অবনীর একদিন || রিমি রুম্মান

পর্দার ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে সকালের সোনা-রোদ এসে পড়েছে বিছানায়। ছোপ ছোপ রোদ মুখের ওপর আলতো করে ছড়িয়ে পড়তেই ঘুমটা হাল্কা হয়ে এলো অবনীর। আড়মোড়া ভেঙে সাইড টেবিলের দিকে হাতড়ে ফোনটা হাতে নেয় সে। সময় দেখার জন্যে আজকাল দেয়াল ঘড়ির প্রচলন ফুরিয়েছে। সময় খুব বেশি গড়ায়নি। আরেকটু ঘুমিয়ে নেয়া যেত। ভাবতে ভাবতে জানালার বাইরে ম্যাপল গাছের দিকে দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে তার। কী পাখি ওটা? নাম না-জানা বাদামী-কমলা রঙ। অদ্ভুত সুন্দর তো! অমনি ডেকে ওঠে সে। কোকিলের মতো কুহু কুহু ডাক। দমকা হাওয়ায় নড়ে উঠল ডাল। গা ঝাড়া দিয়ে উড়ে গেল নতুন এই অতিথি। কোথায় গেল? জানালার পর্দা সরিয়ে ডানে বাঁয়ে তাকায় অবনী। অনন্ত বেদনার মতো অনুভূতিতে পেয়ে বসল তাকে। শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই ফালা ফালা রোদ মুখে এসে আঁকিবুঁকি খেলে যায়।

জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বইমেলার কথা মনে পড়তেই মন ভালো হয়ে যায়। দেশের বইমেলার আমেজ অনেকটাই পাওয়া যায় এই দূর-দেশে। আর তাই তো ঘরের সব কাজ আগেভাগে গুছিয়ে নিয়ে দিনটি একেবারেই নির্ভার রাখতে চায় অবনী। এ-যে শুধুই মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ঘুরে বেড়ানোর দিন। একটা দিন নিজের মতো করে পাওয়ার, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার।

ততক্ষণে জানালার ও-পাশে দুপুরের গমগমে রোদ। গ্রীষ্মের লু-হাওয়া। গোসল সেরে আকাশী-নীল শাড়িটি বেছে নেয় সে ক্লোজেট থেকে। পুরো শাড়ি জুড়ে কালো হরফে লেখা, প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই … শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই। সুমন চ্যাটার্জির লেখা সম্ভবত। ‘ভাগ্যিস পয়লা বৈশাখ, স্বাধীনতা, বিজয়, কিংবা মাতৃভাষা দিবস ও বইমেলাকে উপলক্ষ করে দেশ থেকে শাড়ি আনিয়ে রেখেছিলাম’ মনে মনে নিজেই নিজের বুদ্ধির তারিফ করে অবনী। একদমই সময়ক্ষেপণ করা চলবে না। ঝটপট তৈরি হয়ে নেয় সে। বাঙালি রমণী যতই ঝটপট তৈরি হোক না কেনো, ঘড়ির কাঁটা যেন শত্রুতাবশত পাল্লা দিয়ে ছোটে।

পার্কিং স্পেস থেকে গাড়ি বের করে প্রথমেই পছন্দের কোনও একটি গান ছেড়ে দেয় অবনী। তার কাছে সঙ্গীত ও ড্রাইভিং একে অন্যের পরিপূরক। সূর্য পশ্চিমাকাশে সামান্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। তির্যক কিরণ আড়াল করতে রোদ-চশমার আশ্রয় নেয় অবনী। ফ্রন্ট মিরোরে দেখে নেয় কপালের কালো টিপ ঠিক স্থানে আছে তো? লিপস্টিক ঠোঁটের বাইরে যায়নি তো? সকলের এমন হয় কিনা, কে জানে! কিন্তু অবনীর হয়। যেতে যেতে রেড লাইটে গাড়ি থামলে ফোল্ড করা ফ্রন্ট মিরোর নামিয়ে আরেকবার নিজেকে দেখে নেয় সে। জীবনের প্রয়োজনে বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসেছে হয়ত। কিন্তু তাই বলে দেশের সংস্কৃতি ঐতিহ্য তো আর ভুলে থাকা যায় না।

