অন্য সন্ধ্যে, ভিন্ন বিতোফেন || শিল্পী নাজনীন
১.
দীঘিটা টলটলে। স্বচ্ছ। কাকচক্ষু কি একেই বলে? আকাশটা নেমে এসেছে। হঠাৎ তাকালে ভ্রম হয়। আকাশ না কি দীঘি? ঘুম ভেঙে ওদিকে চোখ পড়তেই প্রথমটায় নিজের মধ্যেও অমন একটা ভ্রম টের পায় নীল। ভ্রম অথবা মোহ। না কি মায়া? নীল বিড়বিড় করে আপন মনেই। তারপর চমকে ওঠে। মনে পড়ে যায় লহমায়। মরতে না পারার ব্যর্থতা আর পুনরায় বেঁচে ওঠার গ্লানি মুহূর্তেই গ্রাস করে নেয় তাকে। তার মধ্যে জেগে ওঠে সীমাহীন হাহাকার, অনন্ত বিষণ্নতা। যন্ত্রণাময় বোধে তাড়িত হতে হতে নীল বুঝতে পারে, বাকী সময়টা, যতদিন বাঁচবে সে, সেই পুরো সময়টা তাকে বহন করতে হবে এই অমানুষিক যন্ত্রণার বোধ, এই তীব্র, তীক্ষ্ণ অনুশোচনার জ্বালা। বস্তুত জীবন যে এতটা ভারী, এতটা দুর্বহ, সেটা এমন করে আগে আর কোনোদিন জানা হয়ে ওঠে নি তার।
সে চোখ রাখে দীঘিতে। কিংবা দীঘিতে ডুবে যাওয়া আকাশে। কী আশ্চর্য। তাতে মাছ সাঁতরায় না। পাখি ওড়ে। আকাশে ওড়া পাখির প্রতিবিম্ব উড়ে যায় দূরে। নীল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। যদি অমনি করে ওড়া যেত! আহা। তাহলে জীবন এত ক্লিশে হতো না, এতটা দুর্বহ। পরক্ষণেই মাথা নাড়ে হতাশায়। মরে গেলেই বেশ হতো। সে যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, সে খবর নিশ্চয়ই গোপন নেই আর এতদিনে। কী করে সে এই বেঁচে ওঠার লজ্জা নিয়ে আবার দাঁড়াবে সবার সামনে, বিশেষত বকুলের সামনে! কল্পনায় সে বকুলের মুখটা মনে করার চেষ্টা করে। বকুলের মিষ্টি, শ্যামল মুখটাতে সে দেখতে পায় তাচ্ছিল্যের হাসি, উপহাসের ভ্রুকূটি। দুঃখে চোখে জল আসে তার। মরে যেতে ইচ্ছে করে আবার। এই উপেক্ষার ভাষা, এই অবহেলার ইঙ্গিত সহ্যের দমটুকু আপাতত আর নাই তার। সে দীঘির বাঁধানো বেদীতে শুয়ে পড়ে চোখ বুজে, তারপর দুর্বল, অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ফের।
২.
বিকেলের মরে আসা রোদে তখন একটা ক্লিশে বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায়। মানুষগুলোও একটু মনভোলা হয়ে বুঝি-বা এড়াতে চায় কোনো হাঁপিয়ে ওঠা একঘেয়েমির রেশ। সোনা সোনা আলোয় অপার্থিব লাগে পুরো বিকেলটাকেই। পদ্মার হিমেল হাওয়ায় সারাদিনে রোদে পোড়া মানুষগুলো তখন গা জুড়িয়ে নেয় আয়েশে। কেউ কেউ দরকারী সওদা ইতোমধ্যেই সেরে নিয়ে বাজারের কোনে বসে ইয়ার-দোস্তদের সাথে আরাম করে বিড়ি ফোঁকা অথবা মস্করায় ব্যস্ত হয়, অন্যেরা নিবিষ্ট হয় কোনো দরকারী পণ্যের দরদামে। এ তল্লাটে যদিও বিজলি বাতি জ্বলছে বেশ কিছুদিন থেকে, তবু মানুষগুলো এখনও সেভাবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে নি তাতে। তাদের মধ্যে সন্ধ্যের পরপরই সব কাজ সেরে নীড়ে ফেরার ব্যস্ততা চোখে পড়ে। কেউ কেউ অবশ্য থাকে নীশাচর, তাদের কথা অন্য।
ঠিক এমন এক অলস বিকেলে, পানসে, একঘেয়ে জনজীবনে হঠাৎই উটকো এক ঢেউ এসে লাগে। সে ঢেউ ঝিমিয়ে পড়া বাজার আর প্রায় ঘুমিয়ে পড়া গ্রামটাকে চাবুকের একঘায়ে জাগিয়ে দিয়ে যায় সহসা।
