অমিতা মজুমদার
একটা জানালা,একটা ইঁদুর, একটা মানুষ
মানুষটা রাস্তার মোড়ে বসে থাকে,
হাতে কিছু বিচিত্র জিনিস নিয়ে।
যার প্রয়োজন সে ঠিক তার সামনে এসে বসে পড়ে,
লোকটা কবিসুলভ কুশলতায় সামনে বসা লোকটির দরকারি কাজটি করে দেয়।
পারিশ্রমিক দিয়ে পথচারী আপন গন্তব্যে পা বাড়ায়।।
লোকটি কী করে?
মানুষের কান পরিষ্কার করে দেয়,
যাতে সে সঠিক কথা সঠিকভাবে শুনতে পায়।
একটা নেংটি ইঁদুর নিশ্চিন্ত মনে সংসার পাতে,
গৃহকর্ত্রীর ব্যক্তিগত তোরঙ্গে।
যা বিয়ের সময় তার বাবা দিয়েছিল,
যাতে খুব যত্নে রাখা আছে সৌম্যর দেওয়া প্রথম শাড়িখানা।
আছে আরও অনেক উপহার,
খুব যত্ন করে স্বামীর জন্য একটা পশমের সোয়েটার বুনেছিল।
সেটাও আছে।
আছে বাবার দেওয়া বিয়ের বেনারসিখানাও,
টুকিটাকি আরও কত কী!
প্রতিবছর ভাদ্র আর চৈত্র মাসে রোদে দেয়,
তোরঙ্গ খুলে একটা একটা জিনিস বের করে।
এবারেও বের করে রোদে দেবে বলে,
কিন্তু হায়!
তোরঙ্গ খুলতেই দেখে নেংটি ইঁদুরের বাড় বাড়ন্ত সংসার,
আর সাধের বেনারসি, সোয়েটার মায় সৌম্যর দেওয়া বালুচরি’র টুকরো পড়ে আছে তোরঙ্গের বুক জুড়ে।
নেংটি ইঁদুরের স্বভাব এমনই,
সে আপন আশ্রয়েরই করে সর্বনাশ!
জানালাটা এতদিন আকাশটাকে এনে দিত শিয়রের পাশে,
তারাগুলো জানালা গলিয়ে টুপ করে এসে বিছানায় পড়ত বসে।
হঠাৎ জানালার সামনে এক প্রাচীর উঠল,
ঝকঝকে তকতকে প্রায় আকাশ ছুঁই ছুঁই।
জানালাটা পরিত্যক্ত হয়ে গেল বিছানার মালিকের কাছে,
জানালা তো কেবল মাধ্যম ছিল আকাশের কাছে পৌঁছানোর।
প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সবাই পরিত্যক্ত হয়,
এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
০৯/০৭/২০২২
দশবছরি বেলা
আশি হোক আর নব্বই হোক দশ যেন পিছু ছাড়ে না,
দশবছরি বয়সটাতে থেকে যায় সেই বকুল বিছানো পথখানা।
যে পথ নিশিজাগা প্রেতাত্মার মতো অশরীরী হয়ে লেপ্টে থাকে,
মন ও মগজে আমৃত্যু যখন তখন করে আনাগোনা।
দশবছরি বয়সে যেমন জানা যায় আত্মপরিচয়,
সে নারী না পুরুষ না-কি তৃতীয় লিঙ্গ!
নিয়ম ভাঙার স্বভাবটা এই দশেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে,
কিছু গোপন স্বপ্নও দেখে ফেলে দশবছরি মন।
যা শুধুই সঞ্চিত হতে হতে,
বনে যায় যক্ষের ধন।
যা হতে পারে খোলা মাঠে ছোট্ট বাছুরের লেজ ধরে দৌড়ে ছোটার আনন্দ,
বা নগরের বদ্ধ ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির ঘরে চোখ রাখা।
দশবছরি মন কত কী আঁকিবুকি করে খেয়ালখুশি মতো,
যেথায় কারও থাকে সংসারের কাটাকুটি খেলা,
কারও থাকে ফেলে আসা মধ্যাহ্ন সময়ের
কিছু গোপন বাসনার ছাপচিত্র।
দশবছরি বেলায় নদীর এপার ওপার করা কিশোর মন,
পাশের বন্ধুর গায়ে জল ছিটিয়ে দিয়ে অকারণ হেসে ওঠে।
দশবছরি মন হার মানা হার গলায় পরার উদগ্র বাসনায়, ছুটে চলে অজানা অভিযানে।
বিজয়া দশমীর ভাসানে গিয়ে সবার চোখ এড়িয়ে, পাশের বাড়ির দশবছরি বন্ধুকে দুই আনার কদমা কিনে দেওয়ার সুখানুভবটুকু আজীবন মনে থেকে যায়।
ঘুড়ি ওড়ানো পাতার বাঁশিতে ভাটিয়ালি সুর তোলা;
পাখিরবাসায় হানা দেওয়া উদ্দেশহীন বনবাদারে ঘুরে বেড়ানো,
সবটা জুড়ে থাকে সেই দশবছরি বেলায়।
যা খাজুরাহো’র গুহাচিত্রের মতো অক্ষয় হয়ে রয় ষাট বা আশিতে।
নগরজীবনে দশবছরি মেয়েটি মায়ের হাত ছাড়িয়ে, একলা হাঁটতে চায়।
যে ছেলেটি দু’দিন আগেও অনায়াসে মায়ের সাথে স্নান করত,
সে কেমন গোপনীয়তা খোঁজে নিজের জন্য।