অদূরে পার্কের দিকটায় গাড়ি পার্ক করে শাড়ির আঁচল, ভেনিটি ব্যাগ ঠিকঠাক মতো সামলে মেলা প্রাঙ্গণের উদ্দেশ্যে হাঁটছে অবনী। পথিমধ্যে গৌরবর্ণের বিদেশিনী বিস্ময়ে বার দুয়েক তাকায় অবনীর শাড়ির দিকে। চোখে চোখ পড়তেই বলে ওঠে, ‘তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ভারতীয়দের আজ বিশেষ কোনো দিন বুঝি?’ চোখ গোলাকৃতি করে তাকায় অবনী অচেনা পথচারীর পাণে। ‘ভারতীয় নয়, বলো বাংলাদেশী। সামনেই চারদিন ব্যাপী বাংলা বইমেলা। আমি সেখানেই যাচ্ছি।’ বিদেশিনী অবনীর সমান্তরালে হাঁটতে হাঁটতে মেলা প্রাঙ্গণে এলো, কী ভেবে কে জানে।

বইমেলার সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন চারিদিক আনন্দে কলরব করে উঠল। বাইরের উন্মুক্ত স্থানে যার যার বইয়ের স্টল সাজিয়ে নিয়েছে মেলা উপলক্ষে দেশ থেকে আগত প্রকাশকরা। অন্যপাশে প্রবাসের স্থানীয়রা। খানিকটা দূরে গাছের নিচে ভিড় জমে আছে। সেইদিকে পা বাড়ায় অবনী। যতই নিকটবর্তী হচ্ছিল, গানের আওয়াজ পরিষ্কারভাবে ভেসে আসছিল। অদ্ভুত এক সুরের মূর্ছনা, বাঁশির সুর। ফুঁৎকার দিয়ে বাজানো এই বাদ্যযন্ত্রটি বরাবরই অদ্ভুত লাগে তার। বাঁশের তৈরি সাধারণ একটি বাঁশির ভেতরে কত সুর যে লুকিয়ে থাকে! কাঁধ অব্দি নেমে আসা ঝাঁকড়া চুলের এক তরুণ গিটারে সুর তুলছে ও গাইছে। তার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে আরও কয়জন। আগত দর্শনার্থীদের অনেকেই গভীর মনোযোগে শুনছে সম্মিলিত এই সঙ্গীত। পাশেই দেশিয় হস্তশিল্পের নানান উপকরণ। বইয়ের পাশাপাশি দারুণ জনপ্রিয়তা এই হস্তশিল্পের। উপচে পড়া ভিড়ের মাঝেই ক্রয় করছে ক্রেতারা। যেন দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে সব। এমন হুমড়ি খেয়ে কেনাকাটা অস্বাভাবিক নয়। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী হ্যারিকেন, তালের পাখা, পিতলের রিক্সা, কাঠের নৌকা, বাবুই পাখির বাসা হাতে পাওয়াটা তো কম কথা নয়। এ-সব ঘর সাজানোর জিনিস হলেও এর সঙ্গে দেশপ্রেম, আবেগ, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। রঙবেরঙের রিক্সা-পেইন্ট করা হারিকেন নজর কাড়ে অবনীর। অথচ বার্ষিক পরীক্ষা শেষে গ্রামে দাদা-নানা’র বাড়ি বেড়াতে গেলে এ-ছিল তাদের রোজকার অতি প্রয়োজনীয় এক অনুষঙ্গ। তবে দেশে থাকতে ঘর সাজাতে ক্রিস্টালের শো-পিচ পছন্দের তালিকায় শীর্ষে ছিল। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে কবে, কখন পছন্দের এই আমূল পরিবর্তন হয়েছে, বলা মুশকিল। এখন বিদেশের বাড়িতে ঘর সাজাতে দেশিয় হস্তশিল্প ছাড়া অন্য কিছুতেই আর মন ভরে না যেন। ডায়নিং স্পেসের দেয়ালে দুই কর্নারে দুটি হারিকেন ঝুলিয়ে রাখলে দারুণ লাগবে দেখতে। দেশীয় ঐতিহ্য ঘরের শোভা বর্ধনের পাশাপাশি দেশের আমেজ তৈরি করবে মনে। মনে মনে ভাবে অবনী।

হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করে অবনী দুটো পছন্দের হ্যারিকেনের দিকে। দোকানী সেগুলো নামিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘বিশ ডলার করে দুটোর দাম পড়বে চল্লিশ ডলার। বিল পরিশোধ করে ব্যাগের চেইন টেনে দিতেই চেইনের ঘড়ঘড় আওয়াজের মাঝে কানে ভেসে আসে , ‘আমাকেও দিন দুটো’। বড্ড চেনা স্বর, চেনা কণ্ঠ। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় সে। একা, একক একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। সে-ও তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই একটু চমকালো যেন মানুষটি। এ চমকানো মেকি মনে হল অবনীর। না-ও হতে পারে। গাছের নিচ থেকে সমবেত গানের আওয়াজ ভেসে আসছে, ‘হইয়া আমি দেশান্তরী …দেশ বিদেশে ভিড়াই তরী রে… ’ দোকানী পাশেই ঘাসের ওপর রাখা কার্টুন থেকে দুটো প্যাকেট বের করে সামনে এগিয়ে দেন। তিনি দোকানীর হাত থেকে প্যাকেট দুটো নিয়ে বিল পরিশোধ করতে করতে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছো, অবনী? প্রশ্ন শুনে তার দিকে আরেকবার তাকায় অবনী। শাদা শার্টের কলার বাঁ-পাশে খানিকটা উল্টে আছে। কানের কাছে কয়েকটি শুভ্র চুল জানান দিচ্ছে চিরকালের নিয়মে সময় অতিক্রান্ত হয়েছে ঢের। ‘ভালো আছি’, কাঁপা স্বরে উত্তর অবনীর। তার কণ্ঠ নিঃসৃত বাক্যটি যেন কারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো না। গ্রীষ্মের মৃদু বাতাসে উড়ে গেল। তারপর ভিড়ের মাঝে দু’জন দুইদিকে মিলিয়ে গেল। এমনও কী কোনদিন হবার কথা ছিল? অচিন দেশে এক ঝলক দেখা হবে, তারপর অচেনার মতো কুশল বিনিময় শেষে দুজনার পথ দুই দিকে বেঁকে যাবে? অবনীর বুকের গহীন থেকে কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এলো প্রাচীন এক দীর্ঘশ্বাস। নাভিদের এই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া যেন বিদ্রুপের জাজ্বল্যমান অট্টহাসির মতো চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে গেল অবনীর হৃদয়।

‘অ্যাই তুমি আসাদের বই কিনেছ?’ কেউ একজন উচ্চস্বরে ভিড়ের মধ্য থেকে বলে ওঠে সন্ধ্যা নামার আগে আধো আলো-আঁধারিতে। সেদিকে তাকাতেই দেখে কবি-বন্ধু রাজেশ দাঁড়িয়ে। কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ। তার কোনো বই প্রকাশ হয়নি এবার। পাশের-জন কবি আসাদ আরমান। অবনীর পরিচিত। তার কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায়। রাজেশ তার বন্ধুর হয়ে বই বিক্রির জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। কবিতা তেমন টানে না অবনীকে। তাই আগ্রহও কম। বিগত সময়ে এমন অনুরোধের ঢেঁকি গিলে গিলে অনেক অপ্রয়োজনীয় বই কিনেছিল সে। যা বছরের পর বছর শেলফের জায়গা দখল করে আছে অপ্রত্যাশিতভাবে। ‘আসাদের বই কেনোনি এখনো?’ বন্ধু রাজেশের তাগিদ। কণ্ঠে, চোখেমুখে বিস্ময়। অপ্রস্তুত অবনী আমতা আমতা করে বলে ওঠে, ‘মেলা শেষে বাড়ি যাবার আগে নিশ্চয়ই নেবো।‘ বইমেলায় পরিচিতজনদের দোকানের সামনে গেলে এমন অপ্রস্তুত হতে হয় প্রায়শই। বিষয়টি বিব্রতকর। নিজের পছন্দের বই কিনবো, এত জোরাজুরির দরকার নেই তো! অবচেতন মনে বিড়বিড় করে অবনী।
‘বইটি পড়া হলে ফেসবুকে একটি রিভিউ অবশ্যই লিখবেন কিন্তু’ কোনো এক ক্রেতাকে বলে চলছিল কবি আসাদ আরমান। ক্রেতার অবয়বে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। বিব্রত ক্রেতা ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই’ বলতে বলতে প্রস্থানে উদ্যত হয়। ‘রিভিউটা কিন্তু মনে করে অবশ্যই আমাকে ট্যাগ করে দেবেন, কেমন?’ কবি আসাদ আরমানের বলা শেষ লাইনটি শুনল কিনা ক্রেতা, ঠিক বোঝা গেল না।