দিনের আলো মুছে দিয়ে সবে অন্ধকার তার ঝিরঝিরে একটা পর্দা বিছিয়ে দেয় আমলাবাড়ি বাজার, পদ্মার কোল আর কালিবাড়ির কালি প্রতিমাটার ওপর। তাতে কালি প্রতিমাটা ঢেরগুণ তেজে জ্বলে উঠে যেন অন্ধকারটাকেই ভেংচি কাটে আরও। বিদ্যুৎ যে কখন আসে, কখন যায়, তার খোঁজ বড় একটা রাখে না এ অঞ্চলের মানুষ। অন্ধকারে তেমন একটা অনভ্যস্ততাও নেই তাদের। সন্ধ্যের সেই আবছা অন্ধকারে কালিবাড়ির বটগাছের নিচের বাঁধানো বেদীতে তখন মাত্রই গাঁজার আড্ডা জমে ওঠে নীল আর তার সঙ্গীদের। গাঁজায় নীলের গলায় লালনের গান দারুণ জমে বলে কেবলই সে মাথা ঝাঁকিয়ে, গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করে, আমি অপার হয়ে বসে আছি…
ঠিক তখন, হঠাৎ-ই, বলা নেই কওয়া নেই, পূবের আকাশের এককোণে ফ্যাকাশে, ঝাপসা একফালি চাঁদ করুণ মুখ বের করে দেয়, আর ক্ষণপরেই তারচেয়েও ফ্যাকাসে, করুণ একটুকরো জোছনা এসে আছড়ে পড়ে পুরো এলাকাটার ওপর। শ্যামলা কালো মেয়ের মুখে হালকা প্রসাধনের মতো ফ্যাকাশে জোছনাটা যখন সন্ধ্যার পাতলা কালো মুখে পড়েছে কি পড়ে নি, অমনি পটাপট জ্বলে ওঠে গেঁয়ো রাস্তায় লাগিয়ে রাখা কয়েকটা বিজলি বাতি। সেই সঙ্গে বাজারের মধ্যের কয়েকটা দোকানেও জ্বলে ওঠে আলো। সেগুলোতে এতক্ষণ জ্বলতে থাকা কুপি বাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নেভাতে নেভাতেই কানে বাজে বিকট চিৎকার। এত বিকট যে বাজারের অবশিষ্ট লোকজনের বুক কেঁপে ওঠে। এমন-কি নীলদের গাঁজার আসরটিকে পর্যন্ত তা কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। সবাই উৎকর্ণ হয়ে চিৎকারের উৎস খুঁজতে সশব্যস্ত হয়ে ছোটে।
ফিকে জোছনা আর বিজলির অকরুণ আলোয় খুবই অপরিচিত এক দৃশ্য চোখের সামনে ভাসে তখন তাদের। বস্তুত দৃশ্যটা সন্ধ্যের সেই রহস্যঘন আলো-আঁধারিতে ভীষণ আধিভৌতিক মনে হয়।
নেহাত-ই অতিলৌকিক এক ছবি হয়ে সেটা ঝুলে থাকে তাদের নাকের ডগায়। দৃশ্যটা তাদের কাছে এতটাই বেখাপ্পা আর বেমানান লাগে যে, প্রথমে তারা এটাকে ভূতুড়ে ভেবে ভয় পায়, ফিসফাস করে। তারা দেখতে পায় বিদ্যুতের খাম্বার সঙ্গে, অনেক উঁচুতে একটি বানরসদৃশ মনুষ্য অবয়ব, কিছু একটা আঁকড়ে ধরে ঝোলে। যে বিকট চিৎকারে এতক্ষণ তাদের কান বিদীর্ণ হয়েছিল প্রায়, তা ততক্ষণে থেমে গিয়ে নামে অশুভ, গা ছমছমে এক নীরবতা। পদ্মার কোল ছুঁয়ে নেমে আসা ফুরফুরে হাওয়ায় উঁচুতে ঝুলতে থাকা শরীরটা দারুণ এক ছন্দে দোলে। ত্বরিতে সম্বিত ফেরে মোহর আলীর। সে চিৎকার করে, শিগগির শুহনো বাঁশ আন রে তুরা! মানুষটা মুন কয় মইরে গেল রে! তাড়াতাড়ি হর!
মোহর আলীর চিৎকারে সম্বিত ফেরে অনেকের। কাছেই জড়ো করে রাখা শুকনো বাঁশ দিয়ে তারা অন্ধকারে ঝুলতে থাকা শরীরে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। পরপর কয়েকটা আঘাতেই গাছ থেকে ফল পড়ার মতো নিথর শরীরটা ঝুপ করে নিচে পেতে রাখা কাপড়ের ওপর পড়ে। শরীরটায় আলো ফেলতেই অস্ফুট গুঞ্জন ওঠে উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে। তারা এ-ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলে ওঠে, তালি পরে এই হলেগান কাহিনি!
