শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
বাইশে শ্রাবণ
আমার মতো নিশ্চয়ই অনেকে প্রার্থনা করেছিল তোমার জন্য
আমার একার চাওয়ায় কি অত জোর যে তোমার দরজায় পৌঁছবে
আমার মতো অনেকজনই ডাক দিয়েছিল তোমায়
নাহলে তুমি হাসবে কেন
আমি ক্ষীণকণ্ঠী
গলায় কাঁপে প্রজাপতির পাখা, তবু শব্দ হয়ে ওড়ে না
তার সাধ্য কি তোমায় ছোঁয়
আমার আঁচলে কি এত ফুল ধরে
যে কোল ছাপানো মালা দেব তোমায়
শুধু দেখতে থাকি
আমার একটি সাদা ফুল লেগে আছে তোমার গ্রীবাভঙ্গে
যখন সবাই মিলে ঘিরে
গান গাইতে গাইতে
তোমায় নিয়ে চলে গেল
শুধু আমি পড়ে রইলাম একা
যেতে যেতে ফিরে
তুমি আমার দিকে তাকালে
আমার পা অবশ মাথা নীচু
আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম
তুমি শুধু আমার দিকে তাকালে
আহা, সেই যে আমার সফলতম না যাওয়া
———————
বিদায়
আমার দরজা পূবের দিকে খোলে
সূর্যমাখা আমার চৌকাঠ
বসেছি আজ আলপনা জাল ফেলে
আঁচল বেয়ে অশ্রুনদীর ঘাট
প্রতিবিম্ব আঁকছি কপাল জুড়ে
তরল ফোঁটা রক্তিম কুঙ্কুমে
আসবে বিদায়, নৌকো বেয়ে যেই
ধোওয়াবো পা কান্নাভেজা ঘুমে।
বিল্বপত্র সুগন্ধি চন্দনে,
সাজিয়ে নেব আমার বরণডালা
বিদায়, তোমার জন্য গেঁথে নিলাম
ভোরবেলাতেই মনখারাপের মালা।
আজ সারাদিন বাজবে তোমার সুর
চলতে ফিরতে চোখ মুছি আনমনে
যাবার বেলা রাতের তারার নীচে
করব প্রণাম নীল পদ্মের বনে।
ক্রমান্বয়ে অশ্বথ পাতায় মুড়ে
থালায় দেব সাজিয়ে অনুনয়
বিদায়, তুমি সঙ্গে নিয়ে যেও তোমার গান
আনন্দবিলাসী আমার একটিমাত্র ভয়
কোন অছিলায়, কোন দু-কথার ফাঁকে
লুকিয়ে রেখে যাবে তোমার বাঁশি
আমার তখন রোজ অকারণ চোখের জলে স্নান
চাইনা হতে দুঃখ অভিলাষী।
——————————
প্রেমের কবিতা
এখন সময় অনেক অন্যরকম
চোখ মেলেছি হাজার বছর পরে
ভিক্ষু শ্রমণ পরিব্রজে আর
যায় না মোহন বংশীর পথ ধরে
হাজার বছর কেমন করে জান?
একশ কি়ংবা দ্বাদশ কেন নয়?
আমার গণিত প্রেমের সঙ্গে মেশে
সহস্রতেই অপেক্ষা শেষ হয়
তখন সময় অনেক অন্যরকম
ধর্ম শরণ তাপস সন্ন্যাসী
চেয়েছিলেন এক গণ্ডূষ জল
কেঁপেছিল অমৃতপ্রত্যাশী
চন্ডালিকার হৃদয় থরোথরো
জল ছিল, না লক্ষ ঝর্ণাধারা?