চারিদিকে মৌমাছির ঝাঁকের মতো মানুষ। এত হৈচৈ-এর মাঝেও মনের ভেতরে ক্যামন এক বিষাদ গ্রাস করে আছে। প্রকৃতপক্ষে হাসিখুশি মুখাবয়বের আড়ালে হৃদয়ভেদী ক্রন্দন ঘুরে বেড়ায় অবনীর মনে। অভিমানের উত্তাপে ঘামছে সে। কোথায় উবে গেলো সকল আনন্দ? আনন্দ কি নিউইয়র্কের গ্রীষ্মকালের মতো ক্ষণস্থায়ী? এত কোলাহল, শব্দ, অথচ দুর্বিষহ এক একাকীত্ব তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে কোন মহাকালের দিকে? পৃথিবীতে কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখাতে আসে। ভালোবেসে হাত ধরে। বহুদূর পথ পাড়ি দেয়ার আশা জাগিয়ে তোলে। তারপর সমাজ, সংসার আর মধ্যবিত্তের ভদ্রতার দোহাই দিয়ে নিজেই একদিন সন্তর্পণে মাঝ দরিয়ায় হাত ছেড়ে চলে যায় অবলীলায়। এতে তার হয়ত কিচ্ছু আসে যায় না। কিচ্ছু না।

অবনীর ভেতরে ক্ষোভ, অভিমান, দলা পাকিয়ে ওঠে। উদ্গত কান্না সামলে হাঁটছে সে এক দোকান ছেড়ে অন্য দোকানে। বই কেনার সেই আন্তরিক মনঃসংযোগ নেই। সে বই হাতড়ে দেখছে। উল্টে-পাল্টে সস্থানে রেখে দিচ্ছে। মূলত সে কিছুই দেখছে না। কিচ্ছু না। তার শুধু মনে পড়ছে অজস্র প্রতিশ্রুতির সাক্ষী প্রাচীন সেই দেবদারু গাছেটিকে। এক হেমন্তে দুপুর আর বিকেলের সন্ধিক্ষণে যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমৃত্যু এক সাথে পথ চলার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল দুজন মানব-মানবী। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। যেন সেখানে কোনদিন কোনও শব্দ ছিল না। ভাষা ছিল না। চোখের কোণে বায়স্কোপের মতো ভেসে উঠছে পেছনের কাল। মাত্র সাত বছর দুই মাস আগে শেষবার দেখা হয়েছিল তাদের রশিদ খাঁ ডিগ্রী কলেজের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে। সেইদিনই নাভিদ অবনীকে জানিয়েছিল, পরিবারের পছন্দে আমেরিকান সিটিজেন পাত্রীর সঙ্গে বিয়ের সুযোগ কোনভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি নয় সে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ভালোবাসা, এই দুইয়ের মাঝে উচ্চাকাঙ্ক্ষা জিতে গিয়েছিল। হেরে গিয়েছিল ভালোবাসা। কলেজ প্রাঙ্গণে দেবদারু গাছের নিচে সেদিন পরাজিত হরিণীর ন্যায় অনেকটা সময় নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল অবনী। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল, মানুষের জীবন তো আর নিরবচ্ছিন্ন সুখের নয়।

