You are currently viewing বিষ্ণু বিশ্বাস সংখ্যা ২০২২

বিষ্ণু বিশ্বাস সংখ্যা ২০২২

বিষ্ণু বিশ্বাস সংখ্যা

আমরা সমসাময়িক কালের হলেও বিষ্ণু বিশ্বাস সম্পর্কে আমি জেনেছি গতবছর। সামরিক শাসনবিরোধী তুমুল ছাত্র আন্দোলনের কারনে ঢাকায় আসা যাওয়া থাকলেও অবস্থান করেছি বরাবরই চট্টগ্রামে। তাই বিষ্ণু বিশ্বাসের সাথে পরিচয় হয়ে ওঠে নি। পরিচয় পেলাম কবি, নাট্যজন ও অনুবাদক বদরুজ্জামান আলমগীরের মাধ্যমে। সাহিত্য জগতের অশ্রুত, অনালোকিত, বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে নিয়োজিত সংগঠনের উন্নাসিকতা ও পক্ষপাতিত্বে উপেক্ষিত এবং শাঁসহীন মধ্যবিত্তদের লাগামহীন স্খলনে বিদ্বেষিত লেখক-কবিদের পাঠকের চোখের আলোর সামনে তুলে ধরাই ছিলো মনমানচিত্রমন ও মননের অন্তর্জাল প্রকাশের অন্যতম উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে বদরুজ্জামান আলমগীরের সাথে মতবিনিময় করে নাম ঠিক করে থাকি। গতবছর তেমন এক আলাপচারিতায় তিনি বিষ্ণু বিশ্বাসের কথা বলেন। বিস্তারিত জানার পর বিষ্ণু বিশ্বাস সংখ্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। তবে তাঁর একটি মাত্র বই- “ভোরের মন্দির” প্রকাশিত হয়েছে ২০০১ সালে যুক্ত প্রকাশনী থেকে এবং বইটি হাতের কাছেই নেই। আমি প্রকাশক নিশাত জাহান রানার সাথে যোগাযোগ করি। বইমেলার পরে তিনি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। ইতিমধ্যে আমি বিষ্ণু বিশ্বাস সংখ্যা প্রকাশের ঘোষণা করি এবং লেখা আহবান করি। বিষ্ণু বিশ্বাসের জানাশোনা মহলের অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেন, তবে একপ্রকার অপরিচিত বিষ্ণু বিশ্বাস নিয়ে লিখতে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেন। খুবই স্বাভাবিক। সেলিব্রেটিদের কদর আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।   এ সময় কবি ও সম্পাদক চঞ্চল নাঈম আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং যুক্ত প্রকাশনী থেকে বইটি সংগ্রহ করে ফোন ক্যামেরায় ছবি তুলে পুরো বইটি আমাকে পাঠান (তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ)। তবে বইটি স্বাচ্ছন্দ্যে পড়া যাচ্ছিলো না।  মেলা শেষে নিশাত জাহান রানা আমাকে ভোরের মন্দির-এর ওয়ার্ড ও পিডিএফ ভার্সন পাঠান এবং নিজে লেখার প্রতিশ্রুতি দেন। আলোর নীচে অনুপস্থিত বিষ্ণু বিশ্বাস সম্পর্কে আগ্রহীদের বিস্তারিত জানিয়ে লেখার-বইয়ের পিডিএফ ভার্সন পাঠিয়ে উদ্বুদ্ধু করার চেষ্টা করেছি।  অনেকেই লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সোৎসাহে তবে প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে অল্পই। উপলব্ধি করেছি যে, পাদপ্রদীপের নীচে না থাকা-থাকতে না পারা কিংবা ছিটকে পড়া অখ্যাত-অজ্ঞাত কবি-লেখকদের লোকসমাজে তুলে আনা কোনো সহজসাধ্য বিষয় নয়। একই বিষয় আমারা দেখেছি কায়েস আহমেদ সংখ্যা করার সময়ও। তবে  যারা লেখা দিয়ে, সাহস যুগিয়ে সাথে থেকেছেন তাদের জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা।

 একজন লেখক কিংবা কবিকে একটিমাত্র বই দিয়ে মূল্যায়ন করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। সিজোফ্রেনিকে আক্রান্ত বিষ্ণুর পরিচিত গন্ডির বাইরে চলে যাওয়া এবং কবিতা যাপনের যে স্বপ্নময়তা তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও ঢাকায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো তার থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলায় জীবনধারায় যে ছন্দপতন আসে তা তার সৃষ্টিশীলতাকে থামিয়ে দেয়। মোট ৬১টি কবিতা নিয়ে ভোরের মন্দির ।  ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্ত প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন শফিকুল ইসলাম।

জন্ম : ২৯ মে, ১৯৬২, বিষয়খালি, ঝিনাইদহ, বাংলােদশ। এসএসসি : ১৯৭৯, নলডাঙা ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয়, এইচএসিস : ১৯৮১, ঝিনাইদহ সরকাির কে সি কলেজ স্নাতক : ১৯৮৫, ইতিহাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

