অনুবাদে কী পাওয়া যায়?
জাভেদ হুসেন
ভাষা হচ্ছে চেতনার শরীর।
– জার্মান ভাবাদর্শ, কার্ল মার্ক্স
১.
ভাষার মধ্য দিয়ে আমরা স্থান ও কাল পার হয়ে ভাবনা পৌঁছে দিতে পারি। মনের মধ্যে যে ভাবনা ছিলো না তা অন্যের কাছ হতে আমার মনে আসতে পারে। পৃথীবিতে প্রায় ৭০০০ ভাষা আছে। এরা একে অপর হতে মৌলিকভাবে ভিন্ন। এদের স্বর, শব্দ, গঠন একে অপর হতে আলাদা। ভাষা আমাদের ভাবনার ধরণ তৈরি করে। ভাবনার ধরণ ভাষাকে নিজস্ব গঠন দেয়। আর ভাবনা মানেই আমাদের বেঁচে থাকার ইতিহাস। তাই ভাষা মানে ঐ ভাষায় কথা বলা মানুষদের জগতের সঙ্গে স¤পর্কের ধরণের ঘনীভুত রূপ।
শার্লেমন বলতেন যে, আরেকটা ভাষা জানা মানে আরেকটা প্রাণ পাওয়া। জীবন ভাষার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ হওয়ার প্রক্রিয়া আমাদের অচেতনে হতে থাকে। ফলে আমাদের জীবনের বোধ আমরা জমা করে রাখি ভাষার মধ্যে। আর নির্দিষ্ট কোন ভাষায় কথা বলা মানুষ সেই ভাষা হতে নিজের বহমান জীবনের বোধকে ধারণ আর প্রকাশ করে। এক সময় মনে হয় যেন ভাষাই বাস্তবকে তৈরি করে। আবার ভিন্ন তর্কও আছে। শেক্সপিয়র এমন বলেছেন –
নামে কী করে
গোলাপ যে নামে ডাকো, সমান গন্ধ বিতরে।
আরেকটু এগিয়ে দেখা যাক। সুর্যকে জার্মানরা বিবেচনা করে নারী আর ¯প্যানিশরা পুরুষ হিসেবে। চাঁদের ক্ষেত্রে ঠিক উলটো। এই যে সুর্যকে কেউ পুরুষদের মতো, অন্য ভাষায় কেউ নারীর মতো করে ভাবছে, এতে কী কোন ফারাক আসে? যদি এই দুই ভাষার মানুষদের একটা ব্রিজ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় – এটা কেমন? জার্মানরা বলবে – ব্রিজটা সুন্দর। মানে নারীবাচক কোন উপমা। ¯প্যানিশ বলবে – ব্রিজটা শক্তিশালী, শক্তপোক্ত। মানে পুরুষবাচক কোন অভিধা। লক্ষ্য করবেন, বহাল দাপুটে বাংলা কাব্যের ধরণ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা সংস্কৃত কাব্য হতে এসেছে। সংস্কৃতে চাঁদ পুরুষ। কিন্তু বাংলা কাব্যে চাঁদ ব্যতিক্রমহীনভাবেই নারী।
কোন ঘটনার বর্ণনাও ভাষার ভিত্তিতে ভিন্ন হয়। ইংরেজরা বলবে – ও নৎড়শব সু ধৎস! কিন্তু অন্য ভাষার কেউ পাগল না হলে নিজের হাত নিজে ভাঙ্গার কথা ভাবতে পারবে না। ধরুন আপনি একটা বাসন ভেঙ্গে ফেললেন। ইংরেজরা বলবে – সে বাসনটা ভেঙ্গে ফেলেছে। একজন ¯প্যানিশ বলবে – বাসনটা ভেঙ্গে গেছে। ইংরেজ মনে রাখবে, বলবে যে কাজটা কে করেছে। ¯প্যানিশ বলবে শুধু কী হয়েছে। কে করেছে এটা তার কাছে গৌন। দুইজন মানুষ একই ঘটনা দেখে ভিন্ন ব্যাপার মনে রাখবে, বলবেও ভিন্ন কথা। এর সাথে অপরাধ, শাস্তি, আইন-কানুন – এই সব ব্যাপার জড়িত। দুই ভাষা যেন দুই জগত!
