অগ্নিবলয়
দীলতাজ রহমান
তৈয়বের মা মারা গেছেন, এই খবরটা জার্মানিতে সামিউলের কাছে বেড়াতে যাওয়া অবস্থায় যখন সামিউলের মা’র কানে পৌঁছুলো, সামিউলের মা সেই বিদেশের মাটিতে বসে সমবয়সী মানুষটির জন্য শুধু শোকার্তই হলেন না, তিনি বেশ একটু স্মৃতিকাতরও হয়ে উঠলেন। ছেলেকে বললেন, আহা, এই বয়সে তৈয়বের বাবার কী হবে!
সামিউল বললো, কি আর হবে? তৈয়বের বড় মা আছেন না? তৈয়বের বাবা ওনাদের বগুড়ার বাড়িতে তৈয়বের বড় মা’র কাছে গিয়ে থাকবেন। অথবা বড় মা ঢাকাতে তৈয়বের কাছে চলে আসবেন! তাদের যে কারো থাকার জন্য তৈয়ব তো একা নয়। আরো ভাইবোন ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য জেলায়ও আছে। সবাই যে যার মতো ভালো পজিশনেও আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তৈয়বের ছেলেটাকে নিয়ে। আন্টিই ওর ছেলেকে রাখতেন। তৈয়বের বউ একটা পাবলিক ইউনিভার্সিটির টিচার।’
সামিউলের মা ছেলের কথার কোনোই উত্তর দেন না। কিন্তু তিনি আনমনে কিছুক্ষণ নিজেকে নিরীক্ষণ করে মনে মনে ভাবলেন, নিজের ছেলেমেয়ের কাছে অতিথি হয়ে এসেই বেশিদিন থাকা যায় না। আর তো সতীনের ছেলের কাছে এসে পড়ে থাকা। তা সম্পর্ক দেখতে যতোই ভালো হোক। আমার তো কিছু জানা হয়ে গেছে!
এরপর সামিউলের মা’র মনে ক’দিন ধরে একটি বিষয় কাঁটার মতো খচখচ করতে থাকে। তবু তিনি ছেলেকে ডেকে কখনো আর তৈয়বদের কারো কোনো খবর জানতে চান না। কিন্তু পুরনো কিছু দৃশ্যের মহড়া সারাক্ষণ তার মনে নতুন করে চলতে থাকে। কিন্তু নাটকের পরিণতি যেন চিত্রনাট্য লেখক লিখে শেষ করেননি। তাই কোনো এক কুশীলব শেষ দৃশ্য একেকবার একেকরকম করে উপস্থাপন করার স্বাধীনতাটুকু কাজে লাগাচ্ছেন।
সামিউলের মা’র ক’দিন যাবত একটানা মনে পড়তে থাকে, তাদের ছেলেদের এসএসসি পরীক্ষার সময় মতিঝিল একটি সরকারি স্কুলে সিট পড়েছিলো।
তখন অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর মায়েরা তাদের সাথে এসে সেই স্কুলের সামনে শেষবেলা পর্যন্ত বসে থাকতেন।
ছেলেদের পরীক্ষা শেষ হলে তারপর তারা হুড়মুড় করে একসাথে উঠে যে যার ছেলের সাথে রিকশায় উঠতেন। যাদের গাড়ি ছিলো তারা গাড়িতে যেতেন।
প্রতিদিন দু’তিনটি চাদর একসাথে বিছানো হতো। সেখানে সবাই গোল হয়ে বসতেন। তারপর রোদ তাড়া করলে তারা সবাই একদিক থেকে আরেকদিকে সরে বসতেন। কিন্তু সেই আগের মতো একসাথে গোল হয়েই বসতেন। কারণ তারা যে কয় ঘন্টা ওখানে থাকতেন, একজনের গল্প আরেকজনের গল্পের সাথে এমনভাবে জোতবাঁধা থাকতো, তা তাদের যে কোনো কারো জন্য খোলাটা নিজের থেকে সহজ ছিলো না! এর ভেতর সবারই থাকতো বাড়ি থেকে আনা কিছু কিছু খাবার। কেউ কেউ আবার সবার জন্য আনতেন ফ্ল্যাক্স ভর্তি চা! কোনো ছেলের বাবা খোঁজ নিতে আসতেন তো তিনিও সাথে করে দোকানের কোনো খাবার ছেলেদের সমবেত মা’দের জন্য প্যাকেট করে নিয়ে আসতেন।
কিন্তু সামিউলের মা মাজেদা বেগমের যা আশ্চর্য লাগতো, তা হলো তৈয়বের দু’জন মা আসতো। এর ভেতর কোনজন তৈয়বের মা, তা আরো অনেক পরে তৈয়বদের বাড়িতে গিয়েও জানতে পারেননি মাজেদা বেগম। অনুমানে জেনেছিলেন আরো অনেক পরে। কিন্তু খোলা মাঠে সেই মায়েদের ভীড়ে তখন সেই ক’টা দিনে তীর্যক থেকে সোজা কোনো প্রশ্নে অন্য কোনো একজন মা-ও চেষ্টা করে জানতে পারেননি!
