You are currently viewing আড্ডার খোঁজে- আবসার হাবীব

আড্ডার খোঁজে- আবসার হাবীব

প্রায় পঁত্রিশ বছরেরও আগের কোতোয়ালির মোড়ের সাধু মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে চিম্বুক রেস্তোরাঁর চিবুকের নিচে বসে যে আড্ডা, সে আড্ডার সৃজনশীল জৌলুস এখনো মনের ভেতরের তারুণ্যকে উসকে দেয়। উজ্জ্বলতা ছড়ায়। খুশীতে মন দোল খায়। কিন্তু সেইদিন, সেই সময়, সব কিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার তুখোড় দিনগুলো আর ফিরে আসবে না এ জীবনে। স্মৃতিতে কেবলি কষ্টের ভাইলিন। বেজে বেজে ক্লান্ত হয়। এ সব ঘুমিয়ে পড়া স্মৃতির এ্যালবাম ছাড়া এখন আর কিছু নয়। অথচ, ইতিহাস পরম্পরায় আড্ডাই কালের সাক্ষী। রাজনীতিরও। কারণ আমাদের তারুণ্যের সেইসব আড্ডা কখনো কোনো স্বৈরসরকার ও সামরিক জান্তা কখনো পছন্দ করেনি।

কবিতার গ্রীবার ছায়ায় বসে আড্ডা। গল্পের কাঠামোতে ঘোরা ফেরা করা। গদ্যে-পদ্যে লুটিপুটি খাওয়া। সদ্য প্রসূতজাত কবিতার ঘ্রাণ, অর্ধ কবিতা, খন্ড কবিতা, অসমাপ্ত গল্প, প্রবন্ধ লেখার কষ্টকর চেষ্টা। চলচ্চিত্রের চুল চেরা বিশ্লেষণ, ফুটবলের গোল মিশের আপসোশ। এসব বিষয়ও আড্ডায় সবসময় রঙ ছড়িয়েছে। সৃষ্টিশীলতায় ভিন্ন রকমের তাগাদা দিয়েছে।

                                                                               কবি সুনীল নাথের  ডিসপেনসারির আড্ডায় কবি স্বপন দত্ত, আবসার হাবীব, কবি ফাউজুল কবির ও কবি রবীন ঘোষ।

আমার আড্ডার শুরু পাড়ার চায়ের দোকানে। পাড়ার বর্ণালী নামের সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী থেকে। এই ধরনের আড্ডা থেকে বকে যাওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা থাকলেও, তখন একটা ব্যাপার ছিল, গুণী জনকে সম্মান করা। গুণীজনরাও পাড়ার ছেলেদের আড্ডায় দেখলে কখনো কখনো নিজেরাই ঐ সব চায়ের দোকানে ঢুকেনি। প্রয়োজন মনে করলে ডাক দিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য শাসন করেছে। এখনকার পাড়ার আড্ডাই ভিন্ন চিত্র। ‘সন্ত্রাস’ একটি শব্দ এই আড্ডায় যুক্ত হয়েছে। তারপর ভালো কিছু করার প্রবণতা এখনো কোথাও কোথাও তরুণদের আগ্রহ অনেক বেশি।

আড্ডা, একটি শব্দ। ব্যঞ্জনা তার অনেক। আড্ডা শব্দের মধ্যেই আড্ডার চিত্রকল্প খেলা করে। আড্ডায় বৈঠকী বা মজলিসী ভাব থাকে। ছন্নছাড়া জীবন অনেক সময় আড্ডায় নিজস্ব ভূমি খুঁজে পায়। কেউ কেউ পথ হারায়।

চট্টগ্রাম কলেজে ১৯৭২-১৯৭৩-এ ভর্তি হওয়া এবং এর পরপরই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে আমার লেখালেখির শুরু। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঐ সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও সদ্য স্বাধীন দেশে হাওয়া লাগলো তারুণ্যে। সাহিত্যে। শিল্পে। নাটকে। খেলাধুলায়। বিশেষ করে নাটকে ও কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ এক আন্দোলনের বহিপ্রকাশ ঘটে। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, নাট্য গোষ্ঠীর আবির্ভাব, দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ, তার পরবর্তী চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা। সবকিছু মিলে চট্টগ্রামের এই সাহিত্যচর্চা ও শিল্পকলার চর্চা রাজধানী ঢাকাকে টপকে পুরস্কার পাওয়া, সুন্দর সুন্দর প্রকাশনা বিভিন্ন ভাবে নাড়া দিতে পেরেছিল।