৬১টি কবিতা থেকে বাছাই করে কবির কাব্যশীলতা, কাব্যমেধা এবং অন্তস্থিত কাব্যভাবনার সাথে পাঠকদের পরিচয়ের জন্য ১০টি কবিতা বাছাই করেছি। এই দশটি কবিতা পাঠকমনে বিষ্ণু বিশ্বাসের সামগ্রিক কাব্যদর্শন সম্পর্কে ন্যূনতম হলেও একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া এই বিশেষ সংখ্যায় সংযুক্ত সকল লেখার মাধ্যমে একটা পরিপূর্ণ  চিত্রনির্মাণে সক্ষম হবেন।

 

লিখেছেন:

বদরুজ্জামান আলমগীর

ফয়জুল ইসলাম

আলী সিদ্দিকী

নিশাত জাহান রানা

নাহিদা আশরাফী

ইচক দুয়েন্দে

নান্নু মাহবুব

লাবণী মণ্ডল

জেবুন্নেছা জ্যোৎস্না

 

সকলের জন্য ঐকান্তিক শুভকামনা।

 

 


 

১০ কবিতা: বিষ্ণু বিশ্বাস

 

ভোরের মন্দির

 

তখনও অনেক বাকি ভোর

অন্ধকার এবং অমেয় জলের বাষ্পে

টুকরো পাতার তরবারি বেজে চলে

ঝনঝন।

অতর্কিতের গুনে গুনে প্রহর

ঘুমিয়ে গিয়েছে কর্ণ

তার উন্মীলিত চোখে হলদে জ্যোতির্লোক

হয়তো তখনই জেনেছিল নিদ্রাচ্যুতি মৃত্যু

ভোরের চিলের ডানায় উড়ে যাবে শব

শূন্যে, সমুদ্রে

নিরঙ্কুশ কাকের আধিপত্যে সৌন্দর্যের মড়ক

শহর, পালাবে আদিভূমে

যেখানে সূচনা-চেতনার।

আদি পিতা, তোমার আদ্যাধ্বনিকল্লোল

অবিনশ্বর শব্দের আজ চাঁদের হাট, দ্যাখো,

স্বর্গত্যাগী ফুল ঝরেছে বকুলের বনে

ধূসর মেহগনি ফাটিয়েছে সমস্ত ফল

আমরা মাটি খুঁড়ি, তুলি বালি, তুলি জল

মাটির গভীর থেকে সমলয় নৃত্যে আসে

বালির আড়ালে ধ্বনি,

মুক্তি, সাধনা, শক্তি।

উড্ডীন, বঙ্গোপসাগর

ঢেউয়ের সংঘর্ষে ঢেউয়ের স্ফূর্তি নোনতা বালির স্ফুরণ স্ফটিকী

গভীর সমুদ্রঘূর্ণি ঘুরে ঘুরে

উড়ন্ত চাকতির মতো নামে ধীরে ধীরে সংকটাবর্তে;

জলজ গম্ভীর শব্দে, ঝংকৃত

 

মিশ্রিত, শব্দের আকাশ এবং আলো

গাজনের ঢোলের রুদ্র নৃত্য

লৌকিক প্রতিবিম্বের যেন বজ্রকণ্ঠ:

উঠে পড়ো,

বেঁধে নাও দড়াদড়ি

স্বর্গ মর্ত্য

স্বর্গের মর্ত্যরে দেবী ও দেবতা

থাকো জাগ্রত

সময় বুঝে নেবে দুঃসময় দুর্মুক্তি

প্রথানির্দিষ্ট

আমাদের ছেলেরা সাগর সন্তান

মেয়েরা সমুদ্রে চলে নদীর মতন।

অসংখ্য চলেছে ধূলিপথে

যে পথ গিয়েছে জঙ্গলে আদি পাহাড়ে

মরণের যাবতীয় উপচার যেখানে, মারণের

আগ্নেয় স্রোতে বিচূর্ণ পাথরের ছাই

তুলে নাও, ছড়াও, সমগ্র ঊষর ভূমিতে।

সময়ের খোলা চোখ, অস্ত্রের সাধনা তোমার

প্রগতি, গতি, পথ এবং পাথেয়-সৌন্দর্যের

শিল্পের সামগ্রিকে নিমগ্ন শিল্পী হাঁটু ভাঙ্গা কাদাখোঁড়া পাখি, সামগ্রী, শব, শব, শব আমি  শবের অধিপতি।

‘এগারো জন মৃত সংঘর্ষে’।

‘ওদের কবর দাও’

‘ধর্ষিতা সাতটি মেয়ে

রক্তাপ্লুত, রক্তনিঃস্ব’

‘তারার আঁধারে আপাতত থাকো, রাখো অবগুণ্ঠন

লাল কমল নীল কমল ঝলমল

ধুয়ে দেবে শরীর ও মন’