মরে গেচে নাহি দেকদিনি?
না না, মরে নাই এহনও। ভ্যান ডাকদে, আঁসপাতালে নিওয়া লাগবি এহনই।
আরও আরও হরেক বাক্যালাপের ভিড় ঠেলে নীল আস্তে সটকে পড়ে সে তল্লাট থেকে। সঙ্গীরাও। লহমায় গাঁজার নেশা টুটে যায় তাদের।
৩.
শ্মশানের কোল ঘেঁষা নারকেল গাছটাতে হেলান দিয়ে পদ্মার অন্ধকার মুখের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে নীল। দুয়েকটা নৌকা ভাসে। অধিকাংশই ডিঙি। মাছ ধরে জেলেরা। পাল তোলা পানসি আজকাল আর চোখে পড়ে না তেমন। ঘন হওয়া অন্ধকারে পদ্মাকে কেমন রহস্যময় লাগে। দিনের পদ্মাকে চেনা যায়, কিন্তু এই রাতের পদ্মা বড় অচেনা, অন্ধকার। তার নিজের মনের মতো। না। তার মন এরচে ঢের বেশি অন্ধকার। আরও বেশি তমসা তাতে। নিজের মনের দিকে তাকিয়ে নিজেই চমকে ওঠে নীল। কবে এত অন্ধকার জমেছে তার মনে? এত এত ছোপ ছোপ কালোয় কবে ঢেকেছে তার সফেদ মন? মকবুল আলীর মুখটা ভাসে চোখের সামনে। ফ্যাকাসে, রক্তহীন। সারা শরীর রক্তে মাখামাখি, দগদগে ঘা। শিউরে উঠে চোখ ফিরিয়ে নেয় নীল। পালিয়ে আসে স্মৃতি থেকে। বুকের ভেতর একটুও কি আশঙ্কা উঁকি দেয় না? একটুও ভয়? প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করে থমকে যায় নীল। বুকের কাছটাতে একটু ধাক্কা লাগে। মরে যাবে না তো? যদি মরে যায়…
৪.
জোহরা বেগম সুর করে কাঁদেন। ছেলের এমন কষ্টে দিক-বিদিক ভুলে ছেলেবউ আর নাতিকে শাপ-শাপান্ত করেন। হালিমা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে তাতে। জোহরা বেগমের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে সে মুখে। শাস্তিস্বরুপ জোহরা বেগমকে একবেলার ভাত বন্ধ করে দেয়। অন্ধ, আলোহীন চোখে জোহরা বেগম তসবি টেপেন, ছেলের আরোগ্য কামনা করেন, সেইসঙ্গে হালিমা আর তার ছেলের মৃত্যু কামনা করে চলেন অনবরত। দাওয়ায় বিছানো কলাপাতায় দগদগে ঘা আর নির্জীব শরীর নিয়ে মকবুল মরার মতো পড়ে থাকে প্রায় পথ্য ও পরিচর্যাহীন। তার শরীরের ক্ষত থেকে ফ্যাকাসে লালরঙা আঠালো কষ গড়িয়ে পড়ে, শরীরময় ওড়াউড়ি করে কতগুলো বিচিত্ররঙা মাছি, মাঝে মাঝে লেপ্টে বসে পড়ে আঠালো ক্ষতে, শুঁড় ডুবিয়ে মহানন্দে ব্যস্ত হয় ভোজে। পৃথিবীর এইসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিবাদ-বিসম্বাদ থেকে নিজেকে অবিশ্বাস্য নিস্পৃহতায় গুটিয়ে রাখে মকবুল। চোখ বন্ধ করে সে পড়ে থাকে অনড়। গ্রামে ঢি ঢি পড়ে যায়। কেউ আর এ বাড়ি মাড়ায় না বিনা প্রয়োজনে। মকবুল চোর। রাতের অন্ধকারে সে বিদ্যুতের তার চুরি করে শহরে নিয়ে বেচে। সেদিনও তেমনই হতো, যদি না হুট করে বিদ্যুৎ চলে আসত। হুঁহ বাবা! কথায় বলে না, সাতদিন চোরের তো একদিন গৃহস্থের! বোঝো এখন ঠ্যালা! প্রাণে যে বেঁচেছ, এইই ঢের!
