You are currently viewing মৃত্যুগন্ধী সড়ক || বিপাশা মন্ডল

মৃত্যুগন্ধী সড়ক || বিপাশা মন্ডল

মৃত্যুগন্ধী সড়ক

          বিপাশা মন্ডল

সাতমহলা বাড়ির মতো ঘন গাঢ়সবুজ গাছপালার নিচে আব্বা আর মাজেদকে দুটো ডেয়ো পিঁপড়ের মতো ছোটো ছোটো দেখাচ্ছে। নদীর ঘাটটার ঠিক পিছনেই শিকদারদের কাষ্ঠল গাছের জঙ্গল। দূর থেকে দেখায় যেন সবুজের ভারী দেওয়াল। স্টিমার ছেড়ে দিলে আব্বাদের একসময় আর দেখা যায় না। শুধু দেখতে পাই আম্মা পাকঘরে পুকুর পাড়ের দীর্ঘ সুপারি গাছটার হলুদ হয়ে আসা পাতা বাকলের দিকে তাকিয়ে আছেন একবুক প্রত্যাশা নিয়ে।
সকাল সাড়ে পাঁচটায় স্টিমার ঘাটে লাগল। ঐ তো হাজার হাজার মানুষ নদীর ঘাটে। সবাই এখানে কিছু না কিছু কাজ করে খাচ্ছে, আমারও একটা কাজ নিশ্চয়ই জোগাড় হবে। নিজের থাকা-খাওয়ার পরেও বাড়ির ছয়টা মানুষের ভাতের সংস্থান নিশ্চয় হবে।
চাচা তখন সকালের কাজ সেরে বাড়িতে নাস্তা করতে এসেছেন। আমার হাতে ধান-চালের বস্তার বদলে ঘুমানোর বেডিং আর দাদার আমলের বড় টিনের ট্রাঙ্কটা দেখেই চাচা বোধহয় বুঝতে পারলেন, আমার উদ্দেশ্য। চাচীকে বললেন, ‘মনুরে পাকঘরের পাশের রুমটা খালি কইরা দেও শেফালির মা।’ চাচী কিছুটা অবাক হলেও তখনই কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। আমার মনটা আড়ষ্ট হয়ে গেল। এখন পরের বাড়িতে উঞ্ছবৃত্তি করতে হবে। প্রতিবার ঢাকা শহরে ঢুকে রাজার মতো দাপিয়ে ফিরে যেতাম, কিন্তু এখন ভিখারির মতো কর্মভিক্ষায় নামতে হবে।
পরদিন সকাল পাঁচটার সময় ডেকে তুললেন ছোটো চাচা, বললেন, “তোর ভালো জামাকাপড়গুলা পইরা সাতটার মধ্যে দোকানে যাবি।”
বুঝলাম চাকরি হয়ে গেছে। ছোটোচাচার কসাইখানায়। নাস্তা করে দ্রুত বের হয়ে গেলাম। চাচার বাসা থেকে দোকান বিশ মিনিটের পথ। ফরসা কাপড় পরার মানে বুঝলাম না। চাচার দোকানে তার সঙ্গে আরও দুইজন কর্মচারী আছে। তারা তো গামছা আর গেঞ্জি পরেই কাজ করে।
চাচা গদীতে বসে আছেন। আমাকে দেখে নেমে এলেন। কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘তোর আব্বার চিঠি পাইছি গত সপ্তাহে। মন খারাপ করিস না, সব ঠিক হইয়া যাইব, দেশের অবস্থা ভালো না, পরিস্থিতি একটু সারলে তোর আব্বারে ঢাকায় নিয়া আইবি, ঢাকা মেডিকেলে ভালো চিকিৎসা হয়।’ আমি অবাক হলাম, আম্মা তো আব্বার চিঠি দেবার কথা কিছু বলেনি। একটু থামলেন চাচা, এরপর কর্মচারী দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সাইফুল আর বিরাম শোন, এই আমার ভাইস্তা, আইজ দিয়া ক্যাশে বইব। দেখছস তো দেশের অবস্থা, আবার গতবছরের মতো অভাব আইতে পারে, আমি একটু দেইখা শুইনা মোকাম করতে চাই। যা মনু, তুই গিয়া ক্যাশে বয়। আইজ হইতেই হাতেখড়ি।’