ছেলেদের পরীক্ষার সময় একত্র হওয়া মায়েদের কেউ কেউ স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, আপনাদের দুজনের কে তৈয়বের আসল মা বলেন তো!’ দুই মায়ের একজন একটু বেশি বয়স্ক। গায়ের রং শ্যামলা এবং তার থেকে বছর দশেক কম বয়স যার তিনি লালচে ফরসা। তখন শ্যামলা আর ফরশা দু’জনে একসাথে গলগল করে হেসে উত্তর দিয়েছেন, দু’জনেই ‘আসল মা, নকল কেউ নই।’
উত্তর পাবে না জেনেও চক্ষুতেচর্মহীন দু’চারজন হা-ভাতে বুদ্ধির মা তবু কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু ঘেরাটোপের ভেতরে থেকে দু’জন নারী সতীন হয়েও সম্পর্কের ভেতর যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে রেখেছেন, তা ক’জন মোটা দাগের বুদ্ধিসম্পন্ন নারীর ছেঁড়াটানেও তখন ছেলেদের পরীক্ষার সেই দীর্ঘ একটানা সময়ের কোনো ফাঁকে এতটুকু খসেনি!
মাজেদা বেগম, মানে সামিউলের মা’র সেই থেকে কৌতূহল ছিলো, দুই সতীনের এত একাত্মতা কেন? কিন্তু মাজেদা বেগম বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ থাকলেও নিজের মনেই আলগোছে কাঁটার মতো প্রশ্নখানা সরিয়ে রেখে দেন। কারণ পরিমিতি বোধ বলে অভিধানে একটি শব্দ আছে, এটা তার জানা ছিলো।
আরো বছর দুয়েক সময় গড়ালে মাজেদা বেগমের এক পরিচিতা তার কানাডা প্রবসী ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন জানালে, মাজেদা বেগম বললেন, মেয়ে একটা আছে বটে। আপনি যেমন চাইছেন, পছন্দ হবে। কিন্তু একটা কিন্তু আছে।
পরিচিতা বললেন, কী সেই কিন্তু?
মাজেদা বেগম বললেন, মেয়েটি দেখেন আগে, মেয়ে পছন্দ হলে, ও কিন্তু কোনো কিন্তু নয়।
ততদিনে ছেলেরা কলেজে উঠে যে যার মতো কলেজে ভর্তি হলেও তাদের বন্ধুদের ভেতর বন্ধুত্বটা তাজাই ছিলো। সেইসূত্রে তাদের মায়েদেরও হাই-হ্যালো চলতো। প্রায়ই একে অপরের বাড়িতে আসা-যাওয়ার মতো ঘটনাও ছিলো। সেই সূত্রে মাজেদা বেগম তার পরিচিতাকে নিয়ে গেলেন তার ছেলের স্কুলের সেই বন্ধু তৈয়বদের বাড়ি। তৈয়বের ইমিডিয়েট বড়বোনটাকে মাজেদা বেগমের চোখে লাগে। আর তা তার রূপের জন্য নয়। বরং মাজেদা বেগমের মনে হয়, বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট নেই, তবু কেন মেয়েটি চোখ টেনে রাখে!
