You are currently viewing পোশাক নিয়ে বিতর্ক: সাম্প্রতিক বাংলাদেশ || মো. রেজাউল করিম

পোশাক নিয়ে বিতর্ক: সাম্প্রতিক বাংলাদেশ || মো. রেজাউল করিম

পোশাক নিয়ে বিতর্ক: সাম্প্রতিক বাংলাদেশ
মো. রেজাউল করিম

মানব-সংস্কৃতির সকল উপাদানই পরিবর্তনশীল। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পশ্চিমা পোশাক, বিশেষত পশ্চিমা পুরুষের পোশাক দীর্ঘকাল পূর্বেই বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন পোশাকের মর্যাদা পেয়েছে। আমরা যদি নিরাপত্তা বাহিনি ও সামরিক বাহিনির পোশাক লক্ষ্য করি তাহলে এই কথার সত্যতা স্বীকার করে নিতেই হয় (ব্যতিক্রমও রয়েছে: আফগানিস্তানে তালেবান সদস্যরা নিজ নিজ সনাতনী পোশাক পরেই দশকের পর দশক যুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধ পোশাকের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে সনাতন পোশাক লুঙ্গি, গেঞ্জি পরেই নয় মাস যুদ্ধ করেছে)। পৃথিবীর সকল দেশের নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনির সদস্যদের (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) পোশাকের ধরণ একই এবং তা পশ্চিমা।

যদিও পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ স্থানীয় পোশাকই পরিধান করে; এতদসত্ত্বেও বলা যায়, দেশীক বা স্থানীয়/ আঞ্চলিক পোশাকের ব্যবহার দূর-ভবিষ্যতে কত বছর স্থায়ীত্ব লাভ করবে তা অনিশ্চিত। হয়ত কালের বিবর্তনে দেশীক বা স্থানীয়/আঞ্চলিক পোশাকের ব্যবহার শত বছর পরেও প্রতীকী রূপেই হয়ত টিকে থাকবে। আরব উপদ্বীপে ধনী-গরিব নির্বিশেষে একই রীতির পোশাক পরে। এখনও অনেক দেশে বিশেষ পার্বন এবং সরকারি উচ্চ পর্যায়ে দেশীক পোশাক ব্যবহার করা হয়; বিশেষত এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে। শত বছর পরে হয়ত তা না থাকতেও পারে। ধারণা করা হয় সকল ধর্মেই বিশেষ কিছু পোশাক আছে যা প্রধানত ধর্মগুরুরা পরিধান করেন, তা-ই হয়ত পৃথিবীর সর্বশেষ বিশেষ পোশাক।

বাঙালির ‘নিজস্ব পোশাক’ বা ‘সনাতনী পোশাক’ কী? এ নিয়ে তেমন কোনও বিতর্ক নাই।

এই দেশের, এমনকি প্রাচীনকালের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের ইতিহাস অনুসন্ধানে প্রধান সমস্যা, এই অঞ্চলের রাজন্যবর্গের উদ্যোগে কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ/অঞ্চলে ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্র তৈরি করা হতো। এই অঞ্চলে তেমন কোনো নিদর্শনও নাই। যা আছে, তা হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয় ভাস্কর্য বা মূর্তি। কিন্তু মিশরীয়, মেসোপটেমিয়া ও গ্রিক সভ্যতা, ভারতীয় অজন্তা, ইলোরা কিংবা পাকিস্তানের সিন্ধু অঞ্চলে মহেঞ্জাদাড়ো-হরপ্পার নগর সভ্যতায় খোদাই করা দেয়ালচিত্রে তৎকালীন সমাজচিত্র, ধর্মীয় কার্যাদির পরিচয় পাওয়া যায়; যা থেকে ঐ অঞ্চলের মানুষের পোশাক সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। বস্তুত ১৬১০ সালে মুঘল শাসক ইসলাম খান এদেশে রাজকীয় ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার কাজটি শুরু করেন। ফলে প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসের জন্য গবেষণাধর্মী নিবন্ধ কিংবা গ্রন্থের ওপরে নির্ভর করতে হয়, যার শুরু অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদে।