বাড়িতে এসে, তাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়েই এসব বলে যায় গ্রামের লোকজন। হালিমা চোখমুখ শক্ত করে শোনে। কখনও খিস্তি করে তাড়ায়। দামড়া ছেলেটা সারাদিন টো টো ঘোরে। রাতেও ফেরে না মাঝে মাঝে। দুঃখে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করে তার। কত কষ্টে লেখাপড়া শিখিয়েছিল ছেলেটাকে তারা। কলেজ পাস করিয়েছিল। তারপরও বখে গেল ছেলেটা। অশিক্ষিত বাপমায়ের কত স্বপ্ন ছিল! জলে গেল সব। নেশা করে ছেলে। নেশা করার টাকা চায় বাপের কাছে এসে, না পেলে উলটপালট করে দেয় সব। এরচে বরং নিজের মতো দিনমজুরি শেখাত ছেলেকে মকবুল, তাতে অন্তত এমন দুর্দিন দেখতে হতো না চোখে। ছেলে এখন চুলে টেরি কেটে, পায়ে বাবুদের মতো স্যান্ডেল পরে ফটাস ফটাস শব্দ তুলে হাঁটে, শুদ্ধ ভাষায় কথা কয়, হাতে ঘড়ি পরে সময় মাপে, মাঝে মাঝে চোখেও কালো চশমা লাগায়। এসব দেখে দেখে মকবুল আলী হতাশ, দুঃখিত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মাঝে মাঝে। রাগে, দুঃখে, শোকে, জল আসে তার চোখে। বুকের মধ্যে একটা ভয়ও জমে থাকে আজকাল। নিজের ছেলেকে চিনতে পারে না আর। কোলে-পিঠে করে বড় করা ছেলেটা কেমন অনাত্মীয়, অচেনা হয়ে গেল চোখের সামনেই, অচেনা ভাষায় কথা কয়, মাঝে মাঝে রেগে গেলে ইংরেজিও কয়। তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে না বেচারা মকবুল। শুধু শুনলে কেমন একটু বুক ধুকপুক করে তার। ভয় ভয় লাগে। শুনতে শুনতে দুয়েকটা শব্দ বেশ চেনাও হয়ে গেছে তার। ননসেন্স, ইডিয়ড, শিট, ফাক ইউ। ছেলের বলার ধরণে মকবুল বোঝে, ওগুলো বিশেষ ভালো কোনো শব্দ নয়, গালিবিশেষ। ত্যক্ত মকবুলের সব রাগ, ক্ষোভ গিয়ে জমা হয় যত নষ্টের গোড়া ঐ ইংরেজি ভাষা আর বউ হালিমার ওপর। ছেলের অনুপস্থিতিতে সে নিজের সব ক্ষোভ ঝাড়ে এই দুইয়ে। রাগে, দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে বলে ওঠে, গুষ্টি চুদি তোর ইংরেজির! শালার ব্যাটা শালা! এটা পয়সা কামানের মুরোদ নাই আবার ইংরেজি ঠাপাও, অ্যাঁ? সুমন্দির ছাওয়াল যিনি কোনেকার!
ক্ষণেক বিরতি নিয়ে আবার সে বকে চলে,শালীর বিটি শালী! আজই তোর শিক্কিত্ ছাওয়াল নিয়ে তুই আমার বাড়িত্তে বাড়াবি! আমি আর এই বুড়ো আড়ে তোর দামড়া ছাওয়ালেক খাওয়াবের পারব নাকো বসা বসা!
বলাবাহুল্য, শেষোক্ত বাক্যাবলী হালিমাকে লক্ষ্য করে বর্ষিত হয়। এই বাক্যবাণে হালিমাকে বিশেষ বিচলিত দেখায় না যদিও। সে এসব অগ্রাহ্য করে নিজ কাজে অখণ্ড মনোযোগ অক্ষুন্ন রাখে।
সেদিনের দুর্ঘটনার পর থেকে, নিত্যকার চেনা চিত্রে চিড় ধরিয়ে মকবুল মৃতবৎ শুয়ে থাকে বারান্দায় বিছানো কলাপাতায়, আর ঘরের দাওয়ায় বসে শাপ-শাপান্ত করে চলে তার অন্ধ মা, অন্যদিকে পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখে ঘরের কাজ করে যায় হালিমা। বাড়ির কোথাও তাদের শিক্ষিত, ইংরেজি বলা ছেলের টিকিটিও মেলে না। সে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দূরে কোথাও গাঁজার আড্ডায় ব্যস্ত থাকে, তেমনটিই দস্তুর হয়ে ওঠে দিনে দিনে।
৫.