মাজেদা বেগম ও তার পরিচিতাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতে বসতে তৈয়বের বড় মা জানলেন ছোটজন বাড়ি নেই। মাজেদা বেগম কোনো ভূমিকা না করে বললেন, অসুবিধা নেই। একজন থাকলেই হলো। এই যে এই সুন্দরী মহিলাকে সাথে করে এনেছি, ওনার কানাডা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য ঠিক ওনার মতো একটা সুন্দরী মেয়ে উনি চান। তো আমার মনে হয় আপনাদের তুহিনূরকে ওনার পছন্দ হবে। আর ছেলেও আপনাদের পছন্দ হবে জেনে আমি ওনাকে সরাসরি সাথে করে নিয়ে এলাম!
তৈয়বের বড় মা বললেন, কিন্তু তুহিনূরের মা তো বাড়ি নেই। তাই আমি কিছু বলতে পারছি না…। আর ওদের বাবাও আমেরিকা গেছেন, অফিসিয়্যাল ট্যুর…।’
তৈয়বের বড় মায়ের কথায় পরিচিতা, ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের মা থতমত খেলেন। তিনি বুঝলেন, এই সেই কিন্তু। পাত্রী’র মা দুইজন।
মাজেদা বেগম পরিচিতার ভাব বুঝেও তৈয়বের বড় মা’কে বললেন, যাক আপনাদের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনেরটা জানা গেলো, কে তুহিনূরের মা!
ছেলের জন্য পাত্রী প্রার্থী পরিচিতা নারীর নাম সুফিয়া খান। তিনি তখনই ঝাড়া গলায় বলে উঠলেন, ছেলেমেয়ের বিয়ে-শাদি মাথায় উঠুক, আগে বলেন আপনি সতীন সহ্য করলেন কেমনে? আমি তো জীবনেও পারতাম না…!
: সহ্য না করে কী করতাম কন?
: বিয়ে করে আনার পর দৌড়াইয়া দিলেন না ক্যান?
: কার বাড়ি থেকে কাকে দৌড়াই। আমি চলে যেতে পারতাম। কিন্ত আমার তখন ছেলেমেয়ে দু’জন।
: মেয়ে দেখে বুঝেছি আপনার সতীন সুন্দর। ও মেয়ের মা অন্যখানে ভালো জামাই পায়নি, যে এই রূপ নিয়ে সতীনের ঘর করতে আসছে?
: সতীনের দোষ ছিলো না। সে এই বিয়েতে রাজি ছিলো না। তার মা-বাপকে অনেক ধরাধরি করে, তার নামে গ্রামের একবিঘা জমি লিখে দিয়ে তারপরে আমার স্বামী তারে আনছে।
: মানে আপনাদের একই গ্রামের?
: হ্যাঁ!
: তা হোক, তবু আপনি চুপ করে থাকলেন?
: চুপ করে থাকলাম মানে, চুপ হয়ে গেলাম। সতীনের ওপর আমার বিন্দুমাত্র রাগ-হিংসা জন্মালো না। বরং মনে হলো, সে-ই প্রমাণ করে দিলো, আমার সাথে প্রতিরাতে যা হতো, তাতে কোনো ভালবাসা ছিলো না। সে মনে মনে আরো ভালো শরীর, সুন্দর মুখের আশা পুষতো। আমি ব্যবহার হইছি পায়খানা-পেচ্ছাবখানার মতো! আর সতীন বাড়ি আসার দু’দিন পরেই আমার নির্বিকার অবস্থা দেখে সে কেঁদে বলেছিলো, আপা, আমাকে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকতে হবে, আমি আপনার শত্রু হয়ে ঘরে ঢুকেছি!’ সে যে এইটা বুঝতে পারছে, সে জন্য প্রতিজ্ঞা করলাম, ওর ওপর কোনো রাগ আমি রাখবো না!
: আপনি প্রতিজ্ঞা করলেন আর বিষদাঁত উপড়ানো সাপের মতো রাগ আপনার কথা শুনলো?
: যে ঘর ছেড়ে চলে যেতে পারিনি সে ঘরের পরিবেশ বিষাক্ত করলে আমারও তো ক্ষতি। মানে আমার আর লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন আসছে কেন!
আমার ছেলেমেয়েরই ক্ষতি। যে সংসারে অশান্তি থাকে সে সংসারের ছেলেমেয়েদের শৈশব পুড়ে খাক হয়ে যায়!
: আপনি নীলকণ্ঠ হয়ে ভার নিলেন সবার শান্তি রক্ষা করার?