উপমহাদেশে সমৃদ্ধ পোশাকের প্রচলন করে মুসলমান শাসকবর্গ। মুসলিম-পূর্ব উপমহাদেশের মানুষদের পোশাক ছিলো খুবই সাধারণ। নীহাররঞ্জন রায় এবং রমেশচন্দ্র্র মজুমদারের মতে বাঙ্গালি নারী ও পুরুষ একটি কাপড় পরতো। নারীর পোশাক ছিল শাড়ি এবং পুরুষের ধুতি। শাড়ি এবং ধুতির মধ্যে পার্থক্য ছিলো এই যে, শাড়ি দৈর্ঘ্যে এবং ঝুলে বড়ো হতো। সমাজের উপর তলার মানুষরা হাঁটুর নিচে নামে এমন ঝুলের ধুতি পরতো। সাধারণ মানুষ ধূতি পরতো অত্যন্ত খাটো মাপের, ধুতি হাঁটুর উপরই থাকতো। বাঙালির সংস্কৃতি গবেষক গৌতম রায়ও বলেন, “উনিশ শতকের প্রথম দিকেও এদেশে মুসলমানরাও ধুতি পরত। মুসলমানরা তহন (তহবন্দ) পরিত না। কাছাকোঁছা দিয়া ধুতি পরিত।১
প্রাচীন যুগের বিত্তবানরা এদেশের মানুষ একটি পোশাকই পরতো। কেননা, প্রাচীন সনাতন ধর্মমতে সেলাইযুক্ত কাপড় পরিধান পাপের কাজ বলে বিবেচিত হতো। এখনও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সেলাইবিহিন কাপড়ই পরিধান করে। মুসলমানদের আগমনের সাথে সাথে মানুষের পোশাক পরার রুচিরও পরিবর্তন হয়। একটি পোশাকের জায়গায় চলে আসে তিনটি পোশাক- উর্ধাঙ্গ, নিম্নাঙ্গ এবং মাথায়।২

মুকুন্দরামের লেখা থেকে জানা যায়, মধ্যযুগে স্বচ্ছল মুসলিমরা পাজামা পরতেন। মুসলিমদের দেখাদেখি হিন্দু মুনিরা পাজামা পরা শুরু করছেন দেখে শূন্যপুরাণে হিন্দুদেরকে ‘পাজামা পরে মুসলিম হয়ে গেছে’ বলে ঠাট্টা করা হয়েছে। মুসলমানদের আগমনের পূর্বে এই অঞ্চলের মানুষজন সেলাই করা পোশাক পরতো না। সেলাই করা পোশাক পরার রীতি মুসলমানরাই চালু করে। মুসলমানদের মাধ্যমেই ‘দর্জী’ নামক একটি পেশার সাথে এই অঞ্চলের মানুষের পরিচয় ঘটে।৩

প্রাচীন বাংলার মানুষ নানা ধরনের খড়ম পায়ে দিত, বিশেষত বিত্তবানেরা। পায়ে জুতো পরাটাকে এই অঞ্চলে জনপ্রিয় করে মুসলিমরা মূলত শরীরকে নাপাক বস্তু থেকে বিমুক্ত রাখার লক্ষ্যে। আর মুসলিম শাসনামলে মুসলমানদের দেখাদেখি এই অঞ্চলের মানুষও মোজা পরা শুরু করে।৪ কেননা, মোজা পড়া ইসলাম ধর্মে সুন্নত। এদেশের ভূমি গ্রিষ্ম ও বর্ষাকালে কর্দমাক্ত থাকে। জুতা ও মোজা পড়লে জুতা খুলে শুধু মোজা পরেই নামাজ আদায় ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত। অনেকেই বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে ধর্মীয় অনুযোগ উত্থাপন করেন এই মর্মে যে, তিনি মুসলিম ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন। কিন্তু ১৮৮২ সালে তোলা তাঁর যে ছবিটি পাওয়া যায় সেটাতে তাঁকে দেখা যায় মুসলমানি পোশাক মাথায় পাগড়ি, গায়ে গলাবন্ধ চাপকান পরিহিত অবস্থায়। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোশাকের মধ্যে মুসলমানি পোশাকের ছাপ পাওয়া যায়; যা প্রাচীনকালের বাঙালি পোশাক না।