সূর্যটা তীর্যকভাবে পশ্চিমে হেলে যায় আর তার থেকে লালচে আলো এসে পড়ে বাঁধানো ঘাটে। পাড়ের দীর্ঘ, সারি সারি গাছগুলোর ছায়া আরও বেশি দীর্ঘ, এলোচুল মেলে নাইতে নামে দীঘির জলে। নতুন এক বিকেল নামে পৃথিবীতে। দুচোখ ভরা মায়া নিয়ে আরেক অদ্ভুত, মায়াবী অপরাহ্ন চোখ রাখে অজপাড়াগাঁ, গোসাইডাঙ্গীর চোখে। দুর্বল, অভুক্ত শরীরে হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তেই কেমন উদ্ভ্রান্ত, অস্থির লাগে নীলের। তার মধ্যে জেগে ওঠে অপার বিস্ময়, আশ্চর্য ঘোর। কোথায় রয়েছে আদতে, প্রথমে বুঝতে পারে না। মনে হতে থাকে বিথোফেনের মাতাল করা সুর ভাসে হাওয়ায়, মোৎসার্টের সুরজালে বিহ্বল হয় চরাচর। মনে হয় পৃথিবী নয়, অন্য কোনো গ্রহবাসী সে।
তবে কি স্বর্গেই চলে এলাম? নিজের মনেই ভাবে নীল। চোখ কচলে তাকায় দীঘির জলে স্নানরত দীঘল বৃক্ষরাশির কালো কালো ছায়ার দিকে। পলকহীন তাকিয়ে থাকতেই চোখ পড়ে দূরে, দীঘির পাড় ঘেঁষে একপাল হাঁসেদের সাঁতরে তীরে ওঠায়, দিনশেষে তাদের নিজেদের চেনা পথে ফিরে যাওয়ার আয়োজনে। আর তখনই দুম করে সব মনে পড়ে যায় আবার। বিষণ্নতা আর অনুশোচনায় নুয়ে পড়ে তার ক্লান্ত, অবসন্ন মন। ঘুমের ওষুধটা কড়া ছিল। সে খেয়েওছিল পরিমাণ মতোই। তবু যে ঘুম ভাঙে তার, আবার যে সে চোখ মেলে পৃথিবীর আলোয়, এই পুনর্জন্মের কৃতিত্ব কিংবা দায়, পুরোটাই পিয়ারের। সে-ই প্রথম আবিষ্কার করে নীলের ঘুমটা অস্বাভাবিক, অদ্ভুত।
নীল ছাড়া অন্য বন্ধুদের অবস্থা ভালো। গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান তারা। পিয়ারের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেশি হওয়ায় এ বাড়িতে নীল প্রায়ই আসে। আসে মূলত পিয়ারদের বাড়ির পাঠাগারের লোভে। সেটা প্রায় অমনি অব্যবহৃতই পড়ে থাকে, যদি না নীল মাঝে মাঝে হানা দেয় তাতে। মূলত এখান থেকেই ধীরে ধীরে চোখ খোলে নীলের। পৃথিবীর উজ্জ্বলতম আলোক চিনতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই সে আবিষ্কার করতে শেখে নিজের জীবনের ঘোরতম অন্ধকারও। অশিক্ষিত, অনুদার এক পরিবারে জন্ম তার, দিনমজুরির আড়ালে মূলত ছিঁচকে চুরিতে অভ্যস্ত এক ঘৃণ্য পিতার সন্তান সে। বন্ধুরা তার সাথে মেশে দূরত্ব রেখে, করুণার দৃষ্টিতে। শুধু পিয়ারই তাকে যা একটু অন্য চোখে দেখে। জীবনের এই ঘোরতম অন্ধকার আবিষ্কারের উত্তেজনায় রাগে, ক্রোধে হিতাহিত বোধ ক্রমশ হারাতে থাকে নীল। বাইরে তেমনই শান্তশিষ্ট গোবেচারাটি দেখতে থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে হয়ে ওঠে অবাধ্য, গোঁয়ার। তার চোখ এড়িয়ে যায় সন্তানের প্রতি অশিক্ষিত, তস্কর বাবার বাৎসল্য, প্রেম, মায়ের অন্ধস্নেহ।