র্ট্যাজেডি হচ্ছে – আজ আমরা জগত স¤পর্কে যা জানি, তার প্রায় সবই জানি ইংরেজি ভাষার জগত দিয়ে। জগতের প্রায় সব মানুষের জানা, তার ভাবনার জগত এখানে গরহাজির। ফলে আমরা যা জানি তা ভয়ানক রকম সংকীর্ণ, খুবই পক্ষপাতদুষ্ট।
২.
অনুবাদ ভাষা দিয়ে হয় না। ভাষা অনুবাদের প্রকাশক মাত্র। অনুবাদ করে আমাদের চেতনা। আমাদের চেতনা হচ্ছে আমাদের বাস্তব জীবনের ইতিহাসের ঘনীভূত ফল। সেই ইতিহাস হচ্ছে আমাদের রাজনীতির ইতিহাস। প্রতিকালে শাসকদের চেতনাই ছিলো শাসক চেতনা। শাসিতরা যতক্ষণ শাসিত থাকে, ততক্ষণ শাসকদের চিন্তাই শাসিতদের চিন্তা হয়ে বিরাজ করে। সেই চিন্তাকে অনুবাদ করে শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন, প্রচার মাধ্যম, সংবিধান। সুতরাং, শাসিতদের মুক্ত হওয়া মানে অন্যের অনুবাদকে খারিজ করে নিজের মতো করে ভাষা তৈরি করে নিজের মতো করে চিন্তার অনুবাদ। সকল অনুবাদই আসলে চিন্তার অনুবাদ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই চিন্তা কার?
৩.
আমাদের জগতও মূল আর অনুবাদ হয়ে বিরাজ করে। দূর্বলরা বাস করে শক্তিশালীদের নিজ মূল জগতের অনুবাদ করা জগতে। যেমন এখনকার বাকি জগত হচ্ছে পশ্চিমের মূল জগতের অনুবাদ। ভারতবর্ষ হচ্ছে ইংল্যান্ডের অনুবাদ করা জগত। আর এই অনুবাদ খুবই বাজে অনুবাদ।
৪.
ভাষা আমার চেতনাকে আকার দেয়। কিন্তু তাকে পাই জন্ম মাত্র। তাকে পাই বহাল, প্রশ্নাতীতভাবে। এর মাধ্যমেই যেহেতু আমার চেতনা প্রকাশ পায়, তাই তাকে প্রশ্ন করা তার মাঝেই থেকে সম্ভব নয় । এই ভাষাকে, মানে আমার জন্মমাত্র পাওয়া অচেতন চেতনাকে প্রশ্ন করা যায়, যাচাই করা যায় আরেক চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে। মানে আরেক ভাষার সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। অনুবাদ হচ্ছে সেই বোঝাপড়া।
৫.
অনুবাদ হচ্ছে টেক্সটের পরকাল। নিজ ভাষাতে সে তার জীবন কাটিয়ে নিয়েছে। সেই আমলনামার ওপর ভর করে এখন পরের কালে আর পরের ভাষায় তার জীবনের হিসাব-নিকাষ।
অনুবাদ কি কেবল মূল টেক্সটের বার্তাই বহন করেন? তা নয়। লক্ষণীয়, সেই টেক্সটেরই অনুবাদ হয় যা কোন না কোন কারনে একটা পরীক্ষা পার হয়ে এসেছে। যে নিজেকে শুধু ভাষা বা ফর্মের কারিগরিতে গুরুত্ব দাবি করে তেমন টেক্সট অনুবাদ হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়। অনুবাদ হয় সেই টেক্সটেরযে নিজের সঙ্গে একটা ইতিহাস নিয়ে আসার সামর্থ রাখে। সময়ের সঙ্গে সে মূল লেখায় যত নতুন ভিন্ন অর্থ যোগ হয়েছে, অনুবাদে সেই সেই সবের নতুন প্রেক্ষিত যোগ হয়। কারন সেই আদি বৃক্ষ পায় নতুন মাটি, নতুন জল-হাওয়া। সেই গাছের ফলের স্বাদ যারা নেবেন তারাও ভিন্ন স্বাদে অভ্যস্থ।
৬.
