে অপরের জন্য ভালোবাসার যে বিস্ময়কর শব্দগুলো প্রয়োগ করতো, সেগুলো না লিখে পারছি না। জান্টু, গুল্লু পল্টু, বিজলু, গুজলু পুজলু, বুজলু লাল্টু, জিঞ্জু, ইত্যাদি। এমনই নানা শব্দের সম্ভারে ওরা নিজেদের প্রকাশ করতো। প্রকাশ করতো হৃদয় নিঙড়ানো ভালাবাসা।

দেখুনতো সেই অদ্ভুত শব্দগুলোর মানে খুঁজে পান কি না। আমি কিন্তু অনেক চেষ্টা করেছি, তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছি। সত্যি বলছি, ওদের দেখলে আপনার মনে হবে না ওরা ঠিক ওই বয়সে এসে কতটা রোমান্টিক! নিশ্চয়ই আপনাদেরও খুব জানতে ইচ্ছে করছে! দেখতে ইচ্ছে করছে! হুম! নিশ্চয়ই একদিন দেখা হবে, গল্প  হবে তাদের সাথে  আপনারও। কোন এক শুভ্র মিষ্টি ভোরে সূর্য যখন সবে তার আলো ছড়াবে চোখে মুখে বা এমনও হতে পারে জোৎস্না রাতে যখন চাঁদের বুড়ি তার পসরা সাজিয়ে বসবে রুপকথার, আমরা তখন গোল হয়ে বসবো ঘাসের উপর। বাটি ভরে ঝালমুড়ি মাখিয়ে নেব।  মজার এই আসরে আমরা শুনবো রুপকথা অথবা প্রেমের অনেক অনেক গল্প, আর ওদের দু’জনের সাথে দেখাও হবে সেদিন। নিশ্চয়ই ওদের ভালোবাসার সেই গল্প আর স্বপ্নস্বাদ ছুঁয়ে দেবে আমাদের হৃদয়।

****************************