দশবছরি বেলার চমকগুলো, বুঝি বলে শেষ করা যায় না।
তাকে তুলে রাখতে হয় হৃদয়ের গোপন কুলুঙ্গিতে,
শুকনো বকুলফুলের মালার মতো।
শুকিয়ে গেলেও যার সুবাসটুকু লেপ্টে থাকে,
শরীর ও মন জুড়ে আমৃত্যু।
০৭/০৭/২০২২
বর্ষা নিয়ে এলোমেলো ভাবনা
সেবার বর্ষায় তোমাকে নিয়ে তুমুলভাবে ভিজব
বলে চিরকুট পাঠিয়েছিলাম।
বলেছিলাম মুষলধারে যখন বৃষ্টি নামবে
আমি দাঁড়িয়ে থাকব তোমার দরজায়।
তুমি বেরিয়ে এসো সেই নীল শাড়িটা পরে।
যেটা অভিমন্যূ দিয়েছিল প্রথম বেতন পেয়ে।
অভিমন্যূ তোমার দাদা আমার বন্ধু
সেই সুবাদে তোমার আমার জানাশোনা।
একসময় অভিমন্যূর বন্ধুত্ব ভুলে তোমায় নিয়ে মেতেছিলাম বয়সের ধর্ম মেনে।
হঠাৎ সেবার বসন্তেই নেমে এলো আগুন বর্ষা হয়ে।
সারা দেশ জ্বলছে তো জ্বলছে।
আমার আর যাওয়া হলো না।
তুমি কি দাঁড়িয়েছিলে আমার অপেক্ষায়!
আগরতলায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা হতো যে হাসপাতালে তার ১১ নম্বর বেডে শুয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম।
বামপাটা গুলি লাগায় কেটে ফেলতে হয়েছিল।
মনে মনে ভাবছিলাম কথা রাখা হলো না আমার।
কল্পনায় দেখছিলাম তোমার ভেজা শরীরে লেপ্টে থাকা নীল শাড়ি।
অনেকটা মেঘ আর আকাশের জড়াজড়ি করে ভেসে বেড়ানোর মতো।
তোমার চুল চুইয়ে পড়ছিল বৃষ্টির ফোঁটা।
নাকের ডগায় চোখের পাতায় চিবুক ছুঁয়ে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমায় লোভী করে তুলছিল।
হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম তোমায়…
টের পেলাম আমি অশক্ত অচল হয়ে পড়ে আছি ১১ নম্বর বেডে।
তারপর কেটে গেছে কয়েক যুগ,অর্ধ শতাব্দী।
আমি বিদেশ থেকে নকল পা লাগিয়ে এসে সুস্থ মানুষের মতোই চলতে পারি।
দূর থেকে কেউ বুঝতে পারে না।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি অনেকটাই।
তাই অনাহারে অর্ধাহারে আমাকে ধুঁকতে হয়নি।
আমি বেশ ক্ষমতা ও পসার অর্জন করেছি।
লোকে মান্যগণ্য করে।
সুখে আছি পরিবার পরিজন নিয়ে।
কেবল মাঝে মাঝে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তাড়া করে বর্ষাকাল এলে।
তোমার নীল শাড়ি পরা বৃষ্টিভেজা শরীর মুখ আসা যাওয়া করে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় অভ্যস্ত ঘুমন্ত চোখের সামনে।
ষোলই ডিসেম্বরের পরে গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে।
শুধু পরিত্যক্ত পোড়ামাটির স্তূপ ছিল তোমাদের বাস্তু ভিটায়।
সকলে বলাবলি করছিল তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল খানসেনাদের ক্যাম্পে।
তোমার আর ফেরা হয়নি।
অভিমন্যূও নিখোঁজ হয়েছিল।
তোমার মা বাবা সেই যে চলে গেছে পাশের দেশে আর ফিরে আসেনি।
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা নদীমাতৃক বাংলায় এখনো বর্ষা আসে ঋতুবৈচিত্রের নিয়ম মেনে।
কেবল বাড়ির উঠোনে দুটো খয়েরি শালিখের হলুদ ঠোঁটে ঝগড়া করা দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে না সেই মেয়েটি।
যাকে এক সময়ের অসাম্প্রদায়িক মনের তরুণ বিপ্লবী
ছেলেটি বৃষ্টিতে ভেজার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সনদধারী আজকের
ধর্মরক্ষাকারী প্রবীণ
চৌধুরী সাহেব।
যতই দুর্বিপাক আসুক বর্ষা বদলায় না
প্রকৃতির ধর্ম বদলায় না।
কেবল বদলায় মানুষের ধর্ম।
মানবিক থেকে হয়ে ওঠে শুধুমাত্র ধার্মিক।
২৫/০৬/২০২৩
=======================