সে ভুলে যায় তার জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করে তার পরিবার, তার শিক্ষা, ভরণপোষণ, যা কিছু চাহিদা সব পূরণ করতে কতটা নাভিঃশ্বাস ওঠে তার না খেতে পাওয়া, রুগ্ন, হতভাগ্য বাবার। সে ভুলে যায় তাকে ঘিরে তার বাবার চোখে, মা এমন-কি অন্ধ দাদির চোখেও জ্বলতে থাকা একটুকরো সোনালী স্বপ্ন। তাকে শিক্ষিত করে, তার মধ্যে আলো জ্বেলে, সে শিখায় নিজেদের জীবনে লেপ্টে থাকা অন্ধকার দূর করার যে উদগ্র বাসনা লালন করে তার পরিবার, স্বপ্ন দেখে প্রাত্যহিক জীবনে জড়িয়ে যাওয়া দৈন্যের কালো ছায়া মুছে ফেলার, বেমালুম সে কথাও ভুলে যায় নীল। বরং এই কথা তার মাথার মধ্যে গেঁথে যায় দৃঢ়ভাবে যে, তার ভিত্ অন্ধকার, তার বাবা মূলত একজন চোর, সমাজের অন্ধকার অংশে তার অবস্থান। ফলে পড়াশোনায় ক্রমশ আগ্রহ হারাতে থাকে সে। পিয়ারদের অব্যবহৃত পাঠাগারে সে যায় বটে, বইও পড়ে, কিন্তু তাতে যে আলো, যে বিভা, তার ছটায় বরং নিজের অন্ধকারটাই আরও বেশি প্রকট হ’তে থাকে তার কাছে, ততই সে কুঁকড়ে যেতে থাকে ভেতরে ভেতরে। নিজের ভেতরে জন্ম নেয়া নব্য শিল্পসত্তা আর তার হীনম্মন্য প্রকৃত সত্তা, এই দুয়ের সংঘর্ষে সে হয়ে পড়ে আরও বেশি হতাশ, আরও বেশি বিষণ্ণ। সমস্যাটা প্রকটাকার ধারণ করে তখন, যখন সে দেখে কলেজ শেষ করার পর তার অধিকাংশ বন্ধু উচ্চশিক্ষার্থে শহরে চলে যায়, এমন-কি পিয়ারও। তার বাপের তেমন সামর্থ্য নেই যে তাকে শহরে রেখে আরও বেশি পড়ায়। বরং তার বাপ-মা দুজনেই চায়, সে এবার একটা চাকরি যোগাড় করুক, পরিবারের ভার নিজের কাঁধে নিয়ে বাপের বোঝা হালকা করুক খানিক। সেটা বুঝে তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়ে নীল। এবং সে উপলব্ধি করে যে, পড়াশোনার নামে যা সে শিখেছে এতদিন, তাতে না সে বাপের মতো দিনমজুরী পেশায় নামতে পারে, না রাতের আঁধারে বাপের মতো চুরি করতে পারে, আর না সে পারে কোনো একটা ছোটখাটো চাকরিও যোগাড় করতে। দিনমজুরী বা চুরি করতে তার আত্মসম্মানে বাধে। আর যা দিনকাল পড়ে, তাতে ছোটখাট একটি চাকরি যোগাড় করতেও লাগে গুচ্ছের টাকা, নয়তো কেউকেটা কারও তদ্বির। যা তার মতো একজনের পক্ষে যোগাড় করা অসম্ভব। কিন্তু তার অশিক্ষিত, মূর্খ বাপ-মা কিছুতেই এই বাস্তবতা বুঝতে চায় না, বোঝেও না, উল্টে উত্তরোত্তর তার ওপর চাপ বাড়াতে থাকে আর সে নিজে কোণঠাসা হয়ে দিন দিন বিগড়ে যেতে থাকে আরও। শেষে সে যোগ দেয় গ্রামের বখে যাওয়া, উচ্ছন্নে যাওয়া কিছু নেশাখোর ছেলেদের সঙ্গে। যারা দিনে টেরি কেটে, হাতে ঘড়ি, চোখে সানগ্লাস আর পায়ে হাওয়াই চপ্পল পরে ফটাস ফটাস শব্দ তুলে রাস্তা দিয়ে হাঁটে, সন্ধ্যেয় গাঁজার আড্ডা জমায় আর রাত-দুপুরে বাড়ি ফিরে টাকার জন্য বাপ-মার সাথে হুজ্জত করে। এদের আরও একটা কাজ আছে। এরা সপ্তাহান্তে সবাই মিলে চাঁদা তুলে দূর গ্রামে কনে দেখতে যায়, সে বাড়িতে পেট পুরে খায়, তারপর পরে মতামত জানাবে, বলে কেটে পড়ে। প্রথম প্রথম এ দলে ভিড়ে মানিয়ে নিতে বেশ একটু বেগ পেতে হয় নীলের, শেষে সয়েও যায়। বকুলের সাথে নীলের পরিচয়টাও সেভাবেই।
৬.