চাচার দোকানে কাজ করতে খারাপ লাগে না। শুধু কাঁচা রক্তের একটা তীব্র অস্বস্তিকর আঁশটে গন্ধ। তবে ভালো খাসি কাটলে চর্বির মিষ্টি গন্ধও ভেসে আসে। কর্মচারী দুজনও ভালো। বিশেষ করে বিরাম, ওর বাসা কাছের বস্তিতে। এতো যতœ করে সব সাফ করে ফেলে যে কোনো পশু পাখির মলমূত্র বা রক্ত বেশিক্ষণ পড়ে থাকতে পারে না। বড় একটা মুড়ির টিনের মধ্যে মাঝে মাঝে ব্লিচিং ফেলে ময়লা জমা করছে দিনের মধ্যে তিনবার গিয়ে ময়লা ডাস্টবিনে ফেলে আসছে। শুধু মনটা একটু খুঁত খুঁত করে, আই এ ফেল করে এখন কশাইয়ের দোকানের ক্যাশিয়ার!
চাচা খেতে গেলে সাইফুলকে দিয়ে কিছুটা দূরের হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে পত্রিকা আনাই, একটা খাতায় চাকরির বিজ্ঞাপনগুলো কপি করে রাখি। রাত্রে দরখাস্ত লিখি। পাঠিয়ে দিই। একদিন চাচী নাস্তা নিয়ে এলেন, বা হাতে একটা খবরের কাগজ, নিচু স্বরে বললেন, ‘দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ মনু, উঠতি বয়সী মেয়েগুলোরে নিয়া এখানে থাকা আর ঠিক না। তোমার চাচা বিষয়টা বোঝেই না।’ আমি প্রথমে অবাক হলাম, জানতাম না যে চাচী লেখাপড়া জানেন, খবরের কাগজ পড়তে পারেন! আর খবরের কাগজ তো আমি প্রতিদিনই পড়ি, কিন্তু কিছু তো চোখেই পড়েনি চাকরীর বিজ্ঞাপন ছাড়া!
দোকানে গিয়ে ঐ দিন আর চাকরির জন্য খবরের কাগজ আনাই না। চাচীর দুশ্চিন্তা ও ভয় আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে। বেলা বারোটার আগেই সাইফুল দুইবার আর বিরাম তিনবার আমার কাছে আবদার করে আজ বেলা একটা বাজলেই তারা ছুটি চায়। ওদের আশ্বস্ত করে বলি, ‘ঠিক আছে, তোমরা যেতে পারবে কিন্তু দেড়টার আগে না, আমি বাসায় গিয়ে খেয়ে আর কাপড় বদলে আসবো।’ ধবধবে সাদা লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরে তো আর কসাইয়ের কাজ করা যায় না! ওরা দুজনে দেখলাম ফিসফিস করে কী হিসেব করে জানালো দেড়টায় বের হলেও ওদের চলবে।
আমি বাসায় গিয়ে কাপড় বদলে লুঙ্গি গামছা ও সবুজ ফতুয়া পরে এলাম।
দেড় মাস হয়ে গেল চাচার বাড়ি আছি দোকানে পশুর মতো খাটছি, কিন্তু চাচা একটা টাকা আমার হাতে ঠেকায়নি, বাড়িতে ওরা কী খাচ্ছে কে জানে, সুফিয়ার একটা চিঠি পেয়েছি একমাস আগে, এরমধ্যে আর কোনো খবর নাই, চাচা চাচী চিঠি পেয়েছেন কিনা তাও জানায়নি। ঐ দিন রাত্রে বলেই ফেললাম, ‘মানুষের বাঁচতে হইলে খাইতে হয়, দেড়মাস হইয়া গেল বাড়িতন আইছি, তারা কি খাইতে আছে কেডা জানে।’ চাচী এবার নরম হলেন, শান্ত গলায় বললেন, ‘তাদের নিয়া ভাইব্বো না, তুমি আসার পনের দিন পরেই একবার মণিঅর্ডার পাঠাইছি, পনের দিন আগেও একবার পাাঠাইছি, দুই-তিন পরে আরেকবার পাঠাব। আমরা এখানে মাছ-মাংস খাব, তারা ওখানে ডাল-ভাতও খাবে না তা কি হয়! ওদের নিয়া চিন্তা কইরো না।’