‘তোমার বয়স পনেরোর নিচে, যাও, ঘুমাও

অথবা সাজো ধূলিযুদ্ধের জেনারেল

ওরা আসবেই-ডালিম কুমার।

চূর্ণিত রক্তের শার্ট পথে ও পাথরে

কাটা মুন্ড অথবা সময়ের হাড়ের গোলা

পাবেই নিশ্চিত রক্তজবার মালাকৃতি

অথবা, মালা।’

‘ওখানে তিনজন সৈন্যের লাশ আর

নপুংসক চাঁদের ওপারে তারা নিবুনিবু

ঘৃতধৌত হেলমেট ঝুলে আছে মস্তকে-মৃতের।’

‘আর দ্যাখো, অগ্নি

চিতায় পুড়ছে শঙ্খের চাবুক

চিতা পোড়ে দাউ দাউ।’

‘আর দুগ্ধপোষ্য শিশু বিধবা ঝলসানো পাঁচজন কৃষিকার

চোখের কোটরে আগুন এখনো একটু একটু জ্বলে

গেয়েছিল ওরা

অগ্নিশুদ্ধির গান সারা রাত সারা দুপুরবেলা।’

‘ছড়িয়ে দাও ওখানকার ও পথের ধূলি

মন্ত্রপূত ধূলি

ধূলির ভিতরের শাদা শাদা ফুল শাদা ডানা

শটীর বনের হাহাকার ও হাওয়া। হাওয়া।’

‘এখানে রক্ত। রক্ত রক্ত রক্তের দিঘি;

‘কেউ চেনো কি, চেনে কেউ যারা মৃত, কেউ চেনো, চেনে কেউ, চেনো কি, কেউ চেনে?’ ভাঙো পথ ব্রিজ

সমর্থ বৃক্ষ থাক কামানের আগে

নোনা রক্তে বাদামি পাল

কালো সমুদ্রের হাওয়া

দোলা দোলা

সূর্যের গুঁড়ি গুঁড়ি অগ্নির দানা

সবুজে আরো সবুজে

আর কালো হাড় জ্বলে অন্ধকারে

যেন সঙ্গীত, মেঘমুক্তির মোহমুক্তির

প্রত্যাশার নদী শুধু বয় যেন ডন।

জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ে তারা ওইখানে

নোনা ও মিষ্টি জলের মিথস্ক্রিয়ায়

সংকীর্ণ খাঁড়ি পথে জল নৃত্যের ফুল বহু দূর।

তারপর, খাড়া পাহাড়ের সারি, অরণ্যের শুরু

সেখানে মানুষ এসেছে বহুবার, বহু স্বপ্নের শেষে এবং প্রারম্ভিক স্বপ্নে। সীমন্তিত পথ, শাদা

ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাওয়া ক্রমলুপ্তির দিকে

যেন লুপ্তি শেষে নেচে যায় আলো নাচে জ্যোতিশ্রী আঁধারে তাই জিগীষা তাই জাগরণে সংশয়ে এবং সংকল্পে সংঘর্ষ

যুদ্ধ হয় আর শেষ হয় যুদ্ধ

বিজয়ী এবং বিজেতা

রক্তের স্রোত জলস্রোতের মতো, জন্মস্রোত যেন পলি

পলি পলি পলিঋদ্ধ ভূমি

শহরের প্রান্তে এসে থামে

যেন মুক্ত হবে শহর, নক্ষত্র বছর

অথবা এখন

নামবে মানুষের ঢল,

বিজয় এবং বিজয়ী-বিজয়ী।

সূর্য উঠে আসে রক্তাপ্লুত

কিন্তু সারিবদ্ধ তারা চোখবাঁধা

আর যখন খুলে গিয়েছে তাদের চোখ

প্রত্যেকের চোখে সূর্য ভিনরঙা।

তাদের মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে সামনে, নগ্না।

স্তন ও যোনির থেকে নিঃসৃত রক্ত, রক্তঝর্না

ছেলেরা অন্ধ হয়, অন্ধ হতে থাকে

মেয়েদের চোখে জল, জল নামে

জল স্রোতস্বতী।

তারপর সূর্যাস্ত এবং আবার সূর্যজ্যোতি

কিন্তু প্রচন্ড ঝঞ্ঝায় কাল রাতে

ওরা উড়ে উড়ে গেছে কবরে

নক্ষত্র যেন আকাশপথে আলোর মতো

প্রবিষ্ট আঁধারে

তারপর মাটি মাটি মাটির নিম্নঋতি।

ঊনশত মৃত্যু পেরিয়ে মৃত্যুর শাদা হাত তখন উদ্বেলিত আর জীবিতের মতো সহস্রের এক  সবুজ হাত মুষ্টিবদ্ধ,

