যুদ্ধ ও হরণের দিন
নাহার মনিকা
বাড়িতে ঢোকার মুখে মাঝবয়েসী এই নির্মেদ নিমগাছের কথা শহীদুলের কাছে শুনেছে তিথি। ওর আরেক প্রেম গাছপালা। তিথির সঙ্গে একই ক্লাসে না হলে সে নাকি রসায়ন বিভাগ ছেড়ে উদ্ভিদবিদ্যায় ভর্তি হয়ে যেতো।
-‘বই পড়ে পড়ে মার্জিনে মন্তব্য লেখা তাহলে তৃতীয় প্রেম?’- তিথি টিপ্পনী কেটেছে।
রিক্সা থেকে নেমে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রেহানা বোরখা খুলে ফেলে। তিথিও নেকাব এর গিট আলগা করে, চুলের ভেতর অনেকক্ষণ ঘামছিলো। দু’জনের কারোরই অভ্যাস নেই। কিন্তু এ কঠিন সময়ে বোরখার আড়াল কাজে দিয়েছে। বড় করে শ্বাস নেয় তিথি। নিমগাছে শাদা শাদা তারার মত ফুল। শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছালো তারা!
এতক্ষণ কেউ কথা বলেনি,বলা চলে গত দু’দিন ধরেই তেমন কথাবার্তা বলেনি। রেহানা যখন রিক্সাওয়ালাকে স্যুটকেসটা নামাতে বলে, ওর কথার প্রতিধ্বনি দ্বিগুণ হয়ে কানে লাগে। অথচ তারা বাইরে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে।
বাস থেকে নেমে রিক্সা পাওয়ার আশা করেনি ওরা, কিন্তু একটা না, তিন চারটা রিক্সা দাঁড়িয়ে, এমনকি রেহানার চেনা একজন পুরনো রিক্সাওয়ালাও।
ঢাকা থেকে রওনা দেয়ার আগে মুস্তাফিজ ভাই যেগুলোকে সম্ভাব্য বিপদের জায়গা হিসেবে ভেবেছিলো, কোন ভাগ্যে সেসব নির্বিঘ্নে পার হয়ে তারা এসেছে কে জানে। ফেরীতে দু’বার বন্ধুকধারী মিলিটারীর এগিয়ে আসা দেখে নিজের বুকের ধক ধক আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল তিথি। ট্রেনের ভেতর থেকে ষ্টেশনে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্রধারী মিলিটারী দেখেছে, তাদের টহল দেওয়া ভারী বুট যেন নিষ্ঠুরতার বাস্প ছড়াচ্ছে বাতাসে। আলেয়া আপা তো অবশ্যই এমনকি তিথি, রেহানাও পাখি পড়ার মত নিলয়কে তাদের গন্তব্য কোথায় ও কেন’র সন্তোষজনক উত্তর শিখিয়ে দিয়েছে। মাত্র চারবছরেই বেচারাকে কত কিছু বানিয়ে বলা শিখতে হলো!
