অদিতি শিমুলের কবিতা
দৃশ্য
খাটালের মোষের মতো অন্ধকার; চলটা-ওঠা বাখারির ফাঁক গলে নির্বাক জেগে থাকে আশ্চর্য সিল্যুয়েট; “দৃশ্য” খড় ঠাঁসা মৃত গাভীর ধারণা জিভ, ঠোঁট দিয়ে চেটে দেয় শিশুচাহিদাগুলো । কালের বানে ভেসে গেছে সেই কবে ধাপালো বাছুর তার কো-ন কা-লে , টনটন করে ফল্গুস্নেহ – বাঁটের অলীক দুধ তবুও ফেনা-ভরতি , উৎলায় । শরীর জুড়ে গেরস্থালী হাঁসফাঁস , সেলুলয়েডে পরিত্যক্ত শ্যাওলা, শুকনো খটখটে , দৃশ্য চলছে…!
মন্থন
জ্বরতপ্ত আঙুলে দ্বিখণ্ডিত হোক বাড়োয়ারি চাঁদ ও প্রণত প্রহর -! মৃত্যুহীন প্রেম ও তৃষ্ণার ঠোঁট পরস্পর ছোঁ’ক এমন , যেন দুগ্ধকাতর কোনও শিশু ! ক্ষুধা হোক, তৃষ্ণা হোক দ্বিগুণ – চতুর্গুণ -বহু-বহুগুণ তাপিত উষ্ণতা বাড়ুক ভয়ঙ্কর নুনের সমুদ্রে – ব্যপ্ত হোক জীবনের অনাহূত তেজ! অন্তর্মুখ থেকে একক অভিনিবেশ বাঁক নি’ক মানবিক উৎকর্ষের ডাক ও প্লাবনে ! নিরাসক্ত তীর ছুটে চলে যাক বহুদূর- লক্ষ্যভেদের এ বাজি ও পুণর্জন্ম প্রদক্ষিণ করে এসে দেখুক নিজেদের রক্তাক্ত মুঠো এবং উপড়ানো নখ ! দেখুক, তাদেরই রক্তবমির ওপর ভাসছে পিঁপড়ের সারি ! আর অগুণতি হাতের সঙ্গে আরও হাত মিশুক- মিথের সঙ্গে আরও মিথ – আরও দীর্ঘ হোক প্রাকারে ঝুলন্ত কালের সিঁড়ি ও কঙ্কাল ! মানুষের রক্ত নাচুক মানুষের মতো— মানুষ তবুও মানুষের মতো হোক।
ঈশ্বরী
আশ্চর্য মত্ত বাতাসের হাত – আঁচড়ে-কামড়ে- রক্তাক্ত গোধূলির নগ্নবুক ! উন্মত্ত কাল – ছুঁড়ে মারলো অনিবার্য আবীর – কম্পিত হলো গিরিখাত -! ছন্দে মথিত খাজুরাহো উৎসব- কৌম আগ্রাসী অন্ধকার, বেহিসেবী লোলুপ জিভ ও লুণ্ঠন উচ্ছ্বাসে — লুফে নিল নাচের মুদ্রাগুলো -! বিমূর্ত নির্মাণ- রাশেফ্লিয়া যোনী ও মাঙ্গলিক নাভিকূপ — গলিতমোমের -অনন্য, অভিজাত কারুকাজ ! স্পর্ধিত আলোয় একইসঙ্গে কাঁপছে নিবেদন এবং প্রগাঢ় প্রার্থনা ! সমাহিত মঙ্গলপ্রদীপ হাতে নাচছে—- ব্রহ্মাণ্ড – পাতাল — চণ্ডালিনী নাচছে —- আলোর পিপাসা — নাচছে আগুন আংরাখা — উলঙ্গ ঈশ্বরী —!