তখনও উঁচিয়ে থাকে

বিরুদ্ধ, হামাগুড়ি দেয়া মাটির বিপরীতে

যেন যে মৃত্তিকার সুগন্ধি ঊর্ধ্বমুখী

তার ঘ্রাণ পাবে সে।

শব্দ শেষ হয়, নৈঃশব্দ এবং দুর্গন্ধ দুর্বিনীত হাওয়ায়

এবং আবার অন্ধকার-শব্দময়।

ভারি চাকায় পিষ্ট পাতার মড়মড় সঙ্গীত, উদ্গীত। উন্মাদচারী যন্ত্রের শিস ক্রমশ দূরে  দূরযায়ী

ওয়াগন ভর্তি লাশ, মানুষের, সমুদ্রসন্ধানী।

অক্সিজেনের  অম্ল  সুগন্ধ আমের শাখায়

গাদিকৃত আঁধারে তখনও নৈঃশব্দ্যচারী

ও ক্রমে নিস্তীর্ণ সে যখন হৃদয়ে তার

মাটি ফুঁড়ে ওঠে কিম্ভূত পুরুষকার

আমি মরি নাই, আমি জীবিত

আমি মরি নাই, আমি জীবিত

কোথাও কে তখনই বাজিয়েছিল, বেজেছিল ঘণ্টা

সূর্যপত্র ঝরে ঝরে স্বর্ণমূর্তির মতো

শস্যকান্তিদেবতা?

জলের মতো গানের মতো তরল হলুদ কুমারী

আনন্দ

নেচেছিল, কোনো ভোরের মন্দিরে নেচেছিল কি

ভোরবেলা?

তার বিচিত্র রেখার শরীর গর্তময়

ডান হাত পরিত্যক্ত করবে। ভারি হাওয়ায়

কুয়াশায় আরো হাওয়ার কুয়াশায়

দেখা যায়, অমৃতের অসম বিভাগ

স্বৈরবৃত্তের সুর অমৃত সংসারী

 

শাদা হাঁসের ডানা বাতাসে ওড়ে।

আর সমুদ্রতীরে সে, তার অন্ধদৃষ্টি

ঝুলন্ত ডান পা ছোঁড়ে সমুদ্রজলে।

অন্ধকার। বধির

নাবিকের মতো গল্প কখন ঢেউয়ের সাথে  ক্রমান্বয়ে দূরে গভীরে আরো দূরে ঢেউ নীলকান্তি নৌগীতির মতো ছড়ায় শব্দ-সুর, বালির আকরে যেন অসীমের আশাহীন সূর্যগীতি,

মৃত কুমারীর, নিষ্পলক পাখির।

রাতের সঙ্গীত

রুকু ও কমলকে

গহিন সমুদ্রের নোনা হাড় নোনা দাঁতে তৃষ্ণা আমার জল দেবে একটু আমাকে? শীতল জলের প্রাণ? শ্যাওলা শাড়ির বহু বহু নারী

তোমাদের ঝর্নাধারা

শত শত পতাকার মতো হলদে সঙ্গীত হবে যখন ভোর হবে, ভোরের আকাশের নীল চোখে গান বন্ধ হোক, আপাতত থেমে যাক।

কোলাহল কলস্বরে কাটে দুপুর বিকাল

গভীর রাতে আদ্যজলের তৃষ্ণা

আমার নোনা হাড়,নোনা দাঁতের।

থেমে থাক, লাল লাল বোতলে সৌগন্ধ  স্থির জলভারে

অপূর্ব অন্তর-উৎসারিত শান্তক্লান্তজল

তোমাদের

আর নোনা হাড়ের আঘাতে ঝরুক আদর? নোনা দাঁতে,নোনা হাড়ে।

সাগরের অজানা গুহায় মানব আমি দাঁড়াব এসে সম্মুখে তোমার,তোমাদের

ঝর্নাধারা

শাদা শাদা পতাকার মতো হলদে সঙ্গীত হবে যখন ভোর হবে ভোরের আকাশের নীল চোখে।

 

পুষ্পদম্পতি 

 

মাঝে মাঝে মনে হয় কখনও নিশ্চয়

খুন হব আমি

লাল রক্তধারার বলিষ্ঠ এক স্রোত

আলতার আল্পনায় রাঙাবে একখানা পাতা যার রঙ মূলত হলুদ,

যে মূলত ঝরা।

এইখানে

একটি গল্পের শুরু এবং সারা-ও হতে পারে-। কিন্তু চলুক না রক্তস্রোত

ঝরা পাতা থেকে বৃক্ষ অব্দি

আর আমি ভাবি

ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে এনেছি

ঝরা, একটি পুষ্পদম্পতি, অদ্ভুত।

লতানো উদ্ভিদফুল, নাম নেই জানা।

তাদের পাঁচ-পাঁচটি পাপড়ি আঙুলের, ডানার মতন একটি মেলেছে পাখা।

চেয়েছে লতায় উড়তে কিংবা উড়েছিল সাথে-সাথে কোথায়, কে জানে, কেউ জানে?