পার্বতীপুরে থেকে বাস এসে দশমাইলে থামার পর সবার হৃদস্পন্দন প্রায় থেমে গিয়েছিল। সেখানে রাস্তার ধারে টহলদার মিলিটারী। নারী আর শিশুদের বাসে বসে থাকার নির্দেশ দিয়ে পুরুষযাত্রীদের সঙ্গে মুস্তাফিজ ভাইকে নামিয়ে নিয়ে গেলে আলেয়া আপা ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করলো, তিথি আর রেহানা রুদ্ধশ্বাস বসে। সময়ের চাকা নিশ্চল হয়ে গেল। হয়তো মিনিট পনেরো, কিন্তু মনে হলো অনন্তকালের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শেষে যখন তাকে বাসে ওঠার অনুমতি দিলো তখন বেলা প্রায় বারোটা। তারপর অবশ্য বড় কোন সমস্যা হয়নি। চলন্ত বাসের খোলা জানালা দিয়ে প্রান্তরের হাওয়াও ঢুকেছিল।
নিলয়ের হাত ধরে, তিথির দিকে “আয়” বলায় উৎসাহ যোগ করে রেহানা। আর তখন দীর্ঘ, অনিশ্চিত যাত্রার ধকল ছাপিয়ে বুদবুদের মত সংকোচ জাপ্টে ধরে তিথিকে। শহীদুলদের বাড়ি, ওর বাবা মা, ভাই। আর সে এভাবে এখানে চলে এসেছে! ব্যাগ হাতে নিতে নিতে তার শরীর কাঁপে।
শহীদুল সামনে এসে দাঁড়ালে সে কি স্বাভাবিক থাকতে পারবে? না, এখন জ্ঞান হারানোর সময় নয়। ‘ তিথি, তিথি স্থির হও, তিথি সংযত হও’- মনে মনে মন্ত্রের মত বলে নিজেকে দরকারী আর কেজো করে তোলার ইচ্ছে দ্রুত ঠেসে ঠেসে মাথায় ভরে তিথি।
একটা বেড়াল রাস্তা পার হয়ে এপাশে দেয়ালের কাছে ঘুর ঘুর করে। বাতাস গুমোট হয়ে গেল, ঝড় আসবে কি? না, সূর্য তো আছে আকাশে। তিথি নিজের মন ঘোরায়, চোখ ঘুরিয়ে বাড়িটার চারপাশ দেখে, পলেস্তারা খসা, একটু মলিন, ম্রিয়মান, ভারী। উঠোনের তারে আসমানী রঙ্গের শাড়ি মেলে দেয়া। একটা বছর দশেকের ছেলে দৌড়ে তারটা নেড়ে গেল। শাড়িটা দুলছে।
শহীদুলের সঙ্গে একান্তে দেখা করার কথা রেহানার কাছে সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে তিথি। যে রুমমেট শহীদুলের খালাতো বোন, বন্ধু হলেও তাকে কিছুতেই সে বলতে পারবে না।
প্রথমদিকে কার্জন হলের বারান্দার রেলিং এ হেলান দিয়ে তাকে কত গল্প বলেছে শহীদুল। আঁচলের খুট আঙ্গুলে পেচিয়ে তিথি শুনেছে আর ভয়ে থেকেছে কেউ দেখে ফেলবে, বিশেষ করে রেহানা – এই আশংকা প্রকাশ করলে শহীদুল জোরে হেসেছে- “আরে ও কলাভবন থেকে এখানে কি জন্য আসবে?”
তিথি তবু শহীদুলের ভাষায়, অমূলক, কাকতালীয় আর অবাস্তব আশংকা করেছে। কিন্তু শহিদুল বড়াই যে পরাস্ত হওয়ার মত ঘোড়সওয়ার সে নয়। উলটে তিথিকে রাগিয়ে দিয়ে বলেছে সে নাহিদ বানু তিথি’র নামে হলের ঠিকানায় চিঠি পাঠাবে। সেদিন তিথি সত্যি রাগ করেছিল।
আরেকবার, তিথি’র জন্য আনা উপহারের বই নিয়ে কি কান্ড!