: আমার মা বলেছিলেন, আমিও তো সতীনের সংসার করেছি। তাই আমি জানি সতীনের আগুন কি! মা আরো বললেন, মা যদি হতে চাও, মাটি হয়ে থাকো। দেখো, অবলা-নিরীহ মুরগির কোলে বারোটা চৌদ্দটা করে বাচ্চা থাকে। মুরগি তো বাচ্চার বাপ খুঁজতে যায় না! বাচ্চা ফুটে গেলে তার প্রধান পরিচয় সে ওই বাচ্চার মা! মুরগি স্বভাবে হিংস্র নয়, কিন্তু মা হয়ে যাওয়ার পরে সে শেয়ালের সাড়ে লড়ে। বেজির সাথে লড়ে। কাক-চিলের উপস্থিতি টের পেলে ঊর্ধ্বমুখে ছুটে তাদের তাড়িয়ে দেয়। বাচ্চারা বড় না হওয়া পর্যন্ত মা মুরগি তেমন কোনো খাবার খায় না। মাটি চেলে পোকামাকড় খুঁটে বাচ্চাদের মুখে তুলে দেয়। মানুষ অতটা পারে না, তাই কখনো মানুষকেও পশু-পাখির থেকে মমত্ববোধ ধার নিতে হয়। তাছাড়া লেখাপড়া যেটুকু শিখেছো, চাকরি করার জন্য তো তৈরি হওনি যে বেরিয়ে আসবে! তোমার বাপই দুটো বিয়ে করেছে, সে আর তোমার দরদ কী বুঝবেন!
: মায়েরা যার যার জায়গা থেকে কমবেশি যে যেটুকু করে, তা ওই পরের ছেলে স্বামী পুরুষটি যেমন কম বোঝে, তেমনি ছেলেমেয়েও যে বোঝে না, তা অবশ্য আমি বুঝতে শুরু করেছি! অবশ্য আমার কোনো প্রত্যাশাও নেই বোঝার!’ সুফিয়া খান বললেন।
: মায়ের কাজ হিসেব করে চলা নয়। মা তো নদীর জলের মতো!’ বললেন মাজেদা বেগম।
: এরশাদ একটা ভালো কাজ করেছিলেন। তার সময় আইন পাশ হয়েছে, দ্বিতীয় বিয়ে করতে বড় স্ত্রী’র স্বাক্ষর লাগে।’ বললেন, সুফিয়া খান!
: সে আইন আইয়ুব খান করেছিলেন। কিন্তু তা কেউ মানতো না। এরশাদ সেটা কড়াকড়ি করেছেন। তবে স্ত্রী’র অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে তিনমাস জেল হয়। বিয়ে তো আর অবৈধ হয় না আপা!’ বললেন মাজেদা বেগম।
তৈয়বের বড় মায়ের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সুফিয়া খান গাঢ়স্বরে বললেন, কিন্তু আপনি তো দেখা যায়, আপনার জামাইরে আবারও জায়গা দিছেন, না হলে আর তিনটা ছেলেমেয়ে কি করে হলো?
: ঠিকই। জানেন, আগেও রাতদিনের কোনো সময়ই ওসব মনে হতো না! কিন্তু উনি আরেকটা বিয়ে করার পর থেকে মাথার ভেতর ওই ভাবনা! সারাক্ষণ মনে হয়, আমার সাথে যা করতো, তা ওর সাথেও করছে!