আজ রাতে আমি

মেরেছি তিনখানা পিঁপড়ে, চারটি ছারপোকা, আমি সাবধানে থাকি

আমার রক্তের স্বাদে বিরত থাকুক

পিঁপড়ে আর ছারপোকারা-আমি জানি, মনে হয়, মাঝে মাঝে

কখনও নিশ্চয় খুন হয়ে যাব আমি।

আর, এ-পুষ্পদম্পতি

তখনও কি থাকে শুয়ে

আমার বালিশটার পাশেই আমার বিছানায় অসংখ্য অসংখ্য পিপীলিকা

তবু ঘিরে আসে?

জীবিত না মৃত তবে?

তখনও থাকে কি মধু উদ্বৃত্ত সে-উল্লাসের, হে পুষ্পদম্পতি?

 

 

জল

 

বাতাস থেমে গেল ঝড় তুলে

শীতল রক্তে ঝরে বরফবৃষ্টি

ভাঙা ডাল, চূর্ণ চূর্ণ ফুল

মৃত্যু, নেচে নত প্লুটোর পায়ে।

দাঁড়াল বিশাল ওক সূর্যের বিপরীতে

চাঁদের স্তন, হলদে পাখির ডানা

সূর্যের আঁধারে জ্বলে, ঝরে পড়ে

শূন্য, এবং শূন্যের ছায়া।

মৃত্যুর বহু আগে সে ছিল

ধরা যাক আছে নীল ঘাসের দিন ও রাত

সূর্য নিভে গেলে সপ্তর্ষি পুকুরের জলে

রৌদ্রাভ জলের ফুল; স্বপ্ন উঠে যায় চাঁদের চোখে।

তারপর বছরের শেষ আর শুরুতে তুষার

নদীর হিমরেখা ফোটে তুষার-শরীরে

‘নদী আছে’ যেভাবে মরুভূমিও বলেছিল কোনোদিন ঢেউয়ের শঙ্খধ্বনি, নড়ে ওঠে জাহাজ, নাবিকের ঘুম।

তার রক্তের ভিতরের বাঁধ ভাঙে রক্ত

দেখা যায় মাইল মাইল রেলপথ

আগ্নেয়, আর শাদা ও লালের পরাক্রম

সৌন্দর্য; আর কিছু নয়।

আরও, আরো বছরের পার

কালো ধূসর শূন্য মাঠ

তেপান্তরের রেখা-মৃত্তিকা

প্রাচীন পৃথিবীর যোনি-সমুদ্র, রক্তক্ষরা।

আলোর দূরাগত ধ্বনি, ক্ষুদ্রাকার

ধ্বনির পিরামিডে আবদ্ধ আশ্রিত

কোথা থেকে, শব্দের পথ ডাকে, সে হাঁটে দেখা যায় জীবন, জীবনের আকৃতি- মস্তিষ্কে

অনাবৃত জ্যোতিষ্কের লাভার উচ্ছ্বাস পশমের বিস্তৃত বোরখার শরীর

খোঁড়ে বরফ যেখানে পাহাড়-পূর্বাদ্রি।

আর কালো পাথরের নারী

নগ্না, নদীর ছায়া যেন

খুঁড়ে চলে নদী

হাওয়ায় ওড়ে শীতল জল, ঝরে জল।

 

নীল কৈ

 

গল্পের শেষ ওরকমটি ছিল না মোটেই, তোমার মনে নেই। সেদিন ছিল রাত্তির-জ্যোৎস্নার। শোনো, আবার বলি, সেদিন ছিল জ্যোৎস্নার রাত্তির-জোনাকিরা কেন যে হঠাৎ আন্দোলনের মতো কেঁদেছিল উথালপাথাল যদিও আমারও আর মনে পড়ে না। তাদের কান্নার জলে চৈত্রের মাঠ গেল ডুবে। ভেসে এলকোথা থেকে শত শত নীল কৈ-

তাদের নীল ডানা আর লাল দৃষ্টি জ্বলে, জলের ভিতরে। তুমি আমি আর আরো বহু কথা কইনি কোনো সেদিন গেয়েছি গান-সমুদ্রের আকাশের আগুনের। অন্তত তুমি এবং আমি, না জেনে

কী সম্পর্ক সমুদ্রের আর আকাশের আর আগুনের। তারপর থেমে গেল জল-কান্নার-জোনাকির নীল ডানা ও লাল দৃষ্টির জল নেমে গেল-

জেগে উঠল ভূমি।

তারপর বহুদিন আমরা গান গাইনে কোনো শুধু গল্প করি নীল কৈ-নীল কৈয়ের।

 

 

 সুধীন্দ্রনাথ

মধ্যাহ্নচূড়ার থেকে নেমে আসে সূর্য, পাথর প্রচ্ছদের ভিতরে হর্ষধ্বনিস্রষ্টার মৃত্তিকার রস ঊর্ধ্বে উৎসারিত স্বাদে (তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে) দুর্মর ইচ্ছার ধনু করে রক্তপাত।

যুদ্ধযানে পুরোহিত অধোমুখ মেশিনগান ছায়ার বৃত্তে গড়ে সূর্য-সূর্যাস্ত

চৈতন্য নির্বেদের শীতল স্পর্শ জ্বালে আগুন, জ্বলে ক্যাকটাস।

 

পেঁচা, ১ম সংখ্যা জানু ১৯৮৭

 

রাত্রি

সে রাত্রি

পরিত্যক্ত পৃথিবীর রাত্রির চোখে

ক্ষুধার্ত চিতার মতো জ্বলে।

তোমার খুলির ভিতরে সৌরছায়া, আগুন সময়ের পৌনঃপুনিক অনন্তপ্রাচীন রাত্রি কোন্ধ্বংস ও সৃষ্টির কথা বলে?