বুদ্ধদেব বসু’র- তিথিডোর। পেছনের মলাটের পাতায় সাহেব কায়দা করে সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখে এনেছেন-‘ যে মুখ একবার দেখলে দিবানিশি মনে পড়ে, সেই তিথি’কে ডোর’। কি সর্বনাশ! লজ্জায় তিথির কানের গোড়া লাল হয়েছিল। তাদের রুমে বইখাতার অন্তত কোন আড়াল নেই। রেহানা যা গল্পের বইয়ের পোকা, একবাক্যে হামলে পড়বে, আর নিজের খালাতো ভাইয়ের হাতের লেখা চিনবে না? এটা নিয়ে তিথি কোন অবস্থাতেই হলের রুমে ঢুকবে না।
‘তাহলে এই বইটা পড়তে নাও’- শহীদুল বাড়িয়ে ধরে, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েষ্টার্ণ ফ্রন্ট। তাদের ডিপার্টমেন্টের সদ্য পি এইচ ডি শেষ করে ইংল্যান্ড থেকে আসা বশির স্যার বইটির নাম বলায় শহীদুল খুঁজে পেতে কিনেছে।
-‘আচ্ছা, আসো তোমাকে পড়ে শোনাই’, বলে মাঝখানের পাতা খুলে ভরাট কণ্ঠে প্রতিটি লাইনে আঙ্গুল স্পর্শ করে পড়েছিল। ডিবেটে পুরস্কার পাওয়া শহীদুলের ইংরেজী উচ্চারণ চমৎকার। তিথির মনে হয় এ কন্ঠস্বর শুধু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। ওর হাতের কব্জি, চওড়া কপাল আর গভীর চাউনি চোরাচোখে দেখে তিথির বুক ধরফড় আর গাল লালচে হওয়া বেড়েছিল। তিথির ভেতরে অন্য আরেক তিথির মন শহীদুলের বুকের ভেতর পিষ্ট হতে চাইলেও সে সেখানে বেশীক্ষণ থাকেনি, এমনকি চা খেতেও চায়নি। শাদা ব্লাউজ নীল শাড়ির খাটো আঁচলে ঢেকে শহীদুলকে খানিকটা বিমূঢ় করে দ্রুত উঠে পড়েছিল।
সেদিনের পর আর এখনো দেখা হলো না।
পঁচিশে মার্চ শুরু হওয়া ঢাকায় তান্ডবের রাতে হলের আর সব ছাত্রীদের সঙ্গে তিথি আর রেহানাও যখন ভয়াল হাঙ্গরের মুখে তাড়া খাওয়া মাছের মত, আকাশে আগুনের স্ফুলিঙ্গ, মর্টার, মেশিনগান আর গুলির প্রলয়ংকরী আওয়াজে দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের কোনায় বসে থেকেছে, জেগে থাকতে থাকতে ঝিমুনী এলে একটাই দুঃস্বপ্ন বার বার দেখেছে তিথি।
সে আর শহীদুল একটা সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠে বসে ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে পেয়ারা খায়। এমন সময় যমদূতের মত এক লোক এসে ছোট্ট ব্লেড কেড়ে নিয়ে তিথির আঙ্গুলগুলো কচ কচ করে কেটে ফেলে। তারপর ব্লেডটা দু’দিক থেকে টেনে লম্বা করাত বানিয়ে তিথিকে মাছের মত একহাতে ঝুলিয়ে পাঁজর বরাবর কেটে দু’ভাগ করে ফেলে। নিজের অর্ধাংশের দিকে তাকিয়ে হতবিহব্বল তিথি শহীদুলকে খোঁজে। ওর হাত তখন পিছমোড়া করে বাঁধা, চোখে কালো কাপড়ের পট্টি। তিথির পা নেই, দৌড়াতে পারছে না। হাত দিয়ে আছড়ে পাছড়ে শহীদুলের কাছে পৌছাতে চায়, পারে না। কোন রক্তপাত নেই, ব্যথাবোধ নেই কিন্তু তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যায়।
যেদিন তারা হল ছাড়ছে, জেতেজুতে কাপড় জামার সঙ্গে হুহু করা মনটাকে ব্যাগে ভরে দিয়ে তিথির ভেতরে আরেক তিথি তখন ইকবাল হলে গিয়ে ব্যাকুল হয়ে শহীদুলকে খুঁজেছে। ছেলেদের হোষ্টেলগুলোতে লাশের স্তুপ। সারারাত গগনবিদারী গুলির শব্দে মন শরীর দুইই অসার। কার্ফ্যু তুলে নেয়া সময়সীমার মধ্যে অন্যকোথাও, নিরাপদ জায়গায় পৌঁছতে হবে। হল ছেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ আর অভিমান যুগপৎ জেরা করেছে তার মন, শহীদুল যদি তার খোঁজে আসে?