এই সবই এক সময় থেমে যায়। কিংবা ধীরলয়ে চলতে থাকে। আড্ডার অভাবে সাফল্যের মাত্রায় পিছিয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম অনেকটুকু। শুধু এ ক্ষেত্রে নয়, এমন কি খেলাধুলার ক্ষেত্রেও। কখনও গড়ে ওঠে গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্য আন্দোলন, লিটল ম্যাগকেন্দ্রিক তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের লেখালেখি ও উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে আবার হারিয়ে যায়। এই দলে আমরা সকলই পড়ি, যারা এখনো টেনে-হেঁচড়ে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে বই প্রকাশ করে জানান দিচ্ছি, ভাই হারিয়ে যাইনি, নিভৃতে চালিয়ে যাচ্ছি। অনেক প্রতিভাবান সাহিত্যিক, খ্যাতিমান কবি, শিল্পী, গায়ক, খেলোয়াড় যেই চোখের আড়াল হয়েছে আমরা আর মনে রাখি না।

নানা আড্ডায় যুক্ত হয়ে নতুন মাত্রা। তারুণ্য চায় সব ভেঙে-ছূঁড়ে নতুন এক নিজস্ব গন্ডী তৈরি করতে। এই সময়ে আমাদের বেড়ে ওঠা। নিয়মিত আড্ডায় যাওয়া-আসার, ফেরা না-ফেরার টান এখনো আবেগের ডালাপালা ছাড়িয়ে বার বার আমার মনের দরোজায় কড়া নাড়ছে। টোকা দিচ্ছে। কিন্তু স্মৃতির নোঙর ফেলেও অনেকের নাম মনে করতে পারছি না।

এটা সত্য যে, আড্ডার ভেতরেই তাৎক্ষণিক সম্পর্কের উজ্জ্বলতা স্পর্শ করা যায়। আবিষ্কার করা যায় মেধা ও মননের। সাহিত্য আন্দোলন বলি, আর গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্য আন্দোলন হয় আড্ডার সম্মিলনে। তর্ক থেকে মিলন এবং সৃষ্টির উন্মাদনা অন্যরকম ব্যঞ্জনা দিতে পারে। জীবন যন্ত্রণায় সুখের পরশ পাথর খুঁজে ফেরার মধ্যেই সাহিত্য আড্ডার মূল মন্ত্রণা। আবার তা চাওয়া-পাওয়ার মিলন ঘটাতে না পারার যন্ত্রণাও।

এরিস্টেটল আড্ডাকে বলেছেন, মস্তিকের ব্যায়াম। সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর কবিতার সেই পংক্তির কথা ভাবুন তো একবার, ‘সে দিন দিতে গিয়ে আড্ডা হারিয়ে ফেললাম রেশনের কার্ডটা’। আড্ডার কাছে নুয়ে পড়া, ছুঁইয়ে যাওয়া দিনগুলো এখনো তাড়া করে আমাকে। আড্ডায় আড্ডায় ছুঁয়ে যাওয়া দিনগুলো মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তাড়া করবে। দীর্ঘ সময়ের অগ্রজ ও অনুজ বন্ধুদের কথা মনে পড়বে। মনে পড়বে ‘জল পড়ে। পাতা নড়ে।’ অর্থাৎ পৃথিবীর কোথাও না কোথাও এখন আড্ডা চলছে, চলছে আড্ডা।

জলযোগ-এর আড্ডায় কবি স্বপন দত্ত, কবি ফাউজুল কবির, কবি রবীন ঘোষ, নাট্যজন মুনীর হেলাল, সন্তোষ বাবু এবং জলযোগের মালিক সুধীর বাবু।