কাঠের খোঁয়াড়ে ঘেরাও দিগন্ত

ব্যাপ্ত বালির মধ্যে পাথর বিছানো চিন্তার বিমূর্ত সন্তান শুয়ে থাকে-

যে অগ্নি থেকে আগুন

ক্রমশীতলতায় ক্রমশ আঁধারে মিশে নীল যন্ত্রণা, অতলান্তিক।

দিগন্তের ওপারে আলোক, মনে হয় দিগন্তের ওপারে জলপ্রপাত, ঊর্ধ্ব ঝর্না ঝাঁপিয়ে পড়ে নীলিমায়

একর একর ফুটে থাকে তিলের বেগুনি ফুল পাথর-নৃত্যে নাচে অরুন্ধতী, অরুণ মনে হয়, মৃত্তিকা মহৌষধি।

কথা ছিল, সমুদ্রের খুব কাছে থাকার সমুদ্র মন্থনে খোঁজা ঢেউয়ে ঢেউয়ে চূর্ণ আকাশ সপ্তর্ষি সূর্য।

কংক্রিট ছায়ায় পৃথিবীর মৃত হিংস্র প্রজাতি ঘৃণা ভয় মৃত্যুর অধস্তন আত্মা

ধুলো ও চূর্ণ সূর্য ছাড়া কিছুই দেবে না।  আমি জানি সে নেই, ঈশ্বর

আদিগন্তজল মৃত্তিকা পাথর

পাথর। স্থির ও লক্ষ্যাভিমুখী অথবা লক্ষ্য জল ও মৃত্তিকা লঙ্ঘিত, পৃথক দেবতা এবার ঘোষণা করো মৃত্যু হোক সাবিত্রী থাক, সাবিত্রী সাবিত্রী সাবিত্রী।

 

প্রেম

অন্ধকার চিহ্নিত করে আলোক

কুয়াশার ক্রমপ্রসারিত হাত

নীরব পত্রের নিচে ছায়া, গাঢ়

বৈরী নীলিমা

বিদ্যুজ্জিহবা দিগন্ত, কঠিনতর যাত্রা

তোমাকে বলেছি সব

অযোগ্যের পৃথিবীতে প্রকৃতি নির্দয়

অপ্রাকৃত ছায়ার দেবতা

ছিঁড়ে খুবলে খায় জাগতিক সুকৃতি ও সময় মন্বন্তরের এ বিপুল অন্ধকারে

আকাশ নিসর্গে ইটের কারুকাজ

আলো আরো আলোকের মোহে অন্ধ

তবু রাত্রি নয়

সেখানে বিমল অপরাহ্ণ

এই অসঙ্গতি

দ্বিতীয় জন্মের কথা বলে, অথবা মৃত্যুর

তবু যেহেতু প্রেম নেই

তোমার জন্ম ও মৃত্যু নেই, ক্ষুধা

তুমি শোনো না, কাঁদো না

লক্ষে ও অলক্ষে অন্ধ অন্ধ

তবু থাকে

অগ্নিমুখ মৃত্তিকার শুদ্ধ ছন্দের সঙ্গীত মনস্তাপ এবং মনস্তাপ

আকাশ সূর্য জল ও তার নৃত্য

পাহাড়ি পাথরে-অবিরাম

তোমার নির্দিষ্ট নিয়তি, এবং তার।

 

 

আলো ক্রমে নিভিতেছে

 

সেইখানে আমরা মিলতাম

প্রাচীন জনাশ্রয়ের প্রান্তউপবনে

(সৌগন্ধের গন্ধ-ফুল, মৃদুজল এবং উদ্ভিদের!) কেবল নাটা ঝাড় আর কাঁটার সমারোহ বহুবিধ

আর অগ্নিবর্শা ছিল প্রত্যেকের হাতে।

প্রতি রাত্রি যেহেতু নক্ষত্রের নিচে

চাঁদের নিচে

অগ্নিনিক্ষেপনির্দিষ্ট

ম্রিয়মাণ স্বপ্নের তেজস্বী ঘোড়া কোনোদিন নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, আরো দূরতম লোক পেরিয়ে যেত; আর সাগরের জলে স্নান করে ফিরত-নীল শরীরে।

ক্রোধ ও স্বপ্নের এই সম্মিলন কেন

সিংহ ও সিংহিনীর রতিস্থানে?

কেন মৃত্যু, আরো মৃত্যু?