রাতে ঘুম আসে না। বিয়ে করে আনার পর অনেকদিন তো আমার কাছে আসেই নাই! এদিকে বুকের আগুন শরীরের আগুন এক হয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই শরীর উত্তপ্ত হয়ে থাকে। তাই যখন এলো ফেরাবো কি, মনে হয় সর্বস্ব দিয়ে তখন আরো বেশি করে ধরে রাখি! রাত ভাগাভাগি নিয়ে দেখলাম আমি হিসেবি হয়ে উঠলাম। শরীরের ভেতর যে এত আগুন লুকানো ছিলো, সে আমিও আগে টের পাইনি! সতীন এসে বুঝিয়ে দিলো। তৈয়বের বড় মা বললেন।
: এখন কি সব সয়ে গেছে? সুফিয়া খান বললেন।
: এই সমাজে নারীরা সয় বলেই পুরুষের অসভ্যতা ঢেকে থাকে। আর নারীর যদি স্খলন একটু থাকে, সেটারই কতরকম কাহিনী তারা বাতাসে ভাসায়! তখন যদি আমি নিজের উগরানো বমি নিজে ফিরে খাওয়ার মতো তাকে গ্রহণ না করে চলে যেতাম, তার খেসারত কদ্দূর গড়াতো বলেন? আমার ছেলেমেয়ে দুটো আমার ওপর রাগ করেই বখে যেতো। তারা তো আমার আগুন চেখে দেখতো না। খালি বুঝতো, মা চলে গেছে! আর আমার মা-বাবাকে বিপদে ফেলা হতো। আবার কাউকে বিয়ে করলেও তো কারো দ্বিতীয় স্ত্রী হতে হতো! তৈয়বের মা বললেন।
: এজন্যই তো পনের বছর ধরে স্বামী মারা গেছে, মাঝে মাঝে জীবন অসহ্য হয়ে উঠলেও ওসব আর ভাবতে সাহস পাইনি। আমার দুই ছেলে। লেখাপড়ার সূত্রে দুটো দুই দেশে। বাংলাদেশে আমি একা।
: আপনি তো রূপবতী নারী। আপনাকে তো যে কোনো রাজকুমার এসে এখনো পঙ্খিরাজে তুলে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা…। মাজেদা বেগম বললেন।
: ওই উড়াল দেয়ার আগেই আমি পঙ্খিরাজ থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। তাই ওড়া হয়ে ওঠেনি! আর রূপটা আমি রাখি বলে আছে। এই রূপ নিয়ে যদি কারো ওপর ভাত-কাপড়-আশ্রয়ের নির্ভর করতে হতো, তা হলে এটা হতো পণ্য! স্বামী মারা গেলে যা ছিলো, তা খুব গুছিয়ে চলেছি। কিন্তু আমি কারো বৈভবের আশা করিনি! অনেকে টোপ দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। কিন্তু ঠেকিয়ে রাখার মতো কাঠিন্যটুকু আমি বহাল রেখেছি। সুফিয়া খান হেসে বললেন।
সুফিয়া খানের রূপের চেয়ে লাবণ্যের ধার বেশি। এজন্যই অনেকেই তাকে সোফিয়া লরেন বলে। কিন্তু শারীরীক সৌন্দর্যের লাবণ্যের চেয়ে ব্যবহারের মাধুর্যের জন্য মাজেদা বেগম সংক্ষেপে তাকে মাঝে মাঝে বলেন, লরেন আপা। যাতে সোফিয়া লরেনই বোঝায় এবং স্মার্ট শোনায়।
তৈয়বের বড় মা আর সুফিয়া খান যতক্ষণ কথা বলছিলেন, মাজেদা বেগম বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কারণ এই বাড়িতে তার ছেলের আরো বন্ধুর মায়েরাসহ একবার এসেছিলেন। সবাই ঢুকেই দেখেছিলেন, তৈয়বের দুই মা-ই যেন দুর্গার মতো দশ দশ বিশ হাতে কাজ করছেন। যেন কে বেশি করে কাকে আসান দিতে পারেন। ছেলেমেয়েগুলোর সাথে দু’জনেরই আচরণ এমন, যে বোঝার উপায় নেই এর কোনোটা একা একজনের। আর তাতে মাজেদা বেগমসহ অন্যান্য মায়েরাও সেদিন বিস্মিত না হয়ে পারেননি। তবে বেশি বড় যে দুটো, তাদেরকে তারা মনে মনে বড়জনের ভাগেই ফেলেছিলেন। সেদিন তৈয়বদের বাড়িতে সবাই একসাথে খেতে বসে আরো চমকালেন, যখন ছোট সতীন বললেন, ‘আপা, আমার কেন যেন এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।’ বড় সতীন ছোট’র সে এঁটো ভাত নিজের প্লেটে ঢেলে নিতে নিতে বললেন, ‘তোমার এগুলো আমি খাই। আমার মাছখানা রেখে দিলাম, তুমি পরে খেও।’