পাড়ার আড্ডা থেকে চট্টগ্রাম কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরতে ঘুরতে কোতোয়ালীর মোড়ের ‘সাধু মিটান্ন ভান্ডারের, সাধুর লম্বা টুলের উপর শুয়ে থাকার সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসছে। সাধুর দোকানের সাহিত্য আড্ডা থেকে চট্টগ্রাম শহরের আড্ডায় মৌলিক পরিবর্তন আসে। এখানে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত শিল্পী- খেলোয়াড়-নাট্যকর্মী সকলই মন খুলে আড্ডা মারতেন। এই আড্ডায় কোনো মধ্যমনি ছিল না। সবাই ছুটে আসতো। যে যার মত করে, আবার সে ভাবেই ফিরে যেতো। সাধুর দোকানে সারাদিনই আড্ডা চলতো দুই-একজন করে। সন্ধ্যার পরে জমজমাট আড্ডা। ২৯ আর সি চার্চ রোড থেকে কবি শিশির দত্ত, নালাপাড়ার দৈনিক আন্দোলন পত্রিকা থেকে আসতেন সম্পাদক-গল্পকার হেনা ইসলাম. চলচ্চিত্র সংসদকর্মী হাসান শহীদ, ফিরিঙ্গী মেয়ের প্রেমে পাগল কবি ত্রিদিব দস্তিদার। আগ্রাবাদ কলোনী থেকে আসতেন দৈনিক আন্দোলন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক কবি স্বপন দত্ত। দেওয়ানহাট থেকে কবি ও প্রচ্ছদ শিল্পী খালিদ আহসান। নাট্যকর্মী মিলন চৌধুরী, শান্তনু বিশ্বাস, মুনীর হেলাল। কবি আহমেদ খালেদ কায়সার, ওয়ালি আহসান ধনু, শিল্পী হাসি চক্রবর্তী, গল্পকার সৈয়দ আহমেদ তারেক, সৈয়দ ইকবাল, মুহম্মদ ইদ্রিস। এই আড্ডায় এসেছেন বেশ কয়েকবার কবি শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, নিমর্লেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা।

১৯৭৫ সালে বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঘাতকের হাতে মৃত্যুর পর সামরিক সরকার তারুণ্যকে নানাভাবে ঘরে বন্দী করে। চেষ্টা থাকে সন্ধ্যার পর তরুণ পেলেই গ্রেফতার করা। এই সময় একদিন সাধুর দোকান থেকে আড্ডা দিয়ে ফেরার পথে চায়ের দোকানে তৃষ্ণা মিটাতে গিয়ে সৈয়দ ইকবালের বাড়ির কাছে কদমতলীতে পুলিশের হাতে রাজনৈতিক কর্মী সন্দেহে গ্রেফতার হন কবি স্বপন দত্ত, সৈয়দ ইকবাল, মুনীর হেলাল, খালিদ আহসান। রাতের মধ্যে অভিভাবকদের চেষ্টায় অন্যারা মুক্তি পেলেও কবি-সাংবাদিক স্বপন দত্তকে মামলা দিয়ে কোর্টের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়। সাংবাদিক প্রদীপ খাস্তগীর, শিল্পী নাট্যকর্মী স্বপন আচার্যের চেষ্টায় ১৭ দিন পর জামিনে মুক্ত হন। আদালতে এই মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হলে তা খারিজ হয়ে যায়। এই ঘটনার পর মূলত সাধুর দোকানকেন্দ্রিক আড্ডার আর জৌলুস ফিরে আসেনি।