বকুল বসে ছিল হালকা গোলাপি, তার ওপর আকাশী ছোপ ছোপ একটা ডুরে শাড়ি পরে। তার শ্যামলা মুখে শাড়ির গোলাপি আভা পড়ায় তাকে মিষ্টি দেখাচ্ছিল খুব। নীলরা এসেছিল চারজন। কনে দেখার উদ্দেশ্যে এসেছে, বকুলের বাড়ির লোকজন এমনটা জানলেও মূলত তাদের লক্ষ্য ছিল খাওয়া। চারজন মিলে শ দুয়েক টাকা কনের হাতে ধরিয়ে দিলেই দিব্যি ভরপেট ভূরিভোজ হয়ে যায়। কনেকে তারা দুয়েকটা প্রশ্ন করে, বেশ একটু পরখ করে দেখে, সেটা বাড়তি পাওনা। দরিদ্র, অসহায় এসব পরিবারের কাছে কন্যা মানে দায়, যে কোনোভাবে তাদেরকে পাত্রস্থ করতে পারলেই তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মেয়েকে পাত্রস্থ করার চিন্তায় অনেক সময়ই তারা এই চক্রে ফেঁসে যায়, ভোজের আয়োজনটুকুই সার হয় তাদের।
বকুল মাথায় আধা ঘোমটা টেনে তাদের সামনে নতমুখে বসে এসে, প্রশ্ন করলে নিচুস্বরে উত্তর দেয়। নীল বেশিরভাগ দিন চুপচাপ থাকে। খাওয়ার সময় গোগ্রাসে গেলে, তারপর সবার সাথে ফিরতি হাঁটা দেয়। বকুলকে দেখে সেদিন তার হঠাৎ কী মনে হয়, ফস করে প্রশ্ন করে বসে, তুমি কি গান জানো?
অবাক, ভীত চোখে ঝট করে তাকায় বকুল। এমন অদ্ভুত, বেয়াড়া প্রশ্ন সে কোনোদিন শোনে নি। শুনবে ভাবেও নি। গরীব, দিনমজুর এক পরিবারের মেয়ে সে, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নামে মাত্র পড়া হয়েছিল তার, সে-ও ঢের আগে। পেটপুরে সে খেতে পায় না তিনবেলা, সেখানে গান কোত্থেকে আর কীভাবে সে শিখতে পারত, ভেবে পায় না একদম। নিরুত্তর বকুল কিছুক্ষণ নীলের চোখে কী একটা খোঁজে, তারপর নামিয়ে নেয় চোখ।
নিজের প্রশ্নে নিজেই থতমত খেয়ে চুপ করে যায় নীল। বন্ধুরাও নড়েচড়ে বসে একবার, গলা খাঁকারি দেয়।
নীলের এমন সৃষ্টিছাড়া প্রশ্নে বকুলের পরিবারের লোকজনকেও হতাশ, বিমর্ষ দেখায়। পাত্র হিসেবে সেদিন নীলকেই জাহির করায় তার প্রশ্নের গুরুত্ব ঢেরগুণ বেশি হয়ে পাত্রীপক্ষের কাছে ধরা দেয় এবং তারা, পুরো আয়োজনের পয়সাটাই জলে গেল, এবারও মেয়েকে পাত্রস্থ করা গেল না ইত্যাকার বিষয় ভেবে মনে মনে ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু নীলের সেদিন কী হয় হঠাৎ, সে সবার সব আশংকা ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় নিমেষেই। বন্ধুদের, বকুলের পরিবারের লোকদের, সর্বোপরি বকুলকে অবাক, হতভম্ব করে দিয়ে সে সহসাই ঘোষণা দেয় যে পাত্রী তার পছন্দ হয়েছে, এবং খুব শিগগিরই সে একটা দিনক্ষণ স্থির করে, বিয়ে করতে প্রস্তত।
নীলের এমন অদ্ভুত আচরণে বন্ধুরা অবাক, প্রশ্নভরা চোখে তার দিকে তাকায়, পাত্রীপক্ষের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কিন্তু সেসবের বাইরেও, নীল সহসা দেখে, তার এমন ঘোষণায় বকুলের শ্যামলা মুখে দপ করে একটুকরো আলো জ্বলে ওঠে, সে অবাক, লজ্জা লজ্জা ডাগর চোখ তুলে নীলের চোখে তাকিয়ে তখন তখনই চোখ নামিয়ে নেয়। আর নীল, নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক কাঁপুনি টের পায়, বুকের ভেতর কী একটা ছলকে ওঠে, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে অভূতপূর্ব শিহরণ।
ফেরার পথে বন্ধুদের টিটকারী, ঠাট্টা-মস্করা উপেক্ষা করে সে চুপ থাকে পুরোটা সময়, এবং এক ফাঁকে জানিয়ে দেয় যে এমন ধাপ্পাবাজিতে আর সে থাকবে না এরপর।
তারপর থেকে বকুলের পরিবার এবং বকুলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে নীল, জানিয়ে দেয় শিগগিরই কোনো একটা কাজ যোগাড় করে বাপ-মায়ের মত নিয়ে বকুলকে ঘরে তুলবে সে। বকুলের সঙ্গে সম্পর্ক যতটা দৃঢ় হয় গাঁজার আড্ডার সঙ্গে সম্পৃক্ততা ততই দ্রুত আলগা হয়ে আসতে থাকে তার। নিজের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা অন্য সত্তাটাকে সে প্রাণপণে চেষ্টা করে বাইরে আনার। একটু একটু করে সে নিজের ভেতরের অন্ধকারটাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে চলে।
কিন্তু সেদিনের সন্ধ্যেটা সব উল্টেপাল্টে দেয়। তার ভেতরের অন্ধকারটাকে ঢেরগুণ বাড়িয়ে তুলে সন্ধ্যেটা তাকে ডুবিয়ে দিয়ে যায় সীমাহীন অন্ধকারে। পিয়ার বাড়ি ফেরে শহর থেকে। বাজারের উত্তরপাশের কালিবাড়ির বাঁধানো বেদিতে সেদিন শখের গাঁজার আড্ডা বসে। সন্ধ্যের আবছা অন্ধকারে, ফিকে জোছনায়, আড্ডা সবে জমে ওঠে তাদের, বন্ধুদের অনুরোধে গলা ছেড়ে কেবলই নীল গেয়ে ওঠে লালনের গান, আর তখনই বিষম চিল-চিৎকারে সচকিত, উৎকর্ণ হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আড্ডা ফেলে তারাও ছুটে যায় দুদ্দাড়। তারপর একছুটে পালিয়ে যায় নীল। জীবন থেকে, পৃথিবী থেকেও পালাতে চায় সে।
৭.