আমার বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেল।

তারপর সবকিছু বদলে যায় এক রাত্রে, আমাদের প্রিয় শহরে গজব নেমে আসে।

সারারাত্রি মেশিনগানের গুলি, বন্দুকের গুলি ভারী ভারী জিপ আনাগোনার শব্দ বড় রাস্তা পেরিয়ে আমাদের গলি রাস্তায়ও পৌঁছায়। আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। নিজের ঘরে চৌকির উপরে পা গুটিয়ে বসে থাকি। টিনশেড বাড়িটার কলপাড়, পায়খানা রান্নাঘর সব যেন আতঙ্কিত অন্ধকারে ঢেকে যায়। মনে হয় ঐ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে ছায়ার মতো অতিমানবিক কোনো অবয়ব, আমাদের সবাইকে গিলে নেবে, আমরা তার অন্তহীন মুখগহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকব অনন্তকাল ধরে। কেউ কাউকে চিনতে পারব না, কেউ কারোর কাছে যেতে পারব না। আমার মুখ থেকে একটা শব্দ বের হয় না, শুধু ঠোঁটের কষ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ে হাতের তালুতে লাগে।
জ্ঞান ফিরলে দেখি, চাচা মাথার কাছে বসে আছেন। চামেলি মিতালী খালিদ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, চাচী সবার পিছনে তার মুখে সারা পৃথিবীর দুশ্চিন্তা। শেফালিকে দেখছি না। আমাকে হুশে ফিরতে দেখেও চাচীর মুখের দুশ্চিন্তা কাটে না। ঘণ্টা তিনেক পরে পুব আকাশ ফর্সা হয়ে আসে। আজ আজানের শব্দ কেমন কান্নার মতো শোনায়।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। চাচীর কাছে গিয়ে নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করি, ‘চাচী, শেফালি কই?’
চাচীর চোখে বোধহয় কোনো পাথর চাপা দেওয়া ছিল, আমার সহানুভূতির প্রশ্নে সেই পাথর এক ঝটকায় সরে গেল, আর প্লাবন নেমে এল দুই চোখে। কিন্তু কোনো শব্দ বের হল না মুখ-নাক থেকে। কয়েক মিনিট পরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন, ‘আমার ছোটোবোন জেবু যে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে জানোতো, কাল ওর জন্মদিন ছিল, দুপুরে এসে জেবু শেফালিকে নিজের কাছে হোস্টেলে নিয়ে গেছে। এমনিতেই ওর অনেক বান্ধবী গ্রামে চলে গেছে, আমি ভাবলাম যাক খালার কাছে, আর রাতেই তো ওখানে …।’ তাঁর গলা বন্ধ হয়ে গেল আপনাআপনি, চোখদুটো ঠিকরে বেরোচ্ছে মনস্তাপে।
ভয়ে আমার হাত-পা জমে গেল। শেফালি কাল জেবু খালার সঙ্গে হলে ছিল? এদিকে ঢাকা ইউনিভার্সির দিকেই তো গোলাগুলির শব্দ সবচেয়ে বেশি হয়েছিল!
সকালে ফজরের নামাজ পরে আমি একবার বাইরে গিয়েছিলাম, যা শুনে এসেছি তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এখন কী করব আমি? আমার কী করা উচিত?
স্থানুর মতো বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। জেবু খালা আর শেফালির খোঁজ নিতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? ভাবলাম প্রথমে সাইফুলের কাছে যাই, হয়তো সে কোনো বুদ্ধি দিতে পারবে।
আটটার দিকে আগের দিনের বাসিভাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও গিলে বেরিয়ে গেলাম সাইফুলের বাসায়। ওর প্রতিবেশির কাছে শুনলাম, সকালে উঠেই বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর চলে গেছে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম।
চাচার বাড়িতে দিন যেন আর কাটে না। মিতালি আর চামেলি সিদ্ধভাত করে। খেতে বসে খালিদ ঝামেলা করে, শেফালিকে খোঁজে। সারাদিনে একবার কষ্ট করে কটা ভাত গিলি, আর ঢাকার অলিতে গলিতে জেবু খালা আর শেফালিকে খুঁজে ফিরি। প্রতিবার বাড়ি ফিরে দরজার সামনে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকি, কড়া নাড়তে হাত সরে না। কোনো খবর পাইনি কোথাও। কী জবাব দেব চাচীকে?