রেহানার কাছে মুখ খোলার আগেই ও তিথিকে জড়িয়ে ধরে বলে-‘ আমি সব জানি। তুই কি ভাবিস আমি কিছু টের পাইনি? কিন্তু এখন কি তেমন সময়?’
কাছেই কোথাও ঠা ঠা গুলির শব্দ শোনা যায়। দূরে আকাশে শকূন উড়তে দেখে তিথির হাতের ওপর আশস্ত করা চাপকে হ্যাচকা টান বানিয়ে দৌড় দেয় রেহানা। তারপর ওর একসময়ের গৃহশিক্ষক অধুনা ঢাকায় চাকুরীরত মুস্তাফিজ ভাইয়ের ধানমন্ডির ভাড়া বাসার দরজার কড়া নাড়ে।
তারপরের দিন, ঘন্টা, মিনিট আর সেকেন্ডের হিসাব কড়ায় গুনে জমা আছে তিথির কাছে। আতংকের অজগর গলায় পেঁচিয়ে কতদিন পর আজকে সে শহীদুলের বাড়িতে এসে পৌঁছালো।
বাড়ির ভেতরে উঠোনে সিমেন্ট গোড়া বাঁধানো গন্ধলেবু গাছে শাদা শাদা ফুল পড়ন্ত বিকেলের রোদে উজ্জল হয়ে আছে। চেয়ারে বসা মুস্তাফিজ ভাই গলা নামিয়ে শহীদুলের আব্বার কাছে ঢাকায় পাকিস্থানীবাহিনীর তাণ্ডব আর তাদের বিভীষিকাময় যাত্রার বর্ণনা দিচ্ছে। সঙ্গে তিনজন নারী নিয়ে প্রাণ হাতে করে যাত্রার অভিজ্ঞতা কাউকে বলতে পেরে এই প্রথম তাকে একটু নির্ভার হলো বলে মনে হয়।
রংপুর, দিনাজপুর, দশমাইলে পাখি মারার মত করে মানুষ হত্যার সংবাদ আসছে। শহীদুলের আব্বার চোখেমুখেও অনিশ্চয়তার ছাপ দেখে তিথির আকুল প্রশ্ন যা কালবৈশাখীর মত বুকের ভেতর ঝড় তুলছে, কন্ঠনালীতে আটকে থাকে। ‘শহীদুল কোথায়’?-এই প্রশ্নটা কেন মুস্তাফিজ ভাইও করছে না? না কি যুবক বয়সী পুত্রে পিতাকে এ প্রশ্ন করা সমীচিন না।
শহীদুলের সঙ্গে একবার দেখা হলে সে সব ক্লান্তি, দেখা না হওয়ার, যোগাযোগ না হওয়ার যন্ত্রণা ভুলে যেতে পারতো। রান্নাঘরের পিঁড়িতে বসে ডিমভাজার আয়োজন করতে করতে শুকনো ঠোঁট ভেঙ্গে ক্লান্তির হাসি হাসে তিথি।
ভুলে যাবে কিভাবে? মৃত্যুর থাবা আর আতংকের অজগর তো এখনো পিছু ছাড়েনি। তবে শহীদুল পাশে থাকলে কণ্টকশয্যাও গায়ে ফুটবে না,- ভেবে তিথির কান এত কিছুর মধ্যেও লাল হয়ে ওঠে।
রেহানার সঙ্গে খালা টুকটাক কথায় তার ছেলেদের প্রসঙ্গ আনে, কিন্তু শহীদুলের কথা বেশী নেই। ছোট দু’জনের।
রাতের খাওয়া শেষে গামছায় মুখ মুছে মুস্তাফিজ ভাই- এখানে পরিস্থিতি যদি খারাপ হয় তারপর কোথায় যাওয়া যেতে পারে- এই নিয়ে আলাপ করে।
শহীদুলের আব্বা আটোয়ারী বা পঞ্চগড়ের কথা বলে। রেহানাদের দাদাবাড়ি আরো ভেতরের দিকে আটোয়ারী।
রেহানা বলে-‘স্যার, ওখানে নাগর নদী আছে। এমনিতে ছোট কিন্তু বর্ষায় অনেক বড় হয়ে যায়। ওখানে যাওয়া মিলিটারীদের কাজ না’।