হিন্দু অভিজাতদের ‘ভদ্র পোশাক’-এ মুসলিম শাসনামলের পোশাকের ছাপ ছিলো স্পষ্ট। ইংরেজ শাসনামলে ধীরে ধীরে পোশাকের পরিবর্তন হতে থাকে। পোশাকের মধ্যে বিচিত্রতা আসে। ইংরেজদের মতো পোশাক পরায় যুবকদেরকে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ই সমালোচনা করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কোট বা চাপকান’ প্রবন্ধে ইংরেজ পোশাক নিয়ে কুসুম-কোমল সমালোচনা করেছেন। বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম সুটেড-বুটেড পোশাকী মানুষ ছিলেন সম্ভবত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

আজ ‘বাঙ্গালির পোশাক’ বলতে যে পোশাকের দিকে ফিরে যাবার আহ্বান জানানো হচ্ছে, সেটা কোন যুগের পোশাক? পাল আমল, সেন আমল, মুসলিম আমল, নাকি ইংরেজ আমলের পোশাক?

সত্যি কথা বলতে, এই অঞ্চলের মানুষের নির্দিষ্ট, স্বতন্ত্র কোনো পোশাক খুবই গতানুগতিক ও ক্লিশে। সেই পোশাক আদৌ কোনো সমৃদ্ধ সংস্কৃতি নির্দেশ করে না। পাশ্ববর্তী দেশ ভুটান, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের প্রাচীন পোশাক অত্যন্ত বর্ণাঢ্য এবং এসব দেশের সরকারি কর্মসূচিতে এখনও দেশের প্রাচীন সংস্কৃতিবাহী পোশাক পরিধান করার প্রচলন রয়েছে। কোনোও কোনও দেশে তা বাধ্যতামূলক। বস্তুত ‘বাইরের’ মানুষরা এসে এদেশের মানুষকে নতুন পোশাক পরিয়েছে। কখনো সেটা তুর্কি, আফগান, পারসিক, আরবীয়, কখনো-বা ইংরেজ। এদেশের মানুষের পোশাক হলো বিদেশী পোশাকের আত্মীকৃত।
সুলতানী শাসনামলের পরে মুঘল শাসনামলে বাংলার জনসাধারণের সাংস্কৃতিক জীবন মুঘলদের আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ, ব্যপকভাবে গ্রহণ করেছিল। সমাজের উঁচু স্তরের লোকেরা মুঘলদের জীবনযাত্রা, অনুসরণ করত। বাংলা হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণির জমিদাররা তাদের আচার-ব্যবহার, উৎসব, পোশাক, পরিচ্ছদ, খাদ্য সকল বিষয়েই মুঘলদের আদব-কায়দা অনুকরণ করত।৫

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের পোশাকের বিবর্তন নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় শোভন শোম লিখেন: “উনিশ শতকে ভদ্র বাঙ্গালীর ব্যবহারিক পোষাক ছিল না। তারা নবাবী আমলের ভদ্র পোষাক চোগা চাপকান-পাগড়ী পরতেন।…ছবিতে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও পাগড়ী, টুপি চোগা চাপকান ইত্যাদি যেসব পোষাকে দেখা যায় সেই পোষাক মুসলিম জামানার উত্তরাধিকার।…রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথদের তিন ভাই-এর সঙ্গে (এক পার্টিতে) চললেন ধুতি পাঞ্জাবি ও চটি পরে। পার্টিতে তাঁদের সাজ পোষাক দেখে হতভম্ভ। কেউ তাদের সঙ্গে কথা বললেন না। পার্টি যারা দিয়েছিলেন আর পার্টিতে যারা গিয়েছিলেন তারা বলেছিলেন, এ কি রকম ব্যবহার, এ কি রকম অসভ্যতা। লেডিজদের সামনে খালি পায়ে আসা। মোজাবিহীন খালি পায়ে পার্টিতে গিয়ে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বলে কথিত রবীন্দ্রনাথকে একদিন ‘অসভ্য’ গালি খেতে হয়েছিল। …সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ ধুতি পাঞ্জাবী প্রায় বাদ দিয়ে দার্জিলিংয়ে দেখা তিব্বতীদের বকুর সঙ্গে মুসলমানী আলখেল্লা মিলিয়ে মাথায় ঈষৎ হেলানো তুর্কী টুপির বদলে এক ধরণের লম্বা টুপি ও মোজাসহ নাগড়াই ব্যবহার করতেন। কারণ তখন সেলাইবিহীন কাপড় সভ্য সমাজ থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হচ্ছিল… । ধুতি চাদর চলতো না। আবার হিন্দু বিয়ে, শ্রাদ্ধ, পূজা ইত্যাদিতে ধুতি চাদর পট্টবস্ত্র পরতে হতো, কাটা কাপড় চলতো না।”৬