দৈনিক আন্দোলন কেন্দ্রিক আড্ডায় পরবর্তী সময়ে এস্টাব্লিস্টমেন্ট বিরোধী সাহিত্য আন্দেলন ‘স্পার্ক জেনারেশন’-এর সূচনা হয়। শুরুতে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন স্বপন দত্ত, হেনা ইসলাম, কাজী রফিক, শিশির দত্ত. শেখ খুরশীদ আনোয়ার ও সৈয়দ ইকবাল। স্পার্ক জেনারেশনের প্রথম সংখ্যায় এই ছয়জনই যুক্ত ছিলেন। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে অনেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কবি স্বপন দত্ত পরবর্তী সব সংখ্যা সম্পাদনা করেন এবং লেখালেখি করার জন্য তাগাদা দিতেন। সকলই একই সংখ্যায় গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ লিখতাম। মুনির হেলাল, কমল সেনগুপ্ত, খালিদ আহসান, শ্যামলী মজুমদার এইরকম আরো অনেকেই। আমি নিজেও যুক্ত হই। এবং নসু মালুম বাড়ি, পূর্ব মাদারবাড়ি, চট্টগ্রাম এই ঠিকানা ব্যবহার শুরু হয় স্পার্ক জেনারেশন পত্রিকায়। এই ঠিকানার কারণে আমার বাসাও আড্ডার একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। এখানে কবি আসাদ চৌধূরী, আবৃত্তিকার কাজি আরিফ ও জয়ন্ত চট্টোপ্যাধ্যায়, কবি-অধ্যাপক স্বপন আদনান। একবার বিবিসির চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় এই বাসায় এসে স্পার্কের কয়েকজন সদস্যের সাক্ষাৎকার, কবিতা রেকডিং করে বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠানের প্রচার করে ছিলেন। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। স্পার্ক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে মিষ্টি গদ্যে গল্প লেখা শুরু করেন কমল সেনগুপ্ত, প্রায় আমার বাসায় আসতেন কাউকে না কাউকে সাথী করে, যেমন জাহিদ হায়দারসহ ঢাকার আরো অনেক নিয়ে। আড্ডা চলতো সারারাত। তারপর যথারীতি সকাল সাতটার শাটল ট্রেন ধরতে ছুটতাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কবি খালিদ আহসান, আবসার হাবীব, নীরা গুণ, কবি শিশির দত্ত ও কবি নর্মিলন্দেু গুণ।

স্পার্ক আন্দোলনের সাথে যুক্ত কবি শিশির দত্তের বাসায়ও কখনো কখনো জম্পেশ আড্ডা হতো। মাসিমা খুব যত্ন করে মাঝে মধ্যে নিরামিষ খাওয়াতেন। এই বাসায়ও রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, নিমর্লেন্দু গুণসহ অনেকেই আড্ডা দিয়েছেন। রাত্রিযাপন করেছেন। এইসব আড্ডা এবং চেম্বার প্রেস কেন্দ্রিক আড্ডা থেকে এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী সাহিত্য আন্দোলন ‘স্পার্ক জেনারেশন’-এর চিন্তা-চেতনায় স্নাত সম্পাদক প্রকাশনীর সূচনা হয়, এই প্রেসের স্বতাধিকারী মোহাম্ম ইউনুস এবং সুহৃদ শহীদুল হক-এর অকৃত্রিম সহযোগিতায়। ‘সম্পাদক’ নামে বুলেটিনও প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে সম্পাদক প্রকাশনী থেকে কবি আসাদ চৌধূরী, নিমলেন্দু গুণ, আবুল মোমেন ও স্বপন দত্তের কবিতার বই প্রকাশ করা হয়। কবি স্বপন দত্তের বইটির প্রচ্ছদের জন্য খালিদ আহসান জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র থেকে পুরস্কার পান ১৯৮০ সনে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে স্পার্ক জেনারেশনের একুশ দিন ব্যাপী দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ, কবিতা পোষ্টার, এক পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করা এই আড্ডারই ফসল। তবে সম্পাদক প্রকাশনী ও স্পার্ক জেনারেশনের উল্লেখযোগ্য কাজ শিশির দত্ত সম্পাদিত ‘স্বনির্বাচিত’ কবিতা সংকলন প্রকাশ। এতে ছিল বাংলাদেশের প্রবীণ-নবীন আটচল্লিশজন কবির কবিতা ও কবিতা বিষয়ক সাক্ষাৎকার, প্রখ্যাত শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রত্যেক কবির মুখের স্কেচ।