মাজেদা বেগমসহ তার ছেলের আরো ক’বন্ধুর মা তখন একসাথে মুখ চাওয়াচাইয়ি না করে পারেননি।
তারপর মাজেদা বেগমের সাথে তৈয়বের ছোটমায়ের একবার দেখা হয়েছিল। সামিউল ততদিনে লেখাপড়া শেষ করে জার্মানিতে সেটেলড। সে দেশে ফিরে এসে তার স্কুলের বন্ধুদেরকে তাদের সবার মা’সহ নিজেদের ধানমণ্ডির বাসায় ডেকেছিলো। তৈয়ব এসেছিলো তার ছোট মা’কে নিয়ে। আর তাতেই প্রমাণ হয় না তৈয়ব ছোটমায়ের ছেলে। সেই তখনই ছিলো তৈয়বের ছোট মায়ের সাথে মাজেদা বেগমের শেষ দেখা।
সেদিন তৈয়বের ছোট মা বলেছিলেন, ঢাকার বাড়িটা বিক্রি করে ব্যাংকের লোন শোধ করে বাকিটা ব্যাংকে রাখা আছে। ছেলেমেয়ে সব একে একে চাকরি-বাকরি পেয়ে বেরিয়ে গেছে। আর ব্যাংকের লোন শোধ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলো। বাড়িতে গাড়ি ঢোকে না বলে কোনোটা আর ও বাড়িতে থাকতেও চায় না। তৈয়বের বাবা বললো, ‘সারাজীবন লোনের ঘানি না টেনে বাড়ি বিক্রিই করে দিই!’ এখন তৈয়বের বাবা আর আমি দু’জন তৈয়বের বাসায় থাকি। কারণ ওর বউও চাকরি করে। ওর ছেলেকে আমার রাখতে হয়। মাজেদা বেগম বলেছিলেন, তৈয়বের বড় মা?
: উনি বগুড়াতে। আমাদের বাড়ি তো শহরে। তার একটা ছেলে লেখাপড়ায় ভালো করতে পারেনি। তাকে দেশে ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছে তার বাপ। তাই উনি ওখানে থাকেন!
তৈয়বের ছোট মা’য়ের সাথে গল্প করার সময় সুফিয়া খানের সাথে তৈয়বের বড় মায়ে’র সেদিনের সেই কথাগুলো মাজেদা বেগমের খুব মনে পড়ে গেলো। সেদিন তৈয়বদের বাসা থেকে বের হতেই সুফিয়া খান বলেছিলেন, মেয়েই তো গেট খুলে দিলো। না বলে আসাতে স্বাভাবিক সাজেই দেখতে পারলাম। তবু মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে। এটাও একটা প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু এইটুকু সময়ের ভেতরই একটা অদৃশ্য মিহিন আগুন আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, মাজেদা আপা। আমি আমার ছেলেকে এই আগুনের অংশীদার করতে চাই না!
‘কী আগুন দেখলেন আপনি একবার এসেই?’ বললেন মাজেদা বেগম।
‘কেন আপনি দেখেন না?’ সুফিয়া খান বললেন।
তারপর মাজেদা বেগমের উত্তরের অপেক্ষা না করেই সুফিয়া খান টানা আবার বলতে লাগলেন, ‘ছেলে দুটিকে শিশু অবস্থায় রেখে তার বাপ মারা গেছে। আমি তাদেরকে খুব আগলে বড় করেছি। আত্মীয়-স্বজনের ভেতরও কোনো ধরণের ঝঞ্ঝাট যেখানে দেখেছি, সেখান থেকে আজো সরিয়ে রাখি। কোনো অশান্তির আঁচ ওদের গায়ে কখনো লাগতে দিইনি।’
‘আপনি তো ছেলে বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে যাবেন। আপনি তো মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন না যে তাকে এদের ভেতর পড়ে থাকতে হবে!’ মাজেদা বেগম বললেন।
‘এইটা কি বললেন আপা! ছেলে হোক আর মেয়ে হোক এবং তারা যত দূরেই থাক, কোনো পরিবারে অশান্তি থাকলে তা নাড়ার আগুনের থেকে আরো দ্রুত বেয়ে চলে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ভেতর।’