আবারও বাঙালির সনাতনী পোশাক প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পুরুষ মানুষ ঘরে, এমনকি বাইরেও যে পোশাকটি সবচেয়ে বেশি পরিধান করে তা হচ্ছে লুঙ্গি। পোশাক হিসেবে লুঙ্গির উদ্ভব দক্ষিণ ভারতে। প্রাচীনকালে এটি দক্ষিণ ভারতে ‘ভেসতি’ নামে পরিচিত ছিল। বার্মাতেও পুরুষ মানুষ লুঙ্গি পরিধান করে। সেদেশের সরকারি কর্মকর্তাগণ অফিসেও লুঙ্গি পরেই আসেন। সাধারণ মানুষ কখনো লুঙ্গি পরে, কখনো জিন্স প্যান্ট পরে অফিস করেন কিংবা বাজারঘাটেও যান। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলের সব ধর্মের মানুষ ঘরে, এমনকি বাইরেও লুঙ্গি পরেন। গ্রামের অবস্থাপন্ন এবং মধ্যবিত্ত মানুষও ধর্মীয় কাজে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন। তবে শহরের মানুষ লুঙ্গি ঘরে পরলেও ঐ পোশাকে বাইরে যান না। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেরা লুঙ্গির পরিবর্তে ঘরেও কোয়ার্টার প্যান্ট, ট্রাউজার পরছে।

নারীদের পোশাকেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বাঙালি নারীর আদি পোশাক শাড়ি। শাড়ি শব্দটি জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে মহিলাদের পোশাক হিসাবে উল্লিখিত ‘সাত্তিক’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করা হয়। শাড়ি বা সাত্তিক এমন এক দীর্ঘ বস্ত্র খণ্ড যা একই সাতে নারীর নিন্মাঙ্গ ও উর্ধাঙ্গকে ঢাকতে পারে। আশির দশকে এদেশের অনেক নারী ঘরে ম্যাক্সি নামের পোশাকটি পরতে শুরু করেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে উপমাহাদেশে মানুষের পোশাক ধর্মীয় বাতাবারনের ছায়ায় ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় সম্প্রদায়-বিশেষের পোশাক নিয়ে বিতর্ক সাম্প্রতিক, হয়ত দুই-তিন দশকের।

হিজাব-বুরকা বিতর্ক: বুরকা মাসলিম জনসংখ্যা-প্রধান এদেশে নতুন পোশাক নয়। তবে এদেশে ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের শুরুর দিকে যখন বেশির ভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র এবং নারীরা শুধু শাড়ি নামের একখণ্ড বস্ত্রই পরিধান তখন সাধারণ নিম্নাঙ্গ ও মধ্যবিত্ত পরিবারে বুরকার ব্যবহার ছিল না, এমনটিই ধারণা করে নেয়া যেতে পারে। তবে সে সময় মধ্যবিত্ত সমাজে নারীরা বাড়ির বাইরে খুব একটা যেত না এবং বাড়িতে বাইরের পুরুষের সামনেও যেত না। তবে উচ্চবিত্ত সমাজে বুরকার ব্যবহার হয়ত-বা ছিল। উনবিংশ শতাব্দিতে ঢাকার নবাব পরিবারে বুরকা পরিধানের চিত্রসমূহ প্রামাণিক দলিল হিসেবে গণ্য হতে পারে। পঞ্চাশ ও ষাট দশকে মধ্যবিত্ত সমাজে বুরকার ব্যবহার এই লেখক দেখেছেন। এটাও দেখা গিয়েছে যাদের বুরকা ছিল না, তারা অন্য আত্মীয়ের বাসায় বা চিকিৎসালয়ে যখন যেতেন তখন শাড়ি বা যে-কোনও কাপড় দিয়ে রিকশার সামনের দিকটা ঘিরে নেয়া হতো।