সেদিন ফজরের নামাজ পড়ে দোয়া পড়ছি, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। চারদিন চাররাত না ঘুমিয়ে চাচী আজ সকালের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি যথাসম্ভব নিঃশব্দে দরজাটা খুলি। দরজার বাইরে ছোটোচাচার দোকানের কর্মচারী বিরাম চাচা। দরজা খুলে ভিতরে আসতে বলবো এরমধ্যে ছোটোচাচা শোবার ঘর থেকে বসার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ান। ইঙ্গিতে আমাদের বাইরে গিয়ে কথা বলতে বলেন। বাইরে এসে বিরাম চাচা জানান শিগগীর গিয়ে কাপড় পাল্টে আসতে হবে সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে টিনের বালতি। হাতে দুটো ময়লা কাপড় তুলে দেন। আমি ভিতরে গিয়ে কাপড় বদলে টিনের বালতি হাতে বেরিয়ে আসি।
হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল হয়, উনি আমাকে ডোমদের পোশাক পড়তে বললেন কেন? তবে কি শেফালি লাশকাটা ঘরে? আমার পা গুলোতে যেন কয়েক মণ ভারী লোহার বাটখারা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। পা মোটে সামনের দিকে এগোচ্ছে না।
বিরাম তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়, সেখানে আরও কয়েকজন গুম্ফধারী বয়স্কলোককে দেখতে পাই। তারাও হাতে বালতি ঝাড়– পিঠে দড়ি বস্তা নিয়ে তৈরি কোথাও যাবার জন্য। বিরাম চাচা একটা ছোটো গামছা দিয়ে বলেন, ‘মুখটা বাইন্ধা নেন ভাইস্তা।’ আমি মুখটা বাঁধি বটে, কিন্তু বুকের ভিতরে এতো জোরে জোরে ধুকপুকুনি হচ্ছে মনে হচ্ছে যেন বুক ফুঁড়ে হৃদপি-টা বাইরে বেরিয়ে আসবে। একটু হেঁটে রাস্তার মোড়ে গেলে একটা জিপ এসে আমাদের তুলে নেয়। গাড়িটা রোকেয়া হলের সামনে থামে। আমরা কয়েকজন ভিতরে ঢুকি। হলের ভিতরে মৃত্যুশীতল নীরবতা। সবগুলো কক্ষ খালি। প্রচ- দুর্গন্ধ বের হচ্ছে অজানা জায়গা থেকে। নিচতলার সবগুলো কক্ষ দেখি। কিছু পাই না। দোতালার সবগুলো কক্ষও খালি। আমার সিড়ি বেয়ে তিনতলা পর্যন্ত কেউ কোথাও নেই। কিন্তু পচা গন্ধ এখন তীব্রতর হচ্ছে। আমিই সবার আগে পাগলের মতো দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি। সামনে ছাদ। ছাদজুড়ে তীব্র আঁশটে গন্ধ। চাচার মাংসের দোকানের গন্ধের চেয়েও অনেক তীব্র আর ভয়াবহ। সেখানে অনেকজন নারীর লাশ পড়ে আছে। আমার মাথা টলে ওঠে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিরাম চাচা আমাকে পিছন থেকে ধরে ফেলে কাঁধের উপরে খামচে ধরে আমাকে শান্ত থাকতে বলে নিচুস্বরে। সিঁড়ির ঠিক ডানপাশে একজন নারী উপুড় হয়ে আছে, সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মৃত তো নিশ্চয়ই, কারণ গন্ধে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আমার হঠাৎ মনে হল, ৭-ই মার্চ যে মহিলটিকে রিক্সায় দেখেছিলাম সে-ই নয়তো! আবার শেফালির কথা মনে পড়ে গেল, আমি দ্রুত একটার পর একটা লাশকে ভালোভাবে দেখতে থাকি, কারোর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। সবাই প্রায় উলঙ্গ, মৃত। রেলিংয়ের পাশে চিৎ হয়ে পড়ে আছে শেফালি, গায়ে একটুকরো সুতো পর্যন্ত নেই। আমার সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কান্না আসে, কিন্তু পিছন থেকে বিরাম চাচা আমার কাঁধ খামচে ধরে আছে। আমার শরীর যে কাঁপছে সে টের পায়। আবারও নিচুস্বরে বলে, ‘মনু, কাইন্দ না, জেবু আফারে খোঁজো। নরপশুগুলায় আমাগো শেফালির মতো বাচ্চা মেয়েটারেও ছাড়ল না, অনেক কষ্ট দিয়ে মারছে প্রত্যেকরে।’ আমার এবার জেবু খালার কথা মনে পড়ে। মাঝে মাঝে চাচার বাড়িতে আসত, কী সুন্দর গান গাইত জেবু খালা! শেফালির কয়েকহাত দূরে জেবু খালা কাত হয়ে মরে পড়ে আছে। সেও সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। সবাই মিলে লাশগুলো ধরাধরি করে নামিয়ে ট্রাকে তুলি। ট্রাকে তোলার সময় বিরাম চাচা আমাকে ফিসফিস করে বলে, শুধু মেয়েগুলারে ধর্ষণ করে শেষ করে নিষ্ঠুরতার ইতি টানেনি মিলিটারিরা, ওদের যৌনাঙ্গে বেয়নেট ঢুকিয়ে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দিয়েছে। এখন দেশের এই শ্রেষ্ঠ মেধাবী মেয়েগুলোকে ডাম্পিং এর জন্য নিয়ে যাওয়া হবে।

সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে চাচার বাড়ি ফিরে আসি। দুইদিন নিজের ঘর থেকে বের হই না। চাচী এখন ধীরে ধীরে অনেকটা স্বাভাবিক আচরণ করছেন। চাচী বোধহয় কিছু টের পেয়েছেন, অথবা চাচাই তাকে বলে দিয়েছেন। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। বেশ কয়েকদিন এমন অচল মুদ্রার মতো স্থবির দিনগুলো পার হয়। দু’তিন দিন পর পর এলাকার ছেলে জহিরের সঙ্গে একটা জায়গায় যাই। যেখানে গেলে মনটা শান্ত হয়। বেঁচে থাকার ইচ্ছা জেগে ওঠে।
কদিন ঘর থেকে দোকানে যাবার উদ্দেশ্যে বের হবার সময় চাচী আমাকে ডেকে বেডিং বাঁধতে সাহায্য করতে বলে। খেয়াল করে দেখি পুরো বসার ঘর বাক্সপেটরায় ভরে গেছে। চাচী অনেকটা স্বাভাবিকভাবে বলে, ‘শোন্ মনু, যা গেছে গেছে, তা তো আর ফিরে পাব না, এখন বাকীদের বাঁচাতে হবে। আমি তোর বাবা-মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি, তুইও আমাদের সঙ্গে যাবি। তোর চাচা তার দোকান ফেলে যাবে না।’
আমি জানাই, আমিও যাচ্ছি তাদের সাথে। চাচা আমার দিকে করুণভাবে তাকায়। একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে সে।
পরের দিন বিকেলবেলা স্টিমার ঘাটে চাচা আমাদের তুলে দেয়, নিজে নেমে যায়। আমি সিঁড়ি টেনে তোলার ঠিক আগের মুহূর্তে লাফিয়ে নামি জেটিতে। চাচী একমুহূর্ত স্তব্ধ থেকে খালিদ ও মিতালির হাত ধরে ডেকে পাতা নিজেদের সিটের দিকে চলে যায়, স্টীমার দূরে সরে যাবার আগে আমি চামেলিকে বলি, তার স্কুলব্যাগের পকেটে একটা চিঠি আছে যেন সে চিঠিটা চাচীকে দেয়।
গতরাতে অনেক ভেবেচিন্তে এই চিঠিখানা লিখে রেখেছিলাম।
শ্রদ্ধেয় চাচী
আপনি প্রতিদিনের কথার চাবুকে আমার বুকের মধ্যে মুক্তির যে আকাক্সক্ষা জ্বালাইয়া দিয়াছেন নিশ্চয়ই তা ভোলেন নাই। চাচার কাছে ফিরিয়া যাইতেছি না। আমি জানি আমাকে কোথায় যাইতে হইবে। কীভাবে এই জানোয়ারদের মোকাবিলা করিতে হইবে। হয়তো আর কখনো আমাদের দেখা নাও হইতে পারে। জানি আপনাদের দোয়া সর্বদা আমার সঙ্গেই আছে। মা-কে জানাইবেন যদি বাঁচিয়া থাকি দেখা হইবে। মা হয়তো আমাকে স্বার্থপর ভাবিবে নিজের ইচ্ছাকে বেশি মূল্য দিলাম বলিয়া। দয়া করিয়া মাকেও আপনি শিখাইয়া দিবেন, দেশ নিয়াও ভাবিতে হয়, নিজের দেশ না থাকিলে এই জীবনের কোনো মূল্য নাই। দেশও আমাদের একটা পরিবার, মানে প্রথম পরিবার। প্রথম মা।’
ইতি
আপনাদের মইনুল

জানি মা হয়তো কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যাবেন। কিন্তু আমার এখন আর কিছুই করার নেই। যে মৃত্যুগন্ধী সড়ক আমি এই কদিনে পার হয়েছি, তাতে আর আমি স্বাভাবিকভাবে আগের জীবনে ফিরে যেতে পারি না। এক নতুন পথ পেয়ে গেছি, গন্তব্য জেনে গেছি। আমাকে এখন দ্রুত আগরতলা যেতে হবে, যত দ্রুত সম্ভব। ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে অন্তত পঁচিশজন তরুণকে আমার এখানকার কাজগুলো করার জন্য তৈরি করে রেখে যেতে হবে।

***************************