চেম্বার প্রেস থেকে স্পার্ক জেনারেশন প্রকাশ ও সম্পাদক প্রকাশনীর প্রকাশনা নিয়ে আমাদের আড্ডা ও চা খাওয়ার জন্য কখনো ছুটতাম ক্যাফে ডিলাইট, কখনো চিম্বুক রেস্তোরাঁয়। পরবর্তী সময়ে এই আড্ডা চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকর্মীদের এক জমজমাট আড্ডা কেন্দ্রে পরিণত হয়।
চট্টগ্রামে নন্দনকাননে বোস ব্রাদার্স কেন্দ্রিক আড্ডা বহু পুরোনো। পাকিস্তানী আমলে একসময় সুচরিত চৌধুরী সমসাময়িক বন্ধু-বান্ধব মিলে আড্ডা দিতেন। সুচরিত চৌধুরী বাড়িকেন্দ্রিক একটি আড্ডাও ছিল। তিনি নিজেও অনেক সময় বান্ধবকে ডেকে বাঁশি বাজিয়ে শুনিয়েছেন। সুচরিত চৌধুরীর পরিচালনায় এই বাড়ি থেকে আশুতোষ চৌধুরীর ‘আমিনা সোন্দরী’ নাটকের মহড়া চলতো এবং পরে এই নাটক বিভিন্ন সময়ে মঞ্চস্থ হয়।

‘অচিরা’ পত্রিকা ঘিরেও একটি আড্ডা ছিল। এই পত্রিকাটির অনেকগুলো সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কবি আবুল মোমেন, মোহাম্মদ রফিক, জিনাত আরা রফিক, আলতাফ হোসেন, অমিত চন্দসহ আরো কয়েজন ছিলেন এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক। পরবর্তী সময়ে আমাদের সময়ের তরুণ লেখকদের কবিতা এই পত্রিকায় নিয়মিত স্থান পেয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কবি ময়ুখ চৌধুরী ‘অসভ্য শব্দ’ কবিতা সংকলন সম্পাদন করে আলোড়ন তুলেছিলেন। ময়ুখ চৌধুরীর নালাপাড়া বাসায়ও একটি আড্ডা বসতো, সাগর বাবুর চায়ের দোকানে গিয়ে চা খাওয়া হতো। আড্ডা চলতো। এই আড্ডায় যাতায়াত ছিল ইফতেখার সাদিক, আহমেদ খালেদ কায়সার, মুসফিক হোসাইন, কাসাকু সাকো, সৈয়দ ইকবাল, খুরশীদ আনোয়ার, স্বপন দত্ত, মাঝে মধ্যে আমিও যেতাম।

কবি মিনার মনসুর, আসিফ দিলওয়ার ও আরো কয়েকজন মিলে নবাব সিরাজদৌল্লা সড়কে আড্ডা দিতেন একটি চায়ের দোকানে কয়েকজন কবি বন্ধু নিয়ে। এখান থেকে বেরিয়েছে মিনার মনসুর সম্পাদিত এপিটাফ, ইব্রাহিম আজাদ সম্পাদিত বৃক্ষ।

চকবাজারের সবুজ হোটেলের আড্ডার কথা সকলেরই জানা আছে। এই আড্ডাটিও ছিল বেশ জমজমাট। এই কবি বন্ধুরা নতুন কিছু করার চিন্তা থেকে বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ এবং নিজস্ব একটি ধারা বা সাহিত্য চিন্তা থেকে কবি এজাজ ইউসুফী ‘উত্তরাধুনিক সাহিত্য আন্দোলন’ সূচনা করেন। কবি এজাজ ইউসুফীর সম্পাদনায় প্রকাশ পেয়েছে ‘লিরিক’ নামের বিশাল পত্রিকা, যেখানে এই আন্দোলনের পক্ষে নিজেদের লেখালেখিগুলো উপস্থাপন করেছেন। কবি এজাজ ইউসুফী, জিল্লুর রহমান, পুলক পাল, মোজ্জামেল মাহমুদ ও হাফিজ রশিদ খান আরো অনেকেই এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম রেজিস্টার্ড সাহিত্য মাসিক পত্র ছিল ‘মনন’। ‘মনন’ পত্রিকা ঘিরেও একটি আড্ডা ছিল। এই আড্ডা বসতো নন্দনকানন ইউনাইটেট হোটেলে। এ আড্ডায় মূলত চলতো কবি সুনীল নাথ, স্বপন দত্ত, মুহম্মদ ইদ্রিস এবং মামুনর রশীদ, কখনো কখনো এই আড্ডায় আসতেন কঙ্কন নন্দী, হেনা ইসলাম। ‘মনন’ সম্পাদনা করতো স্বপন দত্ত। কখনও সুনীল নাথ। ইউনাইটেট হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সুনীল নাথের হোমিওপ্যাথ চিকিৎসালয়ে আড্ডা জমে উঠতো কখনো কখনো। এখানে আসতো ফাউজুল কবির, আশীষ সেন, খালিদ আহসান, আহমেদ খালেদ কায়সার। মাঝে মধ্যে আমি ও স্বপন দত্ত উপস্থিত হতাম। সুনীল নাথ ‘মফস্বল’ নামে একটি পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন।