কেউ জানে না, মুহূর্তরা জানে
প্রেমের সেতু তৈরী করে তারা
হাজার বছর পেরিয়ে দেখি আজ
সেই মেয়েটি আগলে রেখে পথ
তপ্ত রোদে গড়ছে ব্যারিকেড
শীর্ণ হাতে মূর্ত ইবাদত
গরাদ ভেঙে পাঠায় প্রজাপতি
যেখানে তার বন্দী প্রেমিক জাগে
শেকল ছেঁড়ার প্রত্যয়েরি রাত
শ্লোগানে গান ভোরের ললিতরাগে
এখন সময় অনেকটা একরকম
প্রতিদানে গর্জে ওঠে মেয়ে
সড়ক জুড়ে প্রেমের মিছিল চলে
এক গণ্ডূষ জলের কসম খেয়ে
—————————— —
অপেক্ষা
কিছু কি পাওয়ার ছিল?
কিসের জন্য তবে রাত্রি জাগরণ
কিছু কি পাওয়ার ছিল?
থেকে থেকে কেঁপে উঠে
এই কথাগুলো বলে
অনাবিল অনাবৃত নিরালঙ্কার হাতে
মাথার ওপরের ছাদ
চারপাশের দেওয়াল সরিয়ে দিয়ে
এলোমেলো পায়ে সে চলে গেল আনমনে
কাঁটাতারে লেগে ছিঁড়ে গেল শাড়ি
কবেই শুকিয়ে গেল চোখের জল
অকাজের অযথায় ভরে রাখে মন
ধুয়ে ধুয়ে আঁচলে মুছে রাখে নুড়ি
গুনে গুনে চোখে নেয় আকাশের তারা
ফাঁকা মন বড় ঝকমারি
ফিরে ফিরে সেই গুনগুন
কিছু কি পাওয়ার ছিল?
কিছু কি পাওয়ার ছিল?
কেন এই রাত্রি জাগরণ?
একদিন ঘনবর্ষায়
আকাশে অনেক কালো মেঘ
আর মেঘের ওপর আলো
চোখে তার কান্না এল ফোঁটায় ফোঁটায়।
টুপটাপ মাটি ছুঁয়ে হয়ে গেল
অপেক্ষার গাছ সারি সারি।
দিন যায়,
সম্বৎসর সেইখানে মেলা বসে
অপেক্ষার মেলা
কতজন আসে কাঁটাতার, নুড়ি
আর আকাশের তারার গল্প নিয়ে
না পাওয়ার ছায়ায় বসে
গান গায় গুনগুন
অপেক্ষা কুড়িয়ে নিয়ে যায়।
সে কেবল পথে পথে ফেরে
জল ভরা চোখে
দূরে কোনো শুষ্ক রুক্ষ প্রান্তর ডাকে আয়
অপেক্ষা দিয়ে যা।
—————————–
প্রেমের পূর্বাভাস
কখনো পয়ার কখনো অমিত্রাক্ষর
কখনো চতুর্দশপদী
হাওয়া আর মেঘ কবিতা লিখেছে আকাশে
মনে রেখেছে নদী
কারা যেন সেই বই প্রকাশের সভা ডেকেছে
বৃষ্টি শেষে
শুকনো পাতারা এসেছিল একে অপরকে
ভালবেসে
বিদিশা তখন কলেজের ক্লাশে, আনত গ্রীবায়
মুঠোফোনে দিল মন
পাতারা সবাই হৈচৈ করে ফিরবার পথে
প্রেমের বিজ্ঞাপন
হয়ে ভেসে এসে আলগোছে ছুঁল বিদিশার
এলো চুল
ঠিক তখনি পাশেই কোথাও দুটি আড়চোখে
মুগ্ধ হবার ভুল
কবিতার ধুলো ঝরে পড়েছিল ভ্রুপল্লবে
আরক্ত গালে
বিদিশার চোখ জ্যামিতিক মাপে দেখে নিয়েছিল
যে আছে আড়ালে
এভাবেই শুরু প্রেমের গল্প, কোন আনমনে
এখানে সেখানে
কবিতা সভার শুকনো পাতারা হেসে হেসে ফেরে
যখন যেখানে
===============