অনুবাদের মধ্যে একটা ব্যাপার লক্ষনীয়। মূল ভাষা আর অনুবাদের যে ভাষা তাতে অনেকগুলো তফাত থাকে। এখানে যা আছে, ওখানে তা নেই। দু দিকেই কথাটা সত্যি। তবু এখানে যোগাযোগ হয়। এই যোগাযোগে একটা পক্ষ্য দাপটের ভুমিকা নেয়। কে সেই পক্ষ্য তা খুব গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপার। ফারসি থেকে মওলানা রুমির কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদের সময় কোলম্যান যে স্বাধীনতা নেন, তার ফলে কোন ফারসিভাষী ইংরেজির মওলানাকে চিনতেই পারবেন না। কিন্তু ইংরেজি ভাষার যে পাঠক বাজার তার কাছে মওলানা অসহায়। ফলে ইউরোপের চোখে ফারসি না জানা পাঠককে মওলানা রুমিকে চিনতে হয়।
৭.
আগে যেমন বলা হয়েছে, অনুবাদ কেবল বার্তা বহন করে না। প্রতিটি অনুবাদ কর্ম দুটো ভাষার মাঝে একটা সংলাপ। তার মানেই দুটো সংস্কৃতির মাঝে সংলাপ। প্রতিটি অনুবাদকর্ম যে ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে সেই ভাষার সম্ভাবনা আর তার বহাল সীমাবদ্ধতা ধরিয়ে দিতে পারে। তবে ভাষারা একে অপরের কাছে আগন্তুক নয়। ইতিহাসের মাঝে তাদের কিছু সংযোগ থাকতে পারে। এর বাইরেও, মূল লেখায় যা বলা হয়েছে তার অনুভবের সঙ্গে অনুবাদ করা ভাষার অনুভবের একটা আাতমীয়তা আছে নিশ্চয়ই। নইলে তা অনুবাদ করার কথা অনুবাদক ভাববেন না। একদিকে অনুবাদক চান যথাসম্ভব নিখুতভাবে মূল কাজের ফর্ম ও অর্থ নিজ ভাষায় তুলে ধরতে। আবার তা করতে হয় নিজ ভাষার বহাল সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে তাকে অতিক্রম করতে চাওয়ার মধ্যে দিয়ে। এই সীমাবদ্ধতা একই সঙ্গে সম্ভাবনাও বটে। কারন যত নিখুতই হোক না কেন, অনুবাদ কখনই মূলের কপি হতে পারবে না। কারন দুটো আলাদা ভাষা দুটো ভিন্ন সংস্কৃৃতি, জীবনবীক্ষা আর ইতিহাস। ফলে অনুবাদ দুটো ইতিহাস আর জীবনকে একে অপরের সঙ্গে সংলাপে নামায়। অন্য কারো কাছে এমন কিছু আছে যা আমাদের কাছে নেই। সেই না থাকা জিনিষ আমাদের অভাব বোধ হচ্ছে। এই বোধের জায়গা থেকেই অনুবাদ শুরু হয়। এ শুধু শুরু। এর প্রভাব আরো গুরুতর।
৮.
এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদের সময় কী করি আর কী করা উচিত? যেমন, যখন ফারসি থেকে বাংলা করছি তখন কি ফারসিকে বাংলায় রূপান্তরিত করবো, না কি বাংলাকে ফারসিতে নিয়ে যাবো? প্রায় সকল ক্ষেত্রেই, আমরা ফারসিকে বাংলা করতে চাই। করা উচিত বাংলাকে ফারসি। অর্থাৎ নিজের ভাষাকে অন্য ভাষায় নিয়ে যাওয়াতেই অনুবাদের লক্ষ্য পূরণ হতে পারে। নিজের ঘাটতিগুলো পূরণ করা মানে নতুন ভাবনা, নতুন দৃষ্টিকে নিজের মাঝে হজম করা যেতে পারে। নইলে নিজের যা আছে তার মাঝেই অন্য ভাষার স¤পদকে আটিয়ে রাখতে গিয়ে নতুন কিছু আর পাওয়া হবে না। এই ব্যাপারটা আরেক ইঙ্গিত দেয়। অনুবাদ করতে গিয়ে মূল টেক্সটের ভাষাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিই। কিন্তু আসল অনুবাদ হচ্ছে সেই যা মূল টেক্সটকে নিজ ভাষায় আনার চাইতে নিজ ভাষাকে মূল টেক্সটের ভাষায় নিয়ে যাবে। নইলে অনুবাদের মাধ্যে দিয়ে কিছুই পাওয়া হবে না। আর তা যদি না হয় তবে নিজ ভাষা, মানে নিজ ভাবনার জগত যেমন ছিল তেমনই থেকে যাবে।
৯.
দুটো শব্দ দুই ভাষায় একই অর্থ বা জিনিষ বোঝালেও তার দ্যোতনা বা ভাব ভিন্ন হতে পারে। যেমন প্রতিরোধ শব্দটা। একজন ফরাসীর কাছে তা গৌরবের অনুভব, তার মনে পড়বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের জাতীয় সংগ্রামের কথা। আর একজন ইংরেজের কাছে তা তার জাতির বিরুদ্ধে ফরাসিদের বিরোধিতার ইতিহাস মনে করিয়ে দেবে।
১০.
অনুবাদকের কাজ খুব উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু নয়। অনুবাদ খুব ভালো হলে কৃতিত্ব পুরোটাই মূল লেখকের ভাগে যাবে। আর তা না হলে পুরো বদনাম অনুবাদকের প্রাপ্য। আর মূল লেখার মৌলিকত্ব কখনোই অনুবাদে তুলে আনা যৌক্তিকভাবেই সম্ভব নয়। কারন ভাষার শরীর যে শব্দ দিয়ে তৈরি হয়, সেই শব্দের ইতিহাস আর অভিপ্রায় ভাষা ভেদে আলাদা। তা না হলে ভিন্ন ভাষাই তৈরি হতো না। তবে অনুবাদকে যদি নিছক দুটো ভাষার মাঝে কারবার বলে না ধরি, যদি তাকে তৃতীয় কিছুর সাপেক্ষে বিচার করি, তবে অনুবাদে হারানোর বদলে নতুন কিছু পাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
১১.
মূল টেক্সটে যা বলা হয়েছে নিজ ভাষায় তার সমান্তরাল ভাবনাগুলো জোড়া লাগানোতেই অনুবাদকের কাজ শেষ হয়ে যায় না। ভাবনাগুলোকে জোড়া দিয়ে অর্থবোধক এক জায়গায় তো মূল লেখক একবার করেই রেখেছেন। অনুবাদকের কাজ হচ্ছে মূল লেখকের অভিপ্রায়কে নিজ ভাষায় খুঁজে বের করা। মূল টেক্সটের শব্দের কাছাকাছি শব্দ নিজ ভাষায় খুঁজে বের করে তা জোড়া লাগানো অনুবাদকের কাজ নয়। বহু ক্লেশে তাঁকে বরং মূলের বৈশিষ্টের ধরণকে নিজ অনুবাদে তুলে ধরতে হবে। এর মানে মূল আর অনুবাদ – দুটোকেই দুই ভাষা অতিক্রম কওে আরো বড় কোন ভাষার সাপেক্ষে মৌলিক করে তোলা। সেই ভাষা কোন শব্দ দিয়ে তৈরি নয়। সেই ভাষা বহু বৈচিত্রের মাঝে মানুষের একত্বের ভাষা। শব্দহীন এই ভাষা শব্দময় ভাষার মাঝেই লুকিয়ে আছে। অনুবাদকের কাজ একে খুঁজে বের করা।
১৭ জুলাই ২০১৯
ঢাকা