এ বাড়ির উঠোনে আজকে অসৈরণ চাঁদ। না উঠলেই ভালো ছিল। নিমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝুর ঝুর করে জোৎস্না ঝরে পড়ছে। কুয়োতলায় গিয়ে রেহানার সঙ্গে পানি তুলে বালতি ভর্তি করে রাখে তিথি। দূরে হাটের দিক থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসে, কয়েকটা কুকুর ডাকছে, মনে হয় যেন একদল মানুষ কাঁদছে।
মুস্তাফিজ ভাইদের ঘুমের বন্দোবস্ত করে তিথি আর রেহানা খালার সঙ্গে ঘুমোতে এল। রেহানা পাশ ফিরে শুয়ে বললো- ‘যেটুক পারিস ঘুমিয়ে নে তিথি’।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য এই ঘরে শহীদুল এভাবে খাটের ওপর এসে বসতো কি? স্মৃতির পূনরাবৃত্তি করতে করতে ওর বলিষ্ঠ হাতের কব্জি, আঙ্গুল, তুড়ি মেরে হা হা করে হাসি মুখস্থ হয়ে গেছে তিথির। সেজন্যই কি এখানেও সবকিছু চেনা আর আপন মনে হয়! ওর মায়ের সুপারি কাটার জাতি, খাটের বাজুতে চুনের দাগ, আব্বার চশমা, সব।
ঘরের ছাদে ঝুল জমেছে। কাঁচের ছোট আলমারীর ভেতর স্কুল কলেজের প্রতিযোগিতায় পাওয়া ছেলেদের পুরস্কারের কাপ, মেডেল।
-‘আমার ছেলেরা সবাই খেলাধুলায় ভালো। সবচে ভালো শহীদুল, যেমন পড়ালেখা তেমন খেলা। ক্যাডেট কলেজে থাকতে কত প্রাইজ যে বাড়ি আনতো’- খালা আলমারীর পাশে দেয়ালের হুক থেকে তসবী নামায়।
আলমারীর ওপরে কিছু বই। তিথি উঠে দাঁড়ায়- ‘খালা বইগুলা দেখি?’
-হ্যা হ্যা, হারিকেনের কাছে নিয়া আসো, আমার খুব আউট বইয়ে নেশা ছিল। এখন তো’,- খালা দীর্ঘশ্বাস চেপে হাতে তসবী নিয়ে জায়নামাজ বিছায়।
হারিকেনের আলোয় দূর থেকে নাম পড়া যাচ্ছিল না। পথের পাঁচালী, বিষাদ সিন্ধু, ইন্দ্রনাথ আর কিছু পাঠ্যবই। হ্যা, শহীদুলের বই। আর আর, ওই দুটো বইও আছে! অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েষ্টার্ণ ফ্রন্ট আর তিথিডোর! এবার কি সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাবে তিথি? তাকে উপহার দেয়া বই, তিথি আনেনি।
-‘কেমিষ্ট্রি পড়ে কুল পাচ্ছি না’- বলে মুচকি হেসেছিল। তবু বই দুটো নিয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখেছে। বিশেষ করে তিথীডোর।
জ্বরগ্রস্থ রোগীর মত গা ঝিম ঝিম করে তিথির। আড়চোখে মেঝেয় জায়নামাজে বসা খালাকে দেখে নেয়। তার চোখ বোজা, বিড়বিড় করে তসবী জপছে।
দরজা খোলা আছে। তিথি কি বাইরে উঠোনে যেতে পারে না? চরাচর ভাসা জোৎস্না চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ঘরে ঢুকছে। ওই তো উঠোনে গোলাপের ঝোপটার শহীদুল দাঁড়িয়ে আছে। আছে না? বইদুটো এ বাসায় আছে, তার মানে শহীদুল বাড়ি এসেছিল, এসে চলে গেছে। কোথায় গেছে? এ বাড়ির সবাই জানে, কিন্তু কেউ উচ্চারণ করছে না। অথচ তিথির কী ভীষণ জানা দরকার শহীদুল কোথায় আছে! সবটা শরীর পানিতে ডুবিয়ে শুধু নাক বাঁচিয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার মত প্রতীক্ষায় আছে সে।