জলযোগের আড্ডাও বেশ জমে উঠেছিলো। জলযোগ চায়ের দোকানের কর্ণদার আমাদের প্রিয় সুধীর বাবু মারা যাওয়ার পর এই আড্ডা ভেঙে যায়। এখানে নিয়মিত আসতেন স্বপন দত্ত, ফাউজুল কবির, বিজন মজুমদার. আশীষ সেন, মুনির হেলাল, খালিদ আহসান, শিশির দত্ত, হরিশঙ্কর জলদাস, রবীন ঘোষ, কমলেশ দাসগুপ্ত প্রমুখ। এখান থেকে ‘বাকপ্রতিমা’ নামের একটি পত্রিকা বের হয়। এছাড়া ফাউজুল কবির সম্পাদিত ‘বাঙালি’ নামের দ্বি-ভাষিক সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ছাপানো হয়। এই আড্ডায় আসতেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত, অনেকেই তাঁকে দাদা মণি নামে ডাকেন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় অরুণ দাশগুপ্ত যখন যে বাসায় বসবাস করতেন, তখন সে বাসায় তখন একটি আড্ডা ধীরে ধীরে গড়ে উঠতো। বৌদ্ধ মন্দির থেকে, মোমিন রোড। তারপর যোগেশ ভবন – সবগুলো আড্ডায় আমারও যাওয়া হয়েছে। অরুণদার বাসায় ড. অনুপম সেন, স্বপন দত্ত, এ্যাডভোকেট রানা দাশ, আশীষ সেন, কমলেশ দাশগুপ্ত, ফাউজুল কবির, বিজন মজুমদার আসতেন।

এখন চট্টগ্রাম শহরের তরুণ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের আড্ডা বলতে একটিই চেরাগীর মোড়, অর্থাৎ পুরানো বাতিঘর বইয়ের দোকানের সামনে থেকে আজাদী অফিস পর্যন্ত জমজমাট আড্ডা। চলছে তো, চলছেই। এই আড্ডাকে ঘিরে প্রতিবছর কিছু প্রকাশনা হয়। কবিতা-গল্প-প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হচ্ছে। কিছু কিছু লিটিল ম্যাগও প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে মনিরুল মনির সম্পাদিত ‘খড়িমাটি’র কয়েকটি সংখ্যা দেখলাম। এই আড্ডা থেকে প্রদর্শনী, গানের আসর অনেক কিছুই হয়। ‘বাতিঘর’ এখান থেকে সরে গিয়ে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে নতুন করে দৃষ্টি নন্দনভাবে সাজিয়ে বসছে। বিভিন্ন ধরনের বইয়ের সমাবেশ ঘটিয়েছে। ক্রেতারা বই কিনছে। বাতিঘর প্রকাশনায়ও হাত দিয়েছে। বাতিঘরের ভেতরের কফি হাউস ঘিরেও আড্ডা হচ্ছে।

যেখানে বই সেখানে আলোচনা হবে। যেখানে আড্ডা সেখানে তর্ক হবে। যে কোনো বিষয় নিয়ে হতে পারে। হতে পারে বই নিয়ে। রাজনীতি নিয়েও হতে পারে। এই লেখাটি নিয়ে তর্ক হবে, এরপর আড্ডা বিষয়ক একটি ভালো লেখা অবশ্যই হবে। তবে, আড্ডা সবসময় আলো ছড়াবেই।