মৃত্যু, প্রতিটি ঘরের ভিতরে এবং বাহিরে আমরা বাঁচতে না বাঁচাতে চেয়েছিলাম আমি জানি না

তবু মৃত্যুর আকর্ষণ প্রতীকী ও বাস্তব

অন্বেষী এবং অন্বিষ্ট।

বুলেট-প্রতি মৃত্যু, বহুমৃত্যু

বলো হরি, হরিবোল

চাপা কান্না লজ্জাবনত

মানবিক ও বিবেকহীন

বলো হরি, হরিবোল

পুরাণ-যুদ্ধের মতো অমাত্য

কর্ণ ও অভিমন্যু সংকট

 

বলো হরি, হরিবোল

মৃত্যু এখন খড়ের গাদায়

আর ভ্যানে

নিত্য পা দোলায়।

তোমরা আসবে আবার, কথা ছিল প্রাচীন লোকপথে সায়ন্তন আঁধার এইপথ, ওইপথ এবং সেই পথে

কেবল ঝরাপাতা ও বনবিড়ালি

হেঁটে যায়।

অমারাত্রির মতো কালো জুতো, তোমাদের গায়ে রক্তের অবর্ণনীয় মিহি আবির দশদিক থেকে দশবাহু

তোমরা আসবে আবার, কথা ছিল।

বেতাল আলোর ছায়ায় রতোৎসব ঊর্ধ্ব ইন্দ্রিয়জ লাভায় বাষ্পদাহ, বাষ্পক্ষয় আর সংকীর্তিত

ধর্ষণ এবং ধর্ষিতা

প্রজ্ঞার সময়

তোমাদের কালো জুতো, লাল জামা দ্বৈত পদক্ষেপ, দৈত্য এবং দেবতার  কালির মতো কেন লজ্জাহত স্থির, অন্ধকার হল?

ক্রোধ শেষ হলক্রোধের আগুনে? কালোরাত্রির অমেয় কান্তিছত্রভঙ্গ খন্ড আলোর আঁধারে অন্দরে?

তারারা ফুলের মতো ঝরে উত্তাল সাগরে আর পাথর ভেসে আসে তীরে

কালো, ধূসর, লাল

তবু, শবাচ্ছাদনের পাথর-ঘর

কেন দেখবে না সূর্য আলোয় সূর্যময়?

লোকে এবং পরলোকে চোখে অগ্নির ভান্ড

পুনর্জন্ম ধারাবাহিক-বলেছিলে

উদ্বৃত্ত লয়ে, তোমরা একদিন।

হায়! ঢেউ এসে থেমেছে এইখানে

উত্তেজিত; সমুদ্রতীরে তার ঊর্ধ্বাঙ্ক রেখা

নাবিকের নীল দাড়ির মতো আঁকাবাঁকা

অথবা, ভগ্নরেখার নারী, স্তনহীন

হিমাদ্রিরগর্ভিল গর্ত খুঁড়ে দ্যাখে

জীবাশ্ম, তোমারই মতো দাঁড়িয়ে গেছে অবিকৃত, বিদ্যুৎস্খলনে পোড়া বনস্পতি  আর, কালো হাড়ের দেবী ও দেবতা

হস্তমৈথুন ও ক্রমমৈথুনে পুষ্টিহীন

এবং ক্রমে নিস্তীর্ণ

বাহির ও বহির্গামী হাওয়া, হাওয়ায়।

সুতরাং দুরন্তঅন্ধকারে ও দৈব আগুনে

গো-ক্লান্তসময়

সুতরাং ঘুমাই, ঘুমাও মহানিদ্রায় ব্রতী

স্বপ্নচ্যুত, স্বপ্নবিহীন তবু তো নই

নীল ঢেউ ভাঙা শাদা ধুলো

ক্রমায়ত শাদা স্বপ্নে

ত্রি-সমুদ্রের এপার ওপার রক্ত জলে মেশে

ঘুণ পোকা, ফুটো করে তর্জনীর শাদা হাড়

মনে হয় মুক্তোর মাদুলি ভরেছে অন্ধকার

মন্ত্র জপিছে মারণের, মরিবার!

কারা বলেছে তখন, দ্যাখো

চাঁদের আলোয় পুড়েগেছে মেঘ

পথ অদূরে, পথের ওপারে।

 

আমি মরে যাবে, মৃত

(মৃত্যুর বহু আগে) চোখের

প্রতিটি স্কুলিঙ্গ গলে গিয়ে

আমি ভূত, উৎকেন্দ্রিক ভবিষ্যৎ বরফের শীতল শব্দ, শব্দ ঝরার কেহ কি বলিতেছে কাহাদেরও? তোমরা আমাদের আলো দেবে? আলো

আলো

জ্বালাও পোড়াও তোমরা ধ্বংস করো। অতঃপর তুমিও ভূত, কিম্ভূত পৃথিবী মৃত তারার ইচ্ছা জেগে থাক শুধু  আরো নক্ষত্রে ও রক্তে

উদ্দেশ্যের অসীম সে পথে হোক রথী অন্ধকার।

 