বিচ্ছিন্নভাবে ঘোরাঘুরির সময়টায় জনমানুষের কোলাহলের ভিড়ে গৌরবর্ণের বিদেশিনীর ‘হ্যালো’ ডাকে ফিরে তাকায় অবনী। ‘জানো, বইমেলাকে ঘিরে এত আয়োজন, আনন্দ-যজ্ঞ আগে দেখিনি।’ অবনীর কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি। প্রতিউত্তরে মৃদু হেসে কোণের দিকে শেষ প্রান্তে খাবারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্রেতাদের ভিড়। খাবার দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না অদ্ভুত রঙধনু পোশাকের সেলসম্যান দুইজন। লাইনে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা নিতে সময় লাগল বেশ। তবু চায়ের তেষ্টা তো অন্তত মেটানো যাবে। ইংল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, বাংলাদেশ, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত লেখকদের সঙ্গে ছবি তোলায় ব্যাস্ত স্থানীয় লেখক ও পাঠককুল। এক স্থানে একদলা ভিড় লক্ষ্য করল সে। কিসের জটলা কে জানে? এই শহরে তো হুমায়ুন আহমেদ নেই। কিংবা এমন কেউ, যাকে ঘিরে জটলা হতে পারে। খানিকটা এগিয়ে যেতেই বিষয়টি পরিস্কার হল। আলোচিত, বিতর্কিত একজন লেখককে ঘিরে আছে আগত দর্শনার্থী, লেখক ও পাঠকরা। দীর্ঘদিনের নির্বাসিত এই লেখকের সঙ্গে ছবি তুলছে, কুশল বিনিময় করছে সকলে। প্রবাসী লেখকদের অনেকেই খুব বিনয়ের সঙ্গে নিজের লেখা বই তাকে উপহার দিচ্ছেন। তিনি হাসিমুখে সানন্দে তা গ্রহণ করছেন। খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ। অথচ কে বলবে এই লেখক মৌলবাদীদের হুমকির মুখে নিজ দেশে নিষিদ্ধ? বছরের পর বছর নিজ জন্মভূমিতে যেতে না পারার হাহাকার বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর পথে পথে। কে বলবে এই ভিন দেশের বইমেলায় অগণন স্বদেশী মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন নির্বাসিত এই লেখক? আসলে এটি বাক স্বাধীনতার পক্ষে সচেতন জনগনের নিঃশর্ত সমর্থন বৈ আর কিছু নয়।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে মুখ তোলে অবনী। মুখোমুখি সামনে দাঁড়িয়ে নাভিদ। অপার কৌতূহলে সরাসরি তাকায় অবনী। মানুষটির স্বাস্থ্যের ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে এই সাত বছরে।
‘তোমার সঙ্গে এভাবে আটলান্টিকের এ-পাড়ে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।‘ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল নাভিদ।
‘আটলান্টিকের এ-পাড়ে এলেও তোমার সঙ্গে আমার দূরত্ব এক মহাসাগর সমান’ মনে মনে বলে অবনী।
‘কবে এসেছ এ-দেশে? কোথায়, থাকো?’ সেই গমগমে কণ্ঠস্বর। যে কণ্ঠের কবিতা আবৃত্তি শুনে একদিন মুগ্ধ হয়ে মানুষটিকে ভালবেসেছিল অবনী।
‘এই তো চার বছর হয় এসেছি। স্বামীর সঙ্গেই আছি।‘ বেশ জোরের সাথে কথাটি বলল যেন। চোখেমুখে স্বতঃস্ফূর্ত ভাব বজায় রাখতে সচেষ্ট হলো সে। স্বামী, সন্তান নিয়ে প্রবলভাবে সুখে আছে, ভালো আছে, এমনটি বুঝিয়ে দিতে হবে নাভিদকে। জগতে কারও জন্যে কিছু তো থেমে থাকে না।
কিন্তু কথা আর বেশিদূর এগিয়ে নেয়া গেল না। বন্ধু সুজানা আর জয়ীর ডাকে দ্রুতই প্রস্থান করতে হলো অবনীকে। গল্প, আড্ডা, ছবি তোলা চলে। রাত বাড়ে। বিদায় নিয়ে পার্ক করা গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে অবনী। সে কাঁধ ঘুরিয়ে পেছনে তাকায় বারবার। যতদূর চোখ যায় একমুখী দৃষ্টিতে কী যেন খুঁজে ফেরে। অন্তরাত্না বলছে, ‘কী খুঁজছো, অবনি? বিষাদ? সুখের সংসারে থেকে?’ চোখের জল ভু-পৃষ্ঠে পতিত হওয়ার আগেই নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে সে। ‘আক্ষরিক অর্থেই স্বামী, সংসার নিয়ে সুখে আছি আমি’ বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে মনে মনে বিড়বিড় করে অবনী। তবে দিনশুরুর সময়ের আনন্দে উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত অবনী নামের মেয়েটি দিনশেষে কোথায় নিরুদ্দেশ হল? আকস্মিকভাবে বিদ্যুৎ ঝলকের ন্যায় কেনইবা দেখা হলো অতীতের সঙ্গে বর্তমানের? এক অফুরন্ত জিজ্ঞাসা নীরব বাতাসের মতো আবছা হয়ে ঘুরে বেড়ায় অবনীর মস্তিস্কে।

মানুষের জীবনটাই বুঝি বারবার পিছনে ফিরে দেখার। এ এক বিচিত্র অনুভূতির মায়াজাল। এখানে কেবলই প্রতিশ্রুতিভঙ্গের একটি হাত ছাড়া আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারে না অবনী।

*******************************