ওই তো শহীদুল চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে স্থির তাকিয়ে আছে ঘরের ভেতর খাটের ওপর বসা তিথির দিকে। তিথির ভেতর থেকে আরেকজন, প্রতীক্ষায় আকুল, আলুথালু হয়ে থাকা তিথি এক ছুটে বের হয়ে যায়, ডানা ঝাপ্টানো ঝড়ো পাখির মত উড়ে পরে তার বুকে। কিন্তু ঠাঁয় দাঁড়ানো শহীদুলের ভেতর থেকে অন্য আরেক শহীদুল বেরিয়ে আসে না।
এই বইগুলোর প্রতি পৃষ্ঠায় শহীদুলের হাতের স্পর্শ আছে। তিথি তর্জনী ছোঁয়ায়। স্পর্শের ভাষা কি শোনা যায়। বইয়ের পাতায় কান পাতলে হবে? একদম শেষ পাতায় সেই হাতের লেখা – তিথি কে ডোর। ঝর্না কলমের কালি লেপ্টে গেছে। ভিজে গিয়েছিল। যেদিন শহীদুল বাড়ি এসেছে সেদিন তাহলে ঝড়বৃষ্টি ছিল!
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েষ্টার্ণ ফ্রন্ট এর ভেতরের পাতায় দাগিয়ে রেখেছে এই লাইনগুলো- “We were eighteen and had begun to love life and the world; and we had to shoot it to pieces. The first bomb, the first explosion, burst in our hearts. We are cut off from activity, from striving, from progress. We believe in such things no longer, we believe in the war.”
তিথির গলার কাছে ব্যথা আটকে থাকে, যেন তাকে রেখে যাত্রীবোঝাই বাস চলে গেল, সে একা খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে! পাতা উলটে চলে তিথি। শেষের পাতায় কালো কালির বাংলা অক্ষর জ্বলজ্বল করে, শহীদুল লিখেছে-’ আমি যোদ্ধা না। হওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু আমি একা নই।”
তার মানে, তার মানে কি? ছটফট করে ওঠে তিথি। খালাকে কিছু বলবে? জানতে চাইবে? কিন্তু এ বাড়ির কেউ তো মুখ ফুটে কিছু বলছে না।
সকালে আধোতন্দ্রা ভেঙ্গে গেলে ধরমড়িয়ে উঠে বসে তিথি। ঘরে কেউ নেই।
তিথিডোর বইটা খুলে শেষের পাতা সাবধানে ছিঁড়ে আনে। কাগজটা ব্লাউজের ভাঁজে লুকিয়ে নেয়। এটা তার।
এবার অন্য বইটা, এর শেষ পাতা উল্টিয়ে ছিড়ে আনে।
তারপর কুচিকুচি করে আঁচলে গিট দিয়ে রাখে। রেহানাকে বলে পুরো বইটা পুরিয়ে ফেলতে হবে।
কুয়োতলায় শহীদুলের দুই কিশোর ভাই ঘুমভাঙ্গা চোখে কাঠ কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছে।
তিথিকে দেখে কালিমাখা শাদা দাঁতে হাসে।
খালা রেহানার সঙ্গে রান্নাঘরে ব্যস্ত।
মুস্তাফিজ ভাই নিলয়কে নিমগাছে পাখি দেখাচ্ছে।
এই মনোরম সকালে দেশের কত জায়গায় কত যুদ্ধ চলছে।
সবাই জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। তিথিরও মনে হয়, বলার কি দরকার?
**************************************