 

সেই অন্ধকার মৃত স্তম্ভ

 

সেই অন্ধকার মৃত স্তম্ভ গলে যাবে।  পথে ও পাথরে

ধুলো এবং ঘাসে

বিচূর্ণ সূর্য ঝরে আছে।

পাহাড়ের নিচে অগ্নিক্ষরণ

বীর্যীকরণ

ঝনঝন ঝর্না

বাদল চেয়ে মাদলে ঘা।

রক্তঝর্নার নিচে তোমার দুপুর

প্রাত্যহিক

রক্তঝর্নার নিচে তোমার জপতপ

আহ্নিক।

কাল ভেঙেছে স্নানঘরের

বন্ধ দরোজাটা

প্রাচীন গুহার পাশে দাঁড়িয়েছে এসে ভবিষ্য, ছুঁড়ে দেবে বিপুল অন্ধকারে?

গুহার ভিতরে অন্ধকার

তোমার হাতে অন্ধকার

সংঘর্ষে ফুটে ওঠে ক্রিসেন্থিমাম

এবং বিস্তারচিত্র।

তীর, তীরন্দাজ, লাশ

ঘর গেরস্ত

মৈথুন। আগুন, শীর্ষাকাশ

আর অন্ধকারের নিচে পুড়ে যাচ্ছে অন্ধকার।

 

 

বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়

 

যেভাবে শুরু হবে ভাবা গিয়েছিল, সেভাবে হয় নি কিছুই।

ধীরে ভিড় হল, অস্বচ্ছন্দ কথার রেশ, ধীরে চিন্তার এলোমেলো হাওয়া, পালের চতুর্দিকে  লেগে একটি সাম্পান, গোলাকার একটি চরের গোলের ভিতরে পলো হয়ে আছে। পশু এবং মৎস্যশিকার আমাদের শুধু অভিপ্রায়-অভিজ্ঞান কিছু নেই। এইভাবে কেউ বলেছিল,  ওর নাম নেই, ছিল, মনে নেই। আপাতত ওর একটা নাম হোক, যে ভাবে সমুদ্র অথবা  নীলগিরি হয়েছিল-সে, বালক বীর। তার সাথে কথা হল আজ। ও গতকালের কথা  বলছিল। ঘুড়ি উড়াত, তাই, আকাশের সীমা অতিক্রম করতে চেয়েছিল প্রথম।

সে ভাবত ওই কালো গ্রামটির ওপারের ওপারে ফাঁকা মাঠে কোনোদিনকার জামগাছটির  নিচে উবু হয়ে পড়ে আছে আকাশ-ওকে ছোঁয়া যাবে সন্ধ্যার কিছু আগে, যেখানে  অন্ধকার কোনোমাত্র সমস্যা না।

ওর গল্পগুলি সি ত মজার। তাকে উৎক্ষিপ্ত করতে চেয়েছিল বহুদূর নক্ষত্রের শক্তির  আঁধারে-যেখান থেকে আলো এসে শাদা শাদা পৃষ্ঠাগুলি ভরে উঠবে কালো ধলা  অক্ষরগুলির স্বভাব সম্ভব গল্পগ্রন্থ।

ওর বয়েস কত হবে, ও কি পারবে?

তবু, ও তো বালক বীর-বলা হয়েছে, আজ অথবা গতকাল ওর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে।  সে একটি গ্রামের কথা বলল-বৈকালের একটি ধূলিপথ সোজা চলে গেছে আর এক  গ্রামের দিকে। মাঝখানে ছোটমতো এক ব্রিজ। পথটি জলস্রোতের সুবিধা-অসুবিধার জন্যে  ভেড়িবাঁধের মতো উদ্ধত উঁচু। তার ঢালুর দুপাশে সবুজ ঘাসে খুব কালো খুব শাদা, খুব  খয়েরি রঙের গরু চরে বেড়াচ্ছে স্বাভাবিক। এবং সে একটিই রাখাল দেখেছিল ছাতির  আড়ালে। স্বপ্নের প্রকৃতিতে তার মনে হল-সেই কবেকার সে রাখাল। গতিশীল ঘোড়াটি  রয়েছে ব্রিজের উপর টগবগে শাদা। তার ছাতিটি ছুঁড়ে ফেলল বৃষ্টির ভেতর। দন্ডায়মান  ঘোড়াটির সে-ই আরোহী। প্রথমে সে গোলাকার গোলের দশদিক ধূলি ওড়াল। তারপর  সোজা পুব থেকে পশ্চিম আকাশে। তবু ও তো বালক বীর-বলা হয়েছে-আজ অথবা  গতকাল ওর সাথে কথা হয়েছে। ধান্য ঢেউয়ের খোঁজে ফেরত আসছে, ও বলে গেল।

আমরা ততদিন পায়ে হেঁটে বহুদূর মোগল গোলাপবনে এক স্বপ্নময় সৌগন্ধ্যে ঘুমাব।

২৫/১১/৯২