‘তা বটে!’ মাজেদা বেগম বললেন। ‘মনে করেন, যে পরিবারে সম্বন্ধ করবেন, অনেকে মনে করেন, ফ্যামিলির ভেতরের অবস্থা যেমনই থাক, মেয়ে বিয়ে দিলে তো জামাইয়ের সাথে দূরে থাকবে। তার গায়ে আঁচ লাগবে না। আসলে কিন্তু তা নয় মাজেদা আপা!’ সুফিয়া খান বললেন।
‘সেটা আমিও বুঝতে শিখেছি?’ মাজেদা বেগম বললেন।
‘শোনেন আপনার মেয়েকে জামাই দূরে নিয়ে থাকে। কিন্তু পরিবারে অশান্তি থাকলে, আপনার মেয়ের জামাইও তো ওই পরিবারের অংশ, সে কি পরিবারের কলহ টের পেয়ে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়েও অংশগ্রহণ না করে থাকতে পারবে? আর মেয়ে অশান্তির পরিবারে মেয়ে বিয়ে দিলে তো, সেই শ্বশুরবাড়িই যদি তাকে থাকতে হয়, সেটা হয় চুলোয় নেমে আগুন পোহানোর মতো! … মেয়েদের তো স্বামী যেখানে থাকে, সে সেখানে তার থাকাটাই স্বাভাবিক।’
তৈয়বের ছোট মা’য়ের মৃত্যু-সংবাদে মাজেদা বেগমের বুকের ভেতর একটা নিঃশ্বাস দীর্ঘ হয়ে বুকেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এতদিন পর সেদিনের সুফিয়া খানের খুঁচিয়ে বের করে দেখানো আগুনের আঁচটা এবার যেন নিজের ভেতর টের পাচ্ছেন।
মাজেদা বেগম বুঝতে পারেন, এখন তৈয়বের বাবা তৈয়বের বড় মা’য়ের কাছে গিয়েই থাকবেন। কারণ পুরুষ মানুষের প্রথম বয়সে স্ত্রী’র প্রয়োজন যতটা, বৃদ্ধ বয়সে প্রয়োজন অনিবার্য। তাই তো স্ত্রী মারা গেলে সব বুড়োই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে ওঠে এবং চাকরানি থেকে শুরু করে যাকে পায়, তাকেই বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু জোয়ানকালে বউ মারা গেলে পুরুষরা সাধারণত দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে যায় না।
মাজেদা বেগম আরো ভাবছেন, যখন তাদের তিনজনের ঢাকা-বগুড়া এই দুই জায়গায় থাকাটা ভাগাভাগি হয়েছিলো, কে কোথায় থাকবে, তাতে কি তৈয়বের বড় মা’র মতামতের ধার আর দু’জন ধরেছিলো? তাহলে এই একটা সুযোগ বড় মায়ের। মাজেদা বেগমের ইচ্ছে করে, তৈয়বের বড় মা পালিয়ে যান বাড়ি ছেড়ে। সেটাই তার স্বামীর প্রতি সারাজীবনের মোক্ষম প্রতিশোধ হয়। কিন্তু নারী-পুরুষ, দুইজাতের কেউই বোধ হয় সে প্রতিশোধটা এই পড়ন্ত বেলায় এসে নিতে পারে না! কোথাও ক্ষমা নামক গুণটি শ্যাওলার মতো মানুষের কোথাও মনের ভেতরে না হলেও অসহায়ত্ববোধে এসে ঠেকে থাকে। শরীর-মন দুর্বল হলে তা-ই জোয়ারের মতো ফুলেফেঁপে ওঠে! আর তার নাম হয় ক্ষমা! জীবনটা তখন গোঁজামিলে বোঝাই ঠেকে বলেই হয়তো বোঝার ভারের নিচে সুকোমল সব বোধ চাপা পড়ে যায়! কিন্তু মাজেদা বেগম যেন তৈয়বের ঘুমন্ত বড় মা’কে ঘুমের ভেতরও ধাক্কাতে থাকেন। বলেন, পালান আপনি! জীবনে আর কি পাওয়ার আছে আপনার? যৌবনে ঘায়েল হওয়ার, অপমানিত ও নিগৃহীত হওয়ার মোক্ষম প্রতিশোধ এই এখন বিনা কসরতে আপনি নিতে পারেন। যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যান! পারলে সংসারের কিছু অর্থ তুলে নিয়ে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। তেমনটি না পারলে প্রয়োজনে পৃথিবী ছেড়ে পালিয়ে যান! সব বাঁচাই কি বাঁচা! কোনো কোনো মরণও বেঁচে থাকার চেয়ে অধিক!
****************************