পিয়ারই তাকে আবিষ্কার করে পরদিন, শ্মশানের নির্জন কোণে, ঘুমে অচেতন, সংজ্ঞাহীন। সে হাসপাতালে ছোটে নীলকে নিয়ে সেই প্রায়ান্ধকার ভোরে, একা। ফলত একই হাসপাতালে মাত্র একটি রাতের ব্যবধানে বাপ-ছেলেকে দুটি বেডে মৃতবৎ পড়ে থাকতে দেখা যায় তখন। একজন চৌর্যবৃত্তিতে নেমে বিদ্যুৎস্পষ্টতায়, অন্যজন জীবনের দুঃসহ লজ্জা আর গ্লানি থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা-চেষ্টায়। তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে পিয়ার তাকে ফিরিয়ে নেয় নিজ বাড়িতে, ভালোবেসেই হয়তো।
দিনদুয়েক পর দুর্বল, অসুস্থ শরীরে ধীরে ধীরে পিয়ারদের বাঁধানো দীঘির ঘাটে গিয়ে শুয়ে দীঘিতে নামা আকাশ দেখে নীল। দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার জাগে, আবার ঘুমোয়। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘন হয়, ঘন হয় নীলের মধ্যে জন্ম নেওয়া ঘোর। সে বুঝতে পারে না কোনটা সত্যি, তার বেঁচে থাকা না-কি মৃত্যু, জেগে থাকা না-কি ঘুম। তার মন থেকে মুছে যায় সব অন্ধকার, মুছে যায় একহাট লোকের সামনে রক্তাক্ত, শরীরময় দগদগে ক্ষত নিয়ে মৃতবৎ ফ্যাকাসে মুখে সংজ্ঞাহীন পড়ে থাকা তার জনকের মুখ, বিদ্রুপাত্মক, অপমানের চাবুকে ভরা সেই একহাট জনতার ছুড়ে দেওয়া শ্লেষাত্মক বাক্যরাশি, যা মূলত বর্ষিত হয় তাকেই লক্ষ্য করে। সে ভুলে যায় কলাপাতায় শুইয়ে রাখা তস্কর মকবুল আলীর নির্জীব, ঘেন্না জাগানো ঘেয়ো শরীর, ভুলে যায় তার গ্লানিময় জীবন, বেঁচে থাকার দুঃসহ, দুর্বহ লজ্জা। সন্ধ্যের অন্ধকারে দীঘির বাঁধানো ঘাটের খোলা হাওয়ায় শুয়ে নিজের জীবনে নামা অন্ধকারকে ধীরে ধীরে বিস্মৃত হতে থাকে নীল। প্রবল এক ঘোর তাকে জড়িয়ে নিতে থাকে। তার মাথার ওপর ঝাঁকঝাঁক মশা সেই অন্ধকারে বাজিয়ে চলে অন্য এক বিথোফেন। নীলের মনে হয় এমন এক ঘুমেরই সে অপেক্ষায় ছিল এতকাল, এমন এক পৃথিবীর। ঘুমের মধ্যে সে তলিয়ে যায় অন্য এক পৃথিবীর স্বপ্নে, ডুবে যায় অন্য এক সুরের মায়ায়। সেখানে অন্ধকার নেই, বিদ্রুপের ছুরি নেই, অপমানিত, লাঞ্চিত জনকের মুখ নেই, এমন-কি ক্লিশে এক জীবনে পুনরায় বেঁচে ওঠার গ্লানিটুকু পর্যন্ত নেই। অন্য এক ঘুমে, ভিন্ন এক বিথোফেনে ডুবে নতুন এক জীবন খোঁজে নীল, মুক্তিও।
============================