আশির দশকে ঢাকায় আরব দেশীয় হিজাব প্রসার লাভ করতে থাকে। সে-সময় মফস্বল শহরে হিজাব প্রসার লাভ না করলেও একটি কথার প্রচলন শোনা যেত- হিজাবে নারীকে সুন্দর দেখায়। সেই থেকে গোটা দেশেই হিজাব প্রসার লাভ করতে থাকে। একথা ভাবা মোটেও সমীচীন হবে না যে, হিজাব যাঁরা পরেন, তাঁরা সকলেই ধর্মীয় পোশাক হিসেবে এটি ব্যবহার করেন। এই লেখক ২০ জন বিবাহিত নারীর মাঝে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেন যে, (স্যাম্পলের আকার খুবই কম), ৮জন এটিকে ধর্মীয় পোশাক হিসেবে ব্যবহার করছেন। ৬ জন পরিবারের চাপে, অনুরোধে কিংবা মূল্যবোধের কারণে ব্যবহার করছেন এবং ৬ জন সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ব্যবহার করছেন। একটি সময় স্কুল-কলেজগামী মেয়েদেরকে বাবা-মা বুরকাও পরিয়ে দেয় যেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ইভ-টিজাররা নির্দিষ্ট মেয়েকে চিনতে না পারে। বিপরীত চিত্রও রয়েছে, তা হচ্ছে অনেক মেয়ে নিরাপদে অভিভাবকের চোখ এড়িয়ে ছেলেদের সাথে ঘোরাঘুরি করার জন্য নিরাপদ পোশাক হিসেবে এটিকে গ্রহণ করেছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আরো একটি কারণে (নেকাববিহীন) বুরকার প্রচলন বাড়ছে। বর্তমানে নিরাপত্তাজনিত কারণে ঢাকার মতো বড়ো শহরে স্কুলপড়ুয়া মেয়ে, এমনকি ক্ষেত্রেবিশেষে ছেলেদেরকেও মায়েরা স্কুলে আনা-নেয়া করেন। স্কুলে যাবার জন্য পোশাক পাল্টিয়ে অন্য একটি পোশাক পরার চেয়ে অনেক মা গৃহস্থালী কাজের মধ্যেই ঘরোয়া পোশাকের ওপরে একটি নেকাববিহীন বুরকা পরে স্কুলে চলে যাচ্ছেন।

তবে এই শতাব্দীর শুরু থেকে ইউটিউবে ইসলামী বক্তাদের প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বুরকা ও হিজাবের ব্যবহার বাড়ছে এটি অনেকেই ধারণা করা অসঙ্গত হবে না। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতেও ইসলাম ধর্মীয় গ্রুপগুলোতে নারীর শালীনতা বিষয়ক প্রচারণা হিজাব-বুরকা ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমোবর্ধমান বলেই মনে করি। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করি। তবে দূর-ভবিষ্যতে, শত বছর পরে এদেশে নিশ্চয় পোশাকের রীতি বিপরীত দিকে প্রবাহিত হবে বলেই মনে করি।

একথা অনস্বীকার্য যে পোশাক বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের পছন্দের (Freedom of Choice) স্বাধীনতা রয়েছে। পশ্চিমা জেন্ডার বিশেষজ্ঞবৃন্দও বলেন, “Gender specialists often advocate for the freedom of choice when it comes to dress, emphasizing that clothing should not be a tool of oppression or discrimination. They believe that everyone, regardless of gender, should have the autonomy to express themselves through their clothing without fear of judgment, societal pressure, or harmful gender stereotypes”.৭ তবে সকল প্রকার স্বাধীনতাই দেশের প্রচলিত আইন, ক্ষেত্রবিশেষে রীতি-নীতি ও সামাজিক মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে নয়। এবং, পছন্দের স্বাধীনতা সকল দেশের প্রচলিত আইন ও সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারা স্বীকৃত না। উদহরণ হিসেবে বলা যায়, বেশির ভাগ দেশের সংবিধানে মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার একই সাথে সেসব দেশে এই আইনও রয়েছে যে, যেসব লেখালেখি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে বা সমাজের বেশিরভাগ বা নির্দিষ্ট বিশেষ জনগোষ্ঠীর মনোকষ্টের কারণ হবে তা সরকার বাতিল করতে পারে। সুতরাং আমরা এই অনুসিদ্ধান্তে আসতে পারি। হিজাব নয়, বুরকা নিয়ে কিছু সমস্যাও উদ্ভুত হচ্ছে। নিরাপত্তার কারণে বুরকা কখনো-বা সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষাতে একজন ছাত্রী বুরকার মুখমণ্ডলের অংশ উম্মোচন করতে অস্বীকার করলে তার মৌখিক পরীক্ষাও নেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ঘটনাপ্রবাহ অনেক দূর অব্দি গড়ায়। এটা নিশ্চয় একটা সমস্যা। মৌখিক পরীক্ষা কে দিচ্ছেন তা নিশ্চিত হওয়ার অধিকার কর্তৃপক্ষের নিশ্চয় রয়েছে। প্রশ্ন করাই যেতে পারে যে, ঐ ছাত্রী যদি হজ¦ আদায়ও করতে যান তাহলেও তো তাঁকে ইমিগ্রেশনে মুখমণ্ডল প্রদর্শন করতেই হবে। ইতোপূর্বে ঢাকার একটি মহিলা কলেজে একজন আবাসিক ছাত্রী তার বন্ধুকে বুরকা পরিয়ে আবাসিক হলের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে ধরা পড়ে যায়। হিজাব নয়, ক্ষেত্রবিশেষে বুরকা পরিধানকারীকে ছাড় দিতে হবে।