সমর্পিত অন্ধকার
অবিরাম, অনুক্ষণ; এই যে ভিতরে-ভিতরে রক্তিম আশার মতো কাঁপে ঘননীল একটি অবাধ শিখা ! বিরহী বাতাস এসে আরও কানে-কানে দিয়ে যায় মন্ত্রণা, যেন বৃষ্টির নরোম ফিঁসফাঁস; দূর থেকে রৌদ্রতপ্ত সব দিনে জলজগন্ধি এক উন্মাতাল হাওয়া এসে নিজের স্বপ্ন বলে যায় , আর বলে যায় “আশ্চর্য রূপকথা” নিছক গল্পের ছল করে ! দূরে-বহুদূরে কোথাও কালোজলে ঢেউ তুলে রাত্রিদিন আক্রান্ত জোড়াশুশুক ! প্রখর সূর্যের তলায় – চন্দ্রাতপে ধুলো-মাটির আটপৌরে সংসারে জমে ওঠে তাহাদের প্রেম এবং অভ্যন্তর ! জলের ওপরে জল, শব্দবিহীন এই আতপ্ত সন্তরণ আর অপূর্ব বেদনামন্থনে তাদের যুগ্মহৃদয় এখন পাড়বিহীন এক নদীর সমর্পিত অন্ধকার !
মানুষ
রক্তে রক্তে ডংকা বাজাও, স্ফুলিঙ্গ ওড়াও জংধরা মগজের কোষে কোষে, মানুষ, তুমি তোমার হাত উঁচিয়ে ধরো – মনে রাখো , এই তোমার সাক্ষর ! হে বানভাসি, প্রয়োজনে খুলে দাও অস্পৃশ্য সকল বন্ধন, খুলে দাও জলমুখ – প্লাবন ভাসাও — ভাসাও নূহের নৌকো ! সবখানে তুমি চিৎকার করো, জানান দাও তোমার অস্তিত্ব ! যেমন করে নবাগত শিশু প্রথম চিৎকারে জানিয়ে দেয় তার উপস্থিতি! তার প্রাপ্য অধিকার – তার মৌলিক প্রয়োজনগুলো তার চাই ই চাই – এই কবন্ধ সময়ের প্রেক্ষাপট , নড়ে যাক যবনিকা, কপট অন্ধকার ! ভুমিকম্প হোক, মারীবীজগুলো নিপাত যাক, মানুষের প্রতি মানুষের নোংরা পরোয়ানার কৌশলগত মুন্সিয়ানা এখন শিল্পের পর্যায়ে, অথচ,প্রমিত শিল্পের প্রতি কারোর কোনও ঋণ নেই -! টেবিলবৈঠক অবধিই রুই-কাৎলাদের হাঁকডাক। হে মানুষ, তাদের শয়তানী অশ্লীল মুণ্ডুগুলো চুল্লিতে তুলে দাও, আগুন জ্বালাও সমস্ত ভণ্ডামিতে; ছুঁড়ে দাও মানুষের নিকট ঘুমজাগানিয়া তোমার/তোমাদের আর্তলাভা ও আহ্বান ! মানুষের আমিত্ব যেখানে জমাট বরফ, বসে যাওয়া তোমার পাঁজর থেকে তুলে আনো ওঙ্কার — ওঁম— তোমার/তোমাদের স্তব্ধ কণ্ঠ থেকে তুলে আনো টঙ্কার , ঝাঁজ – মাঠে, প্রান্তরে ধূলোয় নেমে এসে মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়াও। তোমার/তোমাদের পুনর্জাগরণ হোক এই স্নিগ্ধ হাওয়ায় -হাওয়ায়— কেটে দেওয়া সতেজ শেকড়গুলো বহুদূর পর্যন্ত প্রোথিত হোক বারংবার – সজীব শস্যে ভরে তোলো প্রাণের উঠোন। প্রতিশ্রুতিগুলো পাথরে, মাটিতেই খোদাই হোক, মানুষ, তোমাদের ভালো হোক, মঙ্গল হোক।
================