দেশের সংবিধান এমনকি পশ্চিমা দেশের সাগর সৈকতে মানুষ, বিশেষত নারী যে পোশাক পরে, সেই পোশাক পরে নিশ্চয় মার্কেটপ্লেসে যাবে না। যদি কেউ যায়-ও সেই ব্যক্তি পাবলিক ন্যুইসেন্স ভঙ্গকারী হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে সামাজিক মূল্যবোধের প্রভাব সর্বত্রই ব্যপক। সামাজিক মানুষ এই মূল্যবোধকে অস্বীকার করতে পারে না। উদহরণ হিসেবে বলা যায়: একজন সমাজ কর্মী বা কর্মকর্তা যদি কোট-প্যান্ট টাই পরিধান করে গ্রামীণ মানুষের সমস্যা নিরূপণ বিষয়ক গবেষণা কর্মে যান তাহলে সেই ব্যক্তি বা গ্রুপকে গ্রামীণ সাধারণ মানুষ কখনো আপন করে নিবে না। ফলে গবেষকদল তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাবেন না। আবার ঐ একই দলে যদি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা কোনো পুরুষ অথবা চুলকে রঙিন করে রাঙিয়ে কোনো নারী থেকে থাকেন তাহলে গ্রামীণ মানুষ তাদের দিকে এত বেশি মনোযোগ নিবিষ্ট করবে যে, গবেষকদল তাঁদের কাঙ্ক্ষিত কর্ম-সম্পাদন করতে পারবেন না।

একই ভাবে একজন নারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-তে যদি জিনসের প্যান্ট এবং শর্ট টপস পরেন, তাহলে সেটা হয়ত অলোচনায় আসবে না। কিন্তু ঐ একই পোশাক পরে সেই নারীই যদি অজ পাড়াগাঁয়ে যান তাহলে তিনি অশ্রদ্ধার মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারেন।

তবে তখনই কিছুটা বিস্ময় বোধ হয়- যখন কিছু মানুষ পহেলা বৈশাখে পুরুষের পাজামা-পাঞ্জাবি ও নারীর ‘শাড়ি পড়া’ বাঙালি সংস্কৃতি লালন-পালনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় মনে করেন; আবার সেই মানুষই যদি পরদিন (পুরুষ) থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে বাইরে যান, কিংবা নারী জিনসের প্যান্ট ও শর্ট টপস পরে পোশাকের স্বাধীনতা বলে মনে করেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

তথ্যসূত্র
১. রায়, গৌতম। “বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদান”, আদর্শলিপি প্রকাশন, ঢাকা, ২০২২, পৃষ্ঠা ১৮১।
২. মুরশিদ, গোলাম। “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি”, অবসর, ঢাকা, ২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৬৪।
৩. মুরশিদ, গোলাম। “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি”, অবসর, ঢাকা, ২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৬৭।
৪. মুরশিদ, গোলাম। “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি”, অবসর, ঢাকা, ২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৬৪।
৫. রহিম, (ডক্টর) এম এ। “বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস” (দ্বিতীয় খণ্ড), বাংলা একাডেমী, ১৯৮২, পৃষ্ঠা সাত।
৬. সোম, শোভন। “জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সংস্কৃতি”: দেশ, কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৮।
৭. Butler, Judith: Gender Trouble: Feminism and the Subversion of Identity, Routledge, New York, 1